ঢাকা থেকে চেন্নাই বেশি দূরত্বের পথ নয়, কিন্তু দুই জনপদের পুলিশ নিয়ে আমরা একটা তুলনা করব, যাতে দেখা যাবে দুই শহরের মধ্যে দিনরাতের তফাত। ২৪ জানুয়ারি ভারতীয় দৈনিক দ্য হিন্দু ও প্রথম আলোতে পুলিশ নিয়ে দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর খবর ছাপা হয়েছে। দ্য হিন্দু পত্রিকার শিরোনাম ছিল, ‘ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তামিলনাড়ু সরকারকে নোটিশ দিয়েছে’। খবরের কাগজে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ভারতের মানবাধিকার কমিশন ওই নোটিশ দিয়েছে। তামিলনাড়ুতে দুই হাজার বছর ধরে ষাঁড়ের খেলা চলে আসছে। ২০১৪ সালে ওই খেলার ওপর সুপ্রিম কোর্ট একটি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। তামিলনাড়ুর আমজনতা এ সিদ্ধান্তকে তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতির ওপর আঘাত হিসেবে দেখেছে।
গোটা তামিলনাড়ু এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ফুঁসে ওঠে। রাজ্যটির এ আর রাহমানের মতো অস্কার বিজয়ী মিউজিক কম্পোজারও অনশনে যোগ দেন। ক্রিকেট ও চলচ্চিত্রের তারকারা জনগণের আন্দোলনের পাশে দাঁড়ান। এমনকি একটি তামিল সংবাদপত্র ঘটনাটিকে ভারতের ‘আরব বসন্ত’ বলেও উল্লেখ করেছে। এ রকমের এক কথিত বসন্তে পুলিশ যেটুকু ‘অপরাধ’ করেছে, তা আমাদের দেশে এখন আর সংবাদপত্রে তেমন গুরুত্ব পায় না। একসময় আমরা তথাকথিত ‘মৃদু লাঠিপেটা’য় বড় রকমের প্রতিবাদ দেখেছি। রাজ্য পুলিশের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম অভিযোগ করেছে, তারা বিনা উসকানিতে প্রতিবাদকারীদের ওপর লাঠিপেটা করেছে। এই প্রতিবাদ সমাবেশ তারা করেছে সমুদ্রসৈকতে, মেরিনা বিচে। সৈকতে সমাবেশ করেই ‘নেতৃত্বহীন আমজনতা’ তাদের দাবি আদায় করে নিয়েছে। রাজ্য সংসদ ‘জাল্লিকাত্তু’ নামের এই খেলার বৈধতা দিয়ে বিল পাস করেছে।
সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলন এই লেখার বিষয় নয়। আমাদের উদ্দেশ্য হলো এটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো যে ভারতে যেদিন ‘সামান্য’ লাঠিপেটার কারণে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে দেশটির মানবাধিকার কমিশন দ্বারা তামিলনাড়ুকে চোখ রাঙানোর তথ্য বেরোল, সে দিনটিতেই ২৪ জানুয়ারি প্রথম আলো শিরোনাম করল, ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু আইন বাতিল চায় পুলিশ’। তামিলনাড়ু পুলিশ সর্বত্র যে মারমুখো হয়নি, তার প্রমাণ হলো ২৩ জানুয়ারিতে পুলিশ এক বিবৃতিতে প্রতিবাদকারীদের ‘যানজট সৃষ্টি না করে শান্তিপূর্ণভাবে একটি সফল আন্দোলন করার জন্য অভিনন্দন’ জানিয়েছিল। উপমহাদেশীয় পুলিশের এতটা বিনয় সত্যি অভাবনীয়। তারপরও তারা বাড়াবাড়ির জন্য কাঠগড়ায়। আর আমাদের পুলিশের কী আবদার! একটি বেসরকারি বিল হিসেবে এই আইনটি মূলত আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও আন্তরিকভাবে লেগে থাকার কারণে সংসদে পাস হয়েছিল। অবশ্য এ জন্য দেশে পুলিশি নির্যাতন হ্রাস পেয়েছে, তেমনটা জানি না। দেশে পুলিশি নির্যাতনবিরোধী আইনের ঘাটতি ছিল, তা কিন্তু নয়। উচ্চপদস্থ তামিল পুলিশ কর্মকর্তারা বেশ ঘন ঘন বরখাস্ত হন। ২ জানুয়ারি নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবর: ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে তিরুভান্নামালাইয়ের এসপি একজন ইন্সপেক্টর ও এআইকে বরখাস্ত করেছেন। এরপর তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। ভারতের সীমান্ত পেরিয়ে এ রকম অভ্যাস গড়তে আমাদের পুলিশ কবে অভ্যস্ত হবে, জানি না। তবে টিআইয়ের ধারণাসূচকে আমরা কেন যথেষ্ট অগ্রগতি করি না, তার উত্তরের কিছু হলেও সম্ভবত পাওয়া যায় সরকারপ্রধানের উপস্থিতিতে পুলিশি দৃষ্টিভঙ্গির উল্লিখিত বহিঃপ্রকাশের মধ্য দিয়ে। অবশ্য কৃতিত্বের জন্য বিপুলসংখ্যক পুলিশ পদকও পাচ্ছে।
২০১৩ সালের অক্টোবরে সাবের হোসেন চৌধুরী জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, ‘আমি পুলিশি হেফাজতে অন্তরীণ ছিলাম। আমাদের নেতাদের ওপর কীভাবে নির্যাতন চলেছে, সেই বিবরণ আমি সভানেত্রীকে (শেখ হাসিনা) দিয়েছিলাম। তখনই তিনি এই বিল সংসদে আনার কথা বলেছিলেন।’ কিন্তু গত তিন বছরে এই বিল কবে কাকে সুরক্ষা দিয়েছে? আইন আর কী বলবে? সংবিধানেই তো পুলিশি নির্যাতন নিষিদ্ধ। ২০১৩ সালের আইনেই বলা হয়েছে, হেফাজতে কেউ নির্যাতিত হলে আদালত অনতিবিলম্বে ভিকটিমের জবানবন্দি নেবেন। চিকিৎসকদের দ্বারা তা পরীক্ষার নির্দেশ দেবেন। অথচ প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে প্রথমবারের মতো পুলিশের কল্যাণসভায় ওই আইনটাই বিলকুল বাতিলের দাবি উঠেছে। পুলিশ শুধুই আইন বাতিলের আবদার করেনি, তারা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা মানতেও অপারগতা প্রকাশ করেছে। ব্লাস্টের মামলায় গত ১০ নভেম্বরের পূর্ণাঙ্গ রায়ে আমরা একটি গাইডলাইন পাই। আর এখন পুলিশ নির্ভয়ে বলছে, সর্বোচ্চ আদালতের নির্যাতনবিরোধী নির্দেশনা মানা তাদের জন্য অসুবিধাজনক।
প্রথম আলোর রিপোর্ট বলেছে, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এলে বিচারিক আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অভিযোগ আমলে নিতে পারবেন বলে আদালত সম্প্রতি যে রায় দিয়েছেন, সেটিও পুলিশের অধিকারকে খর্ব করছে বলে দাবি পুলিশের।’ এটা তারা সরকারপ্রধানের সামনেই বলছে। অথচ এই আমলে নেওয়ার বিষয়টি ২০১৩ সালের আইনেও বলা আছে। সুপ্রিম কোর্টের দিকনির্দেশনা ও আইন পর্যালোচনা করে আমরা দেখি, সার্বিক বিচারে সংসদের আইনের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার কোনো অসংগতি নেই। এমনকি দিকনির্দেশনায় নির্দিষ্টভাবে নিবারণ আইনের বরাতও দেওয়া আছে। সুপ্রিম কোর্টের দিকনির্দেশনার ৪ ধারা বলেছে, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অস্থিতিশীলতা বা যুদ্ধের হুমকির মতো পরিস্থিতির দোহাই দিয়েও নির্যাতন করা যাবে না। কারও সঙ্গে কোনো ধরনের অবমাননাকর আচরণ করাকে যৌক্তিকতা দেওয়া যাবে না। নিবারণ আইনের ১২ ধারাতেও ঠিক একই কথা বলা হয়েছে।
প্রতীয়মান হয়, গত তিন বছরে ওই আইনের তেমন কোনো কার্যকরতা নেই। আবার সুপ্রিম কোর্টের দিকনির্দেশনা পুলিশ যেমন অনুসরণ করে না, তেমনি আদালতও তা করতে শুরু করছেন, এমনটা মনে হয় না। আমরা দেখলাম পুলিশ আশুলিয়ায় গার্মেন্টস আন্দোলনের অন্তত ১৫ নেতা-কর্মীকে ১৯৭৪ সালের আইনের একটি বিলুপ্ত ধারায় কারাগারে পুরল। তাঁদের গ্রেপ্তার ও রিমান্ড প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের দিকনির্দেশনা মানা হলো না। সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ প্রশ্নের জবাবে মানলেন পুলিশি অভিযোগ যে সুবিবেচনাপ্রসূত ছিল না, বিলুপ্ত আইনে গ্রেপ্তার করা তার একটা প্রমাণ। প্রশ্ন হলো, এর প্রতিকার কী? গার্মেন্টস মালিক ও সরকার উভয়ের তরফে সংশ্লিষ্ট পুলিশ যদি তিরস্কারের পরিবর্তে পুরস্কৃত হন, তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আমরা একটা অনুমান করতে পারি, প্রধানমন্ত্রীকে হয়তো ভুল পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এটা স্বস্তির যে তিনি আইনটি বাতিলের আশ্বাস দেননি। আমরা এর আগে সম্পাদকীয়তে অনুরোধ করেছিলাম, উপযুক্ত ব্যাখ্যা দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যাতে সুপ্রিম কোর্টের দিকনির্দেশনাটি দেশের সব থানায় প্রেরণ করে। আমি আমার কাঁচা হাতে ইংরেজি থেকে এই দিকনির্দেশনার একটি তরজমা করেছি। এই নিবন্ধের নিচে পিডিএফ ফাইল হিসেবে এটি সন্নিবেশ করা হলো, যা শুধু প্রথম আলোর অনলাইনে পাওয়া যাবে। আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন।
পুলিশ কল্যাণ সভায় কুমিল্লা সদর সার্কেলের অতিরিক্ত এসপি তানভীর সালেহিন ইমন যেকোনো নির্যাতনের অভিযোগে তদন্ত ছাড়াই পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নেওয়ার কথা বলেছেন। এই তথ্যটি সঠিক নয়। কারণ, দিকনির্দেশনায় অন্তরীণ ব্যক্তির জখম বা মৃত্যুর কারণ নির্যাতন বলে একটি মেডিকেল বোর্ডের দ্বারা যদি ‘মেডিকেল এভিডেন্সে’ উদ্ঘাটিত হয়, তাহলেই শুধু (সিআরপিসির অধীনে মামলার অপেক্ষায় না থেকে) তা আমলে নিতে বলা হয়েছে। ব্লাস্টের এই মামলাটি কিন্তু একটি বিখ্যাত মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় দ্বারা সমর্থিত। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এ ধরনের রায় কেন দিল, তা জানি না। যেহেতু আদালতের রায়ে আমাদের হাত-পা, মুখ বন্ধ, তাই কিছু বলতে পারি না। কিন্তু আমরা কি আইনশৃঙ্খলা, মানুষের জান-মাল রক্ষা করব না? পুলিশ কাজ করবে না? পুলিশের হাত-পা যদি বেঁধে দেওয়া হয়, তাহলে পুলিশ তার দায়িত্ব পালন করবে কীভাবে? দশটা ভালো কাজ করতে গেলে একটা-দুটো ভুল হতে পারে (প্রথম আলো, ২৪ জানুয়ারি, পৃষ্ঠা-১)।’
সুতরাং ওপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে পুলিশের আপত্তি এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া দুটোই দৃশ্যত জাতীয় সংসদে নিবারণ আইন এবং ওই নন্দিত দিকনির্দেশনাকে সাংঘর্ষিক করে তুলেছে। অথচ ওই আইনটি নিয়ে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ মানবাধিকার-বিষয়ক আন্তর্জাতিক ফোরামে মুখ বড় করে কথা বলতে পারে। কারণ, আইনটির ভূমিকায় সংসদ দাবি করেছে, এ আইনটি নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর-অমানবিক অথবা অমর্যাদাকর আচরণ অথবা শাস্তির বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সনদের কার্যকরতা প্রদানের লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে। এতে ১০ ডিসেম্বর ১৯৮৪ সালের নির্যাতনবিরোধী নিউইয়র্ক সনদ এবং জাতিসংঘ সনদের ২(১) ও ৪ অনুচ্ছেদের বরাত দেওয়া হয়েছে।
লাঠিপেটার জন্য তামিলনাড়ুর পুলিশের জবাবদিহি দেশটির মানবাধিকার কমিশন নিশ্চিত করছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশন কি করছে?
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদন অবশ্য বলেছে, ‘নিখোঁজের ঘটনায় সরকার নিরাপত্তা বাহিনীর যথাযথ করণীয় নির্ধারণে ব্যর্থ হয়। যেখানে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া লোকদের পরিবার-পরিজন সম্ভাব্য অপরাধী হিসেবে র্যাবের নাম উল্লেখ করে বা পুলিশকে চিহ্নিত করে।’ মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ১৫টি গুম-নিখোঁজ, ১টি বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং হেফাজতে ৮টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। আমরা জানতে চাইব, এ জন্য কেউ কোথাও জবাবদিহি করেছে কি না?
আইন ও দিকনির্দেশনা থাকতেও যা, না থাকতেও তা—এটাই কি বাস্তবতা? পুলিশের সংস্কার প্রস্তাব, যা আইনের খসড়া হয়ে পড়ে আছে, মনে হচ্ছে ওটা আরও পড়ে থাকলে আমাদের পুলিশ আরও বেপরোয়া হবে। তারা এখন শুধু প্রচলিত আইন ও সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেওয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছে তা নয়, তারা কার্যত নির্যাতনবিরোধী উল্লিখিত জাতিসংঘ ও নিউইয়র্ক সনদের বিরুদ্ধেও অনাস্থা ব্যক্ত করেছে। তাদেরই শুধু দোষ দিই কেন, তারা তো প্রধান বিচারপতি বর্ণিত ‘দ্বৈত শাসন’ দেখছে। সিভিল প্রশাসন কীভাবে দেশের বিচারব্যবস্থা টুকরো টুকরো করে কেটে নিচ্ছে, তাও দেখছে। তারাই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? পুলিশ তাই দুঃসাহস বা স্পর্ধা দেখাচ্ছে। এসবের রাশ এখনই না টানলে তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার জন্য একটি বিপজ্জনক দর-কষাকষির শক্তি হয়ে উঠতে পারে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন