কক্সবাজার থেকে বাংলাদেশ প্রতিদিনে একটা লেখা দিয়েছিলাম। নিয়মিত সাপ্তাহিক লেখা বাদ পড়লে পাঠকরা দুশ্চিন্তায় পড়েন, নিজের কাছেও খারাপ লাগে। কেমন যেন বিনে সুতোয় সেতুবন্ধ হয়ে গেছে। আপনাআপনি ভদ্রলোকের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে গেছে। সেখানে লিখেছিলাম, কক্সবাজারে সমুদ্রসৈকতের যে ঢেউ আছড়ে পড়ে সেই ঢেউয়ের ঝুঁটি ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে তা দিয়ে বাংলাদেশের প্রয়োজন মিটিয়ে বেশি হতে পারে। কেউ কেউ বিস্মিত, কারো কারো আবার চিন্তার খোরাক হয়েছে। আমি নতুন কিছু বলিনি। এ তো অতি সাধারণ কথা, প্রাইমারিতে পড়া শিশুদেরও এসব বোঝার কথা। নড়াচড়া মানে শক্তি। কম্পনের আরেক নাম জীবন। যেখানেই কম্পন ও ওঠানামা ঢেউ, সেখানেই শক্তি বা জীবন। নীরব-নিশ্চল মৃত্যুর আরেক নাম। আমি কথাটা বলেছি নিরন্তর যে ঢেউ সমুদ্রের পাড়ে আছড়ে পড়ে, সে ঢেউয়ের ওঠানামা কাজে লাগিয়ে বা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে অনায়াসে বিদ্যুৎ বা আরও শক্তি উৎপাদন করা যেতে পারে। আমি একজন নিরেট মূর্খ। বিজ্ঞানের কিছুই জানি না। আমার ছেলেবেলা ছিল দুষ্টুমিতে ভরা। আমাকেও দায়িত্ব দিলে লোহালক্কড় জোড়াতালি দিয়ে দু-চার বছরে বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের চাইতে বেশি এ নরাধম আমিও তৈরি করে দিতে পারি। এ জন্য বাজেটের চার ভাগের এক ভাগ লাগবে না। এক বছরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে ভাঙা কলম ও ছেঁড়া কাগজ বাস্কেটে ফেলে তার অর্ধেক প্রয়োজন হবে কিনা, বলতে পারি না। আর এ তো জগৎসিদ্ধ সত্য। এক বিদ্যুৎ চমকের শক্তি কোনোভাবে কাজে লাগাতে পারলে সারা পৃথিবী না হোক, ভারত উপমহাদেশের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে।
প্রায় এক মাস পর আমাদের সময়-এ ঈদের পর প্রথম লেখা। ঈদুল ফেতরের ১০-১২ দিন আগে লিখেছিলাম, ‘শেষ পর্যন্ত আল্লাহর ঘর মসজিদেও পুলিশ!’ কেন যেন শিরোনাম বদলে ‘অন্ধকারে আলো জ্বালাতে হবে’ শিরোনাম করেছিল। আমরা বয়সী মানুষ। আমাদের নিয়ে যা তা করলে ভালো লাগে না। দেশের জন্মের বেদনার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। তাই যে কারোর যা খুশি ভালো লাগে না। লিখেছিলাম, ‘একজন মুসলমান নিরাপদে মসজিদে আল্লাহ-রাসুলের নাম নেবে, রোজায় তারাবি পড়বে, জুমায় খুতবা শুনবে সেখানেও সরকার, সেখানেও পুলিশ। মসজিদে, মন্দিরে আল্লাহ-রাসুল ও ভগবানকেই থাকতে দেওয়া উচিত। সেখানে সরকারের প্রবেশ ভালো নয়।’ কেন যেন কথাগুলো কেটে দিয়েছিল। জানি সব পত্রপত্রিকা বড় শঙ্কিত। এখানে শঙ্কার কী আছে খুঁজে পাইনি। খুঁজে পেলে আমার কোনো আপত্তি নেই। ‘রোজার একেবারে প্রথম জুমায় পুলিশের খুতবা ভালো লাগেনি। হৃদয়ের কান্না কলমে এনেছি। এ কান্না শুধু আমার একার নয়, এ কান্না প্রতিটি মুসলমানের।’ গতবার লেখা হয়েছিল, ‘হৃদয়ের কান্না কলমে এনেছি।’ বাদ পড়েছিল ‘এ কান্না শুধু আমার একার নয়, এ কান্না প্রতিটি মুসলমানের।’ বাদ পড়ার কী কারণ বুঝতে পারিনি। আমার কান্না ছাপা হতে পারে, সারা দুনিয়ার মুসলিম উম্মাহর কান্না ছাপা হবে নাÑ এ কেমন কথা! মনে হয় এ নিয়ে আর ভবিষ্যতে তেমন কিছু বলতে হবে না।
আজ ক’দিনের সব থেকে আলোচিত ফরহাদ মজহার। ফরহাদ মজহার একটি পরিচিত নাম। দোষে-গুণে মানুষের মধ্যে তিনি একজন। মতের মিল না হলেই কারো জীবন নিরাপদ হবে না, এটা রাষ্ট্রের জন্য অমঙ্গল বা অসম্মানের। ফরহাদ মজহারের সঙ্গে অনেকের মতের অমিল থাকতে পারে। কিন্তু তাকে কেউ উঠিয়ে নিয়ে গুম করে ফেলবে, এটা ভাবা যায় না। অথচ ব্যাপারটা তাই হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘দ্রুত ফরহাদ মজহারকে উদ্ধারের জন্য পুলিশকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত এবং অনেকেই ধন্যবাদ দিচ্ছে।’ কথাটা খুবই যুক্তিযুক্ত। তিনি এ আশাবাদ ব্যক্ত করে তার কাজকর্মের একটা স্বীকৃতির কথা চিন্তা করেছেন, তা তিনি করতে পারেন। দেশবাসীর সঙ্গে আমিও পুলিশকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে চাই। কিন্তু ধন্যবাদ জানাতে হলে পুলিশরা কী সফলতা দেখিয়েছে, তার কিছু তো জানতে হবে। তাই কীভাবে সফল হলেন, যা গোপন রাখার তা গোপন রেখে ধন্যবাদ পাওয়ার জন্য যতটুকু দরকার, তা অবশ্যই বলতে হবে। সবাই জানেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমি পছন্দ করি, ভালোবাসি। জীবনে খুব বেশি মানুষ আমাকে সপরিবারে ভেজা কাপড়ে দেখেননি। সেদিন কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সস্ত্রীক আমাদের পুরো পরিবারকে ভেজা কাপড়ে দেখেছেন। সাধারণ পানিতে নয়, সমুদ্রের অমূল্য লোনা জলে ধুয়ে ওঠা মলিনতাহীন। তাই ধন্যবাদ দিতে গিয়ে কিছু কর্মতৎপরতা অবশ্যই জানতে ইচ্ছে করে।
অপহরণ না, এটা তার বা বিরোধী দলের সরকারকে বিব্রত করার সাজানো নাটক? নাকি সরকারের কারসাজি কিংবা প্রকৃতই একটি অপহরণ, নাকি লোকজন বলছে ভারতে গো-হত্যা নিয়ে ফরহাদ মজহার উচ্চকণ্ঠ হওয়ার ফলÑ সবকিছু একটু ঠা-া মাথায় ভেবে দেখা দরকার। পত্রপত্রিকায় যখন দেখি গো-হত্যা, মনটা বিরক্তিতে বিষিয়ে যায়। মানুষ খাওয়ার জন্য কোনো কিছু হত্যা করে না। হত্যা সেটা, যা কিছুই হোক পরম নিন্দনীয়। গাছ থেকে ফুল ছেঁড়া, ক্ষেত থেকে ধান কাটাÑ এসবই তো তাহলে হত্যা বলে বিবেচিত হবে। স্রষ্টার সৃষ্টির রহস্য বোঝা খুব সহজ নয়। মানুষের খাওয়ার জন্য আল্লাহতাআলা যা সৃষ্টি করেছেন, তা খাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হবে। তাকে হত্যা বলা বরং পাপ বা গুনাহর কাজ। আমরা হুজুকে চলেছি, অনেক কিছু তলিয়ে দেখি না। ফরহাদ মজহারকে যদি ওই কারণে গুম করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে, তাহলে সেটা মারাত্মক নিন্দনীয় ব্যাপার। ইলিয়াস আলী গুম হয়েছে তার পরিবার-পরিজনের বুকের ওপর কী যন্ত্রণার নহর বইছে, আমরা অনেকেই তা বুঝতে চেষ্টা করি না। পেকুয়ার সালাহউদ্দিন আহমেদ। সেদিন তার গ্রামে গিয়েছিলাম। সেও অপহৃত হয়ে এখন মেঘালয়ের শিলংয়ে আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, ‘যদি ফরহাদ মজহারকে পাওয়া না যেত অথবা ভারতে পাচার হয়ে যেত, তাহলে কী হতো?’ সত্যিই চিন্তার বিষয়। আইয়ুব-মোনায়েমের সময় অনেক শহীদ হয়েছেন। সরকারের পতন হয়নি। কিন্তু ২০ জানুয়ারি আসাদের মৃত্যু সব পূর্ব পাকিস্তান জ্বলে উঠেছিল। ২০ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি খুব একটা বেশি সময় নয়, লৌহমানব ফিল্ড মার্শাল মো. আইয়ুব খান ধুলোয় মিলিয়ে গিয়েছিলেন। আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে সসম্মানে মুক্তি দিয়ে পাকিস্তানের রাজধানীতে গোলটেবিলে বঙ্গবন্ধুকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। নয়-দশ বছরের স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কত কথা বলেছেন। ৪ বা ৫ ডিসেম্বর ফরিদপুরের ভাঙ্গায় এক বেইলি ব্রিজ উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন। সেদিনও সেই জনসভায় লাখো লোক হয়েছিল। কিন্তু ঢাকায় ফিরে তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। মিছিলে ট্রাক উঠিয়ে দেওয়া, জিরো পয়েন্টে নূর হোসেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ বুকে-পিঠে নিয়ে শহীদ হয়েছে তেমন কোনো কাজ হয়নি। কিন্তু ডা. মিলনের মৃত্যুতে দেশ জ্বলে উঠে গণবিস্ফোরণ ঘটে। এরশাদকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। তাই সবকিছু ভালোভাবে লক্ষ করা উচিত। এ ক্ষেত্রেও সবাইকে লক্ষ করতে অনুরোধ করছি। মনে রাখবেন, কখনোসখনো মরা শামুকেও পা কাটে।
বহুদিন পর কক্সবাজার গিয়েছিলাম। আমার প্রাণের ধন, কলিজার টুকরা কুশিমণি সমুদ্র দেখেনি। তাকে সমুদ্র দেখানোর জন্যই মূলত কক্সবাজার গিয়েছিলাম। অন্যদিকে ভাস্তি ঝর্ণার বিয়ে হয়েছে পেকুয়া মেহেরনামার নাজিম উদ্দিনের ছেলে রুবেলের সঙ্গে। বিয়ের সময়ই তার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আজ যাই, কাল যাই করে যাওয়া হয়নি। তাই ঝর্ণার শ্বশুরবাড়ি যাওয়া দরকার ছিল। ’৯০-এ দেশে ফিরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, বিশেষ করে চকরিয়া ও পেকুয়ায় বেশ কয়েকবার গিয়েছি। কাদের সিদ্দিকী স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সংগ্রাম পরিষদের চট্টগ্রামের আহ্বায়ক ছিল কফিল চৌধুরী। তার বড় ভাই জিয়া, ছোট ভাই মেজবা ভীষণ কাজ করেছে। সে কারণে ওদের বাড়ি গিয়েছি বারবার। পেকুয়া আগে ছিল চকরিয়ায়। এখন আলাদা উপজেলা। সেখানে বিএনপির প্রধান নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ এখন শিলংয়ে আটক। ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু ভারতের শিলংয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদকে পাওয়া গেছে। তার অনুপস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই সেখানে বিএনপি সমর্থকদের নীরবতা লক্ষ করার মতো। আমি প্রথম শিলং গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তার হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রথম দিকে। এক অপরূপ সুন্দর স্বর্গীয় নগরী শিলং। আসামের গৌহাটি থেকে ৭০-৮০ কিলোমিটার দূরে। আগেকার দিনে আমাদের গ্রামগঞ্জে সন্ধ্যায় মা-বোনদের চুলা থেকে যেভাবে ধোঁয়া বেরোতো, তেমন ধোঁয়ার মতো দূরে তুষার উড়তে দেখা যায়। সব সময় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি লেগেই থাকে। যদিও সেখানে বেশিদিন থাকিনি। শিলংয়ের মানুষজন বেশ ভালো, খুবই বন্ধুবৎসল।
ভাস্তি ঝর্ণার শ্বশুরবাড়ি বিখ্যাত মাতামহুরী নদীর একেবারে পাড়ে। চমৎকার এক সুন্দর পরিবেশ, বেশ ভালো লেগেছে। লোকজন সবাই হাসিখুশি। চাচা-চাচি, ভাই-বোন নিয়ে অনেক মানুষ, অনেক বাচ্চাকাচ্চা। ঝর্ণার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে আমার বাড়িতে বাচ্চাকাচ্চার বড় অভাব অনুভব করেছি। আমার বড় বড় দুই ছেলে-মেয়ে। একটা একটু ছোট। আমি যে বয়সে বিয়ে করেছিলাম আর এক-দেড় বছরের মধ্যে আমার ছেলের সে বয়স পেরিয়ে যাবে। এক ছেলে হলে যা হয়। কিছুই বলা যায় না, বলতেও পারি না। ওদের মায়ের যে বয়সে বিয়ে হয়েছিল, আমার মেয়ের এখন ঠিক সেই বয়স। মেয়েকে বিয়ের কথা বললে বলে, পড়া শেষ করে নিই; ছেলে বলে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিই। এখন আমার কোনো দুশ্চিন্তা নেই, হতাশা নেই, কোনো অভাব নেই। দেবশিশু কুশিমণি ঘরে আসার পর আমার ঘর আলোয় আলোয় আলোকিত, অশান্তির লেশ নেই। কিন্তু একটাই ছোটখাটো কষ্ট, ছেলেমেয়েরা বিয়ে করলে, নাতি-নাতকুর ঘরে এলে আনন্দ হতো। এ নিয়ে দু-চারবার শেখ রেহানা বলেছে, ‘কাদের ভাই, চিন্তা করবেন না। সন্তানসন্ততি আল্লাহর সম্পদ। একসময় দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।’ সেই ভরসাতেই বুক বেঁধে আছি।
আজ যাই, কাল যাই করে প্রায় তিন বছর ঝর্ণার শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হয়নি। তাই এবার রোজার মাঝামাঝি ঠিক করেছিলাম ঈদের পরদিন বা তার পরদিন চট্টগ্রাম, কক্সবাজার যাব। সেভাবেই ট্রেনে ঢাকা-চট্টগ্রাম, সেখান থেকে সড়কপথে পেকুয়া। প্রতিবার ঈদে প্রচ- যানজট হয়। সেতু ও সড়ক যোগাযোগমন্ত্রী বলেছেন, ‘এবার তেমন যানজটে সাধারণ মানুষকে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হয়নি।’ কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। আংশিক সত্য। এবারও যানজট হয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় প্রচ- যানজট হয়েছে। কিছুটা জট কম হওয়ায় কারো কোনো কৃতিত্ব নেই। যেটুকু কৃতিত্ব সাধারণ মানুষ ভয় পেয়ে আগেভাগে বাড়ি ছুটেছিল এবং একটা লম্বা ছুটি হওয়ায় যানজট কিছুটা কম ছিল। আমরা ২৩ তারিখ ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল গিয়েছিলাম। রাস্তা বেশ ফাঁকাই ছিল। কিন্তু আমাদের পেরিয়ে যাওয়ার ১ ঘণ্টা পর থেকেই ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে প্রচ- যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল।
ঈদের পর ২৮ জুন টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা ফিরছিলাম রাস্তা ছিল ফাঁকা। আগেই রেলের ডিজি মো. আমজাদ হোসেনকে সিটের ব্যবস্থা করতে বলেছিলাম। তিনি এডিজি মো. হাবিবুর রহমানকে দিয়ে তূর্ণা এক্সপ্রেসে ব্যবস্থা করেছিলেন। রেলের লোকজন অসাধারণ যতœ নিয়েছিল। ট্রেনে যদিও রাতের খাবার ছিল না। কিন্তু শুকনা খাবার যা ছিল, তা খুবই ভালো ও উন্নত মানের ছিল। তাইওয়ান থেকে আনা নতুন কোচ ছিল বেশ ঝকঝকে-তকতকে। চলেছিল বলতে গেলে ঘড়ির কাঁটা মেলানোর মতো। আগেই চট্টগ্রামের ডিসির সঙ্গে কথা হয়েছিল সার্কিট হাউসে কিছু সময় বিশ্রামের জন্য ব্যবস্থা করতে। তিনি আনন্দের সঙ্গে তা করেছিলেন। পরম সুহৃদ (অব.) মেজর আ. মান্নানের কাছে গাড়ি চেয়েছিলাম। তিনি একটা নয়, জায়গা না হওয়ায় দুটো দিয়েছিলেন। তাই ভাস্তির শ্বশুরবাড়ি পেকুয়ার মেহেরনামায় পৌঁছতে তেমন কোনো কষ্ট হয়নি। তবে ১০-১২ বছর পর কর্ণফুলীর পূর্ব পাড় দেখে বড় বেশি হতাশ হয়েছি। এই কয় বছরে সেদিকে তেমন কোনো রাস্তাঘাট হয়নি। যা রাস্তাঘাট সেই কর্নেল অলি আহমদের সময় হয়েছিল। গাড়ির ভিড়ে রাস্তা সরে না। পটিয়ায় লাগাতার জ্যাম লেগেই আছে। ৮০-৮৫ কিলোমিটার পথ ইউরোপে যেখানে ১ ঘণ্টা লাগার কথা নয়, সেখানে অনেক কষ্টে ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টায় পৌঁছেছিলাম। তবু শান্তি, মোটামুটি ভালোভাবে পৌঁছতে পেরেছিলাম। ঝর্ণার শ্বশুরবাড়ি বেশ ভালো, লোকজন তার চেয়েও ভালো। একেবারে ভেতরের কথা বলতে পারব না, কিন্তু মনে হলো সবাইকে নিয়ে মেয়েটি আমার বেশ ভালোই আছে। আমার সাদামাটা স্ত্রী তার তেমন অভাব-অভিযোগ-অনুযোগ নেই। মাঝেসাজে বলে, ‘তোমার ছেলেমেয়ে, নাতিপুতির অভাব নেই। কতজন তোমায় বাবা, দাদা, নানা ডাকে। সে হিসাবে তোমার ছেলেমেয়ে, নাতি-পুতি, ভাইস্তা-ভাস্তি বেসুমার।’ তার মধ্যে ঝর্ণা খুবই প্রিয়। ওকে আমরা নিজের মেয়ের মতোই আদরযতেœ বড় করেছি, লেখাপড়ায় খোঁজখবর নিয়েছি। যখন যা লেগেছে, যতটা পেরেছি সন্তানের মতো করেছি। প্রিয়রা সুখে থাকলে, শান্তিতে থাকলে কার না ভালো লাগে। আমাদেরও ভালো লেগেছে। আমি যাওয়ায় আশপাশের অনেক লোকজন এসেছিল। থানার ওসি, দারোগা, পুলিশ, অনেক সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা। জানি না তাদের কেমন লেগেছে। কিন্তু আমার ভালো লেগেছে। ছেলেমেয়ে, স্ত্রী ও ঝর্ণার পরিবার-পরিজন নিয়ে যখন মাতামহুরীর পাড়ে ঘুরছিলাম, নির্মল বাতাস হু-হু করে এসে গায়ে লাগছিল। বুক জুড়িয়ে যাচ্ছিল। সারা দেশের সব বাতাস যদি এমন নির্মল হতো সে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সব ক্ষেত্রে; তবে কতই-না ভালো হতো। আমরা যেদিন বিখ্যাত মাতামুহুরীর পাড়ে ঘুরছিলাম, সেদিন সে ছিল শান্ত। কিন্তু ক’দিন থেকে সেই মাতামুহুরী দু’কূল ভাসিয়ে নিচ্ছে। ঝর্ণার বাড়ি থেকে কক্সবাজারের পথে বারবার আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি, হে দয়াময় পরম প্রভু আমার ওদেরকে নিরাপদ ও শান্তিতে রাখুন।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম : রাজনীতিক ও কলাম লেখক
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন