নির্বাচন কমিশন গঠনে এবার যে কমিটি হয়েছে, তারা এখন চাইলেই এমন একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে পারে, যা মাইলফলক হয়ে থাকতে পারে। সেটা কেবল আগামী দিনের নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্যই নয়, অন্যান্য সাংবিধানিক ও আধা সাংবিধানিক পদধারীদের নিয়োগেও আমাদের অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য বাছাই প্রক্রিয়া বের করায় সহায়ক হতে পারে।
নতুন অনুসন্ধান কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের অন্তর্ভুক্তিকে আমরা নাগরিক সমাজের এক নির্ভরযোগ্য প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে পারি। ছয়জনের মধ্যে বয়সে এই শিক্ষাবিদই জ্যেষ্ঠ। আরেকটি বিচারে কমিটির সভাপতি ঘটনাচক্রে কিছুটা হলেও একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করছেন। সেটা এই অর্থে যে তিনি আওয়ামী লীগ আমলে হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক এবং বিএনপি আমলে স্থায়ী বিচারপতি হন। ২০১২ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল মামলায় বিচারপতি খায়রুল হক লিখেছিলেন, রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গের থেকে সুপ্রিম কোর্টের মর্যাদার গুরুত্ব বেশি। বিচারপতি কে এম হাসানের প্রতি ইঙ্গিত করে ওই
রােয় বিচারপতি খায়রুলের পর্যবেক্ষণ ছিল, আন্দোলনের মুখে তিনি পরে সরে দাঁড়ালেও বিতর্কের কারণে বিচার বিভাগের গায়ে তার অনভিপ্রেত আঁচ লাগে। তাই অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের প্রধান উপদেষ্টা করার বিধান বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য ক্ষতিকর। সেটা সত্য। ওই মামলার অন্যতম রায়দানকারী হিসেবে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনও এ মন্তব্যে সায় দেন। একই যুক্তিতে অনুসন্ধান কমিটিতে কর্মরত বিচারকদের রাখার পক্ষে আমাদের সায় নেই।
তবে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের উপস্থিতি একটি নতুন ধারার প্রাথমিক সূচনা বলা যায়। এটা বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থার আলোকে কিছুটা ব্যতিক্রম। রাষ্ট্র পরিচালনায় নাগরিক সমাজের শরিকানাকে কখনো খুব সুনজরে দেখা হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। সে কারণে আমরা নতুন নির্বাচন কমিশনে নাগরিক সমাজের তাৎপর্যপূর্ণ শরিকানা আশা করি। যত গুরুত্বপূর্ণ পদ রয়েছে, তাতে সব সময় এই রাষ্ট্রব্যবস্থা পাবলিক সার্ভেন্টদের দিতে উদ্গ্রীব। এটা একটা অচলায়তন, ভাঙা দরকার। রাষ্ট্র যেন সতর্ক, যার গায়ে কোনো না কোনো ধরনের আনুগত্য বা বিশ্বস্ততার তকমা নেই, এ রকম ব্যক্তি যাতে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অন্দরমহলে ঢুকে পড়তে না পারে। বিদ্যমান আইনের বাছাই কমিটির দিকে তাকালেই এ সত্য ফুটে ওঠে। এটা বোঝার জন্য খুব কাঠখড় পোড়াতে হয় না।
২০১০ সালে ১০ বিচারকের আলোচিত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন যে বিচারপতি নিয়োগের বাছাই প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপের একটা লিখিত রূপ থাকবে এবং তার রেকর্ড থাকবে। ওই দিকনির্দেশনায় বিচারপতি এম এ মতিন খুব জোর দিয়ে লিখেছিলেন, বাছাই প্রক্রিয়া অবশ্যই ট্রান্সপারেন্ট বা স্বচ্ছ হতে হবে। কিন্তু এটা দুঃখের বিষয় যে বাছাই প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের স্বচ্ছতা আজ পর্যন্ত এসেছে কি না, তা প্রতীয়মান হয় না। এমনকি বাছাই প্রক্রিয়ার কোনো লিখিত রূপ আদৌ দেওয়া হয় কি না, তা-ও জানা যায় না। কিন্তু এর দরকার আছে।
নতুন অনুসন্ধান কমিটি স্বাধীন হবে এবং তাদের সেই স্বাধীনতা প্রতীয়মান হতে হবে। কমিটি প্রথম সভাতেই মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে একজন মুখপাত্র এবং ১০ কার্যদিবসের সব আলোচনার বিবরণ লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা নিতে পারে। এর অনুলিপি কমিটি বেঁচে থাকতেই যেন তথ্য অধিকার আইনে প্রকাশ করতে পারে। এ কাজে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুলের সক্রিয় নেতৃত্ব প্রত্যাশিত। তার অনেক কারণ। একে তো সবার জ্যেষ্ঠ, উপরন্তু আমাদের জানামতে কমিটিতে দুজনই তাঁর ছাত্র, আবার কেবিনেট বিভাগ যাঁরা সাচিবিক সুবিধা দেবেন, সেখানেও উচ্চপদস্থদের মধ্যে অন্তত দুজন ছাত্র রয়েছেন। আমরা শুধু একটি নির্বাচন কমিশনই পেতে চাইব না, একই সঙ্গে একটা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টাও দেখতে চাইব। এটা একটা ভালো মডেল হলে সেটা আমাদের অন্যত্রও কাজে দেবে।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশে তিনটি পৃথক আইন এবং নতুন গেজেট প্রজ্ঞাপনের আওতায় চারটি বাছাই কমিটির উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। ২০০৪ সালের দুদক আইন, ২০০৯ সালের মানবাধিকার কমিশন এবং তথ্য কমিশনের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের জন্য গঠিত কমিটির তুলনা করলে যে বৈশিষ্ট্য সবার আগে চোখে পড়ে সেটা হলো, আইন দ্বারা গঠিত কমিটিগুলোর অধিকাংশ সদস্য পদাধিকারবলে কমিটির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। আর যে তিনজনের উপস্থিতিতে কমিটির কোরাম গঠিত হয়, তাতে সকল অবস্থায় সাংবিধানিক পদধারীরাই যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, সেটা নিশ্চিত থাকে। এবারেও তার ব্যতিক্রম নেই।
২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের কমিটির চারজনই সাংবিধানিক পদধারী ছিলেন। সেদিক থেকে আগের চারজনকে (আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের একজন করে বিচারক, পিএসসির চেয়ারম্যান ও সিঅ্যান্ডএজি) বহাল রেখে এবারের রাষ্ট্রপতি সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে লক্ষণীয়ভাবে কমিটিভুক্ত করেছেন। যদিও চট্টগ্রামের সহ-উপাচার্য শিরীণ আখতারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তাঁর অন্তর্ভুক্তি অনেকের কাছে কিছুটা ম্লান হয়েছে তাঁর কক্সবাজার মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্য পরিচেয়। যদিও তিনি মিডিয়ায় বলেছেন, বর্তমানে তিনি ওই পদে আর নেই। বিএনপি রকিব কমিশন গঠনে বর্তমান অনুসন্ধান কমিটির সভাপতির সংশ্লিষ্টতা ও পিএসসির চেয়ারম্যানের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকালে ইসির সচিব হিসেবে কর্তব্যরত থাকার কথা স্মরণে এনেছে। চলমান পরিবেশে এসব এড়ানো কোনো কষ্টসাধ্য বিষয় ছিল না। অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বর্তমানে অবসরজনিত ছুটিতে রয়েছেন। আগামী ৩০ জুন তিনি অবসরে যাবেন। অবশ্য তিনি তাঁর স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গির জন্য নন্দিত, এবার আমরা তাঁর আরও অর্থবহ বিস্তৃতি আশা করব।
আমরা স্মরণ করতে পারি, ১৯৯৬ সালে যখন আইন কমিশন গঠনের জন্য আইন করা হয়েছিল, তখন তাতে বিধান করা হয়েছিল যে কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সরকার নিয়োগ দেবে। কেউ এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি, কেউ বলেনি যে এটাও একটা বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাক। এরপর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ২০০৪ সালের দুদক আইনে বাছাই কমিটি পেলাম। সেই যে বিএনপি একটা খোলস তৈরি করে দিল, সেটা থেকে ২০১৭ সালেও আমরা বেরোতে পারলাম না। তার কারণ দল ও মানুষ বদলায়, কিন্তু এ দেশে সহজে কোনো ব্যবস্থা আমূল বদলায় না। দুদকের আইনের আদলেই ২০১৭ সালে আমরা আবার আরেকটি কমিটি করলাম। তবে আইনটি পেলাম না। কবে পাব, সে বিষয়ে ঘোষণা আশা করি।
২০০৪ সালে বিএনপি দুদকে বিধান এনেছিল, প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের একজন করে বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান থাকবেন। আর এবার বলা হলো, ছয়জনের কমিটিতে কোরাম হবে তিনজনে। মানবাধিকার কমিশন আইনে সাত সদস্যের সমন্বয়ে বাছাই কমিটির কথা বলা আছে। স্পিকারের নেতৃত্বাধীন এই কমিটিতে আইন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইন কমিশনের চেয়ারম্যান, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব, স্পিকার মনোনীত সরকারি ও বিরোধীদলীয় দুজন সাংসদ রয়েছেন। সম্প্রতি কীভাবে নতুন মানবাধিকার কমিশন হলো তার রেকর্ড আমরা জানি না। সুনসান গোপনীয়তায় এসব ঘটছে।
তথ্য কমিশনের পাঁচজনের কমিটিতে প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের বিচারকের নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্পিকার মনোনীত সরকার ও বিরোধী দল মনোনীত দুজন সাংসদ, ‘সরকার’ মনোনীত একজন মিডিয়া প্রতিনিধি আছেন। ২০০৯ সালের আাইনেও আমরা বলিনি যে মিডিয়া প্রতিনিধি রাষ্ট্রপতি দ্বারা মনোনীত হবেন। অার অনুসন্ধান কমিটিতে এবারও আমরা যা করলাম, তার এখতিয়ার রাষ্ট্রপতিকে স্থায়ীভাবে দেওয়া হলো কি না, তা অস্পষ্টই থেকে গেল।
গণতন্ত্রকে বলা হয় সমঝোতার কলা, কিন্তু আমরা সমঝোতার চর্চা চাই না। হুদা কমিশন ও কাজী রকিব কমিশন, দুই পর্বেই শুনেছি যে সিইসি হিসেবে তাঁরা অন্য কমিশনারদের মতকে খাটো করে দেখার প্রয়াস পেয়েছেন। সমঝোতার সংস্কৃতি চালুর দিকেই বেশি নজর দিতে হবে। এমনকি ব্যর্থতার কথা ভেবে এর চেষ্টা থেকে বিরত থাকা গ্রহণযোগ্য নয়। এটা অসাবধানতা নয় যে নতুন অনুসন্ধান কমিটির কার্যপরিধিতে এটা বলা হয়নি যে তারা যত দূর সম্ভব সমঝোতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে। সাধারণত বেজোড় সংখ্যায় কমিটি হয়। এই প্রথম জোড় সংখ্যায় কমিটি হলো। গত অনুসন্ধান কমিটি পাঁচজনের ছিল। এবার ছয়জনের কমিটি। এরপর অযথাযথভাবে বলা হয়েছে, তিনজনেই কোরাম হবে। মানবাধিকার কমিশন আইনে সাত সদস্যের কমিটিতে চারজনে কোরামের বিধান আছে। এখানেও তাই করা যেত। ধরেই নেওয়া চলে, মাত্র ১০ কার্যদিবস বয়সী কমিটিতে অন্তত কোরাম সংকট হবে না। কিন্তু ছয়জনের কমিটির কাজ যদি তিনজনে চলে, আর যদি সিদ্ধান্তের সমতার মতো পরিস্থিতি ভাবা হয়, তাহলে বিধানে কি একটু ত্রুটি ঘটল না? প্রজ্ঞাপন বলেছে, ‘সভায় উপস্থিত সদস্যগণের সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তে’ তালিকা হবে। তবে সমতা হলে সভাপতি নির্ণায়ক ভোট দেবেন। মানবাধিকার আইনে চারজনের কোরামে সমতা হলে সভাপতি নির্ণায়ক ভোট দেবেন, সেটা বোধগম্য। কিন্তু তিনজনের কোনো কোরাম বৈঠকে সমভাবে ভোট বিভক্ত হবে না। তাই কার্যপরিধি ও কর্মপদ্ধতির ৩ দফার (কোরাম) সঙ্গে ৪ দফার (সমতার ক্ষেত্রে) একটা সংঘাত তৈরি হয়েছে। এটা শোধরানোর দাবি রাখি।
আসল কথা হলো, যেভাবে অনুসন্ধান কমিটি হলো, তা থেকে নির্বাচন কমিশন আলাদা হবে তো? প্রতিনিধিত্ব খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অবসরপ্রাপ্তদের যত দূর সম্ভব এড়ানোর একটা প্রচেষ্টা দেখতে চাই। বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত মহলের দিকে তাকাতে বলি। নারীবিষয়ক একটা শর্ত ছাড়া নির্বাচন কমিশনার হওয়ার কোনো যোগ্যতাই রাষ্ট্রপতি বেঁধে দেননি। কমিটি চাইলে তার ‘কার্যপদ্ধতির’ মধ্যে যোগ্যতা নির্ধারণী বিষয় (যার মধ্যে মেডিকেল ফিটনেস অন্যতম হতে পারে) অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এমনকি সৌজন্য সাক্ষাৎকারও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। মার্কিন সিনেটের শুনানিতে অংশ নিতে কেউ বিব্রত হন না। এই কমিটি হতে পারে বাংলাদেশি সিনেট।
পাকিস্তানি ধারা জেনেও আমরা দ্রুত সিইসি নিয়োগে বিচারপতি ধারা ত্যাগ করিনি। অবসরপ্রাপ্ত সচিবদের সিইসি করা হলো ভারতীয় ধারা। আমরা কোন দিকে যাব? এ ধরনের নিয়োগে সততা ও যোগ্যতার সঙ্গে আরও কতগুলো বিষয় দেখা হয়। শ্রীলঙ্কার সংবিধান বলছে, জাতিগত বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদিতার প্রতিফলন থাকতে হবে। আমরা বারংবার বলি, সব সাংবিধানিক পদধারীর নিয়োগের আগে বাছাই প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ। দুদক, মানবাধিকার ও তথ্য কমিশন কোনোটিই সরাসরি সাংবিধানিক সংস্থা নয়। তাই নির্বাচন কমিশন হবে যেভাবে, সামনের দিনে অন্যান্য সাংবিধানিক সংস্থাও হবে সেভাবে। আর সে জন্যই আমরা এই কমিটির মডেল-সাফল্য কামনা করি। আমরা স্লোগান তুলব, ইসি হতে হবে স্বচ্ছতায়, অন্যান্য সংস্থাও হবে স্বচ্ছতায়। ১৯৭২ সালে ১১৮ অনুচ্ছেদে যেভাবে, সেভাবে পিএসসি ও সিঅ্যান্ডএজি নিয়োগেও আইন তৈরি করতে বলেছে সংবিধান। সুতরাং অনুসন্ধান কমিটি এবারে এমন কিছু করে দেখাক, যাতে তাদের স্বকীয়তা ফুটে ওঠে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন