|
কাদের সিদ্দিকী
mjakbar@indiatoday.com |
|
নিপীড়িত বিশ্বমানবতার জয় সুনিশ্চিত
23 September 2017, Saturday
যে কোনো মানুষই মনে করে সে খুব শক্তিশালী। কথাটা অনেক ক্ষেত্রেই যথার্থ। চেষ্টা করলে মানুষের অসাধ্য কিছু নেই। আবার ঠিক সেই মানুষের জীবন এত ঠুনকো, কচুর পাতায় শিশির বিন্দুর চাইতেও নড়বড়ে। ৩১ আগস্ট মরমি শিল্পী আবদুল জব্বারের জানাজায় শরিক হয়ে, বড় মেয়ে কুঁড়িকে বিমানবন্দর থেকে এনে বিকালে পুরো পরিবার টাঙ্গাইলের পথে রওনা হয়েছিলাম। দারুসসালাম থেকে মিরপুর স্বাধীনতা ব্রিজ পৌঁছতে সময় লাগে ৩ ঘণ্টা। তার পর ভেবেছিলাম হয়তো মোটামুটি চলে যাব। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। আরও দুই-আড়াই ঘণ্টা লেগে যায় সাভার পৌঁছতে। হঠাৎই শরীর খারাপ হতে থাকে। প্রচ- গরমে টেকা যাচ্ছিল না, তার মধ্যে শরীর কাঁপছিল। ভালো স্ত্রী আর মা প্রায় একই জিনিস। মা থাকলে সন্তানের যেমন কোনো কিছুর অসুবিধা হয় না, হাত বাড়ালেই সবকিছু পাওয়া যায়। ভালো স্ত্রী ও সন্তানের বেলাতেও একই কথা। আমাকে কাঁপতে দেখে ফরিদ ছুটে গিয়ে পেছনের গাড়ি থেকে দুটি কাঁথা নিয়ে এসেছিল। কাঁথা গায়েও শান্তি পাচ্ছিলাম না। ছেলে দীপ গাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। এক পা- দু’পা করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। তার পর সব চুপচাপ। প্রায় আধা ঘণ্টা পর আবার চলতে শুরু করে। কীভাবে প্রায় ৭ ঘণ্টায় চন্দ্রা বাড়রইপাড়া পৌঁছেছিলাম। বাড়ইপাড়ার আমাদের বহুদিনের পুরনো কর্মী আলী হোসেন। সে কিছুটা এগিয়ে নিতে এসেছিল। তাকে গাড়িতে তুলেছিলাম। অন্য তিন-চারজন পাদানিতে দাঁড়িয়ে ছিল। একসময় আলী হোসেনকে বলেছিলাম আর পারছি না। আশপাশে একটা বাড়ি দেখো। কত আর হবে আরও ৫-৭ মিনিট। আর ২-৪ মিনিট হলে হেঁটে ঘরে যেতে পারতাম না। শহুরে জটিল মানুষদের মধ্যে বাস করে গ্রামের সাধারণ মানুষ যে কত ভালো, সহজ-সরল অনেকেই ভুলে যাই। তেমনই একজন বাড়ইপাড়ার জয়নাল আবেদীন কেবলই ঘর করেছে। উপরতলার দু-তিনটি ঘরের কাজ শেষ হয়েছে, নিচতলা বাকি। গিয়ে শুয়ে পড়ার পর আমার আর হুঁশজ্ঞান ছিল না। ছেলেমেয়েকে টাঙ্গাইলের পথে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। ওরা যেতে পারবে কিনা চিন্তা করার শক্তি ছিল না। সেই যে বেহুঁশ হয়েছিলাম, হুঁশ ফিরেছিল ১৪-১৫ ঘণ্টা পর। এর মধ্যে তাপ উঠেছিল ১০৪ ডিগ্রি। কর্মীরা কখন কতবার মাথায় পানি দিয়েছে, হাত-পা ভেজা কাপড়ে মুছেছে কিছুই জানি না। এক গ্রাম্য ডাক্তার খোরশেদ আলম খুবই যতœ নিয়েছিল। যখন হুঁশ ফেরে, তখন ভেবেছিলাম সকাল ৮টা-সাড়ে ৮টা হবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা ৩টা। টাঙ্গাইল থেকে হাবিবুর রহমান তালুকদার বীরপ্রতীক, হাসমত নেতা, হিটলু, সোহেল, রুবেল আরও কে কে এসেছিল। রাস্তায় তখনো প্রচ- ভিড়। গাড়ি এদিক-ওদিক সরছে না। তার মধ্যেই বাড়ইপাড়া গ্রামের ভেতর দিয়ে সহজেই গড়াই পৌঁছেছিলাম। গড়াইয়ে কয়েক মিনিট হুজ্জতি করে সখীপুরের রাস্তা দিয়ে কোনোক্রমে সন্ধ্যায় টাঙ্গাইল পৌঁছেছি। তখন জ্বরের মাত্রা ১০২ ডিগ্রি। ডাক্তার ডাকা হলো। সে আমার শিক্ষাগুরু দুখীরাম রাজবংশীর মেয়ের জামাই নেত্রকোনার তাপস কুমার ভৌমিক। রাতেই কোরবানির গরু দেখেছিলাম। সকালে তেমন হুঁশজ্ঞান ছিল না। খাওয়া-দাওয়া আগের রাত থেকেই বন্ধ। গলা শুকিয়ে চৌচির। সবাই মিলে নিয়ে যায় টাঙ্গাইল সদর হাসপাতালে। সবাই ঈদের ছুটিতে ব্যস্ত। তবু যে ক’জন জরুরি বিভাগে ছিল অসাধারণ যতœ নিয়েছে। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক পুতুল রায় সম্পর্কে অনেক কথা শুনি। কিন্তু আমার যতেœ কোনো ত্রুটি করেনি। আসলেই বহুদিন এমন অসুস্থ হইনি। ১৬ আগস্ট ১৯৭১-এ হাত-পায়ে গুলি লেগেছিল। রক্ত ঝরেছিল অনেক। কিন্তু তার পরও নেতিয়ে পড়িনি। কোথায় সখীপুর আর কোথায় মেঘালয়ের তুরাÑ চার দিন অবিরাম হেঁটে সীমান্তে গিয়েছিলাম। সেখানেই ছিলাম ১০-১২ দিন। তার পর আবার সেপ্টেম্বরের ১৫-১৬ তারিখ যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসা। তাই ভাবতে অবাক লাগে সামান্য জ্বরে একটা মানুষ এমন হয়ে যায়, এপাশ-ওপাশ করার শক্তি থাকে না। পরম সুহৃদ মেজর মান্নান। পরদিন দুপুরে তার হেলিকপ্টারে ঢাকায় এনেছিলেন। ছিলাম কয়েক দিন বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে। কত মানুষ দেখতে এসেছে, শুভ কামনা জানিয়েছে, তার হিসাব নেই। এই সময় যদি মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন শুরু না হতো, তাহলে যত অসুস্থই হই, তেমন কষ্ট হতো না। অসুস্থ মানুষ দু’চোখ বন্ধ করতে পারিনি। চোখ বন্ধ করলেই নিপীড়িত-নির্যাতিত অসহায় রোহিঙ্গাদের মুখ ভেসে উঠত। শুনে তাজ্জব বনে গেছি, সেলিম নামে এক রোহিঙ্গা তার মাকে ১৮ দিন পিঠে বয়ে নিরাপদ বাংলাদেশে এনেছে। একদিকে শান্তিতে নোবেল পাওয়া সু চি তার দেশের মানুষের ওপর দানবীয় নির্যাতন, মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট, শিশু-নারী-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কারো রেহাই নেই; অন্যদিকে মাতৃঋণ শোধ করতে সেলিম ১৮ দিন মাকে পিঠে বয়ে শেষ পর্যন্ত নিরাপদ স্থানে আসতে সক্ষম হয়েছে। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট পৃথিবী দখল করেছিলেন, অন্য অর্থে বলা যায় জয় করেছিলেন। সিন্ধুতে মিয়াপুরুর কাছে বাধা পাওয়ার আগ পর্যন্ত অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিনা বাধায় পৃথিবীর অর্ধেক জয় করে ফেলেছিলেন। কিন্তু আমার চোখে আলেকজান্ডারের চাইতেও বড় বীর, বড় যোদ্ধা যে মাকে ১৮ দিন পিঠে বয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে এসেছে। একেই বলে মানবতা, একেই বলে প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা। কেউ শান্তিতে নোবেল পেলেই সে যে শান্তির পূজারি হবে, এটা বলা যায় না।
শত শত, হাজারে হাজার নির্যাতিত-নিরন্ন রোহিঙ্গা আমাদের সীমান্তে জীবনের আশায় কাতরাচ্ছে। আমাদের সীমান্তরক্ষীরা রাইফেল তাক করে আছে, সীমান্ত অতিক্রম করতে দিচ্ছে নাÑ এ দৃশ্য দেখে বুক ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। কত ছটফট করেছি, যেভাবে পেরেছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর চেষ্টা করেছি। অং সান সু চি মানুষ মেরে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে যে কলঙ্কের তিলক পড়ছে, রোহিঙ্গাদের আমাদের দেশে ঢুকতে না দিয়ে বিশ্বদরবারে আপনিও সেই একই অপরাধে অপরাধী হতে চলেছেন। তাই সময় থাকতে নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের জন্য দু’হাত প্রসারিত করুন। জানি না কীভাবে প্রধানমন্ত্রীর মানবতা জেগেছে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছেন। তা তিনি জানেন তার এই সিদ্ধান্ত শুধু তাকেই মহান করেনি, আমাদেরও করেছে। আমাদের স্বাধীনতার মর্মবাণীই হলো, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে নির্যাতিত মানুষের পাশে আমরা আমাদের সাধ্যমতো দাঁড়াব। ’৭২-এর ২৪ জানুয়ারি আমার হাত থেকে অস্ত্র নিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হবে সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়। বিশ্বের যে কোনো জায়গায় নির্যাতিত মানুষের পাশে আমরা আমাদের সাধ্যমতো দাঁড়াব।’ বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সেই ঘোষণা আজও আমার কানে বাজে।
জীবন অনেকটাই ওয়ানওয়ে ট্রাফিক। ফেলে আসা দিন ফিরে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বর্তমান বিশ্বরাজনীতিতে মিয়ানমার রোহিঙ্গা সমস্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। একে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এটাকে এক জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে সফলকাম করতে পারলে আপনি হবেন বিশ্বনন্দিত নেতা। ইতোমধ্যেই আপনাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া নিয়ে কথা উঠেছে। আরও উঠবে। কাজের মতো কাজ করলে বুকে সে সাহস থাকলে কারো মুখাপেক্ষী হতে হয় না। নিজের কাজের প্রতি ভরসা করেই এগোনো যায়। আমি লম্বা ধরনের মানুষ, সোজা বলাই পছন্দ করি। বহু মানুষ কেউ বোঝে, কেউ না বুঝেই নানা কথা বলে। এখন যত কিছুর অভাব থাকুক, আমাদের দেশে প-িতের কোনো অভাব নেই। তাই তারা যেভাবে পারেন, সেভাবেই বলেন। কোনো কিছু হলেই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা দেন। মুক্তিযুদ্ধটা যে কত ব্যাপক, কত বিশাল অনেকের ধারণা নেই। সে সময় একমাত্র ভারত আমাদের পাশে থাকলেও পৃথিবীর কোনো দেশ ছিল না। এমনকি রাশিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম দিকে তারাও আমাদের পক্ষে ছিল না। রাশিয়া বেশ কয়েক বছর থেকে ভারতের সঙ্গে একটা অনাক্রমণ চুক্তির চেষ্টা হচ্ছিল। যাতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন প্রখ্যাত কূটনীতিক কৃষ্ণা মেনন। কিন্তু কোনোমতেই চুক্তিটি হচ্ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় উভয় দেশের প্রয়োজনে সেই চুক্তিটি হয়। যেটা আমাদের কাজে লাগে। এখন তো না চাইতেই অনেকেই আমাদের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের পক্ষে কেউ ছিলেন না। শেষ পর্যন্তও অনেক সরকার আমাদের বিপক্ষে ছিল। কিন্তু আমাদের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক, কূটনৈতিক সাফল্যে পৃথিবীর প্রায় সব মানুষ আমাদের দাবির পক্ষে এসেছিল। তাই অত বড় একটা শক্তির বিরুদ্ধে আমরা জয়ী হতে সক্ষম হয়েছি। ভারত মিয়ানমারকে সমর্থন করেছে। কিন্তু কতটা কী করেছে? জ্বালাও-পোড়াও, নারীর সম্ভ্রমহানি, গণহত্যা নাকি অন্যকিছু? রাশিয়াকেও জিজ্ঞেস করা দরকার, তারা মিয়ানমারের পাশে আছে, হত্যাতেও কি তারা পাশে থাকবে? অন্ধকার ঘরে সাপ দেখে শঙ্কিত হওয়া আমাদের কাজ নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের গৌরব আবু সাঈদ চৌধুরী তার সাধ্যেরও বেশি কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী সর্বোদয় নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণকে বিশেষ দূত হিসেবে সারা পৃথিবী চষে বেড়াতে পাঠিয়েছিলেন। সে জন্য আপনার সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী কায়সারের কথা বলেছি। ধ্যান-জ্ঞানে সে কারো চাইতে কম না। শিক্ষাদীক্ষা যা প্রয়োজন সবই তার আছে। আর আপনার সঠিক নেতৃত্ব পেলে শুকনো কাঠেও প্রাণ আসতে পারে, সেটা মাঝেমধ্যে প্রমাণ করেছেন। তাই চিন্তা কিসের? তবে এক মুহূর্ত বসে থাকার সময় নেই। কূটনৈতিক তৎপরতা বড় মারাত্মক জিনিস। এটা চলমান প্রক্রিয়া। একে থামিয়ে দেওয়ার কোনো পথ নেই।
আপনি গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছেন। আপনার প্রস্তাব যথার্থ। ওই সব প্রস্তাব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া এবং সমর্থন আদায়ে দিকে দিকে দূত পাঠানো দরকার। শুনলাম ২ তারিখ পর্যন্ত আপনি দেশের বাইরে থাকবেন। কেন থাকবেন জানি না। নিশ্চয়ই আপনার কাজ আছে। কিন্তু তার চাইতে বড় কাজ আজ অথবা কালই আপনার দেশে ফেরা। দেশকে ইস্পাত-কঠিন ঐক্যবদ্ধ করুন। দেখবেন রোহিঙ্গা সমস্যা কোনো সমস্যাই নয়। বরং এর মধ্য দিয়ে বিশ্বদরবারে আমরা প্রকৃত অর্থেই একটা মহান জাতির স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হব। মিয়ানমার সম্পূর্ণ রাখাইন রাজ্য জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর আওতায় রোহিঙ্গাদের নিরাপদে বসবাসের আপনার প্রস্তাব সারা দুনিয়ার কাছে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য এখনই কাজে লেগে পড়–ন। নিপীড়িত বিশ্বমানবতার জয় সুনিশ্চিত।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম : রাজনৈতিক ও কলাম লেখক
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন