কক্সবাজার সফরকালে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর
বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার কক্সবাজার সফর রাজনীতিতে নতুন উত্তাপ এনেছে। বহুদিন হলো বিএনপিকে কোনো সভা-সমাবেশ করতে দেয় না সরকার। দেশের অন্যতম প্রধান এই দলের তৎপরতা মূলত সীমাবদ্ধ ছিল বিভিন্ন সেমিনার, গোলটেবিল আর টক শোতে। এমন একটা পরিস্থিতিতে বিএনপি কয়েক মাস আগে নতুন সদস্য সংগ্রহের কর্মসূচি নিলে তা নির্জীব দলটির মধ্যে কিছুটা প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক দক্ষতা ও শক্তিমত্তা প্রদর্শনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হচ্ছে জনসমাগম। সেটি সেভাবে দেখানোর সুযোগ পায়নি দলটি, ঝুঁকি নিয়ে তা দেখানোর তেমন চেষ্টাও করেনি তারা।
খালেদা জিয়ার সড়কপথে কক্সবাজার সফরের কর্মসূচি তাই কিছুটা হলেও ছিল দলটির জনসমর্থন প্রদর্শনের একটি কৌশল। কক্সবাজার যেতে হলে তিনি বিমানে যেতে পারতেন। কিন্তু তাতে বোঝা যেত না তাঁকে নিয়ে এখনো মানুষের সমর্থনের মাত্রাটি। অন্যদিকে তিনি সড়কপথে গেলে রাস্তায় রাস্তায় মানুষের ঢল নামবে, এটা ছিল প্রায় অবধারিত (যেকোনো সময় আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এমন সফরে গেলে একই ঘটনা ঘটবে)। কাজেই জেনেশুনে সরকার এটা করতে দেবে কি না, তা নিয়ে মানুষের আগ্রহ ছিল, ছিল উৎকণ্ঠাও।
খালেদা জিয়ার সফর অবশেষে সম্পন্ন হয়েছে। এই সফরকালে কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে। মানুষ যেন রাস্তায় এসে বিএনপি নেত্রীর প্রতি সমর্থন না জানাতে পারে, তার চেষ্টা কিছু এলাকায় হয়েছে। ফেনীতে বিএনপি নেত্রীর গাড়িবহরে দুই দফায় আক্রমণের মতো নিন্দনীয় ঘটনাও ঘটেছে। এই ঘটনার দায় বিএনপির ওপর চাপানোর কাঁচা চেষ্টাও করেছে সরকারের কেউ কেউ। তবে শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার সফর অনেকাংশে নিরাপদই হয়েছে।
এই সফরে বিএনপির অর্জন আছে। সরকারও শেষ পর্যন্ত এটি করতে দিয়ে রাজনীতিতে কিছু স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছে। এ নিয়ে নানা ধরনের কথাবার্তা হয়েছে। তবে আমার বিবেচনায় এই সফরের ঘটনাপরম্পরায় সবচেয়ে মূল্যবান কথাটি বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগ নেত্রীর সফরকালে চট্টগ্রামে তাঁকে ভিআইপি রুম না দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন। বলেছেন, এরপরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদার এবারের সফরকালে তাঁকে ভিআইপি রুম ব্যবহার করতে দিতে বলেছেন, বলেছেন, তিনি নিজেও বিএনপি নেত্রীকে চকরিয়ায় সড়ক বিভাগের রেস্টহাউস ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। এই তুলনা টেনে তিনি অমূল্য সেই আপ্তবাক্যটি বহুবচনে আওড়িয়েছেন: ‘তারা অধম হলে আমরা উত্তম হব না কেন?’
আমি ঠিক নিশ্চিত নই ওবায়দুল কাদের এই দর্শন সত্যি মনে ধারণ করেন কি না। সত্যিই আওয়ামী লীগ এই মনোভাব এখন পোষণ করছে কি না। তবু আমি নিশ্চিত, এত ভালো কথা বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে বলেনি কেউ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দর্শন হয়ে গেছে: তুমি অধম, আমি তাই তার চেয়েও অধম। ইটটি মারলে পাটকেল নয়, এ দেশে মারা হয় লোহার বাড়ি।
একদল ক্ষমতায় এলে তাই আগের দলকে আরও বেশি করে শ্বাসরুদ্ধ করে রাখে, দমন-পীড়ন চালায়, কথা বলার অধিকার হরণ করে। একদল অন্যদলের নেতাকে নিয়ে কটু কথা বললে অন্যদল আরও কটু কথা বলে, আরও নিষ্ঠুর প্রচারণা চালায়। একদল নির্বাচনে কারচুপি করলে আরেক দল ক্ষমতায় এসে আরও বেশি কারচুপি করে।
অধম হওয়ার প্রতিযোগিতা চলে দুই বড় দলের মধ্যে দেশশাসনের ক্ষেত্রেও। এককথায় আমরা এটাকে বলি কুশাসনের প্রতিযোগিতা। একদল ক্রসফায়ার করলে আরেক দল ক্ষমতায় এসে গুম শুরু করে, একদল উচ্চ আদালতে ২০ জন পছন্দের লোক নিয়োগ দিলে অন্যদল ক্ষমতায় এসে ৪০ জন পছন্দের লোক নিয়োগ দেয়, একজন শতকোটি টাকার দুর্নীতি করলে অন্যদল ক্ষমতায় এসে হাজার কোটির দুর্নীতি শুরু করে, একদল কোনো দেশকে তোষণ করার নীতি নিলে অন্যদল আরেক দেশকে দশ গুণ তোষণ করার ভূমিকা নেয়। দিন যায়, ক্ষমতাবদল হয়, বাড়ে শুধু বৈষম্য, অবিচার আর দুর্নীতি। অধম হওয়ার প্রতিযোগিতায় কমে মানুষের স্বস্তি, সম্মান, আশাবাদ। কমে সরকারের জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, সততা।
তাই এ রকম সময়ে ওবায়দুল কাদের যখন উত্তম হওয়ার কথা বলেন, অবশ্যই তা শ্রুতিমধুর লাগে।বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়, সত্যি একটা উত্তম হওয়ার তাড়না আসবে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। সুশাসনের একটা প্রতিযোগিতা হবে এদের গঠিত সরকারগুলোর মধ্যে।
উন্নত গণতান্ত্রিক বিশ্বে তা-ই হয়। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করে আরও সুশাসন ও জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকার দিয়ে। সরকারে থাকা দল আরেকটি নির্বাচনে জেতার চেষ্টা করে আগের আমলের তুলনায় শ্রেয়তর শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, মানুষের অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে আরও বেশি দায়িত্বশীল হয়ে।
ব্যতিক্রম সেখানে নেই, তা নয়। চটকদার রাজনৈতিক স্লোগান, উৎপাদন ও উন্নয়নবিচ্ছিন্ন কর্মসূচি, মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টিকারী ইস্যু ব্যবহার করে জনগণের বৃহত্তর অংশের মনোরঞ্জন করে ক্ষমতার লড়াইয়ে জেতার চেষ্টা সেখানে কখনো কখনো হয়েছে। লোকরঞ্জনবাদের হঠাৎ প্রকোপ আমরা বর্তমান সময়েও কিছু দেশে এখনো দেখছি। কিন্তু তারপর এখনো তা ব্যতিক্রম কিছু। এখনো ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, জাপান, জার্মানিসহ উন্নত বিশ্বে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয় আরও উন্নত, ইনক্লুসিভ এবং জনকল্যাণমুখী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ দলগুলো। খারাপ উদাহরণের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ক্ষমতায় আসার জন্য আরও বেশি লোকরঞ্জনবাদী হয়ে ওঠেনি বিরোধী দল, ক্ষমতায় থাকা দলের কুশাসনের প্রতিবাদ করছে ক্ষমতাসীন দলেরই বহু মানুষ।
আমরা সে তুলনায় কত খারাপ অবস্থায় আছি, তা বোঝানোর জন্য নানা উদাহরণ ও তথ্য হাজির করা যায়। আমি আইনের জগতের লোক। শুধু এখানেই ১৯৯০ সালের পর থেকে একের পর এক আরও অধোমুখী হওয়ার বহু নজির দেখানো যায়। সংবিধান পরিবর্তন, নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন, আইনের শাসনের অধোগতি, বিভিন্ন বাহিনীর আইনবহির্ভূত কার্যক্রম প্রতিটি আমলে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। ১৯৯১ সালের বিএনপি সরকারের চেয়ে ১৯৯৬ সালের আওয়ামী সরকার খারাপ ছিল। সেই আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে ২০০১ সালের বিএনপি সরকার আরও খারাপ ছিল।আর এখনকার আওয়ামী লীগ সরকার অনেকের মতে, তার চেয়েও খারাপ সরকার।আবার অনেকেই বিশ্বাস করেন, ২০১৮ সালে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি সরকার হবে এই আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়েও খারাপ।
এই বিষাক্ত বৃত্ত ভাঙার চেষ্টা বা তাড়না নেই কারোর। এমনকি নেই ন্যূনতম আত্মসমালোচনাও। একদল ক্রসফায়ার নিয়ে প্রশ্ন তুললে অন্যদলটি তারা ক্ষমতায় থাকার সময় কী করেছিল, শুধু তা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এক সরকারকে কালোটাকা, বিদেশে অর্থ পাচার আর ঋণখেলাপির কথা বললে তারা অন্য আমলের তুলনা টানে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কুক্ষিগত করা, তেল-গ্যাস-পানিসম্পদ অন্যের হাতে তুলে দেওয়া, নিজেদের মামলা প্রত্যাহার করে অন্য দলের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা প্রদান, স্বজনপ্রীতি, আঞ্চলিকতা, জঙ্গির প্রকোপ, নেত্রীবন্দনা, জনদুর্ভোগ—যেকোনো প্রসঙ্গে একদলের আঙুল থাকে অন্যদলের দিকে। নিজের দিকে তাকানোর কোনো চিন্তা নেই কারও মধ্যে। যত দোষ তা প্রতিপক্ষের। নিজের দোষ, সে-ও প্রতিপক্ষের অতীত কার্যকলাপের কারণে। কুশাসনের প্রতিযোগিতা এবং আরও খারাপ ও নির্মম হওয়ার প্রতিশোধস্পৃহা—এটাই নিয়ম এ দেশে। কিছু ব্যতিক্রম আছে কালেভদ্রে। কিন্তু তা খুবই অপ্রতুল, খুবই কদাচিৎ।
তিনবারের নির্বাচিত সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রীকে সার্কিট হাউস বা রেস্টহাউস ব্যবহার করতে দিয়ে তাই তা বড়গলায় বলেছেন ওবায়দুল কাদের। এই দেশটা এমন হয়ে গেছে, অতীতে এতবার সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের তাঁদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে যে এটা এখন বড়গলায় বলার মতোই কথা।
তবু ভালো যে ওবায়দুল কাদের এটা করতে গিয়ে অধমের সঙ্গে উত্তম হওয়ার কথা বলেছেন। অন্যকে অধম ভাবলে অসুবিধা নেই। যদি এর পেছনে থাকে তার চেয়ে উত্তম হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি। শুধু কথার কথা নয়, এই দৃষ্টিভঙ্গির সত্যিকারের বাস্তবায়নের প্রত্যাশা করে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ।
আওয়ামী লীগ সরকারে আছে। উত্তম হওয়ার সুযোগ তাই তার বেশি বিএনপির তুলনায়। আওয়ামী লীগ সত্যি উত্তম হলে বাধ্য হয়ে হলেও বিএনপিকেও উত্তম হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সেই চেষ্টা বিএনপি আগে শুরু করলেই বা অসুবিধা কী!
প্রতিযোগিতা হোক ভালো কাজের, ভালো আচরণের, ভালো দৃষ্টিভঙ্গির। দেশ সত্যিকার অর্থে এগোতে পারে শুধু এভাবেই।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন