|
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
test@gmail.com |
|
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস
13 January 2017, Friday
এই লেখাটির শিরোনাম দেখে যে কেউ একটু অবাক হয়ে যাবে। কোনো কিছুকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হিসেবে দাবি করে ফেলাটা নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে, সেই দাবিটি যদি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নিয়ে করা হয় সেটাকে অবিশ্বাস করা হলে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নিয়ে আমার অভিজ্ঞতাটুকু লিখতে বসেছি।
কয়েকমাস আগে কুলিয়ার চরের ই্উ.এন.ও আমাকে ফোন করলেন, তার পরিচয় জেনে আমি যথেষ্ট মুগ্ধ হলাম, নাম ডক্টর উর্মি বিনতে সালাম, আমাদের দেশের ইউএনও’রা ডক্টরেট করছেন জেনে মুগ্ধ না হয়ে উপায় কী? ড. উর্মি ফোনে আমাকে যেটা বললেন সেটা শুনে আমি চমৎকৃত হলাম।
তিনি বললেন, স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসটি অস্ট্রেলিয়াতে অনুষ্ঠিত হয়েছে তিনি তার চাইতে বড় একটি ক্লাস করাতে চান! অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে তাদের সকল সাহায্য সহযোগিতা সুযোগ সুবিধা সহায় সম্পদ নিয়ে যে বিশ্ব রেকর্ডটি তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশের একটি উপজেলাতে সেটি ভাঙার পরিকল্পনা করতে বুকের পাটা লাগে। আমি তাঁর বুকের পাটা দেখে যথেষ্ট অবাক হলাম। তিনি আমর কাছে একটা সাহায্য চাইলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশটির আয়োজন করা হবে আমাকে সেটি নিতে হবে। আমি খুব আনন্দের সাথে রাজি হয়ে গেলাম- স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের সাথে কিছু একটা করার সুযোগ পাওয়া আমার জন্য বিশাল বড় একটা ব্যাপার।
আমি ড. উর্মির প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম সত্যি, কিন্তু তিনি আদৌ সেটা করতে পারবেন সেটা নিয়ে আমার ভেতর তখনো যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ব রেকর্ডটি ভাঙতে হলে একটা ক্লাশরুমে কমপক্ষে তিন হাজার দুইশত ছাত্রছাত্রীকে হাজির করতে হবে। তাদেরকে হাতে কলমে কোনো একটা এক্সপেরিমেন্ট করাতে হবে। এতো বড় ক্লাশরুম কোথাও নেই, তাই সেটা তৈরি করতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের বসার জন্য চেয়ার টেবিল জোগাড় করতে হবে। ছেলেমেয়েদের নিজ হাতে করার জন্য সমান সংখ্যক এক্সপেরিমেন্ট দাঁড় করাতে হবে। এর কোনোটিই খুব সহজ নয়।
সাহস থাকলেই বড় একটা পরিকল্পনা করে ফেলা যায় কিন্তু শুধু সাহস দিয়ে বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায় না। কাজেই আমি খানিকটা দুশ্চিন্তা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি, আমার মনে হতে থাকে কিছুদিনের ভেতরেই ড. উর্মির আরো একটা ফোন পাব যখন তিনি লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবেন যে তিনি শেষ পর্যন্ত ম্যানেজ করতে পারলেন না তাই এবারের মত পরিকল্পনাটি স্থগিত করা হলো্।
কিন্তু সেই টেলিফোন এলো না এবং আমি যখন খোঁজ নিলাম তখন জানতে পারলাম সত্যি সত্যি তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশটির আয়োজন করার কাজ করে যাচ্ছেন। আমি তখন ছেলেমেয়েদের উপযোগী পাঠ দাঁড় করালাম। ছোট বাচ্চাদের চুম্বক নিয়ে এক ধরনের কৌতুহল থাকে তাই আমি চুম্বক তৈরি করা তাদের বিপরীত মেরুতে আকর্ষণ সমমেরুতে বিকর্ষণ, ক্যাম্পাসে উত্তর দক্ষিণ হয়ে থাকা এই বিষয়গুলো নিয়ে কিছু এক্সপেরিমেন্ট দাঁড় করালাম, সেগুলো দাঁড় করানোর সময় লক্ষ্য রাখতে হল খুব অল্প খরচে সেগুলো যেন দাঁড় করানো যায়। কুলিয়ার চর অস্ট্রেলিয়া নয়, এদেশে কিছু একটা করতে হলেই প্রথমে আমাদের দেখতে হয় কতো কম টাকায় সেটা আয়োজন করা যায়!
জানুয়ারির ২ তারিখ কুলিয়ার চরে একটা সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হল। সাংবাদিক সম্মেলন নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা খুব ভালো না। হোটেল সোনারগাঁও বা শেরাটনে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হলে আমি সাংবাদিকদের উৎসাহ নিয়ে যেতে দেখেছি! ছোটখাটো জায়গায় সেরকম উৎসাহ দেখিনি।
আমি ড. উর্মিকে বলে রাখলাম কুলিয়ার চরের সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি যেন খুব বেশি সাংবাদিকদের আশা না করেন এবং সেই সংবাদটি পত্রপত্রিকায় ছাপা হবে সেটিও যেন আশা না করেন। এটি একটি আনুষ্ঠানিকতা এবং তিনি যে তার পরিকল্পনা মতো এগিয়ে যাচ্ছেন আর শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে আসতে পারবেন না তার একটা ঘোষণা ছাড়া কিছু নয়!
কাজেই সাংবাদিক সম্মেলন হয়ে গেল এবং আমি আমার সহকর্মী আর ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশের ছেলেমেয়েদের জন্যে এক্সপেরিমেন্টের একটা শিট তৈরি করার কাজ শুরু করে দিলাম। এসব ব্যাপারে আমি অসম্ভব ভাগ্যবান- কিছু করতে চাইলেই আমি আমার সহকর্মী এবং ছাত্রছা্ত্রীদের পেয়ে যাই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ধরনের সংগঠনের মাঝে “বিজ্ঞানের জন্য ভালোবাসা” নামেও একটা সংগঠন আছে তাদের সব সদস্য মিলে দিনরাত খেটে খুটে বিজ্ঞানের এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য শিটগুলো তৈরি করে ফেলল।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশের জন্যে নির্দিষ্ট দিনটি হচ্ছে জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখ, আমরা বাসবোঝাই ভলান্টিয়ার নিয়ে একদিন আগেই সেখানে পৌঁছে গেলাম। আমরা গিয়ে দেখি বিশাল আয়োজন, এতা বড় প্যান্ডেল আমি জীবনে দেখিনি, এক কোনায় দাঁড়ালে অন্য কোনা প্রায় দেখা যায় না! চারজন করে বসতে পারে সেরকম বেঞ্চ এবং টেবিল বসানো হয়েছে। একেক সারিতে ২৫টি করে বেঞ্চ এবং টেবিল, সারির সংখ্যা ৩২! আগামীকাল এখানে তিন হাজার দুইশত ছেলেমেয়ে এসে বসে আমার কাছে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশ করবে। চিন্তা করেই আমার মাথা ঘুরে যাবার অবস্থা!
আমাদের জন্য ডাক বাংলোয় রাত কাটানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরদিন ভোরে হঠাৎ শুনতে পেলাম পাশের রাস্তায় ছোট শিশুদের কলরব। বারান্দায় এসে দেখতে পেলাম রীতিমত উৎসবে যোগ দেয়ার আনন্দ নিয়ে কোনো একটা স্কুলের ছেলেমেয়েরা প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশ করতে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েগুলো দেখে আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম। আমি জানি পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা আসবে- কিন্তু তারা যে এতো ছোট সেটা আমি মোটেও অনুমান করিনি। এই ছোট ছোট বাচ্চারা কী প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশে বাস চুম্বক তৈরি করে সেটা দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে পারবে?
যাই হোক নির্দিষ্ট সময়ে আমি মাঠে হাজির হয়েছি প্যান্ডেলের চারপাশে দশটি গেট, এই দশটি গেট দিয়ে সারি বেঁধে ছেলেমেয়েরা ভেতরে ঢুকছে। তাদেরকে নিশ্চয়ই এই বিশাল দক্ষ যজ্ঞ নিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে, তার কারণ এতো কম বয়সী ছেলেমেয়েদের এতো কঠিন শৃঙ্খলা দিয়ে আমি এর আগে কোথাও ঢুকতে দেখিনি!
অনুষ্ঠান উদ্বোধন করার জন্যে ঢাকা থেকে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং এমপি নাজমুল হাসান পাপন হেলিকপ্টারে করে আসবেন। হেলিক্টারে তারা সময়মতো পৌঁছাতে পারবেন না বলে আমাদের নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাশ শুরু করে দিতে বললেন। অনেক ভোরেই ছেলেমেয়েরা চলে এসেছে, এটা পৌষ মাস কিন্তু পৌষের শীতের কোনো লক্ষণ নেই প্যান্ডেলের ভেতর গরমে সবাই ঘামছে। দুপুর বারোটা থেকে শুরু করে দেড় ঘণ্টায় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশ হবার কথা, কাজেই আমরা যদি দেরি করি তাহলে বাচ্চাদের কষ্ট দেবার একটা বিশ্ব রেকর্ড হয়ে যেতে পারে! তাই আমরা ক্লাশ শুরু করে দিলাম।
এটা যদি সত্যি সত্যি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশ হিসেবে প্রমাণ করা যায় তাহলে আমিও নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশের শিক্ষক হিসেবে নিজেকে দাবি করতে পারি! পৃথিবীর কতোজন মানুষের এরকম সৌভাগ্য হতে পারে?
আমি মনে মনে যেই বয়সী ছেলেমেয়ে আশা করেছিলাম এই প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশের ছেলেমেয়েরা তার থেকে অনেক ছোট। আমি খুব দুশ্চিন্তার মাঝে ছিলাম তারা সত্যি সত্যি আমার সাথে তাল মিলিয়ে এক্সপেরিমেন্টগুলো করতে পারবে কী না। কিন্তু শুরু করার পর আমি মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম তাদের জন্যে সেগুলো ডাল ভাত! লোহার পেরেকে তার প্যাঁচাতে গিয়ে আমি আধাআধি আসার আগেই তারা পুরোটুকু শেষ করে চুম্বক তৈরি করে এক্সপেরিমেন্ট করতে শুরু করেছে!
আমার বলতে দ্বিধা নেই তিন হাজার দুইশ কমবয়সী ছেলে মেয়েদের এই প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশ নেয়াটি ছিল আমার জীবনের একটি সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দের মুহূর্ত! শিশুরা সেই কাকডাকা ভোরে হাজির হয়েছে, গরমে সেদ্ধ হতে হতে তারা বসে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছে, আমি যখন যেটি বলছি তারা সেটি করছে এর চাইতে আনন্দময় দৃশ্য আর কী হতে পারে? এই বয়সী ছেলেমেয়েদের চুপ করে বসে থাকার কথা নয়, কিন্তু মজার ব্যাপার হল আমি যতবার তাদের চুপ করে যেতে বলেছি তারা ম্যাজিকের মতো নিশ্চুপ হয়ে গেছে! তিন হাজার দু’শ ছেলেমেয়ে এতোটুকু শব্দ না করে প্রয়োজনে পুরোপুরি নিঃশব্দে বসে আছে, মনে হচ্ছে নিঃশ্বাসের শব্দটুকুও আলাদাভাবে শোনা যাবে- আমার মনে হয়েছে সেটাও নিশ্চয়ই একটা বিশ্ব রেকর্ড হতে পারে!
যথা সময়ে ঢাকা থেকে অতিথিরা হেলিকপ্টারে কুলিয়ার চরের এই বিশাল দক্ষযজ্ঞে উপস্থিত হলেন। ছোট একটুখানি আলোচনা পর্ব হল। সবাই ছোট স্টেজে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন, শ্রোতারা যেহেতু ছোট ছেলেমেয়ে কাজেই তাদের উদ্দেশ্য করেই কথাবার্তা বলা হল এবং আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের একটা কথা আমার কানে মধু ঢেলে দিল! তিনি ছেলেমেয়েদের বললেন, কুলিয়ার চরের যে ২৮টি ভিন্ন ভিন্ন স্কুল থেকে এসেছে সেই ২৮টি স্কুলের প্রত্যেকটিতে একটি করে কম্পউটার ল্যাবটেরি তৈরি করে দেবেন!
গিনেস বুক অফ রেকর্ড তৈরি করার জন্যে অনেক চুলচেরা নিয়ম মানতে হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশের আয়োজন করার সময় প্রাণপণ চেষ্টা করা হয়েছে সেই নিয়মগুলো মানার। এখন তাদের কাছে আবেদন করা হবে এবং আগামী কয়েক সপ্তাহ পর আমরা বিশ্ব রেকর্ড তৈরি করতে পেরেছি কী না।
তবে আমার মনে হয় কুলিয়ার চরের ছেলেমেয়েরা বিশ্ব রেকর্ড তৈরি করার থেকেও বড় একটি রেকর্ড তৈরি করে ফেলেছে!
পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণীর ছোট ছোট শিশুরা সবাই তাদের নিজেদের স্কুলের জন্য একটা করে কম্পিউটার ল্যাবরেটরি উপহার দিয়েছে, পৃথিবীর কতোজন শিশু এতোবড় একটা অর্জন করতে পারে?
সবকিছু দেখে আমার মাঝে মাঝেই মনে হয়, আহা! বেঁচে থাকাটা কী আনন্দের!
মুহম্মদ জাফর ইকবাল : কথাসাহিত্যিক; অধ্যাপক, শাবিপ্রবি।
উৎসঃ পরিবর্তন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন