রাষ্ট্র হলো সমাজের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো জমিদারি বা জোতদারের তালুকের বিরাট পার্থক্য। রাষ্ট্র জয়েন্ট স্টক কোম্পানিও নয়। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হয় তার সংবিধান দ্বারা। অল্প কিছু মানুষ তাদের খুশিমতো রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করলে তাকে বলে ফ্যাসিবাদ। যেখানে জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত, তা হলো গণতন্ত্র। বাংলাদেশের সংবিধান বলে দিয়েছে, বাংলাদেশ হবে একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, যেখানে ‘সব ক্ষমতার মালিক জনগণ’।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জনগণই ত্যাগ স্বীকার করেছে, নির্যাতন সহ্য করেছে এবং অকাতরে রক্ত দিয়েছে। তারপর তারা পেয়েছে মালিকানা। কোনো কিছুর মালিকানা কারও থাকলে তাকে ভালোভাবে গড়ে তোলার দায়িত্বও তার। বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব বাংলাদেশের জনগণেরই, অন্য কারও নয়।
সংবিধান অনুযায়ী গঠিত সরকার দেশে নাগরিকদের তাদের যার যার প্রতিভা অনুযায়ী দেশ গঠনের সুযোগ দিলেই তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে। প্রত্যেকেই যদি তার খেয়ালখুশিমতো দেশের জন্য কাজ করতে চায়, তাহলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সে জন্য কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা সরকারের। সরকার জনগণের আবেগ-অনুভূতিকে বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। তা বাস্তবায়নে কাজ করবে সবাই।
আজ রাষ্ট্র থেকে দুহাত ভরে পাওয়ার জন্য একশ্রেণির মানুষের যে আকুলতা এবং সরকারও রাষ্ট্রীয় ভান্ডার উজাড় করে দেওয়ার জন্য উদ্গ্রীব; যা শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের পথে বড় বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি ও তাঁদের সনদপ্রাপ্তি নিয়ে কিছুকাল যাবৎ অব্যাহতভাবে লেখা হচ্ছে। যে বিষয়টির ফয়সালা হওয়ার কথা ৪৫ বছর আগে, তা নিয়ে যা ঘটছে, তা বাঙালি জাতির সাধুতা ও সত্যনিষ্ঠা প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।
বাংলাদেশের নেতারা কখনো যে গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত নেননি, তা নয়। কিন্তু সরকারের গৃহীত অনেক ভালো প্রস্তাব বাস্তবায়িত না হয়ে পরিত্যক্ত হয়েছে। তার ফলে দেশ ও জনগণ কিছু পায়নি। একটি বিষয়ের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায়। ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের এক সপ্তাহ পর প্রবাসী অস্থায়ী সরকারের নেতারা কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। চার দিন পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৬ ডিসেম্বর। তখন আমরা পূর্বাণী হোটেলে সরকারের ইনফরমেশন সেলে কাজ করি। কয়েকজন ভারতীয় সাংবাদিক ও সে দেশের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাও ছিলেন। রাজধানী ঢাকা নগরীর সে এক অদ্ভুত সময়। শোক ও বেদনায় স্তব্ধ নগরী। নগরীর বিভিন্ন ড্রেন থেকে ভেসে আসত গলিত লাশের গন্ধ। রায়ের বাজার, মিরপুর প্রভৃতি এলাকায় লাশের স্তূপ। নাকে রুমাল না চেপে ওসব জায়গায় যাওয়া যেত না। দেশের স্বাধীনতার জন্য যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন, তাঁদের নিশ্চয়ই প্রত্যাশা ছিল একটি সুখী সমাজের। স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে যাঁরা বেঁচে ছিলেন, তাঁদেরও স্বপ্ন ছিল। সে স্বপ্ন একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ এবং সেই সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ গঠনে মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁরাও ভূমিকা রাখবেন। ১৬ ডিসেম্বরের আগে প্রতিরোধ যুদ্ধ যে যাঁর মতো করেছেন। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্র সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। সুতরাং, সরকারের নির্দেশনামতো সবাইকে কাজ করতে হবে। তা করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন সবাই। সেই চেতনা থেকেই প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে মুক্তিবাহিনীর সব সদস্যের দ্বারা ‘জাতীয় মিলিশিয়া’ গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। মুক্তিবাহিনীর প্রভাবশালী নেতাদের দাবিও ছিল তা-ই। ওই লক্ষ্যে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের নাম সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং তা অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দিতে বলা হয়।
জাতীয় মিলিশিয়া গঠন সম্পর্কে সরকারের প্রেস নোটে বলা হয়েছিল:
‘...গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মনে করেন যে, মুক্তিবাহিনী প্রতিভাসমূহের এক অপূর্ব ভাণ্ডার—যাঁহারা দেশ পুনর্গঠন, উহার অর্থনৈতিক কাঠামো পুনরুদ্ধার এবং যত শীঘ্র সম্ভব উন্নতি লাভের জন্য এক নূতন নেতৃত্ব দান করিতে সক্ষম। [ সেই লক্ষ্যে]...অনতিবিলম্বে একটি জাতীয় মিলিশিয়া গঠন করা হইবে এবং তালিকাভুক্ত হউক বা না হউক, সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাকে ইহার আওতায় আনা হইবে।’
যাঁরা একটি পৈশাচিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে তাদের পরাভূত করতে পারেন, তাঁদের পক্ষে দেশ পুনর্গঠনের কাজ করা মোটেই কঠিন নয়। সেদিনের বিধ্বস্ত দেশের ‘অর্থনৈতিক কাঠামো পুনরুদ্ধার’ করাও কঠিন ছিল না। তাই ওই প্রেস নোটে আরও বলা হয়েছিল, ‘আর্থসামাজিক মৌল রূপান্তরের প্রধান শক্তি হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সমবায়ে জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের’ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আমার জানামতে, সরকারের ওই সিদ্ধান্তকে সেদিন শুধু মুক্তিযোদ্ধারা নন, সব মানুষই স্বাগত জানিয়েছিলেন। বিশেষ করে, আশান্বিত হয়েছিলেন গ্রামের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার ও কৃষকশ্রেণি থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধারা।
মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের নামগুলো যখন বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে আসতে থাকল, তখনই সরকার অজ্ঞাত কারণে ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। সেটা হবে ’৭২-এর জানুয়ারির শেষ দিক। সশস্ত্র বাহিনী ও ইপিআরের সদস্যের তালিকা নিয়ে সমস্যা ছিল না, বেসামরিক নাগরিকদের তালিকা যাচাই-বাছাই করতে দুই সপ্তাহের বেশি লাগেনি। ওই তালিকাই ছিল বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে মৌলিক ও খাঁটি তালিকা। ‘ষোড়শ বাহিনী’ কথাটি চালু হয়েছিল বটে, কিন্তু তারা মানুষের কাছে গৃহীত ছিল না।
‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি আরও অনেক পরে উদ্ভাবিত, যখন বিভিন্ন সরকারের সময়ে ভুয়া ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’য় ভরে যেতে থাকে সচিবালয় থেকে গ্রাম-গঞ্জ-জনপদ।
প্রথম মন্ত্রিসভার পরদিনই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ঘুরে ঘুরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলেন। অধিকাংশই জীবিকার কারণে কর্মস্থল ছেড়ে কলকাতা যেতে পারেননি। তাঁরা অজ্ঞাত অমঙ্গলের আশঙ্কায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাজউদ্দীন সাহেব তাঁদের অনেকের কাছে জানতে চাইলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথায় পোস্টিং ছিল। কেউ কেউ অপরাধ স্বীকার করার ভঙ্গিতে নিচু স্বরে বললেন, অমুক ডাইরেক্টরেটে বা মিনিস্ট্রিতে।
তাজউদ্দীন সাহেব বিচক্ষণ মানুষ। তিনি তাঁদের অভয় দিয়ে বললেন, তাতে কী? সবাই ওপারে যাবে না। মন দিয়ে কাজ করুন। এখন দেশ পুনর্গঠনের সময়।
তাজউদ্দীন সাহেব ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেও গিয়েছিলেন। অবশ্য তখন আর তিনি প্রধানমন্ত্রী নেই, অর্থমন্ত্রী। আমার সুযোগ হয়েছিল তাঁর সঙ্গে জেলখানায় যাওয়ার। বাংলার অধ্যাপক কাজী দীন মোহাম্মদকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনিও এইখানে?’ কারাগারের ফটকের কাছে এসে তিনি বললেন, ‘এরা সবাই আমাদের চেনাজানা লোক। কী মুশকিল!’
এরপর কিসের মধ্যে কী হয়ে গেল। একশ্রেণি প্রাপ্তিযোগের জন্য ন্যূনতম নীতি-আদর্শ বিসর্জন দিল। বিশাল একটি অংশ, যাঁদের প্রথম মন্ত্রিসভা আখ্যায়িত করেছিল ‘প্রতিভাবান মানুষ’ বলে, তাঁরা দেশ পুনর্গঠনের কোনো সুযোগই পেলেন না। কোনো রকম সুযোগ-সুবিধা না পেয়ে অনেকে হতাশ হয়ে সব কাজকর্মে উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। কেউ সরকারবিরোধী অবস্থানে চলে গেলেন, কেউ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার উৎখাতে আত্মনিয়োগ করলেন এবং ‘মারেঙ্গা অথবা মরেঙ্গা’ বিপ্লবী নীতিতে খুন করতে লাগলেন এবং খুন হতে লাগলেন। বাহাত্তরে জাতীয় মিলিশিয়া গঠিত হলে মেজর জলিলরা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠনের একজন কর্মীও খুঁজে পেতেন না। রক্ষীবাহিনী গঠনেরও প্রয়োজন হতো না।
বীরত্ব জিনিসটি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রয়োজন হয়, চাকরি রক্ষায় নয়—প্রমোশন ও দুটো ইনক্রিমেন্ট আদায়ে তো নয়ই। মুক্তিযোদ্ধার সনদে কোনো মধুই থাকত না, যদি না তার মধ্যে চাকরিবাকরি-পদোন্নতি প্রভৃতির সম্পর্ক থাকত। ভুয়ারা ভুলে গেছেন, একটি বিএ, বিএসসি বা এমএ, এমকম বা এমএসসির সার্টিফিকেট আর মুক্তিযোদ্ধা সনদ এক জিনিস নয়। মুক্তিযোদ্ধা সনদ কোনো ডিগ্রি নয়, ডিগ্রির চেয়ে হাজার গুণ বেশি এক অমূল্য স্বীকৃতি। ডিগ্রির সার্টিফিকেটে চাকরি হয়, পদোন্নতি পাওয়া যায়; দেশপ্রেমের সার্টিফিকেটে ইতিহাসে স্থান হয়। সামান্য চাকরির চেয়ে ইতিহাস বড়—এই বোধ যাদের নেই, তাদের এই সনদ দেওয়া আর একটি বৃক্ষকে ওই সনদ দেওয়া একই কথা। পার্থক্য শুধু এইটুকু যে বৃক্ষ সনদের অপব্যবহার করবে না, অসাধু সনদ বিক্রি করে খাবে।
বিশেষ এক প্রয়োজনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলাম। তিনি আমার পুরোনো ঘনিষ্ঠ, সেই বাহাত্তর থেকে। তাঁর অফিসের লিফটের গোড়া থেকে বারান্দা প্রভৃতি জায়গায় প্রচুর মানুষ। অনেকেই বীর মুক্তিযোদ্ধা পদবিপ্রার্থী। অনেকের বয়স পঞ্চাশের মতো। আমাকে পেয়ে একজন বেদনা প্রকাশ করলেন, কোনো কারণে আগে সার্টিফিকেট নেওয়া হয়নি, এখন তা পাওয়ার জন্য জুতার সুকতলি ক্ষয় করছেন। বললাম, এত দিন পর ওটা নিয়ে আর কী করবেন? বললেন, প্রমোশন আটকাইয়া আছে।
জাতি হিসেবে আমাদের অনেক গুণ আছে, কিন্তু দোষগুলোর মধ্যে একটি হলো আমরা কোনো কিছুর মহিমা উপলব্ধি করতে পারি না, রক্ষাও করতে পারি না। বরং বলা ভালো, যা কিছু মহান ও গৌরবের, তাকে তুচ্ছ করে ফেলি এবং তার গৌরব নষ্ট করি। যে দেশে আসল অবহেলিত এবং ভুয়াতে ভরপুর, সে দেশের গৌরব করার মতো কিছু থাকে না।
কোনো কিছুর ভুয়ার আধিক্য কখন হয়ে থাকে? বস্তুগত প্রাপ্তি, ভাতা, সুযোগ-সুবিধা কোটা প্রভৃতি যত বাড়বে, তার দ্বিগুণ, তিন গুণ অনুপাতে বাড়তে থাকবে ভুয়া। কোনো সরকারের পক্ষেই ভুয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, কারণ সব সরকারের কিছু ভুয়ার প্রয়োজন খুব বেশি।
যেসব উপাদান প্রশাসনে ও সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে, সেগুলো যত দ্রুত দূর করা যায়, ততই মঙ্গল। গণতান্ত্রিক সমাজে এবং আমাদের সংবিধান মোতাবেক কোনো শ্রেণিই বিশেষ সুবিধা ভোগ করার অধিকার রাখে না। কৃতী তাঁর কাজের জন্য সমাজ থেকে সম্মান ও মর্যাদা পান। একজন মহান দেশপ্রেমিককে মানুষ সম্মান জানিয়ে সালাম দেয়, দেশপ্রেমের জন্য তাঁর পকেটে কিছু টাকা গুঁজে দেয় না। যে তার দেশপ্রেমের বিনিময়ে কিছু অর্থ চায় বা অন্য কোনো বস্তু চায়, সে মর্যাদা পাওয়ার যোগ্যতা হারায়।
প্রতিটি দায়িত্বশীল সরকারের কর্তব্য কিছু বিষয় ন্যায়নিষ্ঠ ও নির্মমভাবে ফয়সালা করা। সে রকম একটি বিষয় মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রদান। মুক্তিযোদ্ধার সনদ বিতরণ স্কুল প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে সনদ বিতরণের মতো হওয়া কাম্য নয়। কোনো কোনো বিষয় জাতীয় সংহতির স্বার্থে একটি জায়গায় শেষ করা উচিত। কিছু মানুষকে অনৈতিক সুবিধা দিতে গিয়ে সরকারকে ইতিহাসের কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন