সাদাপোশাকের পুলিশের কথা আইনে নেই। কিন্তু বাস্তবে এর ভীতিকর অস্তিত্ব আমরা অস্বীকার করতে পারি না। অবশ্য কথিতমতে নিখোঁজ বা গুম হওয়া যে ২০ পরিবারের স্বজনেরা দুদিন আগে ঢাকায় জড়ো হয়েছিলেন, তাঁরা কিন্তু ‘সাদাপোশাকের’ আতঙ্কের কথা সেভাবে বলেননি। এটা হয়তো একসময় খুব তীব্র ছিল। এখন তো তাঁরা দাবি করছেন যে নির্দিষ্ট বাহিনীর পোশাক পরেই তাঁদের ছেলে, ভাই বা স্বামীকে তুলে নেওয়া হয়েছে।
মাঝেমধ্যে আমাদের চোখে পড়ে সাদাপোশাকধারী, তাঁদের হাতে প্রকাশ্যে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। তাঁরা সেসব প্রাণঘাতী হাতিয়ার এমন সাবলীলভাবে নাড়াচাড়া করেন যে তা হঠাৎ কাউকে বিচলিত করে বৈকি। অবশ্য কখনো পারিপার্শ্বিক বিবেচনায় দ্রুত আমরা ধাতস্থ হই, বরং ভয় কেটে গিয়ে প্রশান্তি আসে, ধরে নিই, তাঁরা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, অপরাধ দমনের স্বার্থেই তাঁদের সাদাপোশাকের এই সাজ। কিন্তু কখনো ধন্দও জাগে যে এভাবে অস্ত্র বহন করার বিষয়ে আরোপিত দিকনির্দেশনা বা বিধিবিধান কি খুব কড়াকড়িভাবে মানা হয়? যাঁরা এর অপব্যবহার করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তার খুব প্রচার দেখি না।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই সাদাপোশাক ব্যবহার করার ধারণাকে পুঁজি করে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। অবশ্য এই সাদাপোশাক নিয়ে শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিলেতি বিতর্কও চোখে পড়ছে। ২৭ মার্চ, ২০১৩ ব্রিটিশ টেলিগ্রাফের এক শিরোনাম ছিল: ‘জনগণের চোখে অধিকতর দৃশ্যমান হতে সাদাপোশাকের পুলিশকে উর্দি পরতে বলা হয়েছে’। আমাদের দেশের সিআইডি ও এসবির ধারণা যথারীতি বিলেতি এবং সে দেশে যাঁরা ওই বিভাগে কাজ করেন, তাঁরা সাদাপোশাক পরিধানেই অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু ২০১৩ সালে সাউথ ইয়র্কশায়ারের পুলিশের নতুন কমিশনার হয়ে এসেছিলেন শান রাইট। তিনি এসে হুকুম দিলেন সিআইডিতে যুক্ত থাকা কনস্টেবল এবং সার্জেন্টদের এখন থেকে ইউনিফর্ম পরতে হবে। আর তাতে এমন ঠাঁটবাট বজায় রাখতে হবে, যাতে তাঁদের উপস্থিতি সহজেই আমজনতার চোখে পড়ে।
আমরা অস্বীকার করতে পারি না যে এমন বিরল পরিস্থিতি আসতে পারে, যখন সাদাপোশাক কিংবা উর্দিটা বরং লুকিয়ে ফেলতে পারলেই কোনো অপরাধীকে ধরে ফেলা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু মানতে হবে, সে ধরনের পরিস্থিতি ব্যতিক্রম। এবং কোনো বিরল বা ব্যতিক্রমী অবস্থা মোকাবিলার দোহাই দিয়ে সাধারণ নিয়ম সৃষ্টি করার কোনো স্বাভাবিক প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করা উচিত নয়। ইয়র্কশায়ারের মি. শান রাইটের ওই পদক্ষেপ কিন্তু অনুসরণীয়। তাঁর যুক্তি ছিল: সমাজে পুলিশের যে উপস্থিতি তাকে যত বেশি দৃশ্যমান ও সক্রিয় রাখা যাবে, ততই কিন্তু অপরাধীরা ভয় পাবে। আর নিরীহ মানুষের মনে অধিকতর নিরাপত্তাবোধ জাগ্রত হবে। সব সিদ্ধান্তেরই সুবিধা-অসুবিধা থাকে। আর তাই মি. রাইটের পদক্ষেপের একটা সমালোচনা হয়েছিল এই বলে যে, এর ফলে সিআইডি অফিসারদের যে স্পর্শকাতর কর্তব্য ছিল, তা আগের মতো আর পালন করা সম্ভব হবে না। অবশ্য আমাদের এ বিষয়ে লেখার উদ্দেশ্য ঢালাওভাবে কোনো সিদ্ধান্ত বদলে ফেলার পক্ষে নয়। আমাদের উদ্বেগ যে কারণে সেটা হলো যথাযথ উর্দি, তাদের ব্যাজ, পরিচয়পত্রসহ অন্য যেসব অফিশিয়াল চিহ্ন রয়েছে, সে সবের যথাব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে কি না; বিশেষ করে সাদাপোশাকের চেয়েও এখন বড় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সাদাপোশাকের মাইক্রোবাস, যাতে করে প্রিয়মুখগুলো নিখোঁজ বা গুম করার অভিযোগ উঠেছে।
একসময় ধারণা ছিল সাদাপোশাক মানে অধিকতর নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতা। কিন্তু সেই ক্ষয় কবে শুরু হয়েছে বলা কঠিন। ২০ সেপ্টেম্বর, ২০০৪ সাদাপোশাকের পুলিশ পার্থ নামের এক যুবককে আটকের চার দিন পরে ধানমন্ডি থানায় হাজির করে। হাইকোর্ট ওই চার দিনের ‘অসাংবিধানিক’ আটকের প্রতিকার দেননি। বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী রিমান্ডে আর না পাঠানোর, পাঠালেও নির্যাতন না করার পর্যবেক্ষণ দিয়ে মামলা নিষ্পত্তি করেছিলেন। এভাবে আমাদের আদালতের রায়গুলোতে সাদাপোশাকের কেরামতির কম উল্লেখ নেই।
ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো পত্রিকা বনাম রাষ্ট্র মামলায় ২০০১ সালের ২৫ জানুয়ারি বিচারপতি এস কে সিনহার (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) এক রায়ে দেখা যায়, সেই ডিবির ছাদের পানির ট্যাংকি, যাতে সাদাপোশাকের ডিবি সোর্স জালালের লাশ মিলেছিল, সেখানেও সাদাপোশাকের উল্লেখ আছে। জালালের স্ত্রীর বাসায় ‘সাদাপোশাকধারী’ দুজন গিয়েছিলেন মূল আসামি ডিবির ইন্সপেক্টর জিয়াউল হাসানের পক্ষে, তাঁর আত্মীয় পরিচয়ে। তো সাদাপোশাকধারীরা জালালের স্ত্রীকে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে সাক্ষ্য না দিতে অনুরোধ করেছিলেন।
তবে ৫৪ ধারা ও রিমান্ডের মামলায় সুপ্রিম কোর্টের যে ঐতিহাসিক রায়, সেটাই এখন সর্বতোভাবে প্রচার হওয়া দরকার। পাঠকের মধ্যে কেউ কি আছেন, যাঁরা এসংক্রান্ত গাইডলাইনটিকে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় করার দায়িত্ব পালন করবেন?
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তাঁর রায়ের শুরুতেই লিখেছেন, ‘অপরাধ চিহ্নিতকরণ ও প্রতিরোধের লক্ষ্যে পুলিশ উর্দি পরিহিত ও উর্দিহীন অবস্থায় দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এবং উর্দিধারী পুলিশ সাধারণত কর্তব্যরত অবস্থায় নাম, ব্যাজ ও পদবীসহ তাঁদের শনাক্তকরণ চিহ্ন বহন করে থাকেন। এবং সাদাপোশাকের পুলিশ তাঁদের সঙ্গে পরিচয়পত্র বহন করে থাকেন। কিন্তু সেসব অপরিহার্য অপারেশনাল কারণে দৃষ্টি আকর্ষকভাবে প্রদর্শন করা চলে না। সাদাপোশাকের পুলিশ নিরাপত্তা ও অপরাধসংক্রান্ত গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য নিয়োজিত হয়ে থাকে, আর সে কারণে তাঁরা তাঁদের পরিচয়পত্র দর্শনীয়ভাবে প্রদর্শন করেন না।’
প্রধান বিচারপতি তাঁর এই রায়ে মুঘল আমল ও ব্রিটিশ ভারতের পুলিশি গ্রেপ্তার ও আটকের একটি ঐতিহাসিক পরম্পরা দিয়েছেন। এরপর তিনি যে গাইডলাইন দিয়েছেন, সেটাই আমরা মনে করি, সব থেকে বড় রক্ষাকবচ। সুতরাং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোক, সেটা তাঁরা কে কখন কোন পোশাকে থাকবেন, তার থেকেও বড় কার্যকর দিক হলো, যেকোনো পরিস্থিতিতে এই গাইডলাইন মেনে চলতে হবে। মহামারি, কি সাইক্লোন, সিডর আইলা কি মোরা, এমনকি যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও এর কোনো ব্যতিক্রম তৈরি করেননি সুপ্রিম কোর্ট।
বিধানগুলো নিচে তুলে দেওয়া হলো: ১. আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কোন কর্মকর্তা কাউকে গ্রেপ্তার করার পরে অনুরূপ গ্রেপ্তারের অব্যবহিত পরে একটি স্মারক প্রস্তুত করবেন এবং গ্রেপ্তারের তারিখ ও সময়ের উল্লেখসংবলিত উক্ত স্মারকে অনুরূপ কর্মকর্তা গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির স্বাক্ষর সংগ্রহ করবেন।’ নাগরিক সমাজের উচিত এই বিধান অনুসরণ চলছে কি না তা সরেজমিনে গিয়ে পরখ করা।
২. ‘আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার একজন সদস্য কর্মকর্তা কাউকে গ্রেপ্তার করার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিন্তু অনধিক ১২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের স্থান, সময় এবং অন্তরীণ রাখার স্থান সম্পর্কে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির নিকটতম আত্মীয়কে এবং তেমন আত্মীয়ের অনুপস্থিতিতে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির সুপারিশমতে তাঁর কোনো বন্ধুকে খবর দেবেন।’ এই আত্মীয় ও বন্ধুদের জাগতে হবে, তাঁদের ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না। খবর না পেলে সোচ্চার হোন। কথা বলুন।
৩. ডায়েরির এন্ট্রিতে গ্রেপ্তারের কারণ এবং যে ব্যক্তি গ্রেপ্তারের জন্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যকে অবহিত বা অভিযোগ দায়ের করেছেন, সেই ব্যক্তির নাম-ঠিকানা এবং গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার যে কর্মকর্তার হেফাজতে আছেন, তাঁর বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণসহ গ্রেপ্তারের তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে, ক্ষেত্রমতে, এমন আত্মীয় বা বন্ধুর বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণও উল্লেখ থাকবে।
এর মধ্যে ৬ নম্বর দফাটি গ্রামগঞ্জের মানুষ যাঁরা পুলিশকে শ্রেষ্ঠ ত্রাতা ভাবতে বাধ্য হতে পারেন, তাঁদের পক্ষে অনুশীলন করা কঠিন। তবে এই দফাটিই দরিদ্র বা কমজোরি বা পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য সব থেকে বড় রক্ষাকবচ। কিন্তু একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, এটি রাতবিরাতে, অজপাড়াগাঁয়ে খুব সহজেই অসার বলে প্রতীয়মান হতে পারে। এতে বলা আছে, ‘আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কোনো কর্মকর্তা তাঁর পরিচয় প্রকাশ করবেন এবং যদি দাবি করা হয়, তাহলে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি বা গ্রেপ্তারের সময়ে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের কাছে তিনি তাঁর পরিচয়পত্র প্রদর্শন করবেন।’ কারণ পুলিশের কাছে পরিচয়পত্র দেখতে চাওয়ার কারণেই কারও দুচার ঘা খেতে হতে পারে।
আজকাল ‘ফেক নিউজ’ কথাটির চল বাড়ছে। এরপর হয়তো চল বাড়বে ‘ফেক পুলিশের’। ‘ফেক পুলিশ’ জনপ্রিয় হলে ‘ফেক আইডির’ও চল বাড়তে বাড়ে। সুতরাং কখন কে কাকে বা কারা কাদের গ্রেপ্তার করে, নাকি গুম বা বন্দুকযুদ্ধের বারুদ হাতে তুলে নেয়, সেটাই যখন কখনো শনাক্ত করা দুরূহু হয়ে পড়ে, তখন পোশাক নিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করলেও তো সুবিধা পাওয়া কঠিন। আপাতত ওই নির্দেশনাগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশের বিভাগীয় কর্তারা যদি সিটিজেন চার্টারের মতো করে প্রচার চালান, রেডিও-টিভিতে যদি তার ব্যাপক সম্প্রচার চলে, তাহলে সমাজে একটা রক্ষাকবচ নিশ্চয় তৈরি হতে পারে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার বিবেকবান সদস্যরা ‘ফেক পুলিশের’ অপরাধ থেকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারেন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন