প্রধান বিচারপতির ‘অপসারণের’ পর প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য রাখার পটভূমিতে প্রায় আড়াই শ বছরের ইতিহাসসমৃদ্ধ সুপ্রিম কোর্ট আজ প্রথমবারের মতো ‘সুপ্রিম কোর্ট দিবস’ পালন করতে যাচ্ছে। এ উপলক্ষে নির্মোহভাবে পেছন ফিরে দেখার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। আর তাতে আমরা এমন কিছু দেখি, যা আমাদের উদ্বিগ্ন করে, আত্মজিজ্ঞাসার তাগিদ তৈরি করে।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু সুপ্রিম কোর্ট উদ্বোধন করেন। এখন থেকে সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবছর ১৮ ডিসেম্বর এই দিবস পালন করবে। এবার অবকাশ থাকার কারণে আজ ২ জানুয়ারি তা পালিত হচ্ছে। স্মৃতিচারণা করার কাজে আমরা সম্প্রতি একটি দুষ্প্রাপ্য স্মরণিকা হাতে পেয়েছি। আমরা আজকের যে নয়নাভিরাম মুসলিম স্থাপত্যকলার একটি নিদর্শন হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট ভবনটি দেখতে পাই, এর উদ্বোধন উপলক্ষে সেটি প্রকাশিত হয়েছিল। সম্প্রতি অবসরে আসা বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী বহুকাল এটি আগলে রেখেছেন। ১৯৬৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বর্তমান সুপ্রিম কোর্ট ভবন উদ্বোধন করেছিলেন আইয়ুব খান। যদিও এই ভবন নির্মাণের সার্বিক তদারকিতে ছিলেন গভর্নর মোনায়েম খান। প্রধান বিচারপতি ছিলেন টিক্কাকে শপথ না দেওয়ার জন্য বিখ্যাত বদরুদ্দীন আহমেদ সিদ্দিকী।
আমরা সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক প্রকাশনাগুলোর সঙ্গে এর একটি মৌলিক পার্থক্য লক্ষ করি। আর সেটি হলো, বিচার বিভাগীয় যাঁরাই আছেন, তাঁরা তাঁদের সাম্প্রতিক নিবন্ধে যথাসম্ভব নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের যে একটি দ্বৈরথ, অন্য কথায় স্বাধীন বিচার বিভাগের অর্থই যে নির্বাহী বিভাগের বাড়াবাড়িকে খামোশ বলার হিম্মত রাখা, সেটা কম উচ্চারণ কিংবা পারতপক্ষে এড়িয়ে চলা। কিন্তু ওই স্মরণিকা, যা আইয়ুব-মোনায়েমের দাপুটে পর্বে প্রকাশিত, সেখানে বিচারকেরা গর্বের সঙ্গে স্বাধীন বিচার বিভাগের কী অর্থ, তা পরিষ্কার করে তুলে ধরেছেন।
সাবেক প্রধান বিচারপতিদের দুটি লেখা চোখে পড়ল। তাঁরা দুজনেই সততা ও শুদ্ধতার জন্য সুনামের অধিকারী ছিলেন। আমাদের সাবেক প্রধান বিচারপতিদের অনেকেই অবসরে যাওয়ামাত্র নীরবতা পালন, এমনকি লোকচক্ষুর অন্তরালের জীবনকেই শ্রেয় মনে করেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি আমিন আহমেদ লিখেছেন, ‘সরকারে যে যখনই থেকেছে, তার বাছবিচার না করে পাকিস্তানের বিচার বিভাগ সর্বদা আইনের শাসনের শ্রেষ্ঠত্বের ঝান্ডা তুলে ধরেছে।’ এরপর তিনি যে মন্তব্য করেছিলেন, সেটা ওই স্মরণিকাটি প্রকাশের ৫০তম বার্ষিকীতে আমাদের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই প্রতীয়মান হয়। তিনি লেখেন, ‘বিচার বিভাগের প্রতি দেশের মানুষের অগাধ আস্থা, আল্লাহকে ধন্যবাদ, তিনি নির্বাহী বিভাগের তরফে বিচার বিভাগের ওপর এমন কোনো বিপদ আসতে দেননি, যেমনটি গোলামির জিঞ্জির ভেঙে বেরিয়ে আসা অন্য কতিপয় দেশ প্রত্যক্ষ করেছে।’ চুয়ান্নতে প্রধান বিচারপতি হওয়া আমিন আহমেদ আইয়ুবের আটান্নর সামরিক শাসনকালেও প্রধান বিচারপতি ছিলেন। ওই সময় জেলায় জেলায় আইয়ুবের সেনা প্রশাসকেরা হঠাৎ ‘জনস্বার্থে’ হুকুম জারি করেছিলেন যে অধস্তন আদালতের বিচারাধীন মামলা এক সপ্তাহের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। তখন আমিন আহমেদ তৎকালীন জিওসিকে ফোন করে বলেছিলেন, এই আদেশ বহাল থাকার অর্থ হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অপমৃত্যু। জিওসি দ্রুত ওই আদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।
আমিন আহমেদের ওই নিবন্ধের আরও একটি তথ্য আমাদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে। কারণ, ১৯৭২ সালে যুক্ত করা বিধান, যা সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে ২০১১ সালে এসে নতুন করে টিকিয়ে রাখা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, নিম্ন আদালতের শৃঙ্খলা ও বদলি ইত্যাদি চলবে সংবিধান কার্যকর হওয়ার আগের পদ্ধতিতে। আর আমাদেরই একজন প্রধান বিচারপতি আমিন আহমেদের লেখা থেকে দেখা যায়, নিম্ন আদালত চালানোর দায়িত্ব পাকিস্তান আমলে হাইকোর্টের ছিল। ২০১৮ সালে এসেও আমরা বলি, নিম্ন আদালতের সবটা হাইকোর্টকেই দেখতে দেওয়া হোক। এ বিষয়ে আদালতে দেওয়া আমীর-উল ইসলামের সাম্প্রতিক নিবেদন তাই বিশেষ গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে।
আমিন আহমেদের আরেকটি উক্তি স্মরণযোগ্য: পাকিস্তানের শাসনকার্যে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে। কিন্তু কখনো বিচার বিভাগের কর্তৃত্বের ওপর আঘাত হানেনি। এমনকি সামরিক শাসনের তেজ যখন মধ্যগগনে, তখনো বিচার বিভাগীয় কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়নি।
অপর সাবেক প্রধান বিচারপতি হলেন এম এ ইস্পাহানি। সাতচল্লিশের দেশভাগের যে সময়টায় কলকাতা হাইকোর্ট থেকে কিছু চেয়ার-টেবিল, ঘড়ি ইত্যাদি ভাগের ভাগ হিসাবে আমরা পেয়েছিলাম, তখন পূর্ববঙ্গ সরকারের আইন ও বিচারসচিব ছিলেন ইস্পাহানি। তাঁর লেখায় দেখি, বিচারকেরা তখন বারান্দায়ও বসতেন। বিলাতি বিচারক ওয়েন-পেরি এসব দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আপনারা যে অবস্থায় বিচারকার্য করছেন, তার প্রশংসা না করে কারও উপায় নেই।’ তিনি স্মরণ করেন, এক শনিবারের সকালে মোনায়েম খান নতুন ভবনের স্থান নির্ধারণ করেছিলেন। উল্লেখ্য, বর্তমান সুপ্রিম কোর্ট ভবনের উত্তর-পূর্বাংশে সাতচল্লিশে সামরিক বাহিনীর ব্যারাক ছিল, আইয়ুব খান তখন ঢাকার জিওসি ছিলেন।
গুণমানসম্পন্ন আমাদের মূল সুপ্রিম কোর্ট ভবন কতটা কম সময়ে ও খরচে নির্মিত হয়েছিল, তার সঙ্গে পরবর্তীকালের নির্মাণ ব্যয় ও মানের একটা তুলনা দাবি করা কম কৌতুকপ্রদ হবে না। ১৯৬৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। আর চৌকস প্রকৌশলীদের একটি দল ৪৩০ ফুট দৈর্ঘে্যর ও ৩৭০ ফুট প্রস্থের ১৯টি বিচারকক্ষ-সংবলিত ভবনটি মাত্র ৭৪ লাখ ৭৫ হাজার রুপিতে নির্মাণ করে। মূল প্রাক্কলিত খরচের মধ্যেই ২ লাখ ২৩ হাজার ৬০৭ বর্গফুটের ইমারত নির্মাণ করা সম্ভব হয়। মেসার্স চিশতি ব্রাদার্সের ডিজাইনে গড়া ইমারতটির প্রতি বর্গফুটে ৩৩ রুপি খরচ পড়ে। বিচারপতি এম এ ইস্পাহানি লিখেছিলেন, ‘গাঢ় সবুজের মধ্যে গম্বুজটি যেন একটি মুক্তা হয়ে বসেছে। আশা করব এখান থেকে বিচারপ্রার্থীরা ন্যায়বিচার পাবেন। ইনশা আল্লাহ, এই আদালতের সিদ্ধান্ত বিশ্ববিখ্যাত হবে। অন্যান্য হাইকোর্ট তাঁকে ঈর্ষা করবেন।’
বিশ্বে উন্নত বিদ্যাপীঠের র্যাঙ্কিং হয়। সেই সূত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং আমরা জানি। কিন্তু মানসম্মত সুপ্রিম কোর্টের এমন কোনো র্যাঙ্কিং হয় না। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের কোনো রায় দেশের বাইরের কোনো উচ্চ আদালতের রায়ে উদ্ধৃত হয়েছে কি না, জানি না। তবে ১৯৬৩ সালে আবদুল হক বনাম ফজলুল কাদের চৌধুরী মামলায় ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মোর্শেদের রায়ে (পরে সুপ্রিমকোর্টে সমর্থিত) প্রথমবারের মতো সংবিধানের মৌলিক কাঠামো চূড়ান্ত হয়। ১৯৬৫ সালেই সজ্জন সিংয়ের মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তা গ্রহণ করেছেন। দিল্লিতে ভারতের সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল সোলি সোরবজির বাসভবনে গিয়ে তাঁর মুখেও এ কথা শুনেছি। সোরবজি ড. কামাল হোসেনকে বলেছেন, ‘আপনারা এই রায়টির জন্য বিশেষ গর্ব করতে পারেন।’
আসলে রাষ্ট্রের অন্য বহু সংস্থা যেভাবে রেওয়াজ ও ঐতিহ্য ছাড়া চলতে পারে, সেভাবে সুপ্রিম কোর্ট পারেন না। ভালোভাবে এক কদমও না। তাই অকারণে জ্যেষ্ঠতার নীতি না মানা, আপিল বিভাগ ও হাইকোর্টের বিচারকসংখ্যা নির্দিষ্ট না করা, আবার নির্দিষ্ট করেও তা মান্য না করা, নানা কৌশলে বিচারকদের ওপর নির্বাহী বিভাগীয় হম্বিতম্বি ধরে রাখা, নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা বজায় রাখতে আইন না করার মতো বাংলাদেশি সরকারগুলোর অভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের বিচলিত করে। ঐতিহ্যের রিক্ততা বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতাকে ঋদ্ধ হতে দেয় না। ৪৬ বছর কাটল, উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলোর কোথাও আমরা প্রকৃত মানদণ্ডে শুরুটা পর্যন্ত করিনি।
প্রশ্নই শুধু বাড়ে। উত্তর খুবই কম জমা পড়ে। ১৯৭২ সালে সুপ্রিম কোর্টের যাত্রা শুরুর লগ্নে যুদ্ধকালীন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী, জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মকসুমুল হাকিম, বিচারপতি আবুল হাকিম, বিচারপতি নুরুল ইসলাম, বিচারপতি টি এইচ খান বাদ পড়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কামিনী কুমার দত্ত লেকচারে ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরে বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী (এরশাদের পতনের পরের আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী) ওই বিচারকদের নাম উল্লেখ করে মন্তব্য করেছিলেন, ‘এভাবে একেবারে শুরুতেই বিচার বিভাগ চোট পেল এবং বিচার বিভাগের ওপর জন-আস্থা ঝাঁকি খেয়েছিল। ওই জ্যেষ্ঠ বিচারপতিরা কেন বাদ পড়েছিলেন, তার কারণ কখনো কেউ ব্যাখ্যা করেননি।’
আবার শুরুর শুরুতে নজর দিলে দেখব, কথিতমতে সরকারপ্রধানের হাতে ক্রীড়নক হয়ে বিতর্কিত বিচারকার্য করেছিলেন প্রথম বিচারপতি। প্রায় আড়াই শ বছর আগের কথা। আমাদের বর্তমান সুপ্রিম কোর্টের আদি পর্বের (১৭৭৪) সূচনা কলকাতার মাটিতে। সেই অর্থে স্যার এলিজা ইম্পে আমাদেরও প্রথম প্রধান বিচারপতি। তাঁর নেতৃত্বাধীন আদালতে মহারাজা নন্দকুমারের সব থেকে বিতর্কিত বিচারটি হয়েছিল। হেস্টিংসের আনা কথিত জালিয়াতি মামলার শুনানি ১৭৭৫ সালের ৮ জুন শুরু হয়ে ১৫ জুন প্রায় মধ্যরাতে শেষ হয়। ভোররাত চারটায় প্রধান বিচারপতি ইম্পে নন্দকুমারের ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন। বিখ্যাত আইনবিদ ম্যাকুলে এবং কিছু ঐতিহাসিকের মতে, এটা ছিল বিচারিক হত্যাকাণ্ড। সরকারপ্রধান (গভর্নর জেনারেল) ছিলেন ইম্পের স্কুলসহপাঠী বিতর্কিত ওয়ারেন হেস্টিংস। এটি তাঁর ইচ্ছাপূরণের রায় ছিল বলে অভিযোগ আছে।
রাষ্ট্রের বা কোটারি স্বার্থের সঙ্গে সংঘাতে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা খর্ব হওয়াটাই কিন্তু আদি ইতিহাস। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে আদালতের দ্বন্দ্বের পর দেখি, সংসদ ১৭৮১ সালে আইন করে বলেছে, রাজস্ব দেখতে হাইকোর্টের ক্ষমতা থাকবে না, পরের ৮০ বছর তাই রাজস্ব বিষয়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা বিচারবঞ্চিত ছিলেন। আবার ওই একই সময়ে বিচারকার্যে কলকাতা হাইকোর্টের সুনাম শিখর স্পর্শ করেছিল।
ইদানীং আমরা বিচারক অপসারণে জনপ্রতিনিধিদের (প্রকৃত না হয়েও) শ্রেষ্ঠত্বের সবক শুনতে পাই। তালুকদার মনিরুজ্জামান স্যারের কাছে শোনা, জনশ্রুতি ছিল আইয়ুব খান পাকিস্তানের ক্রিকেট ও জুডিশিয়ারি নিয়ে গর্ব করতেন। আমরা আইয়ুব খানের স্মৃতিকথা ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারি। তিনি লিখেছেন, ‘নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা সংবিধানের বিধানাবলির আওতায় কাজ করছে,Ñ এটা নিশ্চিত করতে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রয়োজন।’
শেষ করব ভারতীয় বিচারপতি কৃষ্ণা আয়ারের সতর্কবাণী দিয়ে, ‘স্বাধীন বিচার বিভাগ ছাড়া গণতন্ত্র দাসত্বে পরিণত হতে পারে।’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন