|
আসিফ নজরুল
abman1971@gmail.com |
|
তিস্তা চুক্তি: আলোচনার গলদ
08 April 2017, Saturday
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন যে তিস্তা নদীতে পানি নেই! আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের ঠিক আগে তিনি এ দাবিটি করেছেন। তাঁর দাবি সঠিক হলে তার অর্থ খুব খারাপ বাংলাদেশের জন্য। কারণ, পানিই যদি না থাকে তিস্তায়, তাহলে তা বাংলাদেশের সঙ্গে ভাগাভাগির চুক্তি হবে কীভাবে?
আমরা জানি, নদী বা এর অংশবিশেষ শুকিয়ে যেতে পারে বিভিন্ন কারণে। নদী শুকিয়ে যেতে পারে ভয়াবহ খরার কারণে বা বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে (যেমন বৃষ্টিপাত কমে গিয়ে)। নদী শুকিয়ে যেতে পারে অবিবেচক রাষ্ট্রের কারণেও। বিশেষ করে জলবিদ্যুৎ ও সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ পানি নদী থেকে সরিয়ে ফেললে নদীর ভাটির অংশ মৃতপ্রায় হতে পারে শুষ্ক মৌসুমে। পৃথিবীতে বহু নদীর ভাগ্যে তাই ঘটছে। আমেরিকাভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাটমসফিয়ারিক রিসার্চের প্রতিবেদন অনুসারে পৃথিবীর ৯২৫টি নদীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশের পানি কমে গেছে ইতিমধ্যে। হ্রাস পাওয়া নদীপ্রবাহের মধ্যে রয়েছে ২১৪টি আন্তর্জাতিক নদীর অনেকগুলোই।
প্রশ্ন হচ্ছে, তিস্তা নদীর ক্ষেত্রে কী হয়েছে? তিস্তা কি আসলেই শুষ্ক নদী হয়ে গেছে ইতিমধ্যে? তিস্তার বা ভারতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত অন্য ৫৩টি নদীর পানি কমে গেলে এটা দেখতে হবে যে এর কারণ কী? এর দায়দায়িত্ব কার? কেন এর কুফল ভোগ করতে হবে ভাটির দেশ বাংলাদেশকে?
২.
তিস্তা নদীর উৎপত্তি হিমালয়ের সিকিম অংশে, তারপর এটি সিকিম দিয়ে দীর্ঘ পথ প্রবাহিত হয়েছে এবং সিকিম থেকে পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় প্রবেশ করেছে। পরে পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রবেশ করেছে।
ভারতের সিকিমে তিস্তা নদীতে রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য ড্যামের নেটওয়ার্ক। তিস্তা ও তার ট্রিব্যুটারি নদী রাঙ্গিতের ওপর বিভিন্ন প্রকল্পের কারণে অ্যাফেকটেড সিটিজেন অব সিকিম এবং সিকিম-ভুটিয়া লেপচা অ্যাপেক্স কমিটি নামে বিভিন্ন আন্দোলনও রয়েছে সিকিমের সাধারণ মানুষের মধ্যে। এরপরও সিকিমে নতুন নতুন প্রকল্পের কোনো শেষ নেই। গত বছর শুরু হয়েছে ৯ হাজার কোটি রুপির বিশালাকৃতির তিস্তা জলবিদ্যুৎ (হাইড্রোইলেকট্রিসিটি) প্রকল্পের কাজ। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং-কালিম্পং অঞ্চলে রয়েছে তিস্তা লো-ড্যাম নামে বিভিন্ন জলবিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্প। এসব প্রকল্পের মূল সম্পদই হচ্ছে তিস্তার খরস্রোতা পানি।
কাজেই মমতার দাবি অনুসারে তিস্তায় পানি নেই, এটি আসলে ঠিক নয়। পানি নেই কেবল তিস্তার বাংলাদেশ অঞ্চলে, সামান্য পানি আছে সীমানার কাছে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায়। পানি নেই বলতে মমতা তাই এই এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানিস্বল্পতার কথা বুঝিয়েছেন, বুঝিয়েছেন এই স্বল্প পানি বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে ভাগাভাগি করার মতো নয়।
৩.
মমতার এই বক্তব্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় গঙ্গা চুক্তির কথাও। গঙ্গা নদীর কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ ভারতের উত্তর প্রদেশ ও বিহারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। এই দুটো রাজ্যে শতাধিক সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে গঙ্গার পানির অধিকাংশ প্রত্যাহার করে নেয় ভারত। অবশিষ্ট পানি ফারাক্কায় এলে তা সমানভাগে ভাগ করে নেয় ভারত (আসলে পশ্চিমবঙ্গ) ও বাংলাদেশ।
গঙ্গার উচ্চ অববাহিকায় পানি প্রত্যাহার কত বেশি, তা আমরা ধারণা করতে পারি ভারত-বাংলাদেশের বিভিন্ন চুক্তি থেকে। ১৯৭৭ সালের গঙ্গা চুক্তিতে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশকে কমপক্ষে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। ১৯৮২ সালেই তা পরিবর্তন করে শুকনো মৌসুমে নজিরবিহীন কম প্রবাহ হলে তা ভাগাভাগির ফর্মুলা বের করা হয়। ১৯৯৬ সালের চুক্তিতেও এমন বিধান রয়েছে। নজিরবিহীন কম পানি কত কম হতে পারে, তার উদাহরণ দেখা যায় ১৯৯৭ সালেই। সেবার শুকনো মৌসুমে কখনো কখনো এমনকি ১০ হাজার কিউসেক পানি পর্যন্ত পেতে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। পরে এই পরিমাণ মাঝেমধ্যে ৩ হাজারের নিচে পর্যন্ত নেমে আসে।
১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তির কোথাও উত্তর প্রদেশ বা বিহারে অবাধে পানি প্রত্যাহার বন্ধের বাধ্যবাধকতা নেই, এসব অঞ্চলে কী পরিমাণ পানি নদীপথ থেকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে, তা জানার অধিকার পর্যন্ত বাংলাদেশের নেই। গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি হলেও তা হয়েছে আসলে ভারতের একটি প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কা পয়েন্টে প্রাপ্ত গঙ্গার অবশিষ্ট পানি ভাগাভাগির চুক্তি।
তিস্তার ক্ষেত্রে আলোচনাও একই ফর্মুলায় হচ্ছে। চুক্তি হলেও তা হবে সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গের উচ্চ অববাহিকা থেকে প্রত্যাহারের পর গজলডোবায় প্রাপ্ত অবশিষ্ট পানি ভাগাভাগির। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, এই অবশিষ্ট পানি ভাগাভাগির মিনতিই বাংলাদেশ জানিয়ে যাচ্ছে কয়েক দশক ধরে। বাংলাদেশ থেকে বহু কিছু পাওয়ার পরও এটুকু দেওয়ার চুক্তি ভারত করছে না পশ্চিমবঙ্গের আপত্তির কথা বলে।
৪.
তিস্তা নদী নিয়ে স্বাধীনতার আগে থেকে আলোচনা শুরু হলেও ১৯৮৩ সালে প্রথম একটি সমঝোতা হয়। এই সমঝোতা অনুসারে তিস্তার পানির (পড়ুন অবশিষ্ট পানির) ৩৯ শতাংশ ভারত ও ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশের পাওয়ার কথা ছিল। বাকি ২৫ শতাংশের কতটুকু বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত তিস্তার গতিপথকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন, তা নিয়ে আরও আলোচনার কথা ছিল। এ আলোচনা কখনো আর সুসম্পন্ন হয়নি।
১৯৮৬ সালে দুই দেশের জয়েন্ট কমিটি অব এক্সপার্টের সভায় বাংলাদেশ নদীর পানি ভাগাভাগির একটি সার্বিক রূপরেখা দেয়। এতে বাংলাদেশ ব্রহ্মপুত্র নদের ৭৫ শতাংশ, তিস্তাসহ আটটি বড় নদীর (পদ্মা ও মেঘনা বাদে) পানির ৫০ শতাংশ দাবি করে। পরে বাংলাদেশ নির্দিষ্টভাবে ২০ শতাংশ পানি তিস্তার নাব্যতার জন্য রেখে দিয়ে বাকি ৮০ শতাংশ সমান ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দেয়। ভারত এটি মেনে নেয়নি। ভারতের কোনো কোনো মহল থেকে বরং পশ্চিমবঙ্গের অধিক পরিমাণ কৃষিজমি ইতিমধ্যে সেচসুবিধা ব্যবহার করছে এই যুক্তিতে তিস্তার সিংহভাগ পানি দাবি করা হয়।
অথচ আন্তর্জাতিক আইনের ন্যায়পরায়ণতার নীতি অনুসারে অববাহিকার দেশগুলোকে বর্তমানের সঙ্গে সঙ্গে অভীষ্ট ব্যবহারের হিসাবও বিবেচনায় নিতে হয়। বাংলাদেশের যে পরিমাণ জমিকে সেচসুবিধা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়েছিল, তা অবশ্যই তিস্তা চুক্তি সম্পাদনে বিবেচনায় নেওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে তিস্তার অবশিষ্ট পানির ৫০ শতাংশ পেলেও তা বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট না-ও হতে পারে। কারণ, সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উচ্চ অববাহিকায় ভারত অবাধে পানি সরিয়ে নেওয়ার পর গজলডোবার অবশিষ্ট পানির ৫০ শতাংশ মানে ৩ হাজার কিউসেক হতে পারে, আবার ৩০০ কিউসেকও হতে পারে!
আন্তর্জাতিক নদী নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের আলোচনার প্যাটার্নই হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি। ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসা ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীরই একদম নিম্নাংশে রয়েছে বাংলাদেশ। অধিকাংশ নদীরই উচ্চ অববাহিকায় বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে বিপুল পরিমাণ পানি নদীর মূল গতিপথ থেকে সরিয়ে নিচ্ছে ভারত। সীমানা এলাকার কাছে অবশিষ্ট পানি ভাগাভাগির জন্য দেনদরবার করতে থাকে বাংলাদেশ। ভারত তাতে একবার মাত্র (গঙ্গা) রাজি হয়েছে, তিস্তার ক্ষেত্রে হয়তো হতে পারে অদূর ভবিষ্যতে। বাকি নদীগুলোর বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট আলোচনাই হচ্ছে না এখন আর।
তিস্তা চুক্তি হয়ে গেলে তা নিয়ে আমাদের অতিরিক্ত আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। কারণ নেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে অসম বাণিজ্য, অসম কানেকটিভিটি, অসম অর্থনৈতিক লেনদেন বা সীমান্তে বাংলাদেশের মানুষকে হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গগুলো ভুলে থাকার।
৫.
নদীর পানির ক্ষেত্রে অবশ্য আশাব্যঞ্জক একটি ঘটনা ঘটেছিল ২০১১ সালে। সেই বছরই একটি ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তিতে ভারত-বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের কথা বলেছে। ভারত ও বাংলাদেশের দুই দেশের মানুষেরই নদীর পানির প্রয়োজন রয়েছে। এই প্রয়োজন সুষমভাবে মেটাতে হলে অববাহিকাভিত্তিক কাঠামোয় বর্ষা মৌসুমের পানি পরিবেশসম্মতভাবে ধরে রেখে শুষ্ক মৌসুমে তা ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য নেপাল-ভুটানকে সঙ্গে নিতে হবে। ব্রহ্মপুত্রের মতো নদ হলে চীনকেও আলোচনায় রাখতে হবে।
অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে কয়েক দশক পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। সেই সময় পর্যন্ত আমাদের সব অভিন্ন নদীর পানির ভাগাভাগির ওপর জোর দিতে হবে, শুধু তিস্তার নয়। বলতে হবে পুরো নদী নিয়ে আলোচনা ও তথ্য বিনিময়ের কথা। সেটি ভারত মানতে রাজি না হলে ১৯৭৭ সালের চুক্তির মতো শুষ্ক মৌসুমে একটি ন্যূনতম পরিমাণ পানির গ্যারান্টি চাইতে হবে।
এসব না করে যেনতেন একটা তিস্তা চুক্তি হয়ে গেলে তাতে আপ্লুত হয়ে পড়লে, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কে ভারসাম্য দূরের কথা, নদীর পানির ন্যায্য অংশই কোনো দিন পাব না আমরা।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন