চারদিকে যেন মৃত্যুর মিছিল। একজন মুসলমান হিসেবে কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে কষ্ট পেতে নেই। তবু হঠাৎ কোনো আপনজন চলে গেলে কেন যেন বুকের মধ্যে কাঁটার মতো বেঁধে। পরপর কয়েকটি মৃত্যু আমাকে কেমন যেন কিছুটা উতালা করে তুলেছে। ২ মে জেলা প্রশাসক মো. মাহাবুব হোসেনের অফিসে গিয়েছিলাম। যত ভালো এবং কর্মঠই হোন কেন যেন এখন কারও কোনো নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব নেই। অভিযোগ ছিল, মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা স্বনির্ভর হওয়ার জন্য সাধারণ মহিলাদের তিন মাসের প্রশিক্ষণে নয়ছয় করেন। ৯০ দিনের প্রশিক্ষণে শুক্র-শনিবারের ভাতা কেটে রেখেছেন। অথচ শুক্র-শনিবার প্রশিক্ষণ হয়েছে এবং তারা প্রশিক্ষণ খাতায় স্বাক্ষর করেছেন। তাদের কাউকে প্রশিক্ষণের জন্য সুই-সুতা দেওয়া হয়নি, ঘরের জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে প্রতি মাসে ৫০ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। ২০ টাকা প্রশিক্ষণ ভাতা যেদিন থেকে ৬০ টাকা হয়েছে সেদিন থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। অভিযোগ, কয়েক মাসের ভাতা তিনি পকেটস্থ করেছেন। প্রশিক্ষণার্থী ৪০ জন এসব নিয়ে কথা বলেছেন সবাই। কিন্তু একজনকে শায়েস্তা করতে থানায় বলেছেন। পুলিশ মহিলাকে খুঁজতে গিয়ে মহল্লায় কঠিন অশান্তির সৃষ্টি করেছে। অথচ দুদক এসব দেখে না। তাই গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা একসময় বাসাইলে কাজ করতেন। সে সময়ও তাকে যেমন উপযুক্ত মনে হয়নি, সেদিন তো আরও হলো না। জেলা প্রশাসক মাহাবুব হোসেন একজন ভালো মানুষ বলে অনেকের কাছে শুনেছি। ভদ্রলোককে আমারও বেশ ভালো লাগে। কিন্তু সেদিন গলার জোরে মাহাবুব হোসেনের জেলা প্রশাসক না হয়ে মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তারই জেলা প্রশাসক হলে ভালো হতো। অমন চাপার জোর সাধারণত নেতা-নেত্রীদের হয়। কিন্তু সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের হয় জানা ছিল না। বৈঠকটি খুব ভালো হয়নি, ভালো লাগেনি। যদিও ওসবে কিছু হবে না, তবু জেলা প্রশাসক তার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কিছু করতে পারেননি। কোনো প্রশাসকই পারবেন না, কারণ এখন শৃঙ্খলা ভেঙে গেছে। যার হাটঘাট এবং চাপার জোর যত বেশি সেই-ই এখন সব। প্রসঙ্গটা এলো এজন্য যে, একসময় ঘাটাইল কলেজের ভিপি প্রিয় অ্যাডভোকেট আকবর হঠাৎ হাজির হয়েছিল। গুটিসুটি হয়ে সালাম করে বসতেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমার ছেলে তোর বাবা কেমন আছে? বলেছিল, ভালো। বীর মুক্তিযোদ্ধা দুর্লভ চরিত্রের অধিকারী মোয়াজ্জেম হোসেন খানকে তার গ্রামের বাড়ি রতনপুরে কবর দিয়ে ফিরতি পথে মাতবর খাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কদিন আর হবে, তিন-চার মাসের বেশি নয়। বাড়ির সামনে মূল রাস্তায় পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে একদিন খাওয়ার অনুরোধ করেছিল। কথা দিয়েছিলাম যাব। কিন্তু আর সে কথা রক্ষা করা হলো না, যেতে পারলাম না। ঘাটাইলের মাতবর খাঁর মতো অমন স্বাধীনচেতা মানুষ খুব একটা দেখিনি। প্রথম পরিচয় হয়েছিল ১৯৬৭-’৬৮ তে। সারা জীবনই ভাবতাম মাতবর খাঁ আমার থেকে ২০-২২ বছরের বড়। সেদিন জানলাম তার জন্ম ১৯২৮ সালে। সেদিক থেকে তিনি আমার থেকে ১৯ বছরের বড়। ’৬৯-এর গণআন্দোলনের সময় থেকে কখন কীভাবে কী করে তিনি পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা শুরু করেছিলেন যা ছিল আজীবন। প্রথম দিকে একজন প্রবীণ মানুষের ওভাবে সালাম করায় খুব বিব্রত হতাম। ধীরে ধীরে বিব্রতকর অবস্থাটা কেটে গিয়েছিল। সেটাও তারই কল্যাণে। ’৭১-’৭৫ আমাদের ছিল এক স্বর্ণযুগ। যেখানেই যেতাম সেখানেই মানুষ আর মানুষ। তখন কোনো এক সভায় লাখো মানুষের উপস্থিতিতে তারস্বরে মাতবর খাঁ বলেছিলেন, ‘আমি তো কাদের সিদ্দিকীকে সালাম করি না, আমি সালাম করি আমার বাপকে। সে ক্ষেত্রে তার বয়স কত সেটা তো বিচার-বিবেচনা করি না। ’ মাতবর খাঁ এক অসাধারণ ভালো মানুষ ছিলেন। তার অন্তর ছিল প্রেমে ভরা সমুদ্রের মতো বিশাল। তিনি দেশকে যেমন ভালোবাসতেন, তেমন ভালোবাসতেন দেশের নেতা বঙ্গবন্ধুকে। সেই কারণে আমাকেও পাগলের মতো ভালোবাসতেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘাতকের হাতে বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে নিহত হলে তার প্রতিবাদে এক কাপড়ে ঘর ছেড়েছিলাম। অক্টোবরের কোনো এক দিন যমুনার নিশ্চিন্তপুর চরে বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজররা আমাকে ধরার জন্য হেলিকপ্টার নিয়ে অভিযান করেছিল। যেখানে বগুড়া যুবলীগের সভাপতি খালেকুজ্জামান খসরু শহীদ হয়েছিল। আক্রমণকারীদের করুণ দশা বর্ণনা করতে চাই না। আক্রমণকারীদের নেতা এক মেজর মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে ছিল। তাই আমাদের বন্দুকের ধার তার জানা ছিল না। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি বলে লাশ ফেলে সেদিন পালিয়েছিল। নিশ্চিন্তপুরে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা আমাকে আক্রমণ করে ধরে নিয়ে গেছে, মাঠে কাজ করা অবস্থায় মাতবর খাঁ এ রকম খবর শুনে পাগলের মতো বাড়ি ফিরে গরুর চাড়ি থেকে মস্ত বড় দুটি ষাঁড় ছেড়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠেছিলেন, ‘হে দয়াময় আল্লাহ! আমার যা ছিল এই দুইটা ষাঁড় আমি আজাদ করে দিলাম। তুমি আমার বাবা কাদের সিদ্দিকীকে মুক্ত আজাদ করে দাও। ’ এই ছিলেন মাতবর আলী খাঁ। যার সঙ্গে কোনো রক্তের সম্পর্ক ছিল না, আল্লাহর কাছে তার দয়া পাওয়ার জন্য কত আকুল করা আকুতি। গত শনিবার তার বাড়ি গিয়েছিলাম। বড় ছেলে আকবর আগাগোড়াই আমাকে আপনজন ভাবে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে সব সময় সঙ্গে থেকেছে। আমি যখন বর্ধমানে, তখন একবার কোনো মামলায় পড়ে দু-তিন মাস আমার বাড়িতে ছিল। আমাদের গৌরব সাবেক রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে তখন সে মানবাধিকার কর্মী হিসেবে কাজ করত। আমাকে কত যে চিঠি লিখেছে এখন সে কথা ভাবলে অবাক লাগে। ওরা কেউ হয়তো আমার চিঠি যত্ন করে রাখেনি, কিন্তু আমি পরম যত্নে ওদের সব চিঠিপত্র লালন-পালন, ধারণ করেছি। সেদিন যখন মাতবর খাঁর ছোট ছেলের বাড়িতে খাবার খাচ্ছিলাম বার বার মনে হচ্ছিল, যার জন্য আসা-যাওয়া আজ সে নেই। অথচ আমরা তার পরিচিতরা বেশ আছি, খাচ্ছি-দাচ্ছি; কোনো কিছুতে কমতি নেই। ১৩ তারিখ শনিবার ছিল আমার বাবার ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। ঘাটাইল থেকে সরাসরি ছাতিহাটি গিয়েছিলাম। গ্রামে গেলে বাবা-মার কবর দেখে কেমন যেন লাগে। কবে তাদের পায়ের কাছে জায়গা হবে ভেবে আকুল হই। সেদিনও তেমনটা হয়েছি। আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি, আল্লাহ যেন আমার বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনকে বেহেশতবাসী করেন, সেই সঙ্গে পরম প্রিয় মাতবর খাঁকেও।
মাতবর আলী খান মারা গেছেন ৬ তারিখ। আকবরই ফোন করেছিল। ৮ তারিখ সহকর্মী আলমগীর একটা অনলাইনের খবর এনে দেয়। হাতে নিয়ে দেখি আবদুল মতিন মিয়া হিরু আর নেই। চমকে উঠেছিলাম। আবদুল মতিন হিরু ওভাবে চলে যাবেন ভাবিনি। তার তেমন অসুখ-বিসুখের কথাও শুনিনি। মনে হয় সেই দিনই অথবা তার পরের দিন আবদুল মতিনের এক ভাই এবং মেয়ে মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা এসেছিল বাবার স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিলের আমন্ত্রণ নিয়ে। ১২ তারিখ শুক্রবার ঢাকায় থাকার কথা ছিল। সুস্মিতারা গেটে আসার আগেই সিরাজুল আলম খান ফোন করেছিলেন। বহুদিন পর তার ফোন। স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা আলোড়িত হয়েছিলাম। ভরা গলায় তিনি বলেছিলেন, ‘কাদের, মতিনের মেয়ে তোমার গেটে। ওরা তোমার কাছে গেছে। ’ সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়েছিলাম গেটে। যদিও ওরা ভুল করে অন্য বাড়িতে যাওয়ায় তখনো পৌঁছেনি। লোক দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম। সিরাজুল আলম খান কত বড় মানুষ। একসময় আমি ছোট্ট কাদের, তিনি বিশাল সিরাজুল আলম খান। কেন যেন কখনো বড়কে ছোট আর ছোটকে বড় বলে মানতে পারি না। সত্যকে সত্য বলা আমার কোনো জন্মগত দোষ কিনা তাও জানি না। সুস্মিতা এসেই বলেছিল, ‘প্রেস ক্লাবে বাবার জন্য একটা আলোচনা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছি। কাকা আপনি যাবেন। ’ কেন যাব না, না যাওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বলেছিলাম যাব। এক পর্যায়ে সুস্মিতা বলেছিল, ‘গিরানী আঙ্কেলের সঙ্গে আপনার বাসায় কয়েকবার এসেছি। ’ গৌরাঙ্গীর আশরাফ গিরানী, সে ছিল এক অসাধারণ মানুষ। হুজুর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তার আধ্যাত্মিক গুরু, কাজী জাফর আহমদ রাজনৈতিক আর আমি অস্ত্র গুরু। তিন মেরুর তিনজনের সমন্বয় ঘটাতে গিরানীর কোনো কষ্ট হতো না। বরং সহজেই সে সেটা পারত।
প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে আবদুল মতিন মিয়া হিরুর স্মরণসভা তার মেয়ে সুস্মিতা অসাধারণ সঞ্চালন করেছে। অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। আ স ম আবদুর রব, প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম, ম. হামিদ, এম রশিদুজ্জামান মিল্লাত, হুমায়ুন কবির হিরু, স্বপন ফকির, প্রফেসর ছানোয়ার, শামসুন্নাহার চাঁপা। মানুষ চলে গেলে শত্রুও বন্ধু সাজে। সেখানেও তেমন হয়নি তা নয়। তবু ভালো লেগেছে। কোনো দলীয় নয়, শুধু পারিবারিক চেষ্টায় অমন অনুষ্ঠান আজকাল খুব একটা দেখা যায় না। মিল্লাত, স্বপন খুবই আন্তরিক বক্তব্য রেখেছে। সব থেকে ভালো লেগেছে প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের কথা। অকপটে সাবলীল সত্য কথা বলেছে। মির্জা আজমকে যতই দেখি ভালো লাগে। আমার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় খুব খেটেছে। ওর ভাঙা জিপে আমার স্ত্রীকে নিয়ে অনেক জায়গায় গেছে। আজমের মামা বা চাচা কেউ একজন পৌরসভা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিল। সিরাজুল ইসলাম তখন স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী। তার দাপটে আজমদের তখন চলা মুশকিল। ও রকম অবস্থায় আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। আজমের নিষ্ঠা এবং সাহস আমাকে সব সময় আলোকিত করে। সেবারও করেছে। এখন বোঝা যায় আ স ম আবদুর রবের বয়স হয়েছে। কিন্তু সহকর্মীদের জন্য তার মায়া-মমতা-ভালোবাসা অফুরান। কারও স্মরণসভায় রাজনীতি করতে যাই না, বক্তৃতা করতেও না। দোয়া এবং তার কল্যাণ কামনা করতে যাই। সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল মতিন মিয়া হিরুর স্মরণসভায়ও সে কারণেই গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, রাজনীতিতে তিনি বড়, না ছোট তার বিচার করতে যাব না। আমার চোখে আবদুল মতিন হিরু একজন অত্যন্ত সফল পিতা। তার তিন সন্তান, তিনজনই বিসিএস। এটা কম কথা নয়। নারীর সম্মান, নারী শিক্ষার জন্য রসুলে করিম (সা.) একসময় সাহাবাদের বলেছিলেন, ‘কোনো বাবা যদি তার তিনটি কন্যাকে শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে উপযুক্ত পাত্রে পাত্রস্থ করতে পারে তাহলে আল্লাহ তাকে বিনা বিচারে বেহেশতে নেবেন। তখন সাহাবারা প্রশ্ন করেছিলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! সবাই তো তিন কন্যার পিতা নাও হতে পারেন। কারও যদি দুটি কন্যা হয়। তিনি বলেছিলেন, দুই কন্যা হলেও চলবে। সাহাবাদের শেষ প্রশ্ন ছিল, কারও যদি এক কন্যা থাকে। নবী করিম (সা.) বলেছিলেন, এক কন্যাকেও সুশিক্ষিত করে ধর্মকর্ম শিখিয়ে উপযুক্ত পাত্রে পাত্রস্থ করলে সে পিতাকেও আল্লাহ বেহেশতে নেবেন। ’
স্বাধীনতার পরপরই আমাদের মামাতো বোন রওশন আক্তার রুনু আমাদের বাড়িতে উঠেছিল। তখন সে সিক্স-সেভেনে পড়ে। আমার বড় মামা ছানা মামার অনেক ছেলেমেয়ে। ছোটবেলায় ময়মনসিংহে রাধা সুন্দরী আর বিদ্যাময়ীর পাশে তাদের বাড়িতে অনেক গেছি। রুনু বাবর রোডের বাড়িতে আমার মায়ের কাছে সন্তানের মতোই লালিত-পালিত হয়েছে। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যা পর্যন্তই সে বাবর রোডে ছিল। ’৭১-এ একবার হানাদাররা আমাদের বাড়িঘর পুড়ে ছারখার করে দিয়েছিল। ’৭৫-এ আবার আমার পরিবার ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। সে কী কষ্ট, কী নির্যাতন, জেল-জুলুম-অত্যাচার। এখন সরকারের আশপাশে যারা হালুয়া-রুটি লুটছে, বঙ্গবন্ধুর রক্ত-মাংস-কলিজা চিবিয়ে খাওয়ারা মন্ত্রিসভায় বসে লম্ফঝম্ফ করছে তাদের বোঝানো যাবে না আমরা কী কষ্ট করে বেঁচে আছি। আমাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কতটা কষ্ট সহ্য করেছে এবং এখনো করছে। সেই রুনুর স্বামী মোখলেছুর রহমান বকুল ফজরের নামাজের সময় পড়ে মাথায় রক্ত জমে অচেতন অবস্থায় জামালপুর থেকে ময়মনসিংহ, ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় অধ্যাপক দীন মোহাম্মদের আগারগাঁওয়ে নিউরো সায়েন্স ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাঁচেনি। আমি যেদিন মোখলেছুর রহমান বকুলকে ময়মনসিংহ মেডিকেলে দেখতে গিয়েছিলাম সেখানে প্রফেসর বলছিলেন, খুব কঠিন অ্যাটাক হয়েছে। সার্ভাইব করার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু মানুষের মন মানতে চায় না। প্রিয়জনের জন্য ভালো মানুষরা চেষ্টার কোনো ত্রুটি করে না। ছোটখাটো রুনু তার স্বামীর জন্য চেষ্টার ত্রুটি করেনি। ফেরার পথে হাসপাতালের পরিচালক ব্রি. জেনারেল মো. নাছির উদ্দীন আহমদের ঘরে গিয়েছিলাম। মোটাসোটা শ্যামলা ভদ্রলোক খুবই আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। হঠাৎই এক সময় বলেছিলেন, ‘একদিন আপনার সঙ্গে অনেক কথা হয়েছিল। ’ কিন্তু আমার মনে পড়ছিল না। তখন তিনি বলছিলেন, ‘জামালপুর সার্কিট হাউসে অনেক বছর আগে আমরা রিক্রুটমেন্টে গিয়েছিলাম। ’ সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি সেই দুই মেজরের একজন? বলছিলেন, ‘হ্যাঁ। ’ সে এক মজার ব্যাপার। সব জেলা থেকে সেনাবাহিনীতে লোক নেওয়ার কথা। তাই দুই মেজর সার্কিট হাউসে উঠেছিলেন। আমার সঙ্গে দেখাশোনা-কথাবার্তায় বোধহয় অনেকেরই আগ্রহ হয়। তাদেরও হয়েছিল। দুজন মেজর কথা বলতে এসেছিলেন। কথার এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, দুজনই মেজর। কার কত দিনের চাকরি। একজনের আট বছর, আরেকজনের ১৮ দিন। শুনে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আট বছরের মেজর সাহেবকে, এত দিন মেজরি করে কী মনে হচ্ছে? ক্ষমতা কোথায়? তিনি বলেছিলেন, ‘ব্যাটালিয়ন কমান্ডার হলে বোধহয় একটা স্বতন্ত্র ক্ষমতা পাওয়া যাবে। ’ ১৮ দিনের মেজরের ক্যাপ্টেন থাকতে ধারণা ছিল মেজরের অনেক ক্ষমতা। তখনো তার তেমন ধারণাই ছিল। হঠাৎই কত বছর পর সেই জুনিয়র মেজর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাছির উদ্দীন আহমদ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের পরিচালক। সেদিনই রুনুর জামাই মোখলেছুর রহমান বকুলকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। আমার এক প্রিয় বোন মমতা ইংল্যান্ডে থাকে। তার স্বামী দুলাল আমার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে রাতদিন কাজ করেছে। মমতা আবার কাজী মন্টু এবং কাজী ফিরোজ রশীদের আপন বোন। কদিন আগে সে আমার বাড়ি খেতে এসে বার বার বলছিল, টাঙ্গাইলে আমার খালার বাড়ি। বলেছিলাম, আমি জানি। আমার বড় মামীই তোমার খালা। আমার মামীরা দুই বোন। একজন রুনুর মা, আরেকজন কাজী ফিরোজ রশীদ এবং কাজী মন্টুর মা। মমতা সেটা জানতে পেরে অভাবিত খুশি হয়েছিল। নাটক থিয়েটার ফেসবুকে হারানো আত্মীয় পেয়ে খুশি হওয়ার কথা মাঝেমধ্যে শুনি। কিন্তু চোখের সামনে এমন খুশি হওয়ার ঘটনা খুব কমই দেখেছি। প্রিয়জনের মৃত্যু কারও কাছেই সহজ নয়। কিন্তু তবুও বলব, আমার চাচাশ্বশুর আবদুল আজিজ কোরায়েশী কয়েক মাস বাবর রোডে অচেতন পড়ে থেকে পরপারে গেছেন। তাকে দেখাশোনা খুব সহজ ছিল না। রুনুর স্বামীর তার পরিবারকে কষ্ট না দিয়ে সহজে চলে যাওয়া এটা আল্লাহর প্রিয় হওয়ার লক্ষণ। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি তার প্রিয় বান্দাদের সব ত্রুটি ক্ষমা করে তাদের বেহেশতবাসী করেন।
৩০ এপ্রিল আমার মেয়ে কুঁড়ি লন্ডন থেকে এসেছে। ওকে আনতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে পুরনো বিমানবন্দরের কাছে প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম। এত যানজটের কারণ কী? পরে শুনলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হাওরের বানভাসি মানুষের দুর্দশা দেখে ফিরছেন। তিনি পুরনো এয়ারপোর্টে নামলেন, তার গাড়িবহর আমাদের ক্রস করে চলে গেলে তারপর নিষ্কৃতি। ১৮-২০ বছরের পুরনো গাড়ি। এসি ছিল না। আমার তিনটি ছেলেমেয়েই হাঁসফাঁস করছিল। বিশেষ করে ঠাণ্ডার দেশ থেকে এসে কুঁড়ির কাহিল অবস্থা। তাই লিখেছিলাম, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! শহরে যাতায়াত না হয় গাড়িতেই করলেন। কিন্তু বাইরের জেলাগুলোয় যাওয়া-আসার সময় নিজের অফিস, বাড়ি থেকে সরাসরি আকাশে উঠতে এবং ফিরতে পারেন। ’ বঙ্গভবন, গণভবন ও তেজগাঁও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আগে থেকেই হেলিপ্যাড আছে। প্রধানমন্ত্রীর তেজগাঁও কার্যালয় থেকে পুরনো তেজগাঁও বিমানবন্দর ২-৩ মিনিটের পথ। কিন্তু সেখান থেকেও তিনি বিমানবন্দরে গেলে ২-৩ ঘণ্টার যানজট লেগে যায়। তাই প্রস্তাব দিয়েছিলাম। এই প্রথম তাজ্জব হলাম, গত মঙ্গলবার সাড়ে ৮টার মধ্যেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দফতরের পরিচালকদের একজনের ফোন পেয়ে, ‘স্যার! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার লেখা পড়েছেন। আপনার প্রস্তাবে তিনি খুবই খুশি। ব্যাপারটা হয়তো অল্প সময়ের মধ্যেই বিবেচিত হবে। ’ ঘণ্টা পার না হতেই আরেকজনের ফোন। তারপর আরেকজন। কেউ পরিচালক, কেউ মহাপরিচালক। কেউ অন্য কিছু।
লেখক : রাজনীতিক।
উৎসঃ বিডি-প্রতিদিন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন