এমন দুটি ধারণার ওপর অনুসন্ধান কমিটি এখন পর্যন্ত অবিচল রয়েছে বলে মনে হচ্ছে, যার সপক্ষে জোরালো কোনো যুক্তি নেই। প্রথমত, ২০ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, যাঁদের নাম চূড়ান্ত করা হবে, তাঁদের প্রার্থী হিসেবে দেখা হবে না। কমিটির সূত্র গতকাল বৃহস্পতিবার আমাকে বলেছে, কমিটির অভিমত হচ্ছে ২০ জনের শর্ট লিস্ট প্রকাশ না করা এবং বন্ধ খামে প্রার্থীদের নাম রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া। অন্যদিকে কমিশনের সম্ভাব্য যেসব সদস্যের নাম নানাভাবে শোনা যাচ্ছে—এমন যাঁকেই জিজ্ঞেস করি, তাঁদের কেউ কেউ ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা সূত্রে আগ্রহী বলে জানালেও তা বলেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে।
আমাদের সংস্কৃতি হচ্ছে, খুব উঁচু পদ হলে তাঁরা নিজেরা সেটা চাইছেন, তা প্রকাশ পাক, তা কখনো তাঁরা চান না। এবারও সেই সংস্কৃতি চলছে, কেউ প্রার্থী নন। শুধু তাঁরা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে কিছুটা ‘অনিচ্ছা’ সত্ত্বেও ডাক এলে সাড়া দেবেন। সার্চ কমিটির মাধ্যমে সম্প্রতি নিয়োগ পেয়েছেন—এমন একজন বললেন, তিনি ডাক আসার আগে কিছুই জানতেন না। এমনটা বাংলাদেশের বাস্তবতা হতে পারে। কিন্তু সেই হওয়াটা স্বচ্ছতা সমর্থন করে না। এখন স্বচ্ছতার যুগ। ব্রিটেনে এক হাজারের বেশি বছর ধরে গোপনীয়তার ভিত্তিতে হাইকোর্টের বিচারক নিয়োগের রেওয়াজ চলেছে। সেই রেওয়াজ ২০০৫ সালে পার্লামেন্ট বাতিল করে দিয়েছে। তারা বিচারক নিয়োগে একটি জুডিশিয়াল কমিশন করল। এখন দ্য টাইমস পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে তাদের হাজির হতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যাঁর নাম সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে প্রস্তাব করেছেন, সিনেটের শুনানিতে তাঁকে তুলাধোনো করার প্রস্তুতি শুধু ডেমোক্র্যাটরাই নন, রিপাবলিকানরাও নিচ্ছেন। এটাই নিয়ম।
আমাদের যাঁরা ব্যারিস্টারি পাস করতে বিলাতে যান, তাঁরা সঙ্গে করে যেন সনদটাই আনেন। কারণ, তাঁরাও ফিরে এসে কেউ বিচারক হওয়ার জন্য ‘প্রার্থী’ হতে সাক্ষাৎকার দিতে লজ্জিত বোধ করেন। অবশ্য গোপন তদবিরে লজ্জা নেই বলেই মনে হয়। সারা দুনিয়া বদলাচ্ছে। আশপাশের প্রতিটি দেশ এখন আমরা যে প্রসঙ্গে স্বচ্ছতার কথা বলছি, সেই পথে চলছে। নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কা কেউ বসে নেই। অকার্যকর রাষ্ট্র পাকিস্তান পর্যন্ত গত বছর তার ২২তম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে টেকনোক্র্যাট হিসেবে একজন নাগরিক নির্দিষ্ট কিছু যোগ্যতা সাপেক্ষে যাতে সিইসি হতে পারেন, সে জন্য বিধান করেছে।
ভারতে লোকপাল আইন পাস হলো ২০১৩ সালে। এটাই সব থেকে উত্তম উদাহরণ। আমরা আশা করব, অনুসন্ধান কমিটি এই উদাহরণটি কবুল করুক যে ২০ নাম তারা প্রকাশ করবে। তারা এখন যে যুক্তিতে গোপনীয়তা বজায় রাখছে, সেটা আমাদের ভারতের ডিপার্টমেন্ট অব পার্সোনেল অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের (ডিওপিটির) কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই বিভাগকে লোকপাল খোঁজার সাচিবিক সুবিধা দিতে নিয়োগ করা হয়েছে। মর্যাদার দিক থেকে ভারতের সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের চেয়ে উঁচু আসনে বসবেন লোকপাল। কারণ, নির্বাচন কমিশনের কোনো দুর্নীতির বিষয় খতিয়ে দেখবেন লোকপাল। তাঁকে বাছাইয়ে যে কমিটি হলো, সেটাই তাঁর মর্যাদা নির্দেশক। প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, স্পিকার ও বিরোধীদলীয় নেতা—এই চারজনের মনোনয়নে রাষ্ট্রপতি একজন আইনবিদকে করবেন পঞ্চম সদস্য। আমরা মনে রাখব, আমরা পরপর দুবার বঙ্গভবনকেন্দ্রিক যা করলাম, তা কোনো রাষ্ট্রের ঠিক সুস্থতার পরিচায়ক নয়। শুধু একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের জন্য ৩১ দলের অংশগ্রহণ ৪৫ বছর বয়সী একটি রাষ্ট্রের পরিচালনাগত পরিপক্বতা নির্দেশ করে না। তবে আমরা তো বেকায়দায় পড়ে নিশ্চয় একে স্বাগত জানিয়েছি। এখন এই অর্জনকে একটি কাঠামোর মধ্যে নিতে হবে। সে জনই অনেকেই আইন চাইছেন এবং ২০২৪ সালের জন্য হলেও তা এখনই করা উচিত।
ভারত এখন লোকপাল নিয়োগে যে পথ অনুসরণ করছে, সেই পথে একদিন তাদের সব সাংবিধানিক পদধারীরা নিযুক্ত হবেন। আমাদের প্রস্তাবিত বিধান লোকপাল বিলের মতো হলে ভালো। প্রথমে বাছাই কমিটি, তারপর তারা একটি অনুসন্ধান কমিটি নিয়োগ দেবে। আমাদের এবারের অনুসন্ধান কমিটি যে দুই দফায় ১৬ নাগরিকের সঙ্গে বসল, সেটা কিন্তু বাছাই কমিটি ও অনুসন্ধান কমিটি নামে দুটি আলাদা কাঠামো থাকার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।
ভারতে লোকপালের চেয়ারপারসন ও সদস্যদের নিয়োগে প্রথম সার্চ কমিটি কার্যকর হয়নি। রাষ্ট্রপতি চাইলেও বিচারপতি থমাস ও আইনজীবী ফলি এস নরিম্যান সার্চ কমিটিতে যাননি। তাঁরা এই যুক্তিতে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন, যে প্রক্রিয়ায় তাঁদের বাছাই করতে বলা হচ্ছে, সেটাকে তাঁরা যথেষ্ট স্বাধীন মনে করেন না। এ বিষয়ে ভারতীয় মানের সঙ্গে আমরা কতটা পিছিয়ে, সেটা এ ঘটনা থেকে অনুধাবন করতে অনুরোধ করি। লোকপালের জন্য ভারতে প্রথমবারের মতো বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো। ৩০ দিনের ব্যবধানে প্রায় সাড়ে চার শ ব্যক্তি দরখাস্ত করলেন। সব প্রার্থীর পূর্ব বৃত্তান্ত ডিওপিটি সংগ্রহ করে সার্চ কমিটিকেও দিয়েছিল। এরপর আবারও নতুন করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে সার্চ কমিটি শর্ট লিস্ট করেছিল। আর সেটা যখন মিডিয়া প্রকাশ করতে বলল, তখন তা ডিওপিটি প্রকাশে অস্বীকার করল। এর বিরুদ্ধে তথ্য কমিশনে নালিশ করা হলো। প্রধান তথ্য কমিশনার রায় দিলেন, এটা প্রকাশ করতে হবে। তখন ডিওপিটি তা প্রকাশ করল। সব গণমাধ্যমে তা এল। আর তখন জানা গেল, লোকপাল চেয়ারপারসন হতে দরখাস্তকারী ১৬ জনের মধ্যে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের তিন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিও আছেন। তাহলে আমরা কেন এই উদাহরণ মেনে নামগুলো প্রকাশ করব না?
বিভিন্ন সূত্রমতে, আমাদের বর্তমান অনুসন্ধান কমিটি নাম প্রকাশ না করার পক্ষে যে যুক্তি দিচ্ছে বলে খবর পাই, সে ধরনের যুক্তি দিয়েছিল ডিওপিটি। প্রধান তথ্য কমিশনার রায় দিয়েছিলেন যে, এই গোপনীয়তা আইন সমর্থন করে না। আমাদের ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইনটি পরখ করে দেখার পর মনে হচ্ছে, এই আইন সার্চ কমিটির গোপনীয়তা বজায় রাখার অবস্থান সমর্থন করে না। তারা এখন ২০ নাম গোপন করলে তাতে আইনের ব্যত্যয় ঘটবে। এ থেকে রেহাই পেতে চাইলে তাদের দায়মুক্তি নিতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে ফোন করে জানতে পারি, তাঁরা এখনো সম্মত কার্যবিবরণী তৈরি করেননি। প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো প্রেসকে বলে দিচ্ছেন। আমরা বলব, এর নাম অ্যাডহক-ইজম। এ থেকে পরিত্রাণ চাই। তথ্য অধিকার আইনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসচিবের সঙ্গে কথা হয়েছে। গত বুধবার নাম জানতে চেয়ে ই-মেইলে দরখাস্ত করেছি। আইনে আছে, তারা ২০ কার্যদিবসের মধ্যে উত্তর দেবেন। সুতরাং ৮ ফেব্রুয়ারির আগে তাঁরা উত্তর না দিলে আইনের লঙ্ঘন হবে না। কিন্তু আইনের ব্যাখ্যা সুবিবেচনাপ্রসূত হলে প্রতিকার পেতেও পারি। সার্চ কমিটির অন্তত উচিত নামগুলো মন্ত্রিপরিষদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা।
প্রসঙ্গক্রমে এটাও বলি, উপযুক্ত ব্যক্তিদের নাম বাছাইয়ে অনুসন্ধান কমিটি মন্ত্রিপরিষদ সচিবকেই মুখপাত্র করেছে। কিন্তু তারা নিজেরা কেউ হননি। যদি কমিটির সদস্য কেউ হতেন, তাহলেই সেটাই সমীচীন হতো। এটা নীতিগত একটা প্রশ্ন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিশ্চয়ই যোগ্য। কিন্তু প্রশ্নটি যোগ্যতার নয়। সাচিবিক সহায়তা ও স্বাধীন কমিটির মুখপাত্র হওয়া এক বিষয় নয়। অনুসন্ধান কমিটির নজরে আমরা রুলস অব বিজনেসের বিধান আনছি। সেখানে বলা আছে, সরকার চাইলে যেকোনো সচিবকে সরকারের মুখপাত্র নিয়োগ করতে পারেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে মুখপাত্র করার ফলে অনুসন্ধান কমিটি সরকারি ছায়ার মধ্যে আছে। অথচ তারা চাইলেই নিজেদের মধ্যে কাউকে মুখপাত্র করতে পারে। অনুসন্ধান কমিটির মুখপাত্র জনগণের সঙ্গে কথা বলছেন। সরকারের সচিবকে মুখপাত্র রাখলে সরকারি গন্ধটাই প্রকট হয় না কি?
২০ জনের নাম প্রকাশ করা নিয়ে কমিটির কোনো সংকোচ দেখানো উচিত নয়। পাঁচজন বিশিষ্ট নাগরিককে প্রকাশ্যে ডাকা হয়েছে বলেই একজনের বিষয়ে তাঁর ফৌজদারি মামলাবিষয়ক তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। তাঁকে বাদ দেওয়া সহজ হয়েছে। এটা প্রমাণ করে যে, কমিটির পক্ষে সব তথ্য জানা সম্ভব হয় না। একই ধরনের ভুল তারা কমিশনার বাছাইয়ে করতে পারে না, তা তারা হলফ করে বলতে পারে না। নাম প্রকাশ করলেই তবে ঝুঁকি কমবে। স্বচ্ছতার দাবিও পূরণ হবে।
তবে যদি নাম প্রকাশ একান্ত না-ই করা হয়, তাহলে কমিটির সামনে একটি বিকল্প আছে। সেটি হলো কমিটির সভায় আমন্ত্রিত একজন শিক্ষাবিদের দেওয়া একটি ফর্মুলা। ওই ফর্মুলাটি হলো, কমিটি তাদের শর্ট লিস্ট আমন্ত্রিত নাগরিকদের কাছে প্রকাশ করবে। তখন তাঁরা (আমন্ত্রিতরা) প্রত্যেক প্রার্থীর বিষয়ে তাঁদের মতামত দেবেন। কিন্তু শর্ত দুটি। প্রথমত, তাঁরা মতামত দেবেন, কিন্তু তার নিচে তাঁরা সই করবেন না। দ্বিতীয়ত, এ-সংক্রান্ত মতামতের গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। আমন্ত্রিত বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের ওই সভায় তাৎক্ষণিক আরও একজন শিক্ষাবিদ এই ধারণাকে সমর্থন করেন। পরে আমন্ত্রিত আরও কয়েকজনের সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়েছে, তাঁরাও একমত হয়েছেন। নির্বাচন কমিশন যাঁদের নিয়ে হবে, তাঁদের সৎ, সাহসী ও যোগ্য হতে হবে—শুধু এ রকম পরামর্শ পাওয়ার জন্য বিশিষ্ট নাগরিকদের ডাকাডাকির দরকার নেই। স্বচ্ছতার স্বার্থে শর্ট লিস্ট প্রকাশ করাই বেশি কাম্য।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন