রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজ থেকে ১১০ বছরেরও বেশি আগে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তার শিরোনাম ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’। তাতে তিনি বলেছিলেন:
‘আজ বাংলাদেশে উত্তেজনার অভাব নাই, সুতরাং উত্তেজনার ভার কাহাকেও লইতে হইবে না। উপদেশেরও যে বিশেষ প্রয়োজন আছে তাহা আমি মনে করি না। বসন্তকালের ঝড়ে যখন রাশি রাশি আমের বোল ঝরিয়া পড়ে তখন সে বোলগুলি কেবলই মাটি হয়, তাহা হইতে গাছ বাহির হইবার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। তেমনি দেখা গেছে, সংসারে উপদেশের বোল অজস্র বৃষ্টি হয় বটে, কিন্তু অনেক স্থলেই তাহা হইতে অঙ্কুর বাহির হয় না, সমস্ত মাটি হইতে থাকে।’
সেকালে উপদেশের বোল ছড়াতেন সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। ঠাকুর মহাশয় নিজেও খুব বিনয়ের সঙ্গে ওই রচনায় যথেষ্ট উপদেশ উপস্থাপন করেছেন। এখন নানা রকম মিডিয়ার যুগ। টেলিভিশন টক শোতে এবং সংবাদপত্রের উপসম্পাদকীয় কলামে প্রতিদিন অজস্র উপদেশ বর্ষিত হয়ে থাকে। কলাম রচয়িতার সব উপদেশ যদি সরকার বাস্তবায়ন করতে চায়, তাহলে সরকারের মাথা খারাপ হয়ে যাবে। তারপরও উপদেশ দেওয়া বন্ধ থাকবে না। উপদেশ দেওয়া বন্ধ হওয়াও উচিত নয়। উপদেশ আছে বলেই জগৎ-সংসার আজও চলছে এবং কিছু লোক বাধ্য হয়ে উপদেশ শুনছে বলেই পৃথিবীটা বসবাসযোগ্য আছে।
আজ বাংলাদেশের অবস্থা নিয়ে তার জনগণের উদ্বেগের অন্ত নেই। মা-বাবা সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে উদ্বেগে থাকেন। কেউ কর্মস্থলে গেলে বাড়ির লোক উদ্বেগে থাকে, যতক্ষণ না ঘরে সে ফিরে আসে। মসজিদ, মন্দির, বিহার, গির্জায় যাচ্ছে মানুষ ভয়ে ভয়ে। সুপারমার্কেটে ঢোকার সময় মানুষ দেখে নেয় বেরোনোর দরজা কোন দিকে। বিয়ের বরযাত্রী অথবা বউভাতের অনুষ্ঠানে ভয়, সভা-সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কথা বাদই দিলাম। যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠান এবং মাওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভায় বোমা হামলার পর থেকে সভা-সমাবেশ আর নিরাপদ মনে করে না কেউ। তারপর একুশে আগস্ট শেখ হাসিনার সভায় যে নারকীয়তা ঘটে যায়, তারপরও যে মানুষ জনসভায় আজও যায়, তাতে বোঝা যায় বাঙালির সাহস শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু বছরখানেক
যাবৎ সন্ত্রাসের যেসব দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে, তাতে শুধু উদ্বেগ নয়, আতঙ্কগ্রস্ত আজ সমগ্র জাতি। এখন এই অবস্থার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে বাংলাদেশ বসবাসের জন্য অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে। বলতে গেলে আংশিক অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছেও।
গত চার দশকে বাংলাদেশের দৃষ্টিগ্রাহ্য আর্থসামাজিক উন্নতি হয়েছে। সে জন্য সরকারি ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রয়েছে। ৪০ বছর আগে সকালের দিকে গ্রামের পথে দেখা যেত কিছু বালক হাফপ্যান্ট বা ময়লা পায়জামা-শার্ট পরে স্কুলে যাচ্ছে, তাদের বই-খাতা দড়ি দিয়ে বাঁধা। সেই স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে দেখা যেত একজন কি দুজন বালিকা। আজ কোনো প্রত্যন্ত পল্লিতে গেলে দেখা যায়, শত শত ছেলেমেয়ে একসঙ্গে কোলাহল করতে করতে স্কুলে যাচ্ছে। তাদের গায়ের কাপড় ময়লা বা ছেঁড়া-ফাটা নয়। পরিষ্কার স্কুলের পোশাক। বই-খাতা মায়ের শাড়ির ছেঁড়া পাড় বা দড়ি দিয়ে বাঁধা নয়। প্রায় সবারই পিঠে রেক্সিনের স্কুলব্যাগ। আমি সম্প্রতি সীমান্ত এলাকার দূরবর্তী গ্রামে গিয়েও এই দৃশ্য দেখেছি। বুকটা ভরে যায়। চোখে পানি আসে, যখন দেখি দরিদ্র পরিবারের বাচ্চা মেয়েদের স্কুলে গিয়ে পড়ার আগ্রহ।
সেটা গেল একদিক। অন্যদিকে শিল্প অঞ্চলগুলোতে সকাল সাড়ে সাতটা বা রাত সাড়ে আটটা থেকে ১১টা পর্যন্ত যে দৃশ্য দেখা যায়, সে দৃশ্য বেগম রোকেয়ার সুলতানা স্বপ্নেও দেখতে পাননি। এমনকি মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট পর্যন্ত হতবাক হয়ে যেতেন আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন কলকারখানায় নারীর অংশগ্রহণ দেখে। তাঁরা অবদান রাখছেন নারী প্রগতিতে এবং অর্থনীতিতে। কিন্তু প্রগতিকামী নারীদের প্রধান শত্রু ধর্মীয় মৌলবাদ এবং দ্বিতীয় শত্রু বখাটে-লম্পট পুরুষ। মৌলবাদ ও বখাটেপনাকে হেদায়েত একমাত্র কোনো প্রগতিশীল রাষ্ট্রই করতে পারে। তবে সামাজিক চাপেরও খুব বেশি প্রয়োজন।
বহুদিনের চেষ্টায় এই যে সামাজিক অগ্রগতি এবং অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জিত হয়েছে, তা তো শেষ হয়ে যাবে, যদি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ আরও ছড়িয়ে পড়ে। আতঙ্কের মধ্যে অগ্রগতি অর্জন সম্ভব নয়। সন্ত্রাসবাদ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সমান্তরালভাবে চলতে পারে না।
আজ পৃথিবীতে বিজ্ঞানের যে উন্নতি, যার ফল ভোগ করছি আমরা উন্নয়নশীল দেশের মানুষ, যারা বিজ্ঞানে বিশেষ কোনো অবদান রাখিনি,
সে জন্য পশ্চিমের অবদান ৯৫ শতাংশ। সেখানকার উঁচু মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থার অবদান ১০০ শতাংশ। কিন্তু সেই পশ্চিমই পৃথিবীতে এমন কিছু রোগ ছড়িয়েছে, যার দ্বারা আজ আমরা আক্রান্ত। তারাও আক্রান্ত। তফাত হলো তারা অন্যায় করে আক্রান্ত, আর আমরা দোষ না করে আক্রান্ত। পুরো পৃথিবীই আজ জঙ্গিবাদ দ্বারা আক্রান্ত। এখন সেই রোগের প্রতিষেধক কী? আমাদের বাঁচার জন্য প্রতিষেধক আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। প্রতিষেধকের জন্য পশ্চিমের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে চলবে না।
সেই প্রতিষেধক হলো প্রাচ্যের নৈতিকতা। প্রাচ্যের নৈতিকতার উৎস এশিয়ার প্রবর্তিত ধর্মগুলো ও সামাজিক আচার ও রীতিনীতি। অহিংসা, ভ্রাতৃত্ববোধ, প্রতিবেশীর প্রতি ভালোবাসা—এসব হলো আমাদের প্রাচ্যের নৈতিক বৈশিষ্ট্য। হাজার হাজার বছর আগে, এমনকি সেই ঋগ্বেদেরও আগে, ঋক্, সাম প্রভৃতি পবিত্র বেদে যে অনর্ঘ বাণী উচ্চারিত হয়েছে, বস্তুত তা সেকালের মুনি-ঋষিদের মুখনিঃসৃত। তার অর্থ সেই ধরনের মহাজ্ঞানী মানুষ এই উপমহাদেশে চার-পাঁচ হাজার বছর আগেও ছিলেন।
যে ভূখণ্ডে চার-পাঁচ হাজার বছর আগে মহাজ্ঞানী মানুষ ছিলেন, সেখানকার মানুষের নৈতিকতার তুলনা পশ্চিমের কোনো দেশে নেই। আজ আমাদের এতটা নৈতিক অধঃপতন হবে কেন? আর্থসামাজিক উন্নয়ন আর সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ ও নৈতিক অধঃপতন একসঙ্গে চলতে পারে না। এর যেকোনো একটা জয়লাভ করবে।
সমাজকে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদমুক্ত করা না গেলে আর্থসামাজিক উন্নতির গতি থেমে যাবে। বিশেষ করে, নারী প্রগতি থেমে যাবে। সেটা এই যুগে খুব বড় ক্ষতি। ভবিষ্যৎ হবে তমসাচ্ছন্ন। যে মেয়ে আজ মাধ্যমিক পাস করল, তার মেয়ে বা ছেলেকে সে অন্তত বিএ, বিএসসি, বিকম পাস করানোর স্বপ্ন দেখবে। মেয়েদের উন্নতির পথে যেসব বাধা আছে, তা অপসারণের ব্যবস্থা করলে তারা নির্বিঘ্নে নিজেরাই পথ চলতে পারবে। সমাজ থেকে সন্ত্রাসবাদী ভয় দূর করার দায়িত্ব সরকারের। কখনো সেটা করতে গেলে লাঠির সদ্ব্যবহারের প্রয়োজন হবে, কিন্তু লাঠিই সব সমস্যার সমাধান নয়। রাষ্ট্রে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও সমাজে উচ্চতর নৈতিক মান প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সবকিছু সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। নৈতিকতা একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার। পারিবারিক বা রাষ্ট্রীয় নয়। জঙ্গিবাদের পথে যারা গেছে তারা ব্যক্তিগতভাবে গেছে, পারিবারিকভাবে যায়নি। একই পরিবারের সব সদস্য একসঙ্গে সৎ হবেন বা একটি সরকারি প্রশাসন বিশেষ একটি দিন বা সপ্তাহ থেকে দুর্নীতিমুক্ত হবে, তা অবিশ্বাস্য। সৎ ও নীতিমান হওয়ার জন্য বংশগত ও জন্মগত স্বভাবের ভূমিকা আছে বটে, তবে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত খুব বড় ব্যাপার।
আজ জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের যে প্রকোপ দেখা দিয়েছে, এর জন্য প্রধানত বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর নেতারা দায়ী। তাঁদের পাপের বোঝা বইতে হচ্ছে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের মানুষকে। কোথাকার আলাই-বালাই আজ আমাদের সমাজে ঢুকে পড়েছে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ আমাদের খুঁজে নিতে হবে।
দুর্নীতির কারণে আমরা কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারিনি। তার সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী তৎপরতা। অপচয়, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস কমাতে পারলে আর্থসামাজিক অগ্রগতি এখন যা হয়েছে, তার চারগুণ হতো। শান্তিপূর্ণ সমাজে মানুষকে স্বাধীনভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিলে সরকারের ওপর চাপ কমে। মানুষকে আতঙ্কের মধ্যে থাকতে বাধ্য করলে তারা রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য বোঝা।
বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমেই নির্ভর করছে জাতির ভবিষ্যৎ। অতীতের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়, কিন্তু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে প্রয়োজনমতো গড়ে তোলা সম্ভব।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন