দীর্ঘ দিন ধরেই আবাসন–সংকট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ধরনের অস্থিরতার কারণ হচ্ছেদীর্ঘ দিন ধরেই আবাসন–সংকট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ধরনের অস্থিরতার কারণ হচ্ছে
অধ্যাপক শফিউল আলম ভূঁইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। স্মার্ট আলোচক হিসেবে টিভি টক-শোর দর্শকেরাও চেনেন তাঁকে। ১৪ মার্চ সকালের পত্রিকা খুলে দেখি, তিনি এক অসাধ্য সাধন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিজয় একাত্তর হলের প্রভোস্ট তিনি। এই হলে ছাত্রদের আসন বণ্টনের কাজটি করত তাঁর নেতৃত্বে হল প্রশাসন। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন এটি নিজেরাই কুক্ষিগত করার চেষ্টা করলে তিনি দৃঢ় হাতে তা প্রতিরোধ করেছেন আগের রাতে।
যাঁরা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানেন, তাঁদের বোঝার কথা কতটা সাহসিকতাপূর্ণ ও দায়িত্বশীল কাজ ছিল এটি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের প্রতাপ প্রদর্শনের অন্যতম জায়গা হচ্ছে ছাত্রদের থাকার হলগুলো। অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে আসন বরাদ্দ করার কথা হল প্রশাসনের। কিন্তু বেআইনিভাবে কাজটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে করে থাকেন ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। শুধু তা-ই নয়, যখন-তখন হল থেকে ছাত্রদের অমানবিকভাবে বের করে দেওয়া, হলে অছাত্রদের থাকতে দেওয়া, হলের ছাত্রদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধ্য করা, ক্লাস বা অসুস্থতার কারণে অংশ নিতে অসমর্থ হলে শাস্তি প্রদান করা, হলে নিজ নিজ গ্রুপের ছাত্রদের দিয়ে মারপিট করানোর অভিযোগও রয়েছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।
তবে এমন নয় যে এই অপরাধ শুধু ছাত্রলীগই করে থাকে। এর আগে একই ধরনের কাজ করেছে ক্ষমতাসীন বিএনপির ছাত্রসংগঠন হিসেবে ছাত্রদল। এরশাদ আমলেও অধিকাংশ হলে ছাত্রদল এবং জহুরুল হক হলের মতো দু-একটা হলে ছাত্রলীগ হলে আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে অন্যায় প্রভাব বিস্তার করত। ১৯৯০ সালের পর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলোর আমলে এসব ঘটনা ক্রমেই বাড়তে থাকে উদ্বেগজনকভাবে। বর্তমান সরকারের আমলে এসবের জের হিসেবে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে।
হলে আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে এই অরাজকতার আসল কারণ কী? কেন তা প্রতিরোধ করতে পারে না বা চায় না বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসন? এসব প্রশ্ন বিবেচনা করে দেখলে বোঝা যাবে, অধ্যাপক শফিউল আসলেই কতটা অসাধ্য সাধন করেছেন বিজয় একাত্তর হলে। বোঝা যাবে শফিউলের মতো উদাহরণ সৃষ্টি করা কেন জরুরি হয়ে পড়েছে অন্যদের জন্যও।
২.
হলে ক্ষমতাসীনদের ছাত্রসংগঠনগুলোর অন্যায় প্রভাব বিস্তারের মূল কারণ রাজনৈতিক। অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতাসংগ্রাম ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রতিটি সরকারের আমলে তার ছাত্রসংগঠনের কাজ হয়ে দাঁড়ায় লাঠিয়ালের মতো। দলের ছাত্রদের মূল দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় সরকারের ন্যায়-অন্যায় যেকোনো কাজ সমর্থন করা এবং বিরোধিতাকারীদের সশস্ত্রভাবে হলেও প্রতিরোধ করা।
এসব কাজ করলে ছাত্রাবস্থায় হলে সহজে আসন পাওয়া যায়, পরে সেখানে কর্তৃত্ব দেখানো যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণকাজে বখরাসহ বিভিন্নভাবে টাকা উপার্জন করা যায়, সরকারের কাছ থেকে অর্থ, চাকরি, ব্যবসাসহ বিভিন্ন সুবিধাও পাওয়া যায়। কোনো আদর্শ নয়, মূলত লোভ থেকেই বড় দুটি দলের ছাত্রসংগঠনগুলোর অনেক নেতা-কর্মী এসব কাজে লিপ্ত হয়ে ওঠেন।
ক্ষমতাসীন সরকারগুলো সহজবোধ্য কারণে তাদের ছাত্রসংগঠনের এসব কাজের পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। সরকারবিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (এবং কতকাংশে চট্টগ্রাম বা রাজশাহীর মতো বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো) অসীম সম্ভাবনা রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠলে সরকারের বিভিন্ন অন্যায় কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর পক্ষে বড় আন্দোলন গড়ে তোলা সহজসাধ্য হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্ট আন্দোলন থেকে অতীতে সরকার পতনের মতো ঘটনাও ঘটেছে।
এই ‘আশঙ্কা’ যেকোনো মূল্যে দমন করানোর জন্যই সরকারগুলো তাদের ছাত্রসংগঠনগুলোকে ব্যবহার করে থাকে। যে বড় মিছিল করতে পারবে, যে বেশি মারমুখী হতে পারবে, তাকে ছাত্রসংগঠনে তত বড় পদে বসানো হয়, বিভিন্ন অন্যায়ের দায় থেকে মুক্ত রাখা হয় এবং বিভিন্ন সুবিধার প্রলোভন তাদের সামনে রাখা হয়।
এই পরিস্থিতিতে ছাত্রাবাসগুলো হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের কর্মী নিয়োগের সবচেয়ে বড় জায়গা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩৬ হাজার ছাত্রছাত্রীর মধ্যে কমপক্ষে ২৪ হাজার আসেন ঢাকার বাইরে থেকে। অথচ আবাসিক সুবিধা দেওয়া যায় খুব বেশি হলে ৬ হাজার জনকে। বাকিদের উপায় কী? উপায় হচ্ছে, তাঁরা দিনে-রাতে সরকার আর ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের মিছিল করবেন, তাদের পক্ষে স্লোগান দেবেন, সরকারবিরোধীদের সমূলে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করবেন। বিনিময়ে তাঁরা দুজনের রুমে ঠাসাঠাসি করে হলেও ছয়জন মিলে থাকতে পারবেন, না হলে হলের বারান্দা, ছাদ বা মিলনায়তন/লাইব্রেরির ‘গণরুমে’ থাকার সুযোগ পাবেন।
অলিখিত নিয়ম হচ্ছে, বড়জোর হলের কোনো রুমের বৈধ দুজন ছাত্রকে আসন দেবে হল প্রশাসন, রুমপ্রতি বাকি ছয়জনকে হলে ওঠাবে ছাত্রলীগ, আগে হলে ছাত্রদল। এই ছয়জনকে তো মিছিলে আসতে হবেই, বৈধ দুজনও মিছিলে না এলে যেকোনো অজুহাতে কিল-ঘুষি খেয়ে বিদায় করা হবে হল থেকে।
প্রভোস্ট আর হল প্রশাসনের দায়িত্ব হচ্ছে এসব অন্যায়ের প্রতিকার করা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রভোস্ট পদে নিয়োগ পান ক্ষমতাসীন সরকারের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সমর্থকেরা। তিনি সরকার–সমর্থক হয়ে সরকারের ছাত্রসংগঠনের মিছিলের লোক কমানোর কাজ কীভাবে ঠেকাবেন? এই কাজে তিনি কীভাবে সরকারের অনুগত বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য, প্রক্টর বা পুলিশের সাহায্য পাবেন? এত ঝামেলা করে তিনি নিজের চাকরি, প্রভোস্টের বিশাল বাংলো, নানা ধরনের সুবিধা হারানোর ঝুঁকি কেন নেবেন? তিনি কোনো ঝামেলায় না গেলে তাঁর অধীনের হাউস টিউটররা এই ঝুঁকি কীভাবে নেবেন?
৩.
এমন এক পরিস্থিতিতে অধ্যাপক শফিউল কীভাবে বিজয় একাত্তরে হলের আসন বণ্টন নিজের হাতে রাখতে পারলেন? তিনি সিটে অবৈধভাবে অতিরিক্ত ছাত্রদের ঢুকিয়ে দেওয়াও ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। ঠেকাতে পারেননি গণরুমে ছাত্রলীগের নেতাদের দ্বারা কিছু ছাত্রকে থাকতে দেওয়ার ব্যবস্থাকে। এই নেতারাই তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্লোগান দিয়েছেন ১৪ মার্চ রাতে, তাঁর কার্যালয়ের জানালা ভাঙচুর করেছেন, হলের হাউস টিউটরদের গালমন্দ করেছেন। তিনি তবু মধ্যরাতে হলে ছুটে গেছেন দায়িত্ব পালন করতে, তিনি সাহস করে গেছেন বলে তাঁর সঙ্গে যেতে পেরেছেন হাউস টিউটররাও।
শফিউল নিজেও বর্তমান সরকারের প্রকাশ্য সমর্থক, বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার-সমর্থক নীল দলের একজন নেতা। কিন্তু তাই বলে তিনি নিজের দায়িত্ববোধ বিসর্জন দেননি। তবে শফিউল এ ক্ষেত্রে যে বাড়তি সুবিধা পেয়েছেন, তা হলো তিনি একটি নতুন হলের প্রভোস্ট, আগের প্রভোস্টদের সৃষ্ট কোনো অরাজকতার ভার তাঁকে বহন করতে হয়নি।
পুরোনো হলের প্রভোস্টদের জন্য এই কাজ কঠিন, কিন্তু অসম্ভব কি? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একবুক স্বপ্ন নিয়ে শিক্ষার্থীরা আসেন মুক্ত মানুষ হতে, মুক্ত মননশীলতা চর্চা করতে। হলে থাকতে দেওয়ার বিনিময়ে দাস বানানো হয় তাঁদের। পড়াশোনা শিকেয় তুলে অপরাজনীতির দাসবৃত্তিতে বাধ্য করা হয় তাঁদের।
হল প্রশাসনে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষকেরা। কোন নৈতিকতায় তাঁরা দিনের পর দিন মেনে নেন এসব?
৪.
আমি বিশ্বাস করি, এখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব আরও বেশি। দীর্ঘ দিনের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু প্রস্তাবও দিচ্ছি।
এক. হলে আসন বণ্টন করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হোক প্রথম বর্ষের ছাত্রদের। সিনিয়র ছাত্রদের মতো তাঁরা নতুন শহরকে চিনতে বা কোনোভাবে কিছু উপার্জন করতে শেখেন না, পরিচিতমহলও তাঁদের অনেক ছোট থাকে। তাই আবাসন–সংকট না কমা পর্যন্ত অন্যদের বাদ দিয়ে নতুন ভর্তি ছাত্রদের শতভাগ আসন ছাত্রাবাসে নিশ্চিত করার নীতি গ্রহণ করে তা ক্রমান্বয়ে কার্যকর করা হোক।
দুই. হলের প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষকদের পদে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হোক, যাঁরা সেখানে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও বহুবিধ দায়িত্ব পালন করা শিক্ষকদের পক্ষে এটি সম্ভব হয় না অনেক ক্ষেত্রে।
তিন. হলের প্রতিটি রুমের আসনসংখ্যা বৈধভাবে দ্বিগুণ করা হোক। যেমন দুজনের রুমকে চারজনের (যেখানে ইতিমধ্যে থাকছেন অন্তত ছয়জন), চারজনের রুমকে আটজনের বলে ঘোষণা করা হোক।
চার. হলের ভেতর যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হোক। হলে ছাত্রদের ডেটাবেইস তৈরি করা হোক, ছাত্রনেতাদের সঙ্গে নিয়মিত উদ্বুদ্ধমূলক বৈঠক বাড়ানো হোক, হলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে বাড়ানো হোক। নতুন নতুন হল নির্মাণ করা হোক।
এগুলো কবে হবে বা আদৌ হবে কি না তার জন্য বসে থাকলে চলবে না। হলের প্রভোস্টরা অন্তত নিয়মিতভাবে যথেষ্ট সময় হলে দিতে পারেন, গণরুমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারেন, বৈধ-অবৈধ সব ছাত্রের ডেটাবেইস তৈরি করতে পারেন, লাইব্রেরি রুমে পড়ার পরিবেশ সুষ্ঠু করতে পারেন। অবৈধদের ওঠানো বন্ধ না হোক, অন্তত বৈধদের বহিষ্কার ঠেকাতে পারেন।
চাইলে অনেক কিছুই করা যায়। বিজয় একাত্তরের প্রভোস্ট এর আরও একটি উজ্জ্বল প্রমাণ!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন