বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ দলিলে সই করছেন জেনারেল নিয়াজি (ডানে)
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পর ২০ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টো দেশটির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। সেনাবাহিনীর পরাজয় ও আত্মসমর্পণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানজুড়ে জনগণের মধ্যে যে ক্ষোভ দেখা দেয়, তা প্রশমনের জন্য তিনি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করেন। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি হামিদুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশনের অপর দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি আনোয়ারুল হক ও বিচারপতি তোয়ায়েল আবদুর রহমান। ভুট্টোর উদ্দেশ্য ছিল সব দায় ইয়াহিয়া খান ও সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর চাপানো।
হামুদুর রহমান কমিশন প্রথম পর্বে সাবেক, বহাল সামরিক কর্মকর্তাসহ ২১৩ জনের জবানবন্দি নেয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া, জুলফিকার আলী ভুট্টো, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধান। দ্বিতীয় পর্বে ভারতে যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক সেনা কর্মকর্তাসহ ৭২ জনের জবানবন্দি নেওয়া হয় দেশে ফিরে যাওয়ার পর, যাঁদের মধ্যে জেনারেল নিয়াজি, রাও ফরমান আলীও ছিলেন। যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় ও আত্মসমর্পণের কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি কমিশন সেনা কর্মকর্তাদের নৈতিক ও চারিত্রিক দুর্বলতাগুলোও তুলে ধরেছে এবং একটি আধুনিক পেশাদারি বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে কিছু সুপারিশ করেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কমিশন মাত্র ১২ কপি রিপোর্ট তৈরি করেছিল, যার একটি দেওয়া হয় জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে। তিনি এই রিপোর্ট কখনো প্রকাশ করেননি। বরং নিজের কাছে একটি কপি রেখে বাকিগুলো ধ্বংস করে দিয়েছেন। ভুট্টো ভেবেছেন, রিপোর্ট প্রকাশিত হলে সেনাবাহিনী নৈতিকভাবে আরও ভেঙে পড়তে পারে এবং অসম্মানিত হতে পারে। এ ছাড়া রিপোর্ট প্রকাশ না করার আরেকটি কারণ হলো কমিশন মৃদুস্বরে হলেও তাঁর সমালোচনা করেছে। ১৯৭৫ সালে ভুট্টো প্রধান বিচারপতিকে জানান, রিপোর্টটি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে হয় হারিয়ে গেছে অথবা কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে, কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এরপর প্রধান বিচারপতি সেনাপ্রধান জিয়াউল হককে প্রকাশ করতে বললে তিনিও একই জবাব দেন।
২০০০ সালে এই মর্মে খবর প্রকাশিত হয় যে হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু তখনো সেটি অবমুক্ত করা বা প্রকাশিত হয়নি। ২০০০ সালের আগস্টে ইন্ডিয়া টুডেতে রিপোর্টের কিছু অংশ প্রকাশিত হওয়ার পরপরই পাকিস্তানেরও একটি সাময়িকীতে ছাপা হয়; সেটি ছিল সম্পূরক রিপোর্ট। পাকিস্তান সরকার স্পর্শকাতর কতিপয় অংশ বাদ দিয়ে মূল রিপোর্ট প্রকাশ করে ২০০০ সালের ডিসেম্বরে।
ইন্টারনেট সূত্রে আমাদের কাছে রিপোর্টের যে ইংরেজি কপিটি এসেছে, তাতেও বেশ কিছু জায়গায় ‘সংযুক্ত নয়’ লেখা আছে। সেই অংশগুলো বাদ দিয়ে মোটামুটি পুরো রিপোর্টটিই পাওয়া গেছে। রিপোর্টে মোট ৬০টি অধ্যায় আছে। শব্দসংখ্যা তিন লাখ। এতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতার চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে।
সত্য যে আড়াল করা যায় না, হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টই তার প্রমাণ। কমিশন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল উপাদান—গণহত্যা, গণধর্ষণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের বিষয়টি অগ্রাহ্য করেছে। তারা নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধকে ডিসেম্বরে সংঘটিত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের দিকে নিয়ে গেছে এবং সবকিছুতে ভারতের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। এসব অপূর্ণতা সত্ত্বেও হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টে এমন কিছু তথ্য পাওয়া গেছে, যাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি চারিত্রিক দুর্বলতাগুলো তথ্য-প্রমাণসহ উপস্থাপিত হয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী অভিযানের শুরু থেকে বাংলাদেশে পোড়ামাটি নীতি নেয়; যেখানে তারা মানুষ চায়নি, মাটি চেয়েছে। এই কথাটি শুধু রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতে লেখা ছিল না, ছিল পাকিস্তানের অধিকাংশ সেনা কর্মকর্তার অন্তরে। তারা বেসামরিক মানুষকে হত্যা থেকে শুরু করে নারী ধর্ষণ, অর্থ লুট, অর্থ আত্মসাৎ, বাড়িঘর পোড়ানোসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা করেনি।
হামুদুর রহমান কমিশন গণহত্যার বিষয়টি আমলে না নিলেও সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য হিসেবে সেনা কর্মকর্তাদের নৈতিক স্খলন, চারিত্রিক দুর্বলতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তা ও সাক্ষীদের বক্তব্য নিয়েছে। কমিশন সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করে তিন ধরনের অভিমত দিয়েছে। প্রথমত, জেনারেল নিয়াজি, মোহাম্মদ জামশেদ, এম রহিম খান, জি এম বারিক সিদ্দিকী, মোহাম্মদ হায়াত প্রমুখের বিরুদ্ধে সামরিক আইনে বিচারের সুপারিশ। বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে এস এ আনসারি, মঞ্জুর আহমেদ, আবদুল কাদির খানসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে।
কমিশন বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তাকে দায়ী করলেও বেশির ভাগকে দায়মুক্তি দিয়েছে। তাদের কাছে দায়মুক্তি পেয়েছেন বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত রাও ফরমান আলীও। যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা স্পষ্টত দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন। যাঁরা ভুট্টোর পক্ষে ছিলেন, তাঁদের মৃদু তিরস্কার করেই কমিশন ছেড়ে দিয়েছে। আর যাঁরা ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁদের আগেই সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
জেনারেল নিয়াজি হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টকে প্রহসন হিসেবে উল্লেখ করে আরেকটি কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছিলেন। তাঁর মতে, জুলফিকার আলী ভুট্টোর এই কমিশন গঠনের এখতিয়ার নেই। কেননা, তিনি নিজেই পাকিস্তানের অখণ্ডতা ধ্বংস ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য দায়ী।
একাত্তরে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংসতার খবর বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রচারিত হলেও পাকিস্তানের কোনো কর্তৃপক্ষ এখনো পর্যন্ত স্বীকার করেনি। হামুদুর রহমান কমিশনও অনেক বিষয়ে সায় দিয়েছে। তা সত্ত্বেও রিপোর্টে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতা, কাপুরুষতা ও চৌর্যবৃত্তির যে চিত্র তথ্য–প্রমাণ, সাক্ষ্যসহ রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে তাঁদের বিচার করার জন্য যথেষ্ট। একটি প্রশিক্ষিত বাহিনীর সদস্যরা যেভাবে নিজ দেশের মানুষের ওপর হত্যা ও নৃশংসতা চালিয়েছে, তার নজির খুব বেশি নেই। জেনারেল নিয়াজি লিখেছেন, তাঁর কাছে মনে হয়েছে, তিনি শত্রুদেশে এসেছেন। আসলে পাকিস্তানিরা কখনো এই ভূখণ্ডকে তাদের দেশ মনে করেনি।
নিয়াজির আগে খাদিম হুসেন রাজা ছিলেন ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডিং অফিসার। তিনি আ স্ট্রেনজার ইন মাই ওউন কান্ট্রি পাকিস্তান ১৯৬৯-১৯৭১ বইয়ে উত্তরসূরির বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন, যাতে নিয়াজি বলেছিলেন, ‘এই হারামজাদা জাতি জানে না আমি কে? আমি তাদের জাত বদলে দেব।’ তিনি বাঙালিকে বোঝাতে পারেননি, বাঙালিই প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণ করিয়ে তাঁকে ঠিকই বুঝিয়ে দিয়েছে। কীভাবে যুদ্ধ মোকাবিলা করতে হবে, সে সম্পর্কে খাদিম হুসেন নিয়াজিকে বোঝাতে চেষ্টা করলে তিনি জবাব দেন, ‘বন্ধু, এসব নিয়ে শঙ্কিত হয়ো না, আমি পরিস্থিতি সামাল দেব। এখন তুমি আমাকে তোমার বাঙালি বান্ধবীদের টেলিফোন নম্বরগুলো দাও।’ নিয়াজি তাঁর অধীন সেনাদের বাঙালি নারীদের ধর্ষণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যা শুনে একজন তরুণ বাঙালি সেনা কর্মকর্তা আত্মহত্যা করেছিলেন।
কমিশনের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, নিয়াজি শুধু বাংলাদেশেই গণহত্যা চালাননি; শিয়ালকোট ও লাহোরে জিওসি থাকাকালেও তিনি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন এবং সাইদা বুখারি নামের এক নারীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক করেন, যিনি লাহোরে সিনোরিটা হোম নামের একটি পতিতালয় চালাতেন। এ ছাড়া নিয়াজি পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পান চোরাচালান করতেন বলেও কমিশনের কাছে অনেক কনিষ্ঠ কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন। আর জেনারেল জামশেদ খানের স্ত্রী ঢাকা থেকে পাকিস্তানে যাওয়ার সময় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টাকা নিয়ে যান। এ ছাড়া অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ছিল ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব, লে. কর্নেল মুজাফর আলী খান জাহিদ, লে. কর্নেল বাশারত আহমেদ, লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজ প্রমুখের বিরুদ্ধেও। ভাইকে দিয়ে পান ব্যবসা চালাতেন রাও ফরমান আলীও।
যখন সেনাসদস্যরা একটি জনগোষ্ঠীর নিরস্ত্র ও বেসামরিক নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যায় লিপ্ত থাকেন, তখন আর তাঁরা নিজেদের পেশাদার দাবি করতে পারেন না। ১৬ ডিসেম্বরের অনেক আগেই পাকিস্তানি সেনাদের নৈতিক পরাজয় ঘটেছিল।
ইয়াহিয়া সরকার ১৯৭১ সালে ‘গণহত্যা’ সফলভাবে পরিচালনার জন্য সাতজন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাকে সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব হিলাল-ই জুররতে ভূষিত করে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি, জেনারেল আবু বকর, জেনারেল গোলাম ওমর, জেনারেল রহিম খান, ব্রিগেডিয়ার এস এ আনসারি, ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবার। (সূত্র: মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা ও নির্যাতন, লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির)
রিপোর্টে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাপুরুষোচিত আচরণ, দুর্নীতি, বাঙালির ওপর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ, অগ্নিসংযোগ, হত্যাকাণ্ড, বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও জওয়ানদের হত্যা, লুট, নারী ধর্ষণ-নির্যাতন, হিন্দু হত্যা ইত্যাদির নাতিদীর্ঘ বর্ণনা আছে। আছে পাকিস্তানি সামরিক শাসক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কথাও। পরবর্তী কিস্তিতে সেসব নিয়ে আলোচনা করা হবে।
আগামীকাল: ইয়াহিয়ার ক্ষমতালিপ্সা ও নারী সঙ্গীরা
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন