বনানীর ধর্ষণের ঘটনার পর শুল্ক গোয়েন্দারা আপন জুয়েলার্সে অভিযান চালিয়েছেন, আগে কেন তা হয়নি?বনানীর ধর্ষণের ঘটনার পর শুল্ক গোয়েন্দারা আপন জুয়েলার্সে অভিযান চালিয়েছেন, আগে কেন তা হয়নি?
আমার মেয়ের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। সে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। তার ইতিহাস বইয়ে সক্রেটিসের ওপর একটি নিবন্ধ রয়েছে। সক্রেটিসকে কেন হেমলক পান করিয়ে হত্যা করা হলো, এটি পড়ে সে ছুটে আসে আমার কাছে। সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ ছিল, সে তরুণ সমাজকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে। আমার কন্যা এটাই জানতে চায় যে প্রশ্ন করতে শেখানো অপরাধ কেন? প্রশ্ন করাই–বা অপরাধ ছিল কেন গ্রিসে?
আমার কন্যা জানে না প্রশ্ন করা এখনো অপরাধ বহু দেশে। বিশেষ করে, বাংলাদেশের মতো দেশে। প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে হয়। ভুল উত্তর হলে তা থেকে আরও প্রশ্নের জন্ম নেয়। উত্তর একেবারে পাওয়া না গেলেও প্রশ্ন মানুষকে সচেতন করে, চিন্তা করতে শেখায়। প্রশ্নই মানুষকে বিদ্রোহী করতে আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শেখায়। জবাবদিহি আর স্বচ্ছতা নামের সুশাসনের যে স্তম্ভগুলো আছে, তার ভিত্তিই হচ্ছে প্রশ্ন করার স্বাধীনতা।
আমাদের এই সমাজের ক্ষমতাসীনেরা তাই প্রশ্নকে ঘৃণা করেন, প্রশ্নকারীকে দমন করেন। এই কাজে তাঁরা সফল যে হননি তা বলা যাবে না। সংসদ, সংবাদ সম্মেলন, আদালত—সব জায়গাতেই আমরা এর প্রতিফলন দেখি। প্রতিফলন দেখি এমনকি নাগরিক সমাজেও।
প্রশ্নহীন এমন সমাজেই বনানীর ধর্ষকদের মতো বেসামাল বিত্তের দম্ভে বিকৃত মানসিকতার যুবক আর সহযোগীদের জন্ম হয়, সরকারি ব্যাংকের টাকা লুটপাটের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা নিরাপদে থাকেন, মামলা হলে নিরাপদে বিদেশে চলে যেতে পারেন, লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হতে পারে। প্রশ্নহীন সমাজেই একঝিনাইদহে তিন দিনে নিখোঁজ হতে পারেন ৯ জন ব্যক্তি। এর আগে এ রকম নিখোঁজ হওয়া কাউকে কাউকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহত হওয়ার পর ‘জঙ্গি’ বলেই জানানো হয়েছে।
প্রশ্নহীনতার এই সব উদাহরণ শুধু গতকালের প্রথম আলোর প্রথম পাতা থেকে নেওয়া। আসল চিত্র নিশ্চয়ই আরও ভয়াবহ। কিন্তু প্রশ্ন কি আসলেই আমরা করতে পারি না কখনো? পারি হয়তো কিছু ক্ষেত্রে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশ্নই তোলা যায় না বা যাঁদের তোলার দায়িত্ব, তাঁরা তোলেন না। প্রশ্ন না তোলাই যখন প্রবণতা হয়ে দাঁড়ায়, তখন বিচ্ছিন্নভাবে যাঁরা প্রশ্ন তোলেন, তাঁরা জবাবটা আর আদায় করতে পারেন না। বরং প্রশ্ন করার কারণেই অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্ত হন অপ্রাসঙ্গিক, অন্যায় ও অসত্যভাবে।
২.
অনাচার, অবিচার, অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার মূল দায়িত্ব সংসদের। জনগণের টাকায় প্রতিষ্ঠিত এটি রাষ্ট্রের অন্যতম ব্যয়বহুল প্রতিষ্ঠান। এর অন্যতম দায়িত্বই হচ্ছে সরকারের কাছ থেকে জবাব আদায় করা। অথচ বাংলাদেশে সংসদ বহু আগে থেকেই অনেকাংশে স্তাবকদের জায়গায় পরিণত হয়েছে। আগে বিরোধী দল বলে কিছু একটা থাকত বলে ঢালাও সমালোচনার পাশাপাশি সংসদের ফ্লোরে এবং বিশেষ করে কমিটিগুলোতে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করা হতো, সরকারকে এর জবাব দিতে হতো। এখন সংসদে বিরোধী দল বলতে আসলে কিছু নেই বলে সেই সামান্য চর্চাও আর নেই। গুম, ক্রসফায়ার, ভারতের সঙ্গে অসম চুক্তি নিয়ে সংসদে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় না, কেউ প্রশ্ন তোলেন না সড়ক নির্মাণের দুর্নীতি, ব্যাংকের টাকা লোপাট বা প্রশ্নপত্র ফাঁসের দুর্নীতি নিয়েও।
প্রশ্ন তোলার আরেকটি আদি প্রতিষ্ঠান আদালত। প্রশ্ন তোলা থেকে আদালতকে বিরত রাখার জন্য ঢালাও মামলা প্রত্যাহার করা হয় কিংবা পুলিশ কর্তৃক মামলা গ্রহণই না করার প্রবণতা সৃষ্টি করা হয়। উচ্চ আদালত প্রশ্ন তোলার পরিবর্তে কখনো কখনো প্রশ্ন তোলার সুযোগই রুদ্ধ করা হয়েছে, এমন নজিরও ছিল কিছুদিন আগে (যেমন সাগর-রুনি এবং রামপাল-সম্পর্কিত মামলা)। বর্তমান প্রধান বিচারপতি আসার পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু আদালতের স্বাধীন সত্তা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে গিয়ে তিনি নিজেই হয়েছেন ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার শিকার।
প্রশ্নহীন এক সমাজ গড়ার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে এ দেশের নাগরিক সমাজ বারবার রুখে দাঁড়িয়েছে। এখন তাদের অধিকাংশ ম্রিয়মাণ নানান হিসাব-নিকাশ বা ভীতি থেকে। ফুলবাড়ীর বিরুদ্ধে আমরা তাই যে বিশাল নাগরিক সমাজকে সোচ্চার হতে দেখি, আরও ভয়াবহ রামপালের বিরুদ্ধে তাদের অধিকাংশকে অনুপস্থিত দেখি। ইয়াসমিন হত্যার বিরুদ্ধে আমরা যেভাবে নাগরিকদের সোচ্চার হতে দেখি, একইভাবে তুলনীয় তনু হত্যার বিরুদ্ধে আমরা সেই আন্দোলন আর দেখি না। বিসিএসে প্রশ্ন ফাঁস হলে আমরা যাঁদের তুলকালাম করতে দেখতাম, আজ তাঁদেরই কেউ কেউ প্রশ্নপত্র ফাঁসকে আমলেই নেন না। আগে যেসব রাজনীতিককে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করা যেত সংবাদ সম্মেলনে, এখন তাঁদের সংবাদ সম্মেলন পরিণত হয়েছে অনেকাংশে স্তাবকতা চর্চায়। নানামুখী চাপের কারণে আগের মতো উত্তাপ নেই এখন অন্য শিবিরের সংবাদমাধ্যমগুলোতেও।
প্রশ্নহীন এই সমাজে একমাত্র নতুন আশার আলো হয়ে দাঁড়িয়েছে সামাজিক গণমাধ্যম। এরও ক্ষমতা ও সম্ভাবনাকে সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা চলছে নানা আইন, দমন–পীড়নব্যবস্থার মাধ্যমে এবং হুমকির পরিবেশ সৃষ্টি করে।
৩.
প্রশ্নহীন এই পরিবেশ সমাজে কী ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে, তার কিছুটা নজির আমরা বনানীর ধর্ষণের ঘটনার মধ্য দিয়ে পেয়েছি। ধর্ষণের এই অভিযোগ সারা দেশে তুলকালাম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ামাত্র আমরা সরকারের কিছু প্রতিষ্ঠানকে তৎপর হয়ে উঠতে দেখেছি। র্যাব-পুলিশ অপরাধীদের গ্রেপ্তারের কাজ করেছে, শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ একজন ধর্ষকের বাবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালাচ্ছে, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বিশেষায়িত কমিশনও তৎপর হয়েছে।
মনে হতে পারে, সবই তো ঠিক আছে, সবাই তো প্রশ্ন তুলতে পেরেছে, সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো তো ঠিকমতো কাজ করছে। কিন্তু গভীরতর বিশ্লেষণে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা দায়িত্বহীনতা ও জবাবদিহিহীনতার বহু উদাহরণ পাব।
বনানীর ধর্ষণের ঘটনার পর শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের ভূমিকা দিয়েই শুরু করি। জননিন্দিত একজন ধর্ষকের বাবার স্বর্ণের দোকান আপন জুয়েলার্সে অভিযান চালিয়ে এরা সবার চোখে পড়েছে। তারা এ–ও বলছে যে সারা দেশে আপন জুয়েলার্সের মতো বহু সোনার দোকান থাকা সত্ত্বেও বৈধভাবে সোনা আমদানি করে না কেউ।
তাদের এই বক্তব্যের একটাই মানে হতে পারে—তা হচ্ছে, স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের স্বর্ণের উৎস সম্পর্কে সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও এত দিন এ নিয়ে আসলে কোনো প্রশ্ন তোলেনি তারা। একজন অভিযুক্ত ধর্ষকের বাবা স্বর্ণ ব্যবসায়ী না হলে, এ নিয়ে মিডিয়ায় তোলপাড় না হলে, এখনো তুলত না সম্ভবত।
শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ বনানীর ঘটনার পর অভিযান চালাচ্ছে শুধু আপন জুয়েলার্সে। প্রশ্ন উঠেছে, কেন দেশি-বিদেশি অন্য স্বর্ণের দোকানগুলোতেও নয়? এ দেশের আইনে কি তাহলে লেখা আছে যে শুধু ধর্ষকের বাবার বৈধ কাগজপত্র থাকতে হবে সোনা মজুতের? লেখা কি আছে যে কারও সন্তান ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পরই কেবল তার বাবার ব্যবসার সততার খোঁজ নেওয়া হবে?
বনানীর ধর্ষকদের অস্ত্র বহন আর হোটেলে মদ্যপান নিয়েও নানা অভিযান আর তদন্ত চলছে। কিন্তু এই ধর্ষণের খবর ফলাও হওয়ার আগে এসব অভিযান আর তদন্ত হয়নি কেন? আমাদের কোনো আইনে লেখা নেই যে শুধু ধর্ষকদেরই অস্ত্র বহন ও ব্যবহার করার ক্ষেত্রে আইনের বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। এ দেশের আইনে এটিও লেখা নেই যে শুধু ধর্ষণ হয়েছে এমন হোটেলের মদ বিক্রির লাইসেন্স থাকতে হবে। আইন সবার জন্য। অবৈধ সোনা, অবৈধ মদ, ট্যাক্স বা শুল্ক ফাঁকির বিরুদ্ধে অভিযান তাহলে কেন হচ্ছে না সব সোনার দোকান আর হোটেলের বিরুদ্ধে। রুটিন প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব হিসেবে কেন পালন করা হয়নি এত দিন?
এসব প্রশ্ন আমরা কেউ কেউ তুলেছি বটে। কিন্তু আসলে এসব প্রশ্ন তোলার কথা সরকারের আরও বড় কর্তাদের। সেখানে অধীন প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি নিয়ে প্রশ্ন না থাকলে কোনো লাভ হয় না। আমরা সরকারের কোনো মহলকে এসব প্রশ্ন তুলতে দেখিনি এখনো। দেখব কি না, সন্দেহ। বনানীর ধর্ষণের ঘটনার তদন্ত ও মামলা এখন পর্যন্ত যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা শাস্তি পাবেন বলে আশা করতে পারি। কিন্তু শীর্ষ পর্যায় থেকে এসব প্রশ্ন না তোলা হলে বাকিরা থাকবে বহাল তবিয়তে।
৪.
গতকালের সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে সরকারি ব্যাংকের টাকা লোপাটের সংবাদও। সরকারি ব্যাংকগুলোতে থাকা জনগণের টাকা লোপাট নিয়ে সংবাদপত্রে বহু প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। তারপরও এসবের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কোনো বিচার হয়নি। যেসব ক্ষেত্রে মামলা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বিদেশে চলে গেছেন নিরাপদে। বেসিক ব্যাংকের বিপর্যয়ের মূল হোতার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন স্বয়ং অর্থমন্ত্রীও। তারপর তাঁর বিচার হয়নি, তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করার দায়িত্ব অনুভব করেনি এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনও। আমরা এখন পত্রিকায় পড়ি সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে এক লাখ কোটি টাকা! ভাবা যায় এটা!
এসব আর্থিক অনিয়ম কিংবা গুম-খুনের মতো ভয়াবহ অপরাধ এবং রামপালের মতো সর্বনাশা প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠেছে বিচ্ছিন্ন ও দুর্বলভাবে। এ দেশের রাজনীতিবিদেরা এসবের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে সোচ্চার হতে পারেননি। নাগরিক সমাজ জোরালো কণ্ঠে অব্যাহত ও ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ করতে পারেনি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো জবাবদিহি নিশ্চিত করার দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। ফলে সমাজে এখনো যাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন বিচ্ছিন্নভাবে দুর্বল কণ্ঠে, ক্ষমতাসীনেরা তা অবজ্ঞা করতে পারছেন অনায়াসে।
বনানীর ধর্ষণের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদটা জোরালোভাবে হয়েছে। ফলে এর দায়দায়িত্বের প্রশ্নটি এখন পর্যন্ত এড়ানো যায়নি।
কিন্তু আমরা কি কিছু শিখেছি এখান থেকে? বুঝতে পেরেছি যে প্রতিবাদটা এভাবেই করতে হবে সব অনাচারের বিরুদ্ধে? প্রশ্ন তুলতে হবে সবাইকে?
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন