বেশ কিছু দিন কয়েকটি ঘটনা মানুষের মুখে মুখে ২৪ ঘণ্টা ফিরছে। ১০ মে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার ‘ভিশন ২০৩০’, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটিতে স্বাধীনতাবিরোধীরা বা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আছে বলা, রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণ, আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে ‘অমন তো আমরাও করি’ এমন পশুসুলভ কথাবার্তা, আপন জুয়েলার্সের অবৈধ সোনা এবং হোটেল রেইনট্রিতে লাইসেন্সবিহীন বিদেশি মদ, সর্বোপরি জননেত্রী প্রধানমন্ত্রীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনÑ এসবই এ ক’দিনব্যাপী আলোচনার বিষয়বস্তু।
‘ভিশন ২০৩০’ নিয়ে এর আগেও দু-এক কথা বলেছি। ভিশন ২০৩০ আহামরি কিছু নয়। বিএনপির মতো কয়েকবার ক্ষমতায় যাওয়া দলের জন্য এটাই স্বাভাবিক। তবে ভিশন ২০৩০ দেওয়ার আগে মানুষের মধ্যে যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল, নির্দ্বিধায় বলা যায় সেটা ফলপ্রসূ হয়নি। সরকারি দল আওয়ামী লীগ বলছে, এটা তাদের কাছ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া। হতেই পারে। সবারই উদ্দেশ্য এবং কথা মানুষকে কাছে টানা। এ জন্য সব দলই সাধ্যমতো তার মনের মতো করে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি দেয়। বিএনপিও তেমনই করেছে। এটা করে অন্যায় কিছু করেনি, বরং একটা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু তাদের এই দায়িত্বশীলতার পরিচয় রক্ষা করার ইচ্ছা ও ক্ষমতা আছে কিনা, এটাই বিচার্য। বিত্তবৈভব মানুষকে সংগ্রামবিমুখ করে তোলে, কথাটা যে কারো জন্য প্রযোজ্য। শুধু বিএনপির জন্য নয়।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। এখন অনেকেই মনে করছে সেটা তাদের ভুল। মনে করতেই পারে। মনের গতি আলো বা শব্দের গতির চেয়েও বেশি। তাই মনে করার ব্যাপারে কাউকে কেউ বাধা দিয়ে কিছু করতে পারবে না। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি সফল নাকি ব্যর্থ। এক অর্থে বিএনপির নির্বাচন বর্জনের ডাক এ উপমহাদেশের রাজনীতিতে একটি গণতান্ত্রিক সফল আন্দোলন। ৫ জানুয়ারি নির্বাচন শুধু বিএনপি বর্জন করেনি, বর্জন করেছিল সরকারি জোটের বাইরে সব ক’টি দল। মনোনয়ন দাখিলের পরই দেখা যায় ৩০০ আসনের ১৫৩টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে আওয়ামী জোট। একটা পার্লামেন্টের মেজরিটি যদি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়, তাহলে সে সংসদের বৈধতা কোথায়? দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৪৭ আসনে ৫০ কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। তাহলে আরও দু-একশ কেন্দ্রে ৫-১০ ভোট পড়েছে। দুই-চার-পাঁচশ বা হাজার কেন্দ্রে
দু-একশ ভোট পড়েছিল। সাধারণ লোকজনের ধারণা, ২-৩ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। নির্বাচন কমিশন ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে দাবি করেছিল। অর্ধেক সিটে ৪০ শতাংশ ভোট পড়লে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সব ক’টি আসন মিলিয়ে সর্বমোট ২০ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ২০ শতাংশ ভোটে পৃথিবীর কোথাও কোনো সংসদ দেশ শাসন করার স্বীকৃতি অর্জন করে না। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা হয়েছে। যদিও সরকারি দল, নেতৃত্বদানকারী লোকজন প্রথম দিকে খুবই শঙ্কায় ছিল। তাই প্রধানমন্ত্রী ভয় পেয়ে হোক আর সাহস করে হোক বলেছিলেন, ‘এ নির্বাচন সংবিধান রক্ষার বাধ্যবাধকতার নির্বাচন। আমরা সবাই মিলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অবশ্যই করব।’ প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভুল পরিচালনায় সরকারকে তা করতে হয়নি। খুনখারাবি-রাহাজানি-ধর্ষণ যাই হোক, দেশে তারা তাদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পেরেছে। কেন পেরেছে সেদিকে তাকালে দেখা যাবে কথাবার্তা বলেই হোক আর বাস্তবতার খাতিরেই হোক, খালেদা জিয়া বা বিএনপি নেত্রীর আহ্বানে সরকারি জোটের বাইরে কোনো দল যে নির্বাচনে যায়নি, এ জন্য পরবর্তী অবস্থায় তারা কারো সঙ্গে যোগাযোগ বা কোনো দলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়নি। বাঙ্গিবনে শেয়াল রাজার মতো তারা তাদের নিরঙ্কুশ রাজত্ব চালিয়েছে। এর পর পরই এসেছিল উপজেলা নির্বাচন। কোনো বিরোধী দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে এমনকি নিজের জোটের কাউকে পাত্তা না দিয়ে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। নিজেদের এত জনপ্রিয়ভাবে যে অনেক অনেক উপজেলায় একজন বিএনপি নয়, দু-তিনজন বিএনপি দাঁড়িয়ে যায়। ফল যা হওয়ার তাই হয়। মহাভরাডুবি। নির্বাচনে অবশ্যই কারচুপি হয়েছে, কিন্তু সেটা দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরতেও তারা ব্যর্থ হয়। আসে পৌর নির্বাচন। সেখানেও একই অবস্থা। এরপর এক অভাবনীয় কা- ঘটে। দীর্ঘ তিন-সাড়ে তিন মাসের লাগাতার অবরোধ। প্রথম কয়েক দিন গাড়িঘোড়া, দোকানপাট বন্ধ থাকে। জেলে-তাঁতি-কামার-কুমারের মুখে হাত ওঠা বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়, রিকশাওয়ালার পেটে খাবার নেই, সবজিচাষি রাস্তায় বসে। তাই ধীরে ধীরে মানুষ নিরুপায় হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। অনেকবার বলার চেষ্টা করেছি, খালেদা জিয়া অবরোধ প্রত্যাহার করুন, প্রধানমন্ত্রী আলোচনায় বসুন, দেশকে বাঁচান। শোনেননি। শেষ পর্যন্ত বিএনপি অনির্দিষ্টকালের অবরোধ প্রত্যাহার করতে পারেনি। আপনাআপনি সাধারণ মানুষের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এখানে সরকারের যে খুব কৃতিত্ব আছে, বলার উপায় নেই। কিন্তু হয়েছে। সেই দীর্ঘ তিন-সাড়ে তিন মাস অসম্ভব জ্বালাও-পোড়াও হয়েছে। বিএনপি যে ধোয়া তুলসী পাতা তেমন নয়। জ্বালাও-পোড়াওয়ে সরকার তাদের দায়ী করেছে। সব জ্বালাও-পোড়াও তারা না করলেও, অনেক জ্বালাও-পোড়াও সরকারের ইঙ্গিতে হলেও বিএনপি জনগণের সামনে তা তুলে ধরতে পারেনি। এখনো পোড়া গন্ধ নাকে লাগে, সরকারি দল এবং সরকারের প্রধান নেতা অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে দেশ ও বিদেশের কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। সত্যিই অনেক মানুষ বিশ্বাস করেছে, সব জ্বালাও-পোড়াও বিরোধী দল করেছে। সরকার সেটা শুধু মোকাবিলার চেষ্টা করেছে। ওর মধ্যেই ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। তারা অংশ নেয়। সেখানেও গোহারা হারে। এরপর সিলেট, চট্টগ্রাম আরও আরও কয়েকটি করপোরেশন নির্বাচন হয়। সেখানেও ফলাফল বিএনপির পক্ষে যায়নি। যাবে কি, তারা তো আন্তরিকই নয়। সর্বশেষ দুটি আলোচিত নির্বাচন একটি নারায়ণগঞ্জ, আরেকটি কুমিল্লা। নারায়ণগঞ্জের বিএনপির শেষ দিন পর্যন্ত কোনো প্রার্থী ছিল না। সেলিনা হায়াৎ আইভী একজন উল্লেখযোগ্য শক্তিশালী প্রার্থী। ফল যথার্থই তার দিকে গেছে। কুমিল্লা নির্বাচন। কোছের ছুরি কোছ না কাটলে সেখানেও বিএনপির বিজয় হতো না। আর অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে মনিরুল হক সাক্কু আরও অনেক বেশি ভোট পেতেন। নির্বাচনের দিন কুমিল্লা কোটবাড়িতে জঙ্গি আছে বলে বাড়ি ঘিরে রাখা এবং মৌলভীবাজারে জঙ্গি বলে সাতজনকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলাÑ এরও কিছুটা প্রভাব কুমিল্লা নির্বাচনে পড়েছে। যাহোক, আসল কথা প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির যেভাবে অগ্রসর হওয়া উচিত, সেটা কখনো করেনি। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে কোলে-কাঁখে-বগলে যেখানেই রাখা হোক, পাকিস্তানের অত ভক্ত-অনুরক্ত হওয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধা দেওয়া বা অস্বীকার করা মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। একের পর এক সব ক’টি মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ বিএনপিকে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। সর্বোপরি সব সময় তারা নিজেদের সম্রাট মনে করে অন্যদের দয়ার পাত্র হিসেবে ভাবে, তখন তারা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভিশন ২০৩০Ñ ২৫৬, ২৫৭ অনুচ্ছেদের ঘোষণা। যেখানে বিএনপি ছাড়া আর কেউ ছিল না। সরকারি দল আওয়ামী লীগকে দাওয়াত করতে গিয়েছিলেন। শুনলাম অফিসে লোক পাননি। তা কী করে হয়? এক দেশ এক সমাজ, রাজনীতির এপিঠ-ওপিঠ বিরোধী দল সরকারি দলকে দাওয়াত করার সুযোগ পাবে নাÑ এটা কেমন কথা? আন্তরিকতা ও ইচ্ছা থাকলে যোগাযোগ করে বিএনপির নেতারা দাওয়াত করতে যেতে পারত। এমন দায়সারা কাজ দায়িত্বশীল কোনো দলের মানায় না। আমাদের অনেককেই চিঠি দেওয়া হয়েছে। আমার মনে হয়েছে, আমরা যাই তারা দাওয়াতের সময়ই এটা চাননি। দাওয়াত দেওয়া দরকার দিয়েছেন। এভাবে জমিদারি চলতে পারে, রাজনীতি নয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক সংগ্রাম সেটা তো মোটেই নয়। শেষ পর্যন্ত যা হওয়ার তাই হয়েছে। কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি।
ছাত্রসমাজের ১১ দফার কথা বলব না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা প্রথম প্রথম অনেকেই মেনে নেয়নি। নিজেদের অনেক লোকও আজেবাজে কথা বলেছে। কিন্তু ছয় দফায় যখন সাধারণ মানুষ রাজনীতির খোরাক পেয়েছে, চারদিকে জ্বলে উঠেছে এবং দ্রুত সফলতা আসে। তখন ছয় দফা হয়ে ওঠে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, সর্বোপরি ছয় দফা হয় স্বাধীনতার মাইলফলক। তাই কোনো ভিশন উচ্চারণ বা উপস্থাপন করলেই হয় না। বাস্তবায়নই হচ্ছে আসল। দেখা যাক কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়।
সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা লাখো-কোটি মানুষের মনের কথা বলেছেন। তাও আবার কোনো চায়ের দোকানে বসে নয়, একেবারে এজলাসে প্রধান বিচারপতির আসনে বসে বলেছেন, ‘বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটিতে অনেক স্বাধীনতাবিরোধী মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের মানুষ স্থান পেয়েছে।’ কীভাবে বললে এটা বিশ্বাস করতে হবে আর প্রতিকার হবে। কাদেরিয়া বাহিনীর এক উজ্জ্বল নক্ষত্র জাহাঙ্গীর হোসেন তালুকদারকে স্বাধীনতাবিরোধী এক উকিল, যার নানা আলবদর ছিল সে হাইকোর্ট থেকে নির্দেশ বের করেছে, জাহাঙ্গীর হোসেন তালুকদার এবং টাঙ্গাইল মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার জহুরুল হক ডিপটি মুক্তিযোদ্ধা না। সেদিন হঠাৎ করে শুনলাম দাপনাজোরের সাখাওয়াত হোসেন মান্নানের মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম নেই। এ এক মহাতামাশা। যে মান্নানের সৌভাগ্যবশত যুদ্ধের সময়ের অনেক ছবি আছে। যেসব ছবি অনেক ক্ষেত্রে বড় বড় জেনারেলের হার মানাবে। কিন্তু সে এখনো মুক্তিযোদ্ধা নয়। তার অসহায় মা অনাদরে দিন কাটান। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করায় হাজার হাজার কাদেরিয়া বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হতে পারেনি। এখন যাদের দিয়ে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে, তারাও অনেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্মায়নি। মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে হয়েছে, কোথায় হয়েছে তাদের জানার কথা নয়। যেমন সাখাওয়াত হোসেন মান্নান শুধু মুক্তিযোদ্ধা নয়, ‘৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিল। হালুয়াঘাটের বারাঙ্গাপাড়ায় সে শহীদ হয়। তার পরও সে মুক্তিযোদ্ধা নয়। কয়েকবার মন্ত্রীকে বলেছি, আরও যেখানে যেখানে বলার বলেছি, প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। কিন্তু কেন যেন কোনো কাজ হয়নি। কেমন যেন সবার অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় এবং তাদের সম্মানী ভাতার দাবি উত্থাপন করে আওয়ামী লীগ ছেড়েছি। মন্ত্রণালয় হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা হয়েছে, কিন্তু সম্মানজনক হয়নি। সবই কেমন যেন অবহেলার বিষয়বস্তু। এর পরিত্রাণ কোথায়, বুঝতে পারছি না। কিন্তু প্রতিকার যে একটা আছে বা হবে, সেটা ইতিহাসের পাতায় পাতায় খুঁজে পাওয়া যায়। সহজ বা কঠিন, একদিন আগে বা পরে এসবের প্রতিকার হবেই হবে।
রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণ নিয়ে আজ কিছুদিন ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়া বড় সোচ্চার। শেষ পর্যন্ত বিত্তশালীদের কঠিন শাস্তি হোক বা না হোক, এমনিতেই সামাজিকভাবে এদের শাস্তি একটা হবেই হবে। কেমন বাপ আপন জুয়েলার্সের মালিক দম্ভ করে বলে, ‘অমন নষ্টামি তো আমিও করি।’ নষ্ট জায়গা থেকে কেউ উঠে এলে সে এমন নষ্ট কথাই বলে। রেইনট্রি হোটেলের মালিক হারুনুর রশিদ এমপির ছেলে সাংবাদিকদের ওপর গু-া লেলিয়ে দেয়। তার পরও বলব দেশে আইনশৃঙ্খলা আছে? ছেলেবেলায় শুনেছিলাম, ‘এ্যত গাছ টান দিলে বেতগাছ নড়ে, কানা কুক্কায় ডাক দিলে সমুদ্র নড়ে’ মানে বুঝতাম না। এবার চোখের সামনে দেখলাম। পাপ করলে তার যে শাস্তি আল্লাহর তরফ থেকে হয়, সেটাই হলো রেইনট্রি হোটেল। আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদের প্রতিদিনের হাত খরচ ২ লাখ টাকা। আমরা দেশ স্বাধীন করে প্রতিদিন দুইশ টাকা হাত খরচ করতে পারি না। আর কোথাকার অপদার্থ তার হাত খরচ দিনে ২ লাখ টাকা। সে রেইনট্রিতে গিয়ে নারী ধর্ষণ করবে না তো কী করবে? রেইনট্রিতে নারী ধর্ষণ, আপন জুয়েলার্সের অবৈধ সোনা। এ সোনা আবার কীভাবে বৈধ হবে তা আল্লাহই জানেন। এক ছটাক সোনা বৈধভাবে আমদানি হয় না, এক টুকরো হীরা আসে না। কিন্তু এদের দোকানভর্তি সোনা-হীরা। কী বিচার হবে জানি না। কিন্তু কিছু একটা হবে এটা জানি।
সেদিন ছিল প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। পরিবার-পরিজন নিয়ে তাকে শুভ কামনা জানাতে যেতে চেয়েছিলাম। যারা তাকে জানান, তাদের যেখানে যেখানে বলা দরকার বলেছিলাম। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। জনগণের নেতা জননেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু অনুমতি ছাড়া কোনো মানুষই তার কাছে যেতে পারে না। আমরা তো নয়-ই। শুনেছি শত্রুপক্ষের তালিকায় আমাদের নাম। প্রধানমন্ত্রীর স্বামী মারা গেলে শোক জানাতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়েছিলাম। আমাদের স্বামী-স্ত্রীর সামনে দিয়ে একজন শাঁইশাঁই করে গেট পেরিয়ে গেল। কিন্তু আধা ঘণ্টা বসে থেকে আমরা স্বামী-স্ত্রী অনুমতি পাইনি। সেদিন যে শাঁইশাঁই করে গিয়েছিল সে একসময় ’৭৫-এ প্রতিরোধ সংগ্রামে আমার বোঁচকা টানত। প্রধানমন্ত্রীর হেয়ার রোড থেকে গিয়েছিলাম সুধা সদনে। সেখানেও বাড়ির কাছে যাওয়া যায়নি। ২-৩ ঘণ্টা পর মাগুরার আসাদ ভাইয়ের ছেলে শেখর ফোন করেছিল, আপনি সুধা সদনে গিয়েছিলেন শোক বইয়ে স্বাক্ষর করতে পারেননি। যখন খুশি আপনি আসবেন বলে রাখা হয়েছে। আর যেতে ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আমার স্ত্রী নরম দিলের মানুষ। শেষ পর্যন্ত গিয়ে স্বাক্ষর করে এসেছিলাম। অথচ চার-পাঁচ বছর আগে ড. ওয়াজেদ দুলাভাই যখন এক মাস হৃদরোগ হাসপাতালে ছিলেন, আমার স্ত্রী নাসরীন সেই এক মাসই তাকে খাইয়েছিল। ’৮১ সালে যেদিন নেত্রী দেশে ফেরেন, সেদিন দিল্লি থেকে কলকাতায় নেত্রীর সঙ্গে একই প্লেনে এসেছিলাম। তার কিছুদিন পর যখন ওয়াজেদ ভাইও চলে আসেন সেবারও দিল্লি থেকে কলকাতা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে এসেছিলাম। কার পাশে বসাবেন বোন, না দুলাভাইয়ের পাশে সমাধান টেনেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। তিনি তাদের দুজনের মাঝে বসিয়ে দিল্লি থেকে কলকাতা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেছিলেন। কলকাতা থেকে যখন ঢাকার বিমানে ওঠেন আমার চোখে খুব একটা পানি আসে না, তবুও কেন যেন সেদিন এসেছিল। তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনই কেঁদেছিলেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা সব সময় আমাকে আপন ভাইয়ের মতো দেখতেন। আমিও তাকে রাজনীতি ছাড়া মায়ের মতো সম্মান করি। কতবার যে আমার মাথা তার বুকে জড়িয়েছেন, মাথায় হাত বুলিয়েছেন। আমি আমার মাথায় মায়ের হাতের স্পর্শই অনুভব করেছি। আমার বাবা যেদিন মারা যান তার দুদিন আগে ঢাকার বাসায় একই সোফায় মা-বাবা আমায় মাঝে বসিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন, যেমনটা দুলাভাই ড. ওয়াজেদ ও প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে নিয়ে মাঝের সিটে বসিয়ে বলতে বলতে বারো-পনেরশ কিলোমিটার আকাশপথ পাড়ি দিয়েছিলেন। সময় কি কঠিন নিয়ামক, কখন কার অনুকূলে আবার কার প্রতিকূলে বয়ে চলে এক মুহূর্ত আগেও বোঝা যায় না।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম : রাজনীতিক ও কলাম লেখক
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন