|
মিজানুর রহমান খান
mrkhanbd@gmail.com |
|
বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতায় বাজেটের খড়্গ
06 June 2017, Tuesday
বিচার বিভাগের বাজেটে ও বিচারকদের বেতন-ভাতায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দেখার কোনো লক্ষণ যে নির্বাহী ও আইনসভার মধ্যে নেই, সেটা বেশ পরিষ্কার। কিন্তু তাই বলে সুপ্রিম কোর্টের বাজেট ২০১৬-১৭ অর্থবছরের চেয়ে মাত্র ১০ কোটি টাকা বেশি প্রস্তাব করা হবে? বাজেটে অর্থমন্ত্রী অনুমিত মূল্যস্ফীতি ধরেছেন সাড়ে ৫ শতাংশ। সেটা বিবেচনায় নিলে সুপ্রিম কোর্টের জন্য কোনো বরাদ্দ বাড়েনি। দেশের বয়স ৪৫ বছর হলেও বিচার বিভাগের বাজেট তৈরিতে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে কার্যকর পরামর্শ গ্রহণের কোনো চিন্তাভাবনা পর্যন্ত নেই, সেটাই বড় দুঃখের। এটা শুরু করতে হবে।
অনেকে এই প্রসঙ্গে বর্তমান প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সরকারের বিরল টানাপোড়েন স্মরণ করতে পারেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এটা এই রাষ্ট্রের স্বভাবের সঙ্গে জড়িত। শাসকেরা কখনোই বিচার বিভাগের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করতে চাননি, তাই এখনো চান না। এটা অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে আগামী ফেব্রুয়ারিতে যখন আমরা নতুন প্রধান বিচারপতি পাব, তখনো এই ধারার কোনো পরিবর্তন হবে না। তবে সময় এসেছে এ কথা বলার যে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে ইতিমধ্যে এমন সব দলিলপত্রে সই করেছে, যাতে বিচার বিভাগের স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে তার আর্থিক স্বাধীনতার কথাও স্বীকার করা হয়েছে।
ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে একটা তুলনা করতে চাই। তার আগে বলে নিই, এই রাষ্ট্র এখনো ভাবতেও পারেনি যে অধস্তন আদালতের বাজেট নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে কথা বলা দরকার। এমনকি বিচার বিভাগ পৃথক্করণ হওয়ার পরেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। কোনো আইনজীবী সমিতি, যারা যথারীতি নীল ও সাদায় বিভক্ত, তারাও এ নিয়ে অদ্যাবধি টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করেনি।
নতুন বাজেটে চার লাখ মামলার ভারে জবুথবু সুপ্রিম কোর্টের জন্য কোনো প্রকল্প রাখা হয়নি। বর্তমান সংস্কারমুখী প্রধান বিচারপতির আমলে অবকাঠামোগত কোনো বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি। সামনে দ্রুত হবে, তারও আলামত দেখি না। ই-জুডিশিয়ারি ভারতসহ বিশ্বের সর্বত্র ব্যাপকভাবে বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে। আমরা শুরু করতে পারিনি। বর্তমান প্রধান বিচারপতি ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার প্রকল্প আইসিটি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করাতে চেয়েছিলেন, একনেক আটকে দিয়েছে। আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় বলেছে, আইসিটি নয়, এটা তারাই করবে। কিন্তু যারাই করুক, বাজেটে তো বরাদ্দ থাকতে হবে। বাজেটে বরাদ্দ রাখা হলো না কেন? অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতায় ডিজিটাল বিপ্লবের আওয়াজ আছে, সেখানে ই-জুডিশিয়ারি নেই। ৩২৪ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনিক ভবন নির্মাণের প্রস্তাবও একনেক থেকে ফেরত এসেছে। প্রি-একনেক থেকে ফেরত এসেছে মাত্র ১৮ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ বিচারকদের জন্য বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণের একটি প্রস্তাব। এবার একনেক থেকে ৪০টি নতুন হাইকোর্ট বেঞ্চ বসার উপযোগী ১৫৫ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ ‘এনেক্স ভবন টু’ নির্মাণের প্রস্তাবও ফিরে এসেছে।
বিচারকের সংখ্যা নির্ধারণ করতে না চাওয়ার অর্থ হচ্ছে, এই রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বিচারিক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। পদ্ধতিগতভাবে বিচারক নিয়ন্ত্রণে বিশ্বাসী বলেই তারা জনসংখ্যা ও মামলার অনুপাতে বিচারকের সংখ্যা নির্দিষ্ট করতে বিশ্বাসী নয়। গত অর্থবছরে সুপ্রিম কোর্টের জন্য বাজেট বরাদ্দ ছিল ১৫৫ কোটি টাকা। এর সবটাই বেতন-ভাতাসংক্রান্ত। সংশোধিত বাজেটে ১৩ কোটি টাকা বেড়েছে, সেটা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আরও ৩ কোটি টাকা কমিয়ে ১৬৫ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। অবশ্য একজন কর্মকর্তা বলেছেন, গত ৮ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভায় সুপ্রিম কোর্টের প্রতিনিধির সঙ্গে সরকার আলোচনা করেছিল। সুপ্রিম কোর্ট নতুন অর্থবছরে ২০৩ কোটি টাকা দাবি করেছিলেন, তারা ১৮৮ কোটি টাকা দিতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে, ২৩ কোটি টাকা কম। পরে যদি ১৮৮ কোটি টাকাও হয়, তাহলে তা কতটা পর্যাপ্ত বাজেট, সেটা একটা জ্বলন্ত প্রশ্ন থেকে যাবে।
বাজেটে সুপ্রিম কোর্ট এবং আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ পৃথকভাবে দেখানো হয়। অধস্তন আদালত পরিচালনার বাজেট আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দেখানো হয়। এর অর্থ এই টাকা খরচে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শের দরকার নেই। বলা বাহুল্য, এর মধ্যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় সরকারের হস্তক্ষেপের মনোভাব স্পষ্ট।
আইন ও বিচার বিভাগের জন্য আগের অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে আরও কমে সেটা ১ হাজার ৪২৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। নতুন অর্থবছরে ১ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট, আইন ও বিচার বিভাগের বাজেট যোগ করলে যদি বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ ধরা হয়, তাহলে সেটা হবে ১ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা। আমাদের দেশের ইতিহাসের বৃহত্তম বাজেটটি টাকার অঙ্কে ৪ লাখ ২৬৬কোটি টাকা। সে হিসেবে বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ শতকরা হিসাবে দশমিক ৪ শতাংশদাঁড়ায়। ভারতেও বিচার বিভাগের বাজেট অপ্রতুল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারত বিচার বিভাগের জন্য বছরে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা খরচ করে। কেন্দ্রীয় বাজেট দেখলে এটা বোঝা যাবে না। ২০১৭–১৮ অর্থবছরের কেন্দ্রীয় মোট বাজেটের মাত্র দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ (১ হাজার ৭৪৪ কোটি রুপি) বিচার বিভাগ পেয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দের বাইরে বিচার বিভাগের জন্য রাজ্যগুলো গড়ে তাদের বাজেটের কমবেশি এক-দেড় শতাংশ ব্যয় করে থাকে।
আমাদের এবারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)-সংক্রান্ত বই যথারীতি অনেকটা মোটা। এডিপিতে বিচার বিভাগ-সংক্রান্ত দুটো প্রকল্পের কথা আছে। ৬৪ জেলা সদরে ২ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ সিজিএম ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ৮৫৫ কোটি টাকা খরচ করা সম্ভব হয়েছে। কারণ, সব থেকে হেলাফেলায় এর কাজ চলছে। বাকি প্রকল্পের নাম আইন মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা বাড়ানো। ৩৯ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ প্রকল্পটি তার প্রথম বছরে ৩৪ লাখ টাকা খরচ করেছে।
পাকিস্তানি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আমাদের অনেকের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। কিন্তু আমরা লক্ষ করি না যে সেখানে বাজেট কতটা বৃহৎ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তারা ‘ল কোর্টস’ খাতেই ৫ হাজার ৬১ কোটি রুপি বরাদ্দ দিয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পাকিস্তানের পাঞ্জাব সরকারের বাজেট পেশের পর দৈনিক ডন-এর খবর পড়ে বুঝলাম, সেখানে বিচার বিভাগের প্রতি সরকারি মনোভাবের কী ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। ১ হাজার ৩০০ কোটি রুপির বেশি শুধু প্রাদেশিক বিচার বিভাগের (অধস্তন আদালত ও লাহোর হাইকোর্ট) জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। তার মানে, পাকিস্তান তার একটি প্রদেশের বিচার বিভাগের জন্য যা খরচ করে, আমরা গোটা দেশের জন্য প্রায় তাই খরচ করি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকারের পরে আমরা চট্টগ্রামে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ পেলাম না। অথচ জলপাইগুড়ি হাইকোর্ট বেঞ্চের নির্মাণকাজের তদারকির সভা বসবে আগামী মাসে। ২০১২ সালে মমতা কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি নারায়ণকে নিয়ে জলপাইগুড়ি সার্কিট বেঞ্চের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। হাইকোর্টের বিচারকেরা বয়কট করেছিলেন, কিন্তু মমতার সংকল্পই টিকল। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে আমাদের সরকার নাকি ‘জনস্বার্থে’ বিরোধে লিপ্ত আছে, কিন্তু এ ধরনের গণমুখী বিষয় নিয়ে তো কোনো বিরোধ দেখি না।
ভারতে ১৪তম ফিন্যান্স কমিশন বিচার বিভাগের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো এবং অন্যান্য উন্নয়নে নির্দিষ্ট সুপারিশ পেশ করেছে। আমরা এ রকম কোনো কমিশন করার আলোচনাও শুনি না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৫ সালে প্রতিটি রাজ্য সরকারকে দেওয়া চিঠিতে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে ওই কমিশনের সুপারিশমতে তারা যেন তাদের বাজেটে অব্যাহতভাবে পর্যাপ্ত বরাদ্দ বজায় রাখে।
পাকিস্তান প্রসঙ্গেই ফিরি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ইসলামাবাদে অবস্থিত সুপ্রিম কোর্ট ১২০ কোটি রুপির বেশি খরচ করেছেন। একই সময়ে লাহোরের (পাঞ্জাবের রাজধানী) হাইকোর্ট প্রায় ২৪৩ কোটি রুপি এবং পাঞ্জাবের নিম্ন আদালতের বাজেট ছিল ৬৮৪ কোটি রুপি। সেখানকার জনসংখ্যা এখন সাড়ে সাত কোটি। দেখার বিষয় হলো, লাহোর হাইকোর্ট দ্বারাই তারা সমগ্র পাঞ্জাবের পুরো জনগোষ্ঠীকে উচ্চ আদালতের সেবা দিচ্ছে না। লাহোরের মূল আসন (প্রিন্সিপাল সিট) ছাড়াও তারা রাওয়ালপিন্ডি, মুলতান ও ভাওয়ালপুরে পৃথক সার্কিট বেঞ্চ করেছে। সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য তারা হাইকোর্টের ৬০ জন বিচারক নিয়োগ এবং ৪টি পৃথক স্থানে বেঞ্চ বসাতে পারলে আমরা ১৭ কোটির জন্য ৮৫ জন বিচারককে (উত্তর প্রদেশের জনসংখ্যা ১৯ কোটি। এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারকসংখ্যা ১৬০) যথেষ্ট মনে করছি কেন? আর শুধু ঢাকায় হাইকোর্ট ধরে রাখতে পণ করে থাকব কেন? বিচারের সুবিধা দোরগোড়ায় নিতে আমাদের এত কার্পণ্য কেন?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তরবঙ্গের মানুষকে হাইকোর্টের সেবা দিতে ৩৫২ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক চট্টগ্রামে সার্কিট বেঞ্চ বসাতে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব নাকচ করেছিলেন, কিন্তু এ নিয়ে কোনো বিরোধ দেখি না। বিচার বিভাগীয় বাজেট সরকারের মনমতো করার বিষয়টি কোনো তাৎপর্যহীন আটপৌরে বিষয় নয়। এর সঙ্গে দ্রুত বিচার এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন নিবিড়ভাবে জড়িত।
আমাদের বিচার বিভাগীয় বাজেট কয়েক গুণ বাড়াতে হবে। বিচারকদের বেতন-ভাতা আকর্ষণীয় করতে হবে। ইমপিচ বা অভিশংসন নিয়ে তর্ক নয়, কী করে আন-ইমপিচেবল (অনভিশংসনীয়) বিচারক নিয়োগ করা যায়, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আর সে পথে যেতে বারের সদস্যদের আর্থিক সুবিধার চেয়ে বেঞ্চের আর্থিক সুবিধার শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিতকরণ একটি রক্ষাকবচ।
যদিও আমরা মহামতি প্লেটোকে মনে রাখব, ‘পাবলিক অফিসে যাঁরাই থাকবেন, তাঁদের খুব বেশি আর্থিক সুবিধা না দেওয়াটাই সমীচীন। কারণ তাতে ভয়টা হলো, তখন পাবলিক অফিসগুলোতে স্বার্থপর লোকদের ভিড় জমতে পারে।’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন