দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রতিবাদ সমাবেশদুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রতিবাদ সমাবেশ
রাষ্ট্র একটি প্রকাণ্ড জিনিস। এবং সেই রাষ্ট্রের জনসংখ্যা যদি হয় ১৬-১৭ কোটি, তাহলে সেটি কোনো ছোট রাষ্ট্র নয়, নিঃসন্দেহে বড় রাষ্ট্র, তার ভৌগোলিক আকার যা-ই হোক। সেই হিসাবে বাংলাদেশ কোনো ছোট রাষ্ট্র নয়। এই রাষ্ট্রে যদি কখনো একটি বীভৎস বা লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে, তাতে জনগণের এবং সরকারের বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু যদি একই ধরনের বর্বরোচিত ঘটনা অব্যাহতভাবে ঘটতে থাকে, তাহলে তা বিচার-বিশ্লেষণ ও ঐকান্তিক বিবেচনার দাবি রাখে। রাষ্ট্র ও সমাজকে জবাব দিতে হবে কেন সেসব ঘটছে।
সব মানুষের মধ্যেই কমবেশি মানবীয় গুণ আছে বলেই তাকে বলা হয় সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষ যেহেতু একটি প্রাণী, পাথর বা কয়লার মতো শিলাখণ্ড নয়, সুতরাং একটি পশু হিসেবে তার মধ্যে পশুত্বও থাকবে। বিচার-বিবেচনাহীন নৈতিকতাবিবর্জিত আচরণকে মানুষ নাম দিয়েছে পশুত্ব। কোনো কোনো মানুষের মধ্যে পশুত্বের প্রকাশ বেশি।
কোনো সমাজের একটি বড় অংশের মধ্যে যদি মনুষ্যত্বের চেয়ে পশুত্বের পরিমাণ বেশি থাকে, তাহলে সেই সমাজকে আমরা নিকৃষ্ট সমাজ বলব। পশুত্বের প্রকাশ নানাভাবে ঘটতে পারে। তবে যে সমাজে নারী ও শিশু, বিশেষ করে মেয়েশিশুও লম্পট পুরুষদের থেকে নিরাপদ নয়, সে সমাজ নষ্ট সমাজ। সে সমাজে যতই বড় বড় ব্রিজ-কালভার্ট থাক, আকাশে উঠে যাক উঁচু দালান, সে দেশে যতই নামীদামি হোটেল-রেস্তোরাঁয় ভরে যাক নগরীর অভিজাত এলাকা, জুয়েলারি ও কাপড়ের দোকানে ঝলমল করুক সুপারমার্কেট, রাস্তায় হাজার হাজার দামি গাড়িতে যানজট সৃষ্টি হোক। যে সমাজে নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নেই, মানুষের মর্যাদা নেই, ন্যায়বিচার নেই, মিথ্যার ওপরে সত্যের স্থান নেই, সে সমাজ নষ্ট সমাজ।
আগেই বলেছি, হঠাৎ একটি লোমহর্ষক বা নারকীয় ঘটনা ঘটলে তা মানুষকে দুঃখ দেয়, কিন্তু বিচলিত বা আতঙ্কিত করে না। আমি যখন এই লেখাটি লিখছি সেই দিনের পত্রিকায় পাঁচটি ধর্ষণ ও ধর্ষণের পরে হত্যার খবর বেরিয়েছে। তাদের সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ। অপরাধীদের অবস্থা নিহত ব্যক্তিদের চেয়ে কিছু ভালো। ওসব ছোট খবর কারও মধ্যে এখন আর করুণার উদ্রেক করে না। হঠাৎ হঠাৎ দু-একটি ঘটনা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কারণে নয়, মিডিয়ার কারণে সংবাদ শিরোনাম হয় এবং তা সমাজে আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয় কয়েক দিনের জন্য। আর একটি বড় ঘটনা ঘটলে আগেরটি ভুলে যায় মানুষ। যেমন এখন আর কুমিল্লার তনু হত্যার কথা মানুষের মনে নেই। এবং তনুকে ভুলে যাওয়ার আগেই বুঝে গিয়েছিল ওই ধর্ষণ ও হত্যার কোনো বিচারিক সুরাহা হবে না। কখনো কখনো সমাজের মানুষের অনুমান শতভাগ সত্য হয়।
স্বাধীনতার আগেও এ দেশে যুবসমাজ ছিল। যুবক-যুবতী ছিল। তাদের মধ্যেও আবেগ ছিল। ছেলেমেয়েদের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণও ছিল। কেউ কেউ তখনো প্রেম-ভালোবাসা করেছে। প্রেম-ভালোবাসা মানবসন্তানের চিরকালের বিষয়। নর-নারীর প্রেম না থাকলে অত সুন্দর বৈষ্ণব পদাবলি রচনা সম্ভব হতো না। ষাটের দশকের তরুণদের মধ্যে তারুণ্য ছিল, লাম্পট্য ছিল না। আদৌ ছিল না তা নয়, দশ-বিশ লাখের মধ্যে দু-একজনের ছিল।
ফাজিল-ফখরা যুবক তখনো ছিল। কিন্তু তাদের আচরণেও একধরনের সংযম ছিল। সীমা অতিক্রম করতে তারা দ্বিধা করত। কোনো সুন্দরী মেয়েকে স্কুল-কলেজে যেতে দেখলে ফাজিল প্রকৃতির কোনো ছেলে দূর থেকে শিস দিত। অথবা কেউ তার দিকে দূরে গাছের আড়াল থেকে তাকাত। কিংবা কেউ সজোরে গলা খাকারি দিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করত। আজিমপুর কলোনির জানালায় কোনো মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে কেউ আড়চোখে তাকিয়ে সিনেমার নায়কের মতো সিগারেট ফুঁকত। আমরা ওই কাজকে বলতাম টাংকি মারা। কিন্তু যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের কথা এবং ধর্ষণের পর হত্যার কথা শোনা যায়নি।
ষাটের দশকে আমরা যারা তরুণ ছিলাম, টাকাপয়সার নিতান্ত টানাটানি ছিল, তার মধ্যেও রেস্তোরাঁয় বসতাম। পকেট গরম থাকলে মোগলাই পরোটা, কাটলেট বা কাচ্চি হতো; তা না হলে দু আনার একটা শিঙাড়া ও দু আনার এক পেয়ালা চা খেয়েই রেস্তোরাঁয় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা হতো। সেকালে কী ছিল আড্ডার বিষয়? আমেরিকা বা রাশিয়ার কে মহাকাশে যাচ্ছেন, কোথায় মার্টিন লুথার কিং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার আন্দোলন করছেন, ভিয়েতনামে কোন সপ্তাহে কয়টি মার্কিন বিমান হো চি মিনের মুক্তিসেনারা ভূপাতিত করেছেন, লাতিন আমেরিকায় বামপন্থী আন্দোলন কতটা জোরদার হলো, চে গুয়েভারা পুঁজিবাদী বিশ্বের নেতাদের কতটা টনক নড়িয়ে দিলেন প্রভৃতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হতো।
ওই সব নীরস বিষয়ের বাইরে মজাদার জিনিসও আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল। বৈজয়ন্তী মালা বা আশা পারেখের শরীরের কোন অংশ কতটা উন্মুক্ত, সুচিত্রা সেনের থ্রি-কোয়ার্টার হাতার ব্লাউজে বাহুর কতটা দেখা যায়, নীলো কতটা মুটিয়ে যাচ্ছেন, কিংবা মুশায়রাত নাজিরের মোহনীয় ফিগার এবং মুম্বাই, লাহোর ও কলকাতার নায়ক-নায়িকাদের জীবনাচরণ নিয়েও কথা হতো। আমাদের শাবানা-আজিম, রহমান-শবনম, রাজ্জাক-সুচন্দা, সুজাতা, ববিতা, কবরীও আলোচনায় আসতেন। গাড়লের মতো আলোচনা নয়, বুদ্ধিদীপ্ত বিতর্ক হতো। রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে অথবা জন্মদিন পালনের নাম করে মেয়েদের নিয়ে ধর্ষণের কথা সেকালে কারও কল্পনায়ও আসেনি। স্বাধীনতার আগে ঢাকায় অনেকগুলো চায়নিজ রেস্তোরাঁ ছিল। দশ টাকায় চারজন খেতে পারত। অনেক রাত পর্যন্ত সেগুলো খোলা থাকত। কিন্তু যৌন অপরাধের ঘটনা কোথাও ঘটেনি।
জন্মদিন একটা বিশেষ আনন্দের দিন। যদি কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে তার জন্মদিন পালন করতে চায় তা করবে বাবা-মা-ভাই-বোন ও প্রিয়জনকে নিয়ে। হোটেলেও খানাপিনা–ফুর্তি করতে পারে। যৌন খায়েশ মেটানো আর জন্মদিনের আনন্দ এক জিনিস নয়। ধনীর দুলালের জন্মজয়ন্তী পালন উপলক্ষে কয়েকটি মেয়েকে নিয়ে রেস্তোরাঁয় একটি কক্ষে আটকে বডিগার্ড-ড্রাইভারসহ বন্ধুবান্ধব মিলে যৌন নিপীড়ন চালানো একটা অন্য রকম বিষয়। প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারী পারস্পরিক সম্মতিতে অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু প্রতিটি সভ্য সমাজ বলে, রেস্তোরাঁয় গিয়ে রুম ভাড়া করে ফাতরামি করা ঘোরতর অপরাধ।
ঘটনা কি একটি? কোনো একটি ঘটনা কোনো কারণে মাসখানেক পরে জানাজানি হয়েছে। ও রকম যে কত ঘটছে প্রতি রাতে অভিজাত এলাকার হোটেল-রেস্তোরাঁয় তা শুধু জানেন বিধাতা এবং ওই সব রেস্তোরাঁর ম্যানেজার ও কর্মচারীরা। পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেল কিছু কিছু হোটেল-রেস্তোরাঁ-গেস্টহাউস এবং অননুমোদিত গেস্টহাউসের অপকর্ম নিয়ে প্রতিবেদন করে। কিন্তু সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সে রকম কিছু শোনা যায় না। পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যানেল এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের চাপ না থাকলে বিত্তবানদের দুলালদের কেলেঙ্কারি নিয়ে থানা-পুলিশের মাথাব্যথা নেই।
আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা মিডিয়ার প্রচারধন্য। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন একটি বক্তৃতাসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। দুই ছাত্রীর ঘটনার পর তারা জাতিকে জানিয়ে দিল তাদের বন্ধুদের দ্বারা তাদের জীবনে যা ঘটেছে তা ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’। যেন আমরা তা জানি না। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মিডিয়ার সামনে রেস্তোরাঁর পক্ষে যা বললেন, তা শুনে হয় হেসেছে নয়তো হতবাক হয়েছে অনেক শ্রোতা। তিনি বললেন, এই রেস্তোরাঁয় কোনো মাদকজাতীয় পদার্থ ছিল আমরা তেমন আলামত (পাঁচ হপ্তা পরে এসে) দেখতে পাইনি। কাস্টমসের গোয়েন্দা টিম আগে সেখানে পদধূলি দেয়নি, এখন মিডিয়ার সঙ্গে গেছে।
শুঁড়িখানায় গিয়ে সোমরস পান করে বেহাল হওয়া কিছু বঙ্গীয় নর-নারীর ফ্যাশন। সেদিন এক বাড়িতে দাওয়াত খেয়ে গুলশান থেকে ফিরছিলাম। রাত সাড়ে ১১টা। দেখলাম এক রেস্তোরাঁ থেকে তিন-চারজন নর-নারী বেরোচ্ছেন। এক যুবতীকে ধরাধরি করে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করছেন তঁার ছেলেবন্ধুরা।
মিডিয়ার কল্যাণে ‘ধর্ষণ’ আজ বাংলার মাটিতে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ। বাংলাদেশ নিম্নমধ্য আয়ের দেশ অর্থনৈতিকভাবে, কিন্তু সামাজিক দিক থেকে উচ্চ যৌন নিপীড়নের দেশ। অনেক যৌন নিপীড়নের ঘটনা লজ্জায় অনেকেই গোপন করে যাচ্ছে। যেগুলো প্রকাশ পাচ্ছে এবং মামলা হচ্ছে সেগুলোরও অধিকাংশের বিচার-শাস্তি হচ্ছে না। ফলে চার-পাঁচ বছরের মেয়েশিশু থেকে ৫০-৬০ বছরের নারীরও আজ নিরাপত্তা নেই। পোশাকশিল্পের দরিদ্র মেয়েদের শ্রমেই আজ আমরা ‘নিম্নমধ্য’ পর্যায়ে পৌঁছেছি। ২০২১ নাগাদ ‘মধ্যম’-এ প্রমোশন পাব। জিডিপি বাড়তে বাড়তে নাকি সাত ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের কী আনন্দ! বঙ্গীয় ছাত্রছাত্রীরা পাচ্ছে অঢেল জিপিও ফাইভ। বাংলাদেশ ২০৪১-এ পাবে ‘উচ্চ আয়ের’ তকমা। কিন্তু কী হবে সেই উচ্চ-মধ্যম দিয়ে, যদি নারী ও শিশুমেয়েদের নিরাপত্তা না থাকে? হবে যৌন নিপীড়নের নতুন নতুন রেকর্ড।
যদি কেউ বলে আমি যৌন নিপীড়নের মতো পাশবিকতা পছন্দ করি না, খুব ভালো কথা। কিন্তু তাকে তার প্রমাণ দিতে হবে। সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বা অপরাধীকে ঘৃণা জানাতে রাস্তায় নেমে স্লোগান দেওয়ার দরকার নেই। শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করা যায়, ঘৃণাও প্রকাশ করা যায়। যেমন যদি কেনো জুয়েলারির লোক ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়, তাহলে একজন ভালো নাগরিক কী করতে পারে।
একজন বিবেকবান মানুষ, বিশেষ করে কোনো নারী সেই জুয়েলারি থেকে কোনো অলংকার কিনবে না বলে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যে হীরা-মুক্তা-সোনার ব্যবসায়ী ও তার পুত্র ইয়ার-বন্ধুদের নিয়ে পৈশাচিক কাজে লিপ্ত হয়, তার প্রতিষ্ঠানের কোনো বিজ্ঞাপন কোনো পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল প্রচার না করলেই বোঝা যাবে এবং বলতে পারব, হ্যাঁ, আমাদের সমাজে বিবেক ও ন্যায়নীতি আছে। এখন শুধু মানববন্ধন নয়, ন্যায়নীতির দৃষ্টান্ত স্থাপনের সময় এসেছে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন