রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের উদ্যোগে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানগত বৃহস্পতিবার রাত তিনটায় যখন জয়পুরহাট রেলস্টেশনে নামি, তখন চারদিকে সুনসান নীরবতা। স্টেশন থেকে সদর সড়কের বৈশাখী হোটেলের দূরত্ব কয়েক শ গজ। শেষ রাতে রিকশা বা অন্য কোনো বাহন মিলবে না বলে হেঁটেই সেখানে পৌঁছাই। সহযাত্রী অভয় দিয়ে বললেন, ‘ভয় নেই। জয়পুরহাটে ছিনতাই-ডাকাতি নেই। আছে রাজনৈতিক মাস্তানি। কিন্তু মাস্তানেরা তো এত রাতে জেগে নেই।’
বুঝলাম, মাস্তানদেরও আহার-নিদ্রা আছে। জয়পুরহাটে এটি আমার তৃতীয় যাত্রা। প্রথমবার গিয়েছিলাম আশির দশকে বন্ধু কথাশিল্পী নকিব ফিরোজের সঙ্গে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার দেখতে। বৌদ্ধবিহারটি নওগাঁ জেলায় হলেও জয়পুরহাটের কাছে। কয়েক বছর আগে দ্বিতীয়বার যাই প্রথম আলোর একটি কর্মসূচিতে। এবার স্থানীয় সাংবাদিকদের কর্মশালা উপলক্ষে সেখানে যাওয়া। আগেরবারের মতো এবারও সারাক্ষণের সঙ্গী ছিলেন প্রথম আলোর জয়পুরহাট প্রতিনিধি আসাদুল ইসলাম।
ঢাকার বাইরে গেলে যেমন হয়, একসঙ্গে রথ দেখা ও কলা বেচার কাজটি সারা। কর্মশালার ফাঁকে সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে জানতে চাইলাম, কেমন চলছে জয়পুরহাটের রাজনীতি? তাঁরা বললেন, ২০১৫-এর অবরোধের পর এখানে আর রাজনৈতিক হানাহানি নেই। আওয়ামী লীগ মাঠে ও বিএনপি ঘরে রুটিন কর্মসূচি পালন করে। তবে দুই দলই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বেহাল।
দুপুরে কর্মশালা শেষে আসাদুলকে নিয়ে স্থানীয় নেতাদের সন্ধানে বের হলাম সাংবাদিকেরা বানিয়ে কিছু বলছেন কিনা পরখ করতে। কথা হলো স্থানীয় সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুল আলম, সাধারণ সম্পাদক এস এস সোলায়মান, বিএনপির জেলা সভাপতি ও সাবেক সাংসদ মোজাহার আলী প্রধান, আইনজীবী মোমিন আহমেদ চৌধুরী, কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক আবদুর রশীদসহ বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে।
আওয়ামী লীগের নেতারা বললেন, আগামী নির্বাচনে বিএনপি সমস্যা নয়। সমস্যা হলো দলের বিভাজন। একজন বললেন, দলে ভেজাল ঢুকে গেছে। কীভাবে ভেজাল ঢুকেছে? তিনি জানান, বিএনপি ও জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। বিএনপি নেতারাও জানালেন, বিএনপির ‘শক্ত ঘাঁটি’ জয়পুরহাটে আওয়ামী লীগ সমস্যা নয়, সমস্যা হলো নিজেদের মধ্যকার বিরোধ।
অন্যান্য স্থানে যেমন দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকে, দুজনই নিজস্ব ক্ষমতাবলয় গড়ে তোলেন, জয়পুরহাটে তেমন নয়। এখানে দুই দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অবস্থান হলো ‘মিলেমিশে করি কাজ, হারিজিতি নাহি লাজ।’ কিন্তু তাঁদের মিলেমিশে কাজটি করতে দেয় না বিরোধী গ্রুপ। আলাপ প্রসঙ্গে বিএনপির সভাপতি মোজাহার আলী বললেন, দলে হঠাৎ আসা নেতারা ঝামেলা করছেন। নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত প্রয়াত আবদুল আলীমের ছেলে ফয়সাল আলীম। তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছেন। তাই জেলা কমিটিকে পাত্তা দিচ্ছেন না। জেলা বিএনপির দ্বন্দ্ব নিয়ে অফিসে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে এবং এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। বিএনপির এক নেতার দাবি, ফয়সাল আলীম বিএনপি করলেও সরকারি দলের কর্মীদের নিয়ে ঘোরেন।
দুই দলেরই জেলা কমিটির বিরোধ ছড়িয়েছে উপজেলা ও তৃণমূল পর্যন্ত। বিএনপি কোনো উপজেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেনি। আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে কাজ চালাচ্ছে।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের জোয়ারের সময়ও জেলার দুটি আসন পায় বিএনপি। মোজাহারের মতে, মনোনয়ন ভুল না হলে জয়পুরহাটের দুটি আসনই বিএনপি পাবে। তাদের প্রধান ভরসা জামায়াতে ইসলামী, সদর আসনে যাদের ৪০ থেকে ৫০ হাজার ভোট আছে। আর আওয়ামী লীগের ভরসা সংখ্যালঘু ও বামদের ভোট। বামদের সঙ্গে কোনো সমঝোতা হবে কি না, জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, বামদের এমন শক্তি নেই যে ভোটের ফলাফল পাল্টে দেবে। এর জবাবে বাম নেতা বললেন, বিপদে পড়লে আওয়ামী লীগ তাদের কাছে ধরনা দেয়। বিপদ উতরে গেলে মনে রাখে না।
স্থানীয় সাংবাদিকেরা জানান, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব বেশ পুরোনো। জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিজেদের মতো চলেন। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনে তাদের কোনো প্রভাব নেই। সেখানে আবু সাঈদের একক কর্তৃত্ব। তাঁর সমর্থকদের অভিযোগ, জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তাঁর বিরুদ্ধে কেন্দ্রে নালিশ করেছেন, যাতে তিনি দ্বিতীয়বার সাংগঠনিক সম্পাদক না হন। আবু সাঈদের সঙ্গে আছেন পৌর মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান, সহসভাপতি আহমেদ চৌধুরী ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অারিফুর রহমান এবং ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বৃহৎ অংশ। আবু সাঈদ জয়পুরহাট-২ আসনের সাংসদ এবং শামসুল আলম জয়পুরহাট–১ আসনের।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে উপজেলা নির্বাচনে পঁাচটির মধ্যে চারটিতে আওয়ামী লীগ হেবেছে। জিতেছে কালাইয়ে। জয়পুরহাট সদর, আক্কেলপুর ও ক্ষেতলালে বিএনপি এবং পাঁচবিবিতে জামায়াত জয়ী হয়েছে। পাঁচটি পৌরসভা আওয়ামী লীগের দখলে থাকলেও নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ আছে। আওয়ামী লীগের এক নেতা বললেন, গত পঁাচ বছরে জয়পুরহাটে যে উন্নয়ন হয়েছে, ৪০ বছরেও তা হয়নি। কী উন্নয়ন হয়েছে? তিনি বললেন, রাস্তাঘাট, স্টেডিয়াম, যুব উন্নয়ন কমপ্লেক্স ও মৎস্য ভবন হয়েছে। বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয়েছে। দরিদ্র কৃষকেরা কম সুদে ঋণ পাচ্ছেন। তবে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতিরও প্রসার ঘটেছে, মন্তব্য সাংবাদিক বন্ধুদের। তাঁদের মতে, ২০১৩-১৪ সালে সরকারের বিরুদ্ধে সহিংসতা করেছে জামায়াত-শিবির। আবার সেই দলের একাধিক নেতাকে ফুলের মালা দিয়ে আওয়ামী লীগে নিয়ে আসা হয়েছে।
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ করলে তাঁরা মাদক, বেকারত্বকেই জেলার প্রধান সমস্যা বলে অভিহিত করেন। সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় চোরাচালানও রমরমা। জয়পুরহাটবাসীর আরেকটি আক্ষেপ আছে। জয়পুরহাটে চুনাপাথর আছে, সরকারের পক্ষ থেকে এ রকম ঘোষণা দেওয়া হলে তাঁরা আশা করছিলেন, চুনাপাথর জেলাকে আরও সমৃদ্ধ করবে, সেখানে সিমেন্ট কারখানা হবে। কিন্তু প্রকল্পটি পরিত্যক্ত হওয়ায় তাঁরা হতাশ। জয়পুরহাটে প্রচুর আলু ও সবজি উৎপাদিত হলেও কোনো কৃষিভিত্তিক কারখানা নেই। এখানে প্রতিষ্ঠিত পোলট্রি শিল্প গোটা উত্তরাঞ্চলের চাহিদা মেটায়।
আগামী নির্বাচন কেমন হবে? প্রশ্নের উত্তরে আওয়ামী লীগের নেতারা শেখ হাসিনার দোহাই দিয়ে বলেছেন, নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে না। কিন্তু বিএনপির নেতারা মোটেই আশ্বস্ত হতে পারছেন না। তাঁরা মনে করেন, আওয়ামী লীগ ইউপি ও পৌরসভা নির্বাচনের মতো সবকিছু দখলে নেবে।
নির্বাচন কেমন হবে? একই প্রশ্ন রাখি মধ্যবয়সের এক রিকশাচালকের কাছে। তিনি প্রশ্নের উত্তরে স্থানীয় ভাষায় বললেন, ‘আগে যেমকা ভোট হয়েছে, এবারেও তেমকা হবে।’ ঢাকায় ফেরার পথে তঁার কথাটি কানে বাজতে থাকে। কিন্তু আগে যেমন ভোট হয়েছে, তেমন ভোট তো কেউ চায় না।
২.
জয়পুরহাট একদা পরিচিত ছিল রাজাকার আবদুল আলীম ও আব্বাস আলী খানের জেলা হিসেবে। এই জেলার রাজাকার বদনাম ঘোচাতে সংগীতগুরু কলিম শরাফী ও ওয়াহিদুল হক ২০০৩ সালে যে পঁাচটি জেলায় সাংস্কৃতিক সম্মেলন করেছিলেন, তার মধ্যে জয়পুরহাটও ছিল। এরপর রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের উদ্যোগে ২০০৮ সালে বিশাল সম্মেলন হয় স্টেডিয়ামে। গত বছর জয়পুরহাটের তেঘর হাইস্কুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউট ও স্থানীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের যৌথ উদ্যোগে চারুকলা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল, যাতে ষষ্ঠ থেকে থেকে দশম শ্রেণির আড়াই শ ছাত্রছাত্রী যোগ দেয়। পরে তাদের ছবি দিয়ে ঢাকায় জয়নুল আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনীও হয়।
জয়পুরহাটের সংস্কৃতিচর্চার হালচাল জানতে দেখা করি জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সহসভাপতি আমিনুল হক ওরফে বাবুলের সঙ্গে। তিনি দীর্ঘদিন সংবাদ-এ সাংবাদিকতা করতেন। সেই সূত্রে আমার সহকর্মীও। তাঁর হাত ধরে জয়পুরহাটে অনেকে সাংবাদিকতায় এলেও তিনি আর এখন পেশায় নেই। সার্বক্ষণিক সংস্কৃতিচর্চা করছেন। স্কুলে স্কুলে ঘুরে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের শুদ্ধ সুরের জাতীয় সংগীত গাওয়ার তালিম দিচ্ছেন। স্ত্রী ফেরদৌস আরা চাকরি করেন বলে সেটি সম্ভব হয়েছে।
আমিনুল হক জানালেন, জেলার আদিবাসী গ্রাম নন্দাইলে তাঁরা আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়া ১৯৩৩ সালে হিলিতে ডাক লুটের নায়ক আবদুল কাদের চৌধুরীর ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। প্রশাসনের সহায়তায় জাতীয় সংগীত গাওয়ার জন্য স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সংস্কৃতিসেবীদের দাবি, প্রতিটি স্কুলে অন্তত দুজন সংগীতের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে, যাঁরা জাতীয় সংগীত গাওয়ানোর পাশাপাশি সংগীত, আবৃত্তি, নাট্যকলা, চিত্রকলা ইত্যাদি শিক্ষা দেবেন।
আমিনুল হক জাতীয় সংগীত শিশুশিক্ষার্থীদের কণ্ঠে শুদ্ধ সুরে ধ্বনিত হোক শিরোনামে একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করেছেন। যার বিক্রয়কৃত অর্থ দিয়ে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ জয়পুরহাট শাখা কার্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
তাঁর আহ্বান, ‘নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, নিকটবর্তী বধ্যভূমি ও গণকবর পরিদর্শনের ভেতর দিয়ে কোমলমতি
শিশু-কিশোর ছাত্রছাত্রীদের মনে শৈশবকাল থেকেই বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি দেশাত্মবোধ, অসাম্প্রদায়িকতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জন্ম নেবে এবং চিরদিনের অনির্বাণ শিখা হয়ে জ্বলবে।’
আমিনুল হকের এই উদ্যোগে আরও আছেন মহুয়া মঞ্জুরী, মনিকা মিত্র, উৎপল চৌধুরী, শাহনেওয়াজ চৌধুরী, মোস্তাহেদ ফারুক চৌধুরী প্রমুখ।
আলো দিয়ে আলো জ্বালানোর এই মহতী উদ্যোগে আপনিও শরিক হোন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন