প্রস্তাবিত বিলের খসড়া তৈরিতে অসদুপায় অবলম্বনের আসর থাকলেও থাকতে পারেপ্রস্তাবিত বিলের খসড়া তৈরিতে অসদুপায় অবলম্বনের আসর থাকলেও থাকতে পারে
প্রতিদিন গড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় কত লোক মারা যায়, তার সঠিক হিসাব কারও জানা নেই। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের পুরোধা ইলিয়াস কাঞ্চনের ধারণা, বছরে এখন মোটামুটি ১০ হাজার লোক মারা যায়। এই হিসাব সরকারি নয়। খবরের কাগজ ও অনলাইন থেকে সংকলিত। তবে হতাহতদের সব খবর পত্রিকায় আসে না। সেই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ২৭ ব্যক্তি মারা যায়। কিন্তু আপনি যদি বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি বিআরটিএর ওয়েবসাইট দেখেন তাহলে অবাক হবেন। সেখানে পুলিশের বরাতে ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ২ হাজার ৩৭৬ দেখানো আছে। ২০০৯ থেকে তাদের হিসাবে মৃত ব্যক্তির সংখ্যা কখনো ৩ হাজার ছাড়িয়ে যায়নি। বিআরটিএর কর্মকর্তারা সড়কে পড়ে থাকা লাশ গোনেন না। তাঁরা টাকা গোনেন। বিআরটিএ লোকবল-সংকটে ধুঁকছে। সারা দেশে মাত্র সাড়ে পাঁচ শ লোক কর্মরত। তঁাদের পরিচালনা বাজেট সাকল্যে আড়াই শ কোটি টাকা। কিন্তু তাঁরা বছরে সরকারকে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার রাজস্ব দিচ্ছেন। পরিবহন খাতের কোনো একটি মাঝারি কোম্পানির লোকবল এর চেয়ে বেশি হতে পারে। বিআরটিএর প্রশাসন তদারককারী অতিরিক্ত সচিব নাজমুল আহসান মজুমদার একবাক্যে লোকবল–সংকটের কথা স্বীকার করেন।
তাই বিআরটিএর যা লোকবল, তা যদি তঁারা লাশ গণনার কাজে লাগান, তাহলে এতটা বিপুল স্ফীত রাজস্ব সংগ্রহ অভিযান বাধাগ্রস্ত হতে পারে! রাজস্ব স্ফীতির সঙ্গে কি লাশের স্ফীতির কোনো যোগসূত্র আছে? ফেব্রুয়ারি মাসের কথাই ধরা যাক। কাঞ্চনের মতে, গত কয়েক বছরের মধ্যে ফেব্রুয়ারি মস্ত ব্যতিক্রম। কারণ এ মাসটি সড়কে প্রায় ৫০০ মৃত্যু দেখেছে। কিন্তু তাই বলে এ নিয়ে কোথাও কোনো শোরগোল পড়েনি। এই ৫০০ লোক যদি একসঙ্গে কোথাও মারা যেতেন, তাহলে তঁারা আন্তর্জাতিক খবরের শিরোনাম হতেন, ভুক্তভোগী পরিবারের লোকেরা কিছু না কিছু ক্ষতিপূরণ পেতেন। মন্ত্রিসভায় সড়ক বিলের খসড়া পাসের পর খোঁজখবর নিয়ে যা জানলাম, তা অনুশোচনীয়। শুধু লাশের সংখ্যাই নয়, দেশজুড়ে বিআরটিএর যা লোকবল, তা দিয়ে গাড়ির সুষ্ঠু তদারকি দূরে থাকুক, এর সংখ্যা গণনা করাও কঠিন। সুতরাং এই লোকবল ও ব্যবস্থাপনা দিয়ে একটি আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে বাস-ট্রাকসহ ২০ ধরনের যানবাহনের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ লাখ। এরপর গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেটা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ (২৯ লাখ ৪৮ হাজার ৯০৬) হয়েছে। অথচ এই গাড়িগুলোর তদারকির জন্য এখন অনুমোদিত পদের সংখ্যা ৮২৩টি। এর মধ্যে পরিদর্শক ও সহপরিদর্শকের পদের সংখ্যা ৪০০। কিন্তু বাস্তবে প্রায় আড়াই শ পদ শূন্য রয়েছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, বিআরটিএর একজন কর্মী গড়ে পাঁচ হাজারের বেশি যানবাহন তদারকি করছেন। উত্তরবঙ্গের একটি জেলার এক তরুণ পরিদর্শকের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করলাম। তিনি দুটি জেলা চালান একজন সহকারী দিয়ে। পলিটেকনিক থেকে পাস করে চাকরিতে ঢোকার পর গত দুই বছরে তিনি ছুটিতে যাননি। সুতরাং তাঁরা যে লাশের সংখ্যা গণনা করতে অপারগ থাকছেন, সে জন্য তাঁদের খুব দোষ দেওয়া যায় না। আমরা মনে করি, একটি ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় সড়ক নীতি প্রণয়ন এবং উপযুক্ত জনবল ও লজিস্টিকস সহায়তা ছাড়া প্রস্তাবিত আইন কার্যকররূপে বাস্তবায়ন করা যাবে না।
ইলিয়াস কাঞ্চন জানালেন, গত ডিসেম্বরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) তিনজন বিশেষজ্ঞ ঢাকায় ওই আইন প্রণয়নের খসড়া তৈরির বিষয়ে কতিপয় অভিমত দিয়েছিলেন। তখন তাঁরা সড়ক পরিবহন আইনের শিরোনামে রোড সেফটি বা ‘সড়ক নিরাপত্তা’ কথাটি যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এর সঙ্গে জাতীয় সড়ক নীতির একটা প্রতিফলন থাকতে হবে। কিন্তু সরকারি নীতিনির্ধারকেরা সেটা চাইছেন না। আমাদের দেশে প্রায় সবকিছুই অ্যাডহক ভিত্তিতে চালিয়ে নেওয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে। আর সেটা এ ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাই। তবে যা বড় পরিতাপের এবং সাংসদেরা যে কত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় গত ৪৫ বছরে সংস্কারের স্পর্শ দিতে পারেননি, তার বড় প্রমাণ এই সড়ক খাত। এবারও তাঁরা যে মন্ত্রিসভায় বিলটি পাস করলেন, তারও একটি বাধ্যকর রাজনৈতিক কারিগরি দিক আছে। এটি যদি ১৯৮৩ সালের সামরিক আইনের বিষয় না হতো, তাহলে এই বিলের খসড়া এখনো পাস না হলে অবাক হতাম না। সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিলেন যে সব সামরিক ফরমান অবৈধ। তাই সামরিক অধ্যাদেশগুলোকে সরকার ধীরে ধীরে আইনে রূপ দিচ্ছে। কিন্তু সংসদ বা বিআরটিএ তার প্রতিষ্ঠার তিন দশকেও গুরুত্বপূর্ণ বিধিগুলোতে যথা পরিবর্তন বা তার কোনো নির্ভরযোগ্য বাংলা পাঠ করেনি।
১৯৩২ সালের বেঙ্গল মোটর ভেহিক্যাল ট্যাক্স অ্যাক্ট, ১৯৬৬ সালের ইস্ট পাকিস্তান মোটর ভেহিক্যাল ট্যাক্স রুলস যুগোপযোগী কোনো সংশোধনী ছাড়াই টিকে আছে। ১৯৪০ সালের মোটর ভেহিক্যাল রুলসের একটা বড় সংশোধনী আনা হয়েছিল ১৯৮৪ সালে, তারও তরজমা হয়নি। গত ২৭ মার্চ মন্ত্রিসভায় পাস হওয়া বিলের যে খসড়াটি ওয়েবসাইটে ছিল, সেটি আমরা দেখেছি। মূল আইনটি ১৯৩৯ সালের। আর সেটা তাই ইংরেজিতেই। অন্যান্য আইনের মতোই ব্রিটিশরা ১৯৩৯ সালের আইনটিও খুবই যত্ন নিয়ে করেছে। ওই আইনটিই ঈষৎ বদলে ১৯৮৩ সালে অধ্যাদেশের টিপ পরানো হয়। এটির মোট ধারা ১৭৭। অথচ খসড়া যেটি দেখলাম সেটিতে মাত্র ৭২টি ধারা দেখছি। সংক্ষেপ হয়তো করা যায়। কিন্তু তাই বলে কী করে এক শর বেশি ধারা অপ্রাসঙ্গিক হতে পারে? সরলীকরণের নামে এতটা বাড়াবাড়ি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯৩৯ সালের আগে তৈরি করা বহু ব্রিটিশ আইন আমরা আজও অবিকল অনুসরণ করে চলেছি। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি এবং ১৮৯৮ সালের সিআরপিসি তার প্রমাণ।
আমরা আগেও উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছি যে আইনের খসড়া তৈরিতে অসহনীয় গুরুচণ্ডালী ঘটেছে। বাংলায় আইন করতেই হবে। কিন্তু মনে হচ্ছে, এটা করতে গিয়ে খসড়া তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কাঁচা হাতের আস্ফালন বাড়ছে। সংসদের হ্যাঁ জয়যুক্ত হওয়ার ধ্বনির মধ্যে তা চাপাও পড়ছে। অস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থক আইনের তাৎক্ষণিক খারাপ প্রতিক্রিয়া পরিমাপ করা সম্ভব নয়। কিছুদিন আগে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেছিলেন, ‘আইনের অস্পষ্টতার কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে হাজার হাজার রিটের উদ্ভব ঘটেছে।’ আইন তৈরিতে অদক্ষতাই নয়, কিছু ক্ষেত্রে উদ্দেশে্যর সততা নিয়ে সন্দেহ হয়।
গত সংসদে সন্ত্রাস দমনসংক্রান্ত একটি আইনে জাতিসংঘের একটি প্রটোকল যুক্ত করা হয়েছে। এমনভাবে এর তরজমা করা হয়েছে যা ভুল ও বিভ্রান্তিকর। এ থেকে বাঁচতে হলে যেটা করা দরকার, সেটা হলো সংসদে একই সঙ্গে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় আইন পাস করা। সংসদের ঘুমন্ত ড্রাফটিং উইংকে জাগিয়ে তোলা। প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন বিলে বলা হয়েছে, এই আইন প্রবর্তনের পরে সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা এই আইনের ইংরেজিতে অনূদিত একটি নির্ভরযোগ্য পাঠ প্রকাশ করবে। বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে বাংলা প্রাধান্য পাবে। ১৯৮৭ সাল থেকে বাংলায় আইন তৈরি করা হচ্ছে। যেসব আইনে ইংরেজি পাঠের বিধান রাখা হয়েছে, তা পরে হয়নি। ২০০৬ সালের রাসায়নিক অস্ত্রসংক্রান্ত আইনের ইংরেজি পাঠ আমরা এখনো পাইনি।
আমাদের পরিবহন খাতের আইনি বিষয়গুলো বিআরটিএতে যিনি দেখেন, তিনি এই দায়িত্বে দুই দশকের বেশি সময় ধরে যুক্ত আছেন। বললাম, আমাদের চালক ও কন্ডাক্টর, এমনকি বাস-ট্রাকের মালিক বা তাঁদের পক্ষে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা ইংরেজি বোঝেন না, অথচ সবটাই ইংরেজি করে রেখেছেন কেন। তিনি অবশ্য বললেন, এর অনেকটা বাংলা পাঠ বাজারে সহজলভ্য। যদিও তা ‘অনুমোদিত’ নয়। আমরা বিলের বাংলা বিধানের সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে মূল আইনের ইংরেজি মিলিয়ে দেখলাম, কিছু ক্ষেত্রে এমন তরজমা করা হয়েছে যা দুর্ভাগ্যজনক। এসব অনুবাদ মামলার সংখ্যা বাড়ানো ও বিচারকার্যকে জটিল করতে ভূমিকা রাখছে।
সে কারণে আমরা আশা করব, প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন বিলের ইংরেজি তরজমা যাতে একই সঙ্গে সংসদে উপস্থাপন করা যায়, সে ব্যাপারে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এর ফলে আশা করা যায়, বাংলা ও ইংরেজি উভয় পাঠের খসড়া উন্নততর হবে। প্রস্তাবিত বিলটির কিছু বিধান সিআরপিসি ও দণ্ডবিধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। মোবাইল কোর্টের আড়ালে আবারও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা এই আইনে বিচারে ভাগ বসিয়েছেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা হরদম সংবিধানের বিচ্যুতি ঘটিয়ে অন্যায্য বিচার করছেন। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা মোবাইল কোর্ট আইনে অনধিক দুই বছর জেল দিতে পারেন। প্রস্তাবিত বিলে আছে, কোনো ড্রাইভার তাঁর অপরাধের জন্য তিন বছর শাস্তি পাবেন। অথচ মোবাইল কোর্টের এখতিয়ার দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, এই আইনে (সড়ক পরিবহন) অন্য যা-ই থাকুক না কেন, এই ‘আইনের অপরাধসমূহ’ এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বিচার করবেন। এই বিধান পাস হলে একটা গোঁজামিল তৈরি হবে। আইনে থাকবে তিন বছর, আমলারা জেল দেবেন সর্বোচ্চ দুই বছর।
খুব চেনাজানা একজন অভিজ্ঞ সাবেক জেলা জজের কাছ থেকে একটা বাস্তব গল্প শুনে ব্যথিত হলাম। আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ড্রাফটিং উইংয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তা, যাঁকে আমি একজন দক্ষ ও চৌকস কর্মকর্তা হিসেবে জানতাম, তাঁর বিষয়ে তিনি একটি চমকপ্রদ তথ্য দিলেন। বললেন, এক-এগারোর ট্রুথ কমিশনে তিনিই একমাত্র ড্রাফটিং কর্মকর্তা, যিনি লিখিতভাবে তাঁর দোষ স্বীকার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তিনি স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থ রক্ষায় দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন। ওই বন্ধুটি আমাকে আরও বলেছেন, তিনি তাঁর চাকরিজীবনে কোনো কোনো আইন তৈরির সময় সংশ্লিষ্ট বেসরকারি খাতের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সচিবালয়ে সন্দেহজনকভাবে ঘুরঘুর করতে দেখেছেন।
আমরা আশঙ্কা করি, প্রস্তাবিত বিলের খসড়া তৈরিতে বিশেষ কোনো শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা থাকতে পারে। কারণ এতে জনগুরুত্বসম্পন্ন এমন কতগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধানাবলি, দৃশ্যত মালিকপক্ষের স্বার্থে বাদ দেওয়া হয়েছে, যা ছিল সংবেদনশীল জনস্বার্থের মৌলিক রক্ষাকবচ। এর একটা প্রমাণ হলো, ভারত ৫০ বছর ধরে ক্ষতিপূরণের মতো বিধানাবলি, তাদের আইন কমিশনের সুপারিশে ক্রমাগতভাবে সম্প্রসারিত ও সুনির্দিষ্ট করেছে। অথচ আমাদের মন্ত্রিসভা তা বাদ দিয়েছে। বিলের খসড়া তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের একজনের প্রশ্নের জবাবে প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘ওহ, হ্যাঁ বিষয়টি সম্ভবত বাদ পড়েছে! তবে এর দরকার ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে!’
ব্যাপকভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই ছাড়া প্রস্তাবিত বিলটি পাস করা হবে না, সেটাই আমরা আশা করব।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
উৎসঃ প্রথম আলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন