তিস্তা চুক্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্মতি ছাড়া করা যাবে না, এ বক্তব্য রাজনৈতিকভাবে সঠিক হতে পারে। কিন্তু এর কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। অথচ ভারতের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম এবং তাদের বরাত দিয়ে বাংলাদেশেও এ রকম একটি ধারণা চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশবিষয়ক ভারতীয় বিশেষজ্ঞ ড. জয়িতা ভট্টাচার্য হিন্দুস্তান টাইমস-এ (১০ ডিসেম্বর ২০১৬) লিখেছেন, ‘তিস্তা চুক্তি করতে মমতার সম্মতি অপরিহার্য। এমনকি ভারতের সংবিধানেও পানিকে রাজ্যের বিষয় হিসেবে তালিকাভুক্ত রাখা আছে।’ আমরা এভাবে ভারতের অন্যান্য গণমাধ্যমেও সংবিধানের এই ভুল ব্যাখ্যার ছড়াছড়ি দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে একই প্রতিফলন দেখে আরও বেশি দুঃখ লাগছে।
গত মঙ্গলবার চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের এক আলোচনায় আওয়ামী লীগের নেতা ও সাবেক সাংসদ অধ্যাপক আবদুল মান্নান যখন ওই ব্যাখ্যাই দিচ্ছিলেন, তখন আমি তাঁর সঙ্গে দ্বিমত করি। কিন্তু লক্ষ করলাম, পানি যে রাজ্য তালিকায় আছে, সেদিকেই তাঁর প্রবল আস্থা। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছা আছে, কেবল মমতার রাজ্য সরকারের বাধার কারণেই তাদের পক্ষে তিস্তা বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি করা যাচ্ছে না, এই ধারণার সঙ্গে আমরা একমত হতে পারি না। বাংলাদেশের টিভি টক শোর আলোচনায় যাঁরা ভারতের সংবিধান দেখাচ্ছেন, সেটা তাঁরা জেনে বা না জেনে অন্ধকে হাইকোর্ট দেখানোর মতো একটা কাজ করছেন বলেই মনে হয়।
বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি না করার পেছনে মমতা বা তাঁর রাজ্য সরকারের বিরোধিতা ও সংবিধানের দোহাই দেওয়ার বিষয়টি অগ্রহণযোগ্য। আমরা যদি এটা মেনে নিই যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চাইছে, কিন্তু সাংবিধানিক বাধার কারণে তারা রাজ্যকে পাশ কাটাতে পারছে না, তাহলে তাতে সত্যের অপলাপ ঘটে। উল্টো এতে আমাদের সরকারের দর-কষাকষির ক্ষমতা হ্রাস পায়। প্রকৃত সত্য হলো, পানি রাজ্য তালিকায় আছে, কিন্তু সেটা শুধু ভারতের অভ্যন্তরীণ পানিবণ্টন, আহরণ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এটা কোনোভাবেই কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন ও বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। পানি রাজ্য তালিকায় আছে, সে কথা লেখা ভারতীয় সংবিধানের একাদশ ভাগে। এই ভাগ শুরু হয়েছে ২৪৫ অনুচ্ছেদ দিয়ে, শেষ হয়েছে ২৬৩ অনুচ্ছেদ দিয়ে। পানি রাজ্য তালিকায় থাকার কথা বলা হয়েছে ২৪৬ অনুচ্ছেদে। কিন্তু এরপরই রাজ্যের হাত কাটার বিধান যুক্ত করা হয়। যার মানে দাঁড়ায়, পানি রাজ্যের বিষয় ঠিকই। কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক চুক্তি করা হবে, তখন রাজ্যের কিছুই বলার থাকবে না। তাই মমতার সম্মতি ছাড়া তিস্তা চুক্তি করা যাবে না, সেটা ভারতের সংবিধানের ২৫৩ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। এই অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘এই অধ্যায়ে পূর্ববর্তী বিধানাবলি যাহা কিছু আছে তৎসত্ত্বেও, অন্য কোনো দেশের বা দেশসমূহের সহিত কোনো সন্ধি, চুক্তি বা কূটনৈতিক অঙ্গীকার অথবা কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলন, পরিমেল বা অন্য সংস্থায় কৃত কোনো সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য ভারতের সমগ্র রাজ্য ক্ষেত্রের বা উহার কোনো ভাগের জন্য যেকোনো বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা সংসদের আছে।’ এই অনুবাদও আমার নয়, ১৯৮৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের দ্বারা বাংলায় ছাপা সংবিধান থেকে এটা নেওয়া। আসলে মমতার কাঁধে দায় চাপিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার যে দৃশ্যত একটা বিনম্র অপারগতা জানিয়ে চলছে, সেটা একটা মুখোশের মতো দাঁড়িয়ে গেছে, এর উন্মোচন দরকার।
ভারতের স্বনামধন্য সংবিধান বিশেষজ্ঞ দুর্গা দাস বসুর কমেন্ট্রি অন দ্য কনস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়ার অষ্টম সংস্করণ বেরিয়েছে ২০১১ সালে। লেক্সিস নেক্সিস প্রকাশিত চারজন বিচারপতি বইটি সম্পাদনা করেছেন। তাঁরা হলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সি কে ঠাক্কার, মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারপতি এস এস সুব্রামনি, মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারপতি টি এস দোয়াবিয়া ও কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি বিপি ব্যানার্জি। তাঁরা বইটির ৯ হাজার ১২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, আন্তর্জাতিক চুক্তি কার্যকরতার জন্য যেকোনো আইন প্রণয়নে ২৫৩ অনুচ্ছেদ কেন্দ্রীয় সরকারকে ক্ষমতা দিয়েছে।
বাংলাদেশের পক্ষে যাঁরা ভারতের সঙ্গে দর-কষাকষিতে যুক্ত আছেন, তাঁদের এটা জানা আছে কি না, জানি না। তাঁদের উচিত হবে আলোচনার টেবিলে মোদি কর্মকর্তাদের হাতে বসুর এই বইয়ের একটি কপি উপহার দেওয়া। ওই চার বিচারপতি তাঁদের ভাষ্যে বলেন, কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি কার্যকর করা কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে কঠিন হতে পারত (ইট উড হ্যাভ বিন ডিফিকাল্ট), যদি না সংবিধান কেন্দ্রীয় সরকারকে কোনো স্টেট সাবজেক্টের বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি করতে যোগ্যতাসম্পন্ন না করত।’ তাঁরা বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার এ ক্ষেত্রে রাজ্যের ওপর ‘ইনভেড’ বা হানা দিতে পারে। আর সেটা তত দূর পর্যন্ত, যতটা ভারতের আন্তর্জাতিক চুক্তি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার পূরণ করার স্বার্থে প্রয়োজন পড়ে। তিস্তা চুক্তি যদি ভারতের জাতীয় স্বার্থের জন্য অপরিহার্য বলে গণ্য হয়, তাহলে মোদিজির উচিত হবে ওই বিচারপতিদের মন্ত্র জপ করে পশ্চিমবঙ্গে একটা ‘হানা’ দেওয়া।
পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেছেন, ‘একাদিক্রমে ভারতের দুজন প্রধানমন্ত্রী (মনমোহন সিং ও নরেন্দ্র মোদি) তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ঘরোয়া আলাপচারিতায় নয়, প্রকাশ্যে অঙ্গীকার করেছেন।’ এটাই ভারতের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার। ১৯৯৭ সালে এস জগন্নাথ বনাম ভারত মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেন, সংবিধানের ৫১ অনুচ্ছেদ ‘আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার’ বাস্তবায়নকে সুরক্ষা দিয়েছে। ২০০৪ সালে স্টেট অব ওয়েস্ট বেঙ্গল বনাম কেশরাম ইন্ডাস্ট্রিজ লি. মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, আন্তর্জাতিক চুক্তি করলেই তা ভারতের প্রচলিত আইনে পরিণত হবে না, তাকে ওই ২৫৩ অনুচ্ছেদের আওতায় সংসদে পাস করাতে হবে। সুতরাং, কোনো মুখ্যমন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া ভারত তিস্তা চুক্তিই করতে পারবে না, এটা হাস্যকর যুক্তি।
অতিথি পাখি যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্যের তালিকাভুক্ত বিষয়। ১৯২০ সালে ইঙ্গ-মার্কিন পাখি চুক্তি হলো। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হলো। মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট মিজৌরি বনাম হল্যান্ড মামলার রায়ে বলেছেন, ‘প্রথমেই দেখতে হবে জাতীয় স্বার্থ। রাজ্যকে দেওয়া ক্ষমতা তার আয়তনের মধ্যে ক্রান্তিকালীন, এর কোনো স্থায়ী রূপ নেই। তবে অঙ্গরাজ্যের সম্মতি ব্যতিরেকে তার কোনো ভূখণ্ড বিদেশি রাষ্ট্রকে দেওয়া যাবে না।
ভারতের কার্নেগি সেন্টার গত অক্টোবরে ‘পুটিং দ্য পেরিফেরি অ্যাট দ্য সেন্টার: ইন্ডিয়ান স্টেটস রোলস ইন ফরেন পলিসি’ শীর্ষক ৩৪ পৃষ্ঠার একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। এটি তৈরি করেছেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক হ্যাপিমন জ্যাকব। জ্যাকব দেখিয়েছেন যে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে রাজ্যগুলোর ভূমিকার বিষয়ে সরব থাকা নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ‘স্টেট ডিভিশনস’ চালু করেন। এর শাখা চেন্নাই, গুয়াহাটি, হায়দরাবাদ ও কলকাতায় ইতিমধ্যে খোলা হয়েছে। এসব ভারতের ইতিহাসে নজিরবিহীন। মোদির কথা হলো, ‘টিম ইন্ডিয়া শুধু প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন দিল্লিতে থাকা একটি টিমকে বোঝাবে না, বরং মুখ্যমন্ত্রী এবং অন্যদেরও সেই টিমে সম-অংশীদার হিসেবে দেখা হবে।’ বাংলাদেশ মোদির এই ‘টিম’ নীতির মাশুল দিচ্ছে না তো?
তিস্তা সম্পর্কে জ্যাকবের মন্তব্য, ‘কীভাবে একটি ভারতীয় রাজ্য দুটি সার্বভৌম দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনাকে স্থগিত করে দিতে পারে, এটি তার একটি দৃষ্টান্ত।’ জ্যাকব স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে তামিলনাড়ুর কুদানকুলামে পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা। তবে মনমোহন সিংয়ের হস্তক্ষেপে তাঁকে উল্টো মোড় নিতে লক্ষ করা গিয়েছিল। জয়ললিতা তাঁরই নেতৃত্বাধীন আন্দোলন থামিয়ে রাশিয়াকে তাঁর রাজ্যে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
আরও দুটি ঘটনায় আমরা দেখি, বিদেশনীতিতে রাজ্যনীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কূটনৈতিক মাশুল দিয়েছে। ২০১২ সালে কেরালা উপকূলে দুজন ভারতীয় জেলেকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হন দুজন ইতালীয় নাবিক। তাঁদের বিচার ভারতের মাটিতেই হতে হবে বলে কেরালা বেঁকে বসে। কেরালার মুখ্যমন্ত্রী ওমেন চণ্ডী মমতার মতোই রাজ্যের স্বার্থ বড় করে দেখেছিলেন। ভেবেছিলেন, এ অবস্থান না নিলে তাঁরা রাজ্যের জনগণের রোষানলে পড়বেন। এর ফলে ভারত ও ইতালির মধ্যে কূটনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দিয়েছিল। নয়াদিল্লিকে এ জন্য কড়া মাশুল দিতে হয়। কারণ, ইতালি এর বদলা হিসেবে মিসাইল টেকনোলজি কন্ট্রোল রেজিম (এমটিসিআর)-এ ভারতকে ঢুকতে দেয়নি। বিষয়টি এখন হেগের আদালতে বিচারাধীন। অবশ্য ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অনেকে হয়তো ভাবেন, কমজোরি বাংলাদেশ তো এ রকম কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না!
শ্রীলঙ্কার সংখ্যালঘু তামিলদের পাশে দাঁড়াতেও তামিলনাড়ুর ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল একযোগে দাবি তুলেছিল। ২০১৩ সালের নভেম্বরে কলম্বোয় অনুষ্ঠেয় কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলন মনমোহন সিং বয়কট করেন। জ্যাকব লিখেছেন, ‘স্পষ্টতই রাজ্যের চাপে প্রধানমন্ত্রী সিং সেই সম্মেলন বয়কট করেন। যদিও তিনি জানতেন যে শ্রীলঙ্কাকে এভাবে বিচ্ছিন্ন করা হলে ভারতকে সে জন্য কৌশলগত খেসারত দিতে হতে পারে। কারণ তেমন পদক্ষেপ শ্রীলঙ্কাকে চীনের দিকে ঠেলে দেবে।’
সুতরাং, তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ধোয়া তুলসী পাতা, তার হাত-পা সংবিধান দ্বারা বাঁধাছাদা, সেটা সত্য হওয়ার নয়। কথায় কথায় শুধু মমতা বা একটি রাজ্যের ওপর দোষ চাপানোর যে হাওয়া-বাতাস, তার আসর থেকে নিজদের দূরে রাখতে আমরা যেন ব্রতী হই। জনপ্রিয় জননেত্রী মমতা আলবত রাজ্যের স্বার্থ দেখবেন। কিন্তু তিনি কি কখনো দেশের সংবিধান না মানার কথা বলেছেন? তিস্তা চুক্তি বিলম্বিত হওয়ার দায় দিল্লিকেই নিতে হবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন