হামুদুর রহমান কমিশন বাংলাদেশে গণহত্যার কথা স্বীকারই করেনি। এড়িয়ে গেছে নারী নির্যাতনের বিষয়টিও। সম্পূরক রিপোর্টে কমিশন পাকিস্তান সেনা সদর দপ্তরের উদ্ধৃতি দিয়ে সামরিক অভিযানে নিহতের সংখ্যা ২৬ হাজার বলে দাবি করেছিল। মূল রিপোর্টেও সেই সংখ্যা আছে। বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া তথ্য তাদের কাছে অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে। কিন্তু এই যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী
নয় মাস ধরে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে লাখ লাখ মানুষ হত্যা করল, তা চেপে গেছে তারা। এর একটি কারণ হতে পারে এসব হত্যাকাণ্ড চলেছে অভিযান ছাড়াই। অভিযান হয় দুই পক্ষের মধ্যে। এখানে তারা ঘটিয়েছে গণহত্যা। হলোকাস্ট।
১৯৮১ সালে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার জরিপে দেখা যায়, বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময়ে বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে। গড়ে প্রতিদিন ৬ হাজার থেকে ১২ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। (সূত্র: ২৫ মার্চ কেন গণহত্যা দিবস, মুনতাসীর মামুন)
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংসতার শুরু ধরা হয় একাত্তরের ২৫ মার্চ, যেদিন রাতে তারা নিরস্ত্র মানুষের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝঁাপিয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে সেনা অভিযান চলেছে মার্চের প্রথম থেকেই। ঢাকা, জয়দেবপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভরত মানুষকে তারা গুলি করে হত্যা করেছে। আর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের নামে ঢাকায় যে গণহত্যা চালিয়েছে, তা ইতিহাসের নৃশংসতম ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল পিলখানায় তৎকালীন ইপিআর সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অনেক বিশ্লেষকের মতে, সেদিন ঢাকায় ৮০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস ঘোষণা করেছে।
এসব কিছুই হামুদুর রহমান কমিশনের বিবেচ্য বিষয় ছিল না। তারা অনুসন্ধান করেছে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ও আত্মসমর্পণের কারণ। কমিশন গণহত্যার কথা সরাসরি না বললেও স্বীকার করেছে যে সেনাবাহিনী অভিযান পরিচালনাকালে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে।
কমিশন বাংলাদেশে দায়িত্বরত সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ পেয়েছে, তার মধ্যে ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ ও ২৬ মার্চে ঢাকায় সামরিক অভিযানকালে মাত্রাতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগ ও গোলাবারুদের ব্যবহার। ২. সারা দেশে অগ্নিসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞ। ৩. মার্চ ও ডিসেম্বরে বেছে বেছে বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হত্যা। ৩. ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ সদস্যদের নিরস্ত্র বা বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে বাঙালি অফিসার ও সদস্যদের হত্যা। ৪. সেনা অফিসারদের নির্দেশে পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি হত্যা এবং রহস্যজনকভাবে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া, পরে যঁাদের খোঁজ মেলেনি।
বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ থেকে জানা যায়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেখানে গিয়েছে, সেখানেই পোড়ামাটি নীতি নিয়েছে। প্রথমেই তারা নিরীহ মানুষ হত্যা করে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। দায়িত্ব পালনকারী সেনা কর্মকর্তাদের কেউ কেউ হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের কথা স্বীকার করলেও নিজের দায় এড়িয়ে গেছেন। অন্যের ওপর দোষ চাপিয়েছেন। পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে যঁারা বই লিখেছেন, তঁারাও নিজের সাফাই গেয়েছেন। গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত তিন কুশীলব—টিক্কা খান, নিয়াজি ও রাও ফরমান আলীর বই–ই তার প্রমাণ।
জেনারেল নিয়াজি তঁার পূর্বসূরি টিক্কা খানের ওপর দোষ চাপিয়ে বলেছেন, প্রাথমিকভাবে সামরিক হামলার ভিত্তি ছিল জবরদস্তি এবং অনেক ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী বাছবিচারহীনভাবে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে। ফলে সেনাবাহিনী জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ও বিরাগভাজন হয়েছে। অন্যদিকে রাও ফরমান আলীর দাবি, তিনি বেসামরিক বিষয়াদি দেখতেন, সামরিক বিষয়ে তঁার কিছু জানা নেই। ফরমান আলী টিক্কা খানের পক্ষেও সাফাই গেয়েছেন।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা করেছে, তা স্বীকার করেনি হামুদুর রহমান কমিশন। তবে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের কেউ কেউ যে ‘চেঙ্গিস খান’ ও ‘পূর্ব পাকিস্তানের কসাই’ নামে কুখ্যাতি পেয়েছিলেন, সে কথা অস্বীকার করেনি। গণহত্যা না চালালে পেশাদার সেনা কর্মকর্তারা এসব নামে অভিহিত হবেন কেন?
নিয়াজির জবানবন্দি থেকেই চরম নৃশংসতার আলামত পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার পর আমি প্রত্যেক ফরমেশন কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিই যে লুট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, গণহত্যা বন্ধ করতে হবে। সেনাবাহিনীতে উচ্চমানের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।’ এর অর্থ তঁার এই নির্দেশের আগে এসব অপকর্ম যথেচ্ছ চলছিল। তিনি এ–ও স্বীকার করেন যে লুট করা মালামাল অনেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছে; যার মধ্যে ছিল গাড়ি, রেফ্রিজারেটর ও এয়ারকন্ডিশনার।
রাও ফরমান আলীর ভাষ্য ছিল: ধর্ষণ, লুট, রাহাজানি, অগ্নিসংযোগ, অপমান ও অসম্মানজনক আচরণের ভয়াবহ ঘটনা
তঁারা শুনেছেন। শুধুই শুনেছেন, কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, তা জানা যায় না। টিক্কা খান ঢাকায় আসার আগেই বেলুচিস্তানের কসাই নামে পরিচিত ছিলেন।
হামুদুর রহমান কমিশন বলেছে, প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণে দেখা যাচ্ছে, সামরিক অভিযান চালানোর নামে সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর মাত্রাতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগ ও বাড়াবাড়ি করেছে। তবে তারা এ জন্য উগ্রপন্থী আওয়ামী লীগারদের দায়ী করেছে। তঁাদের অসদাচরণে নাকি পাকিস্তানি সেনারা অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর কমিশনের মন্তব্য, সেনাবাহিনী ফেডারেল সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তিপ্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু সেটি হওয়া উচিত আইনশৃঙ্খলার পুনরুদ্ধারে এবং সেনাসদস্যদের মনে রাখা উচিত ছিল, তারা নিজ দেশের ভূখণ্ডে অভিযান চালিয়েছে। সেখানে কোনোভাবেই তারা জনগণের সঙ্গে আগ্রাসী শক্তির মতো আচরণ করতে পারে না।
কমিশনের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে ব্রিগেডিয়ার শাহ আবুল কাশেম জানিয়েছেন, ২৫ মার্চ কোনো রকম খণ্ডযুদ্ধ হয়নি। অথচ সেনাবাহিনী একতরফা শক্তিপ্রয়োগ করেছে, অভিযান চলাকালে ছাত্রদের আবাসিক হল মর্টার চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
ব্রিগেডিয়ার মিয়া তাসকেনুদ্দিনের মতে, তথাকথিত দুষ্কৃতকারী দমনের নামে অনেক জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ বলেছেন, এমনও গুজব ছিল যে বিচার ছাড়াই বাঙালিদের হত্যা করা হয়েছে।
কমিশনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে লে. কর্নেল এস এম নাইম আলী বলেছেন, অভিযানের সময় নির্দোষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এবং তার ফলে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। অনেককে সাংকেতিক নাম দিয়ে ‘বাংলাদেশে’ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হিন্দুদের হত্যা করার মৌখিক নির্দেশ ছিল। অপর এক কর্মকর্তার মতে, রংপুরে অভিযানের শুরুতেই দুজন বাঙালি অফিসার ও আরও ৩০ জনকে হত্যা করা হয়।
ঢাকার অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার জানিয়েছেন, যঁাদের খুন করা হয়েছে, তঁাদের মধ্যে ছিলেন বাঙালি সেনা ও পুলিশ সদস্য, ব্যবসায়ী ও বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তা।
বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মনোভাব কেমন ছিল, তা উঠে এসেছে ব্রিগেডিয়ার ইকবালুর রহমান শরিফের জবানবন্দিতে। পূর্ব পাকিস্তান ফরমেশন পরিদর্শনের সময় মেজর জেনারেল গুল হাসান সেনাদের কৌতুক করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তুমি কতজন বাঙালিকে হত্যা করেছ?’ বালুচের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল আজিজ আহমেদের ভাষ্য হলো, ব্রিগেডিয়ার আরবাব জয়দেবপুরে সব বাড়িঘর ধ্বংস করে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ ছাড়া মে মাসে হিন্দুদের হত্যা করার জন্য লিখিত নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
তবে এসব কুলাঙ্গারের পাশাপাশি আমরা একজন ব্যতিক্রমী পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাকে দেখেছি, যিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অন্যায় আদেশ মানেননি। তঁার নাম কর্নেল (অব.) নাদের আলী। একাত্তরে যুদ্ধ চলাকালে সেনা সদর দপ্তর তঁাকে বাংলাদেশে পাঠায়। বিভিন্ন স্থানে সামরিক অভিযানেও তিনি অংশ নেন। কিন্তু অভিযানের নামে যখন নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করতে বলা হয়, নাদের আলী তা মানতে পারেননি।
তঁার জবানবন্দি থেকে শোনা যাক:‘আমার প্রথম তথাকথিত অভিযান ছিল ১৫ এপ্রিল ১৯৭১। ১৪ এপ্রিল সকাল থেকে পর্যবেক্ষণ ও তথ্যানুসন্ধানের পর আমি ১৫ এপ্রিল দুটি হেলিকপ্টারে করে কমান্ডো সেনাদের নিয়ে ফরিদপুর শহরের পূর্ব দিকে অবতরণ করি। আমাকে বলা হচ্ছিল, “এই এলাকাটা খুবই বিপজ্জনক। শেখ মুজিবের বাড়ি এই জেলায় অবস্থিত। যাও এবং তাদের দেখিয়ে দাও, বিশেষ করে হিন্দুদের খুঁজে বের করো।” যিনি এই আদেশ করলেন, তিনি আমার সাবেক প্রশিক্ষক ও বন্ধুও বটে। আমি বললাম, “স্যার, যে অস্ত্রধারী নয় এবং আমাকে গুলি করেনি, তাকে আমি হত্যা করতে পারব না। আমাকে এটা করতে বলবেন না, এমনকি সামরিক আইনের অধীনেও এটা বেআইনি।”’
গোটা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে হয়তো দ্বিতীয় নাদের আলী পাওয়া যাবে না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অন্যায় আদেশ মানতে না পেরে তিনি স্বেচ্ছায় পাকিস্তানে বদলি হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও বাংলাদেশের ঘটনা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। একপর্যায়ে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন।
হামুদুর রহমান কমিশনের সুপারিশ ছিল, যেসব সেনা কর্মকর্তা অভিযানের নামে নৃশংসতা চালিয়েছে এবং বাড়াবাড়ি করেছে, পাকিস্তান সরকারের উচিত তাদের তদন্ত ও বিচারের জন্য উচ্চপর্যায়ের কমিশন বা আদালত করা।
গত ছেচল্লিশ বছরেও পাকিস্তানের কোনো সরকার সেই গণহত্যা ও নৃশংসতার বিচার করেনি। এখনো সেই অপরাধবোধ পাকিস্তানকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। (শেষ)
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন