|
কাদের সিদ্দিকী
mjakbar@indiatoday.com |
|
প্রসঙ্গ : ষোড়শ সংশোধনী ও খায়রুল হক
12 August 2017, Saturday
ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের রায়ের পর দেশে যে আলোড়ন চলেছে তা অভাবনীয়। একজন আইনবিদের ছেলে হয়ে সারাজীবন ভাবতেও পারিনি কোর্টের কোনো রায়ের ভাষা, তাদের নিরীক্ষণ নিয়ে সংশোধনের কথা বলা যেতে পারে। বিচারালয়ের চিরাচরিত নিয়ম তারা তাদের মতো রায় দেবেন। নিচের কোর্টের রায় পছন্দ না হলে ওপরের কোর্টে যাবেন। নিচে থেকে ওপরে যেতে যেতে সর্বোচ্চ আদালতে যাবেন। সেখানে যা হবে দেশে আইন-আদালত থাকলে তা মেনে নিতে হবে। পাকিস্তান এমন জঙ্গিরাষ্ট্র, সেখানেও মেনে নেওয়ার একটা প্রবণতা আছে। সংসদে এ নিয়ে আলোচনা হওয়া ভালো নয়। তবু কমবেশি হতে পারে। কিন্তু কেবিনেটে নয়। দুনিয়ার সব নজির ভেঙে ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে তাই হচ্ছে। সর্বত্র আলোচনা। সাধারণ মানুষ করে সেটা ভিন্ন কথা, কিন্তু যাদের আইনের দ্বারা শপথের মাধ্যমে হাত-পা বাঁধা তারা যা খুশি তা করতে পারেন না। এসব নিয়ে সমস্যা হচ্ছে প্রধান বিরোধী দল কোর্টের পক্ষ নিয়েছে। তাই যত যুক্তিযুক্ত কথাই বলা হোক, সেটা বিএনপির পক্ষে বা আওয়ামী লীগের বিপক্ষে যাবে। সেখানে ন্যায়-নীতির কোনো বালাই নেই, কোনো বিবেচনা নেই। সেখানে পক্ষ-বিপক্ষই প্রধান বিবেচ্য।
তবু ন্যায়ের স্বার্থে বলি, সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান। তার কাজ যে কোনো আইন আইনসিদ্ধ করা, হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট নিয়ে কথা বলা নয়। সরকারের পক্ষ অথবা বিরোধী দলের বিপক্ষ নেওয়া নয়। অথচ এমন জঘন্যভাবে তিনি বক্তব্য দিয়েছেন যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তিনি এখন বিচারপতি নন, প্রধান বিচারপতিও নন। সরকারের আজ্ঞাবহ একজন দয়ার পাত্র মাত্র। কারণ অবসরের পর তাকে একটা কাজ দেওয়া হয়েছে। তার সময় বৃদ্ধির সময় এসেছে কিনা জানি না। কিন্তু একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির মতো কথা বলেননি। সাবেক প্রধান বিচারপতি হলেই যা খুশি তা করা বা বলা ঠিক নয়। তার বাধ্যবাধকতা আছে। তার বাইরে তিনি যেতে পারেন না। তিনি যেভাবে হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, দেশদ্রোহিতা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এমন মানবতাদ্রোহী, সমাজদ্রোহী, বিচারদ্রোহীর কোনো বিবেচনার সুযোগ কোথায়? নিজে সাবেক প্রধান বিচারপতি হয়ে বিচারালয়কে এত খেলো এবং ছোট করতে পারেন এটা ভাবা যায়? কক্ষনো নয়। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে জাস্টিসতন্ত্র বলেছেন। একজন মানুষের কতটা ঔদ্ধত্য থাকলে এমন বাজে কথা বলতে পারেন? আমি আমার জীবনে বহু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দেখেছি, আসনে থাকতে তাদের সে কী ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব, চেয়ার ছাড়লে কিছুই নয়। সেটা থানার ওসি থেকে সচিবালয়ের সচিব পর্যন্ত। খায়রুল হককে তেমন চিনি না। কিন্তু তার কর্মকা- ও আচার-আচরণে তেমন ভাবতে বাধ্য করছেন। কোর্ট তার রায়ে কেমন নিরীক্ষণ দেবেন সেটা কোর্টের এখতিয়ার। কী ভাষা হবে সেটাও কোর্টের। কোর্টের অনেক দরখাস্তই পছন্দ হয় না। ভাষার লয়-তাল-মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। ক’দিন আগে জজকোর্টের কয়েকটা আর্জি পড়ে ভিরমি খাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। আর্জির ভাষা স্পষ্ট নয়, সাবলীলও নয়। কিন্তু কোর্টের ভাষা বহু যুগ যেভাবে চলে এসেছে, সেভাবেই চলবে। তাই বাইরে থেকে কোর্টকে পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু ডিক্টেক্ট করা যায় না। এখানে খায়রুল হকের কথাবার্তায় তাকে
সুপ্রিমকোর্টের সুপ্রিম মনে হয়েছে।
তার আপত্তি কোথায়, কী তিনি বলতে চেয়েছেন তা কিন্তু স্পষ্ট হয়নি। সরকারের ঘনিষ্ঠ নেক নজরে পড়ার জন্য লক্ষ্মণের বাণ ছুড়েছেন কিনা সেটা তিনিই জানেন। ক্ষত্রিয়দের গর্ব হিন্দুশাস্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ অর্জুনের চেয়েও খায়রুল হক কঠিন লক্ষ্যভেদী কাজ করেছেন। তবে যাকে লক্ষ্য স্থির করেছেন সেটাই যদি অস্থির হয় তাহলে তার আঘাত কোথায় গিয়ে লাগবে। বাঙালি ভুলো চালের ভাত খায়। তাই বলে সব ভোলে না। কবি নজরুল বলেছিলেন, ‘পুরনো দিনের স্মৃতি কেউ ভুলে কেউ ভুলে না।’ খায়রুল হক যখন প্রধান বিচারপতি তখন মুন সিনেমা হলের মালিকানা নিয়ে এক মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায় দিয়েছিলেন। সে আর্জিতে সরকার নিয়ে কোনো কথা ছিল না, সংবিধান নিয়ে কোনো কথা ছিল না। ব্যক্তিমালিকানার সামান্য সম্পত্তি নিয়ে একটি মামলায় মামলার বাইরে গিয়ে যে জাতীয় সংকটের জন্ম দিয়েছেন ভাবীকালে কোনো বিচারালয়ে বিচার না হলেও অবশ্য অবশ্যই সমাজের আদালতে বিচার হবেই হবে। মামলার এক পর্যায়ে যখন সাংবিধানিক প্রশ্ন আসে তখন যাদের অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ করা হয়েছিল তারা প্রায় সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। অন্তত আরও দুবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচনের কথা ছিল। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকার পক্ষে আওয়ামী লীগও মত দিয়েছিল। তার পরও তিনি কীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের আদেশ দিয়েছিলেন বা রায় দিয়েছিলেন এটা কি দেশবাসী ভুলে গেছে? ক’দিন ধরে দেখছি খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম খুব কথা বলছেন। তার অতীত খুব একটা পরিষ্কার নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বড় ভাই প্রত্যক্ষ পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। তার এক বইয়ের দোকান ছিল। সেখানে কামরুল ইসলাম নিয়মিত বসতেন। ঢাকা শহরে প্রকাশ্য মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কথা না বলে ঢাকায় থাকা যেত না। তাই সময় থাকতে সংযত হওয়া উচিত। বিচারালয়ের মর্যাদা ধ্বংস করা উচিত নয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক এ পর্যন্ত যা বলেছেন তাতে আদালত অবমাননার সব আলামত রয়েছে। সপ্রবৃত্ত হয়ে হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট সাবেক বিচারপতিকে যদি আদালত অবমাননার দায়ে আদালতে হাজির না করেন তা হলে এর আগে দুজন মন্ত্রীকে ক্ষমা প্রার্থনার পরও যে আদালত অবমাননার দায়ে শাস্তি এবং পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে সে রায় অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আমার প্রিয় আ ক ম মোজাম্মেল হক হঠাৎই বলে বসলেন, এবার ঈদে মুক্তিযোদ্ধাদের ৫২ হাজার টাকা দেবে। টাকাটা বকেয়া, না অতিরিক্ত তা বলেননি। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সে যে কী টানাটানি অনেকেই বুঝতে পারেননি। সরকারের কিছু সুযোগ-সুবিধার জন্য টানাটানির শেষ নেই। ’৭১-এ একটা রাজাকার পুলিশ-মিলিটারি বা ইপিআর যারা অবসরে গেছে তারাও পেনশন বা অবসর ভাতা পায়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের বেলায় বাহানার শেষ নেই। রাজাকার পুলিশ বললাম এ জন্য, পুলিশ-মিলিটারি-ইপিআর সব বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। কিছু পুলিশ যেমন অংশ নিয়েছিল, কিছু পুলিশ আবার পাকিস্তান রক্ষায় জান কোরবান করেছে। ইপিআর-আর্মি তাদের ক্ষেত্রেও একই কথা। কিছু মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল আবার কিছু পাকিস্তান রক্ষায় ৯ মাসই পাকিস্তানের হুকুম তামিল করেছে। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার পরপর মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ-ইপিআর-বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর পাকিস্তানের হয়ে কাজ করা সব একাকার হয়ে যায়। যারা পাকিস্তানের পক্ষে থানা পাহারা দিয়েছে, বর্ডার পাহারা দিয়েছে তারা সবাই বাংলাদেশ সরকারের কর্মচারী হয়ে যায়। রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা সব একাকার। সে জন্য কথাটি বলেছি। প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সম্মানী ছিল না। ভাতা ছিল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ৭৫ টাকা, তার পর ১৫০ টাকা। সেখান থেকে এখন বাড়তে বাড়তে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। কিন্তু খুব একটা সম্মানজনক নয়। বেশ কয়েক বছর আগে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী দাবি করেছিলাম। সেটা ছিল ’৯৬-এর পার্লামেন্ট। বলেছিলাম, মুক্তিযোদ্ধাদের ২০০০ টাকা সম্মানী ভাতা দেওয়া প্রয়োজন। অনেকের কাছে ব্যাপারটা বেশি মনে হয়েছে। এখন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ১০ হাজার টাকা। আগে যে সময় ২০০০ টাকা চেয়েছিলাম সেই হিসেবে এখন ৫০,০০০ টাকা হলে হয়তো সম্মান হতে পারে। কিন্তু এখন দেওয়া হচ্ছে ১০,০০০ টাকা। কোনো কাজে বাংলাদেশে অর্থের অভাব হয় না, এমনকি রিজার্ভ ব্যাংকের অর্থ চুরিতেও কোনো অভাব নেই, যত অভাব মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় করতে বলেছিলাম। একটা সময় বিএনপি করেছিল। যুদ্ধাহত এবং সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের অতি সাধারণ একটা ভাতা বা সম্মানী বেশ কিছুদিন চালু রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার এক সময় খেতাবপ্রাপ্তদের জন্যও সম্মানীর সিদ্ধান্ত নেয়। সেই হিসেবে এক সময় পর্যন্ত ভাতাও দেওয়া হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে এক রাজাকারের ছেলে এক সেক্রেটারি ফতোয়া দিয়েছে, একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত ও খেতাবপ্রাপ্ত এই তিনটি ভাতার যেটি সর্বোচ্চ সেটি পাবেন। কী করে রাজাকারের ছেলেকে বোঝাব, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যিনি ভাতা পাবেন, যুদ্ধাহত হলে তিনি যুদ্ধাহতের ভাতাও পাবেন। তিনি যদি খেতাবপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন তাহলে তিনি খেতাবপ্রাপ্তেরও পাবেন। কারণ তিনটা বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা। একটা বাদ দিয়ে আরেকটা ভাবার সুযোগ নেই। এসব জগাখিচুড়ির মাঝে পড়ে একজন রাজনৈতিক নেতা মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম মোজাম্মেল হক যখন যা খুশি তাই বলে চলেছেন। অনেকদিন একসঙ্গে কাজ করেছি, অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছি। তাই তাকে পছন্দ করি বলে তেমন কিছু বলতে পারি না। তবু এসব নিয়ে কথা না বলে থাকতে পারি না। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এমন করা ঠিক নয়। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে তাদের প্রকৃতই সম্মান করা উচিত।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম : রাজনীতিক ও কলাম লেখক
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন