সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক নিয়োগের বিষয়ে পাওয়া নতুন রায় বিচারক নিয়োগে সংবিধান সংশোধন বা সংসদে একটি আইন তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা পূরণ করেনি। তবে এই রায়ে অ্যামিকাস কিউরিদের মন্তব্যে এবং রায়ের পর্যবেক্ষণে যে চিত্র ফুটেছে, তা হলো উপযুক্ত এবং যোগ্যতম প্রার্থী খুঁজে বের করার দায় নিরঙ্কুশভাবে প্রধান বিচারপতির। তিনি ‘যদি’ চান, তাহলে আপিল বিভাগ বা হাইকোর্ট বিভাগের অন্তত দুজন করে জ্যেষ্ঠ বিচারক যুক্ত করবেন। ১০ বিচারকের মামলায় প্রধান বিচারপতির মতামত তৈরিতে এই বিধান বাধ্যতামূলক করেছিলেন হাইকোর্ট বিভাগের বৃহত্তর বেঞ্চ। কিন্তু পরে আপিল বিভাগের রায়ে তা সরাসরি অনুমোদন পায়নি।
নতুন রায়ে বিচারক বাছাইয়ে চার মূলনীতির প্রতি সংকল্প, সততা ও মেধাবী শিক্ষাজীবন ও ৪৫ বছরের ন্যূনতম বয়সসীমার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া প্রধান বিচারপতির নজর কাড়তে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে সম্ভাব্য প্রার্থীর জীবনবৃত্তান্ত প্রকাশ করার একটা ধারণা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে আপিল বিভাগের তালিকাভুক্ত আইনজীবীদের অগ্রাধিকার দিতে। অধস্তন আদালতের বিচারকদের মধ্য থেকে অন্তত তিন বছরের জেলা জজিয়তি থাকার যে সুপারিশ রাখা হয়েছে, তার থেকে জেলা জজদের জ্যেষ্ঠতার তালিকা অনুসরণ উত্তম। সর্বোপরি বিচারক পদ গ্রহণে উৎসাহিত করতে বেতন আকর্ষণীয় করার যে ভাবনা, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যোগ্যতম ও মেধাবীদের টানতে বিদ্যমান আর্থিক সুবিধা বড় বাধা। আদালত বলেছেন, কাউকে বিচারক পদে প্রধান বিচারপতির সুপারিশের পর সরকারি তরফে আর ‘অননুমোদন’ বা ‘আপত্তির’ অবকাশ নেই, যদি তঁার সুপারিশ করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রবিরোধী বা সমাজবিরোধী ধ্বংসাত্মক তৎপরতায়’ লিপ্ত হওয়ার বিষয় না থাকে। প্রশ্ন হলো, সরকারের অপছন্দের ব্যক্তির বিরুদ্ধে এ রকম কোনো অভিযোগ তোলা হলে তার নিষ্পত্তি কে করবে?
এই রায় আমরা পেলাম এমন একটি মুহূর্তে যখন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এবং নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার বিচারক বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে অর্থপূর্ণ আলোচনায় যোগ দিয়েছে। এর আগে সুপ্রিম কোর্ট ৯৯তম সংশোধনীতে বিচারক নিয়োগে সরকারের বক্তব্য থাকার বিধানসংবলিত জুডিশিয়াল কমিশন বাতিল হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। আগে প্রধান বিচারপতি ও চার জ্যেষ্ঠ বিচারকের কলেজিয়াম কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করতেন, তা খুব স্পষ্ট ছিল না। এখন উভয় পক্ষই মেমোরেন্ডাম অব প্রসিডিউর (এমওপি) নিয়ে কথা বলছেন। ভারতীয় আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে থাকা বিদ্যমান এমওপি দেখাচ্ছে কী করে বিদায়ী প্রধান বিচারপতির সুপারিশে জ্যেষ্ঠতমকে প্রধান বিচারপতি করা হয়। জ্যেষ্ঠতমকে প্রধান বিচারপতি করতে ভারত ও পাকিস্তানের আদালত লিখিত বিধান কার্যকর করতে পারলেও আমরা পারিনি। এমনকি এখানে কোনো আলোচনা পর্যন্ত নেই। বিচারকের পদ কয়টি সেটা নির্দিষ্ট আছে ভারত ও পাকিস্তানে, আর শূন্য হলেই প্রাথমিক তালিকাটা আদালত থেকে সরকারের কাছে যায়। এখানে অ্যাটর্নি জেনারেল ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন এবং সংশ্লিষ্টরা মেনে চলছেন যে, পদের সংখ্যা নির্দিষ্ট করা লাগবে না। এটা সরকার ঠিক করবে। হাইকোর্টের নতুন রায় বলছে, ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ বলে সরকার চিহ্নিত করলে প্রধান বিচারপতির সুপারিশ অগ্রাহ্য হতে পারে। আর ভারতে এমওপিতে এই বিধান ঢোকাতে লড়াই চলছে। সরকারের এই শর্তে সুপ্রিম কোর্ট রাজি হলেও তঁারা পাল্টা শর্ত দিয়েছেন এবং সরকার সেটা মেনেছে। আর তা হলো প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন কলেজিয়ামের কাছে নির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা দিতে হবে। কাউকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ চিহ্নিত করার ব্যাখ্যায় সুপ্রিম কোর্ট সন্তুষ্ট না হলে সুপারিশকৃত ব্যক্তিকেই বিচারক নিয়োগ দিতে হবে। এটাই সঠিক অবস্থান। সুতরাং এ বিষয়ে হাইকোর্টের অস্পষ্ট ও সংক্ষিপ্ত অভিমত পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
হাইকোর্টের নতুন রায়ে প্রধান বিচারপতিকেন্দ্রিক নিয়োগ রীতির বিষয়ে ভারত ও পাকিস্তানকে উদাহরণ হিসেবে দেখানো হলেও প্রকৃত চিত্র কিন্তু ভিন্ন। এই দুটি দেশই নিয়োগ পদ্ধতিটি একদা যেখানে নিরঙ্কুশভাবে প্রধান বিচারপতিনির্ভর ছিল, তারা তা তাদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বিসর্জন দিয়েছে। এই অগ্রগতি এবং তার বিস্তারিত বিবরণ আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ রায়ে উল্লেখিত হবে, যথাসিদ্ধান্ত হবে, সেই আশায় থাকলাম।
২০১০ সালে যখন আমরা ১০ বিচারকের মামলায় আপিল বিভাগ থেকে একটা অস্পষ্ট গাইডলাইন পেয়েছি, তখন পাকিস্তানে ১৮তম সংশোধনী এনে সংসদ ও সিনেটে শুনানিনির্ভর নিয়োগ পদ্ধতি চালু হয়েছে। সেখানে সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রাথমিক নামের তালিকা ভারতীয় কলেজিয়ামের মতোই প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন একটি জুডিশিয়াল কমিশন সরকারকে দিচ্ছে। আর বাংলাদেশের নির্বাহী বিভাগ এই চিন্তা ধারণই করতে পারছে না।
পাকিস্তানের কমিশন কীভাবে কাজ করবে, সেই বিষয়ে ভারতের এমওপির মতো একটি বিধি পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। প্রতিটি সভা রুদ্ধদ্বার কক্ষে হলেও তার কার্যবিবরণী লিখিত আকারে মিলছে। আমাদের প্রধান বিচারপতি কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সাত বিচারকের নাম সরকারের কাছে গত বছর পাঠিয়েছিলেন, তা আমরা জানি না। সরকার কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে চাইছে, তাও আমরা জানি না।
ভারত ও পাকিস্তান থেকে শিক্ষার বিষয় হলো, প্রধান বিচারপতিকে মুখ্য জায়গায় রেখেই বাছাই প্রক্রিয়াকে গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করার চেষ্টা করা হয়েছে। হাইকোর্টের নতুন রায়ে ভারতের ১৯৯৩ সালের যে রায়ের বরাত দেওয়া হয়েছে, সেই রায়ে বাছাইয়ে প্রধান বিচারপতিনির্ভরতা বেশি ছিল। কিন্তু ১৯৯৮ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি যখন রেফারেন্স পাঠালেন, তখন সুপ্রিম কোর্ট কলেজিয়াম তৈরি করলেন। বললেন, প্রধান বিচারপতির এক মাথার চেয়ে বহু মাথা ভালো। এখন পাঁচ সদস্যের কলেজিয়াম প্রাথমিক তালিকা তৈরি করে সরকারকে তাদের বিষয়ে পূর্ব বৃত্তান্ত (গোয়েন্দা তথ্য) দিতে বলছেন।
পাকিস্তানের নয় সদস্যের জুডিশিয়াল কমিশনে অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রীকে রাখা হয়েছে। তারপরও সরকারের প্রতিনিধিরা সংখ্যালঘু। আবার প্রধান বিচারপতি যাতে কর্তৃত্ববাদী হতে না পারেন, সেই বিষয়ে যথাযথ রক্ষাকবচ তৈরি করা হয়েছে। যেমন প্রধান বিচারপতি একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি বা অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে কমিশনে দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেবেন। কিন্তু সে জন্য তিনি কমিশনের অপর চার জ্যেষ্ঠ বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করবেন।
এই যখন ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থা, তখন আমাদের হাইকোর্টের রায় পড়ে আমরা ভাবতে বসেছি, এ বিষয়ে আমাদের আরও কত বেশি আলাপ-আলোচনা ও উপলব্ধির দরকার আছে। আমরা কেন একজন প্রধান বিচারপতির কাঁধেই এত বড় গুরুদায়িত্ব পালনের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছি। তিনিই বা সেটা কেন নেবেন। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ব্যক্তিগতভাবে আদালতে বক্তব্য দিয়েছেন। এটা আমাদের বিস্মিত নয়, আহত করেছে। তাঁর যুক্তি: শূন্যতা দেখার দায় সরকারের। কাকে নিয়োগ করা হবে, সেটা সরকারের নিরঙ্কুশ বিশেষ অধিকার, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতি কীভাবে সন্তুষ্ট (প্রধানমন্ত্রী) হবেন, তাই সংবিধান বলেছে। তাঁর অগ্রহণযোগ্য আরেকটি যুক্তি: দেশে আইনজীবী ও জেলা জজের আকাল পড়েনি। তাই সংসদের পক্ষে ৯৫ (২ক) অনুচ্ছেদমতে, অতিরিক্ত যোগ্যতা নির্ধারণী কোনো আইন পাসের দরকার পড়েনি। যখন সাংসদেরা মনে করবেন, তখন আইন হবে। তাঁর যুক্তি সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে যখন তিনি বলেন, ‘প্রধান বিচারপতির সুপারিশ না থাকলে, প্রেসিডেন্ট তাঁকে নিয়োগ দেবেন না।’ প্রধান বিচারপতির সুপারিশ থাকলেই রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন, তা তিনি বলেননি। সাবেক আইন উপদেষ্টা হাসান আরিফ ‘প্রধান বিচারপতির পরামর্শে’ আস্থা জ্ঞাপন করেছেন। সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ আরও এক ধাপ ওপরে উঠে প্রধান বিচারপতির ‘নিরঙ্কুশ এখতিয়ারের’ কথা বলেছেন। ড. কামাল হোসেনও এক শতাব্দী ধরে এই উপমহাদেশে ‘প্রধান বিচারপতির পরামর্শের’ ওপর জোর দেন। ব্যারিস্টার রোকন উদ্দীন মাহমুদও বলেছেন, প্রধান বিচারপতির পক্ষেই যোগ্য আইনজীবী ও জেলা জজ কে, তা জানা সম্ভব। আমরা একটি এমওপি এবং কলেজিয়াম ব্যবস্থা চাই।
আমরা বিশ্বাস করি, এটা বিবেচনার বিষয় যে ভারতের বিচারপতি ও আইনজীবীরা যে বাস্তবতায় শুধু প্রধান বিচারপতিনির্ভর একটা ব্যবস্থার কথা বলতে বলতে কেন তাঁরা কলেজিয়ামের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। আমাদের জানামতে ভারত ও পাকিস্তানের কোনো প্রধান বিচারপতি কলেজিয়াম ব্যবস্থার বিপক্ষে মন্তব্য করেননি। নতুন রায় থেকে দেখা গেছে এবং বাস্তবেও পরিষ্কার যে একটি জাতির জীবনে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলেও রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ এ বিষয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে মুখোমুখি হতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে। কারণ, রিটে সরকার ও আদালত সংশ্লিষ্ট যাঁদের বিবাদী করা হয়েছে, তাঁরা কেউ শুনানিতে অংশ নেননি।
রিটের দরখাস্তকারী যথাক্রমে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির বক্তব্য শুনতে আইনসচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, মন্ত্রিসভা সচিব এবং সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে বিবাদী করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা কেউ আদালতে আইনজীবী পাঠিয়ে বক্তব্য দেননি। এই ঘটনায় বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ যথার্থই ‘ইস্যুজ অব কন্ট্রোভার্সি’ নিরসনে বিবাদীদের অনুপস্থিতিকে ‘দুঃখজনক’ বলে বর্ণনা করেছেন। শুধু দুঃখজনক নয়, একটি জাতির জীবনে এমন ঘটনা বিস্ময়কর।
রায়ে আদালত রিট আবেদনকারীর বরাতে দলীয় ও অযোগ্য ব্যক্তিদের বিচারালয়ে প্রবেশের প্রশ্নে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।
আবার বলেছেন, ‘সন্দেহাতীতভাবে এটা বলা যায় যে প্রধান বিচারপতির দ্বারা সুপারিশের বিদ্যমান প্রক্রিয়া ন্যায্য ও স্বচ্ছ।’ আদালত আরও মন্তব্য করেছেন, বিদ্যমান বিচারক বাছাই প্রক্রিয়াকে আরও উন্নত করার সুযোগ রয়েছে। আসলে আমরা তো কোনো একটি সম্মত প্রক্রিয়া শুরু করতেই পারিনি। ২০১০ সালে দেওয়া ১০ বিচারকের মামলায় আপিল বিভাগের রায় হলো, প্রার্থীর লিগ্যাল অ্যাকুমেন বা আইনি প্রজ্ঞা এবং পূর্ব বৃত্তান্ত যথাক্রমে প্রধান বিচারপতি ও সরকার দেখবে। রায়ে বলা ছিল, বাছাইয়ের প্রতিটি ধাপের লিখিত রেকর্ড থাকবে।
এটা লক্ষণীয় যে বিচারক নিয়োগে সরকারের অগ্রহণযোগ্য অবস্থানটা খুবই পরিষ্কার। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের অবস্থানও কি খুব পরিষ্কার? বিচারক নিয়োগসংক্রান্ত একটি রায় থেকে অন্য একটি রায়ের মধ্যে পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জোরালো রূপ এবং দোদুল্যমানতা আমরা তো অস্বীকার করতে পারি না। ভারত ও পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে যে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন, সেটা আমরা বাংলাদেশে কেন আশা করতে পারি না? আমরা কোথায় আছি?
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন