|
মিজানুর রহমান খান
mrkhanbd@gmail.com |
|
সিআইএর নথি: বন্দুকের মুখে সংলাপ চাননি বঙ্গবন্ধু
26 March 2018, Monday
চার দশকেরও বেশি সময় পরে সিআইএ তার অতি গোপনীয় একাত্তরের নথিগুলো প্রকাশ করেছে। এই শীর্ষ মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাটির অন্যতম এক নিয়মিত কাজ হলো মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য প্রতিদিনের সংক্ষিপ্তসার তৈরি করা। এতে বিশ্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা সম্পর্কে সিআইএর মূল্যায়নের প্রতিফলন থাকে। গত দুই বছরে তারা ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ স্বাধীনতাযুদ্ধ-বিষয়ক বেশ কিছু ‘টপ সিক্রেট’ ব্রিফ অবমুক্ত করেছে। নতুন নথি, কিন্তু খুব অজানা কিছু যে আছে তা নয়। তারপরও মহান স্বাধীনতার মাসে একই বিষয় ও ঘটনাপ্রবাহকে আরও সূক্ষ্ম ও নির্দিষ্টভাবে বুঝতে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতাসংগ্রামের দিনগুলোর তাৎপর্য ও গুরুত্ব তুলে ধারার তাগিদ থেকে আমরা ধারাবাহিকভাবে সিআইএর কিছু নির্বাচিত নথির বরাতে ইতিহাসের দিকে নজর দিতে চেষ্টা করব।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসার কথা ছিল। জেনারেল ইয়াহিয়া ১ মার্চ তা স্থগিত করেছিলেন। এ বিষয়ে ২ মার্চ সিআইএ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বলেছিল, ইয়াহিয়া যুক্তি দিয়েছেন, রাজনৈতিক মতানৈক্য দূর করতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিকদের অসামর্থ্য এবং উল্লেখযোগ্য পশ্চিম পাকিস্তানি পার্টি অধিবেশনে যোগ দিতে নারাজ থাকায় তাঁকে সংসদীয় সভা স্থগিত করতে হয়েছে। মতপার্থক্য কোথায় ছিল, তা চিহ্নিত করে সিআইএ বলেছে, ‘দুই অংশের রাজনীতিকদের মধ্যে মুখ্য বিরোধের জায়গা হলো পূর্ব পাকিস্তান এমন একটি সংবিধান তৈরির জন্য চাপ দিচ্ছে, যা প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়ের মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা সীমিত করে দেবে। পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিকদের আপত্তি সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানিরা আশাবাদী ছিল যে এই দাবি আদায়ে তারা জাতীয় পরিষদে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করবে।’
ইয়াহিয়া গণপরিষদ স্থগিত করে ১০ মার্চ ইসলামাবাদে সর্বদলীয় সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ৪ মার্চ সিআইএ নিক্সনকে বলেছিল, ‘মুজিব সম্মেলনে যেতে নারাজ। কারণ, সেখানে যেতে তাঁর জনগণের চাপ নেই।’ সিআইএ এদিন ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাডের কী ধারণা, তাও নিক্সনকে জানিয়েছিল। নিক্সন ও তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার আর্চার ব্লাডকে বাঙালিদের প্রতি সহানুভূতিশীল বিবেচনায় একাত্তরে ঢাকা থেকে তাঁকে নাটকীয়ভাবে প্রত্যাহার করেছিলেন। এরপর আমাদের দেশে যে বিবেচনায় ওএসডি করে, সেভাবে তাঁকে ওএসডি করে রাখা হয়েছিল। বহু বছর পরে তাঁকে অবশ্য কলঙ্কমুক্ত করে সাহসিকতার সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশের জন্য পুরস্কৃত করা হয়। ব্লাড তাঁর ‘ভিন্নমতের’ জন্য পুরস্কৃত হলেও কোনো মার্কিন প্রশাসন আজ পর্যন্ত একাত্তরের গণহত্যাকে সমর্থন দেওয়ার নীতি অনুসরণের জন্য নিক্সন-কিসিঞ্জারের নিন্দা করেনি। ২০০০ সালে ঢাকায় এসে বিল ক্লিনটন প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত করে শুধু বলেছিলেন, ‘একাত্তরে বিশ্বের অনেক দেশই বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়নি।’ যুক্তরাষ্ট্র তার উচ্চমার্গীয় নীতিনৈতিকতা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের স্বার্থে কখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার কথা চিন্তা করেছে বলেও জানা যায় না। বাংলাদেশের আগামীর প্রজন্মকে এটা সতত মনে রেখে ওই দেশের কাছ থেকে এটা আদায় করে নেওয়ার সামর্থ্য অর্জন করতে হবে।
সিআইএর ওই নথিতে লেখা হয়েছিল যে ‘মার্কিন কনসাল ব্লাড বিশ্বাস করেন, যদি নাটকীয় কোনো অগ্রগতির ঘটনা না ঘটে, তাহলে আগামী রোববারই (৭ মার্চ) মুজিবের তরফে স্বাধীনতা ঘোষণা করার সম্ভাবনা ক্রমশ বাড়ছে।’ ভিন্ন মার্কিন নথি থেকে আমরা এর আগে দেখেছি, একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার সম্ভাব্য ফলাফল বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সুচিন্তিতভাবে বিবেচনায় নিয়েছিল। তাই স্বাধীনতা ঘোষণা এড়ানো হয়। তবে বঙ্গবন্ধু নিজেই পশ্চিমা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তিনি ৭ মার্চে যা ঘোষণা দেবেন, তা হবে স্বাধীনতার নামান্তর। ২০১৬ সালের ১৯ জুলাই অবমুক্ত করা একাত্তরের ওই ৪ মার্চের নথিটি নিক্সনকে অবহিত করেছিল যে ‘গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করায় পূর্ব পাকিস্তানিদের ক্ষোভ প্রশমনে ইয়াহিয়ার নেওয়া পদক্ষেপ মুজিব নাকচ করেছেন। ইয়াহিয়া মুজিবকে এটা অবহিত করতে বলেছিলেন যে গণপরিষদ শিগগিরই বসতে সক্ষম হবে। মুজিব দ্রুততার সঙ্গে ঘোষণা করেছেন যে তিনি তাতে যোগ দেবেন না। কারণ হিসেবে বলেছেন, এটা স্থির করা হচ্ছে ‘বন্দুকের নলের মুখে’।
৪ মার্চ গোয়েন্দা সংস্থাটি অল্প কথায় মুজিবের কৌশল সম্পর্কে নিক্সনকে অবহিত করেছিল এই ভাষায়: ‘আগামী রোববারের বিশাল জনসভায় মুজিব কী বলবেন, তার তাৎপর্য তাঁর বর্তমান অবস্থানের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। কারণ, মুজিব বলেছেন, তিনি ওই দিন তাঁর পরিকল্পনা ঘোষণা করবেন।’ গোয়েন্দা সংস্থাটি ইঙ্গিত করেছে যে ইয়াহিয়ার প্রস্তাবিত সম্মেলনকে বিবেচনায় রেখে মুজিব যে নির্দিষ্ট কোনো একটি ঘোষণা দেওয়াকে বিলম্বিত করেও তাঁর ‘পরিকল্পনা ঘোষণার’ বিষয়ে মুখ খুলেছিলেন, সেটার অন্তত একটা আংশিক ব্যাখ্যা হলো, ক্ষুব্ধ পূর্ব পাকিস্তানিদের কাছে তাঁর নেতৃত্বকে সুরক্ষা দেওয়ার একটা বিষয় সেখানে ছিল। এরপর সিআইএ ব্লাডের ওই ধারণার উল্লেখ করেছিল। নথিটির উপসংহারে লেখা হয়েছিল: ‘দুই দিনের হরতালের দ্বিতীয় দিনে মুজিব শনিবার পর্যন্ত কর্মবিরতি বর্ধিত করেন। যদিও তিনি সংযত থাকারও আহ্বান জানান। ঢাকায় সেনাবাহিনী পুলিশের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং রাত্রিকালীন কারফিউ বলবৎ রয়েছে।’
এর আগে ২ মার্চের নথিটিতে বলা হয়েছিল, ইয়াহিয়ার ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় ইতিমধ্যে স্বাধীনতাপন্থী বিক্ষোভ শুরু হয়ে গেছে। মুজিবুর রহমানের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র আজ ও কাল হরতাল ডেকেছেন। মুজিব নিজেও অধিবেশন স্থগিত করার কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং এ বিষয়ে তিনি ৭ মার্চ অনুষ্ঠেয় সমাবেশে আরও বলবেন। এই পর্যায়ে সংস্থাটি যা নিক্সনকে বলেছিল, সে অনুযায়ী নিক্সনের উচিত ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই সমর্থন দেওয়া, কিন্তু তিনি তা করেননি।
এই নথি আবারও নিশ্চিত করল যে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মতো এই শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থাও পরিষ্কার দেখেছিল, শক্তি দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্তব্ধ করা দুরূহ হবে। তারা তাই লিখেছিল: ‘ইয়াহিয়া সচেতন ছিলেন যে গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হলে পূর্ব পাকিস্তানিদের পক্ষে একটি শক্তিশালী প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি থাকবে। কিন্তু তিনি অনুমেয়রূপে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে তিনি যদি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত না করেন, তাহলে এর বিকল্পটা হলো, পশ্চিম পাকিস্তান অশান্ত হয়ে উঠবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রাধান্যনির্ভর সেনাবাহিনীতে যে প্রতিক্রিয়া হবে, তা হবে আরও নিকৃষ্ট। অন্যদিকে, মুজিব যদি কোনো শক্তিশালী অবস্থান নেন, যেমন তিনি যদি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, তাহলে ইয়াহিয়া অন্য এক সংকটের মুখোমুখি হতে পারেন। ইয়াহিয়াকে তখন হয় পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে চলে যেতে দিতে হবে, কিংবা শক্তি প্রয়োগ করে দেশকে একত্র রাখার চেষ্টা করতে হবে। তবে সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব শক্তিশালী। তাই সেখানে মোতায়েন থাকা সীমিতসংখ্যক পুলিশ ও সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বিবেচনায় শেষের পদক্ষেপটি (শক্তি প্রয়োগ) নেওয়া অত্যন্ত কঠিন হবে।’
এসব নথি তাই নতুন করে পুরোনো সত্যের ওপর আলো ফেলছে যে হানাদার বাহিনী এবং তাদের মিত্রদের জানা-বোঝার মধ্যেই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল।
আগামীকাল: মুজিব জানতেন স্বাধীনতার থেকে কম কিছুও উপেক্ষিত হবে
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন