সরকারি দলের প্রাত্যহিক প্রচারণার প্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে নির্বাচনের আর মাত্র মাসখানেক বাকি। অথচ নেতারাই বলছেন, সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক মিনিট আগেও ক্ষমতা ছাড়বেন না এবং সেই অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন হবে। তাতে বাংলাদেশের মানুষ গুনে দেখছে নির্বাচন হতে আরও অন্তত দেড় বছর দেরি।
উপপ্রধান সরকারি দল জাতীয় পার্টির প্রস্তুতির পাঁয়তারা আরও প্রবল। ভবিষ্যতে তারা সরকার গঠন করবে, এই প্রত্যয় থেকে একটি ৫৮-দলীয় জোটও গঠন করেছে। ওই জোট বিজয়ী হলে প্রধান দল থেকে জনা ২৫ এবং অন্যান্য দল থেকে ৩-৪ জন করে সদস্যকে যদি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী করা হয়, তা হলে মন্ত্রিসভার সদস্যসংখ্যা দুই থেকে আড়াই শ ছাড়িয়ে যাবে। এবং সেই অনুপাতে মন্ত্রী পদমর্যাদার উপদেষ্টা যাঁরা নিযুক্ত হবেন, তাঁদের সংখ্যাও ২৫-এর কম হওয়া অসম্ভব।
সরকারে বাম ঘরানার দুই-আড়াইটি দল আছে। তারা সরকারি জোটের সি-টিম। নির্বাচিত প্রধান দল যা দেবে তাতেই তারা সন্তুষ্ট। নির্বাচনে খাড়া করে যদি পাস করিয়ে আনে তাতেই আনন্দ, আর যদি নির্বাচন-টির্বাচনের ঝামেলায় না জড়িয়ে টেকনোক্র্যাট কোটায় প্রাপ্তিযোগ ঘটে তাতেও পরমানন্দ। মন্ত্রী হওয়া নিয়ে কথা, কী প্রক্রিয়ায় হওয়া গেল, তা বিবেচ্য নয়।
আগামী নির্বাচনের প্রসঙ্গেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান সংসদের সদস্যদের উদ্দেশে বলেছেন, ২০১৪-তে কীভাবে তাঁরা সংসদ সদস্য হয়েছেন তা তাঁরা ভালোই জানেন, আগামী নির্বাচন সে রকম হবে না। অর্থাৎ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে। জনগণের ভোটে পাস করে আসতে হবে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ও বিনা ভোটে নয়। তাঁর কথা শোনার পর অনেকের রাতের ঘুম হারাম হওয়ার জো! অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্যে ঠিকমতো মন দিতে পারছেন না। চার-পাঁচটা মুঠোফোন অনবরত বাজতে থাকলেও ধরছেন না। মন খারাপ।
বিএনপি তাদের ভিশন নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। বাংলাদেশের জনগণ ভীষণ উদ্বিগ্ন দেশে গণতন্ত্র থাকবে কি থাকবে না—এই চিন্তায়, ভিশন-টিশন নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না। অনেকেই জানেন, ২০৩০ কিংবা ২০৪১ সাল পর্যন্ত তাঁরা ইহলোকে থাকবেন না। সুতরাং সেই সময় বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ হলেই কি, জাতিসংঘের ভেটো প্রদানকারী স্থায়ী সদস্য হলেই কি এবং এক নম্বর পরাশক্তি হলেই কি? মানুষ দেখতে চায় আগামীকাল, আগামী মাসে বা আগামী বছরে বাংলাদেশের কি অবস্থা দাঁড়াবে।
উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত না করেই একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন হোক, নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করুক, সেটাই সাধারণ মানুষের দাবি। সব লক্ষ্য অর্জনের এক একটি পর্যায় থাকে। প্রথম পর্যায় বাদ দিয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয় পর্যায় বা শেষ পর্যায় নিয়ে মাথা ঘামানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। জাতি চায় এখন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশে সাধারণ নির্বাচন জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য দেশের শাসনভার যে শুধু পেয়ে থাকেন তা-ই নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি নির্বাচন জাতির ভাগ্যে বিরাট পরিবর্তন আনতে পারে।
১৯৪৬ সালে যে নির্বাচন হয়, তাতে বাঙালি জাতির জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছিল। কিন্তু নেতৃত্বের দুর্বলতায়, শাসকদের গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাহীনতায় সেই পরিবর্তনকে ইতিবাচক ধারায় প্রবাহিত করা সম্ভব হয়নি। সেই অগণতান্ত্রিক অবস্থা থেকে অব্যাহতি পেতে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখে ১৯৫৪-এর সাধারণ নির্বাচন। চুয়ান্নর নির্বাচন শুধু পাঁচ বছর প্রদেশ শাসনের জন্য জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচিত করেনি, জাতির ভবিষ্যৎ রাজনীতির দিকনির্দেশনা দিয়ে যায়। ওই নির্বাচনের শিক্ষা ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে পৌঁছে দেয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত। পূর্ব বাংলা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান, যে শব্দটি বাঙালি আড়াই হাজার বছরে কোনো দিন শোনেনি, সেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তন ঘটে ‘বাংলাদেশ’-এর, যা তার আসল নাম। চুয়ান্নর নির্বাচন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। সেই ভূমিকা রেখেছে আরও একটি নির্বাচন: ১৯৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন। সত্তরের নির্বাচন এবং তারপর একাত্তরে গণহত্যা না হলে তার বিকল্প কি ছিল, তা শিশু ও মানসিক প্রতিবন্ধী ছাড়া যে কারও পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব। সেই বিকল্প ভালো হতো কি মন্দ হতো, তা কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচন ১৯৭৩-এর নির্বাচনটি হতে পারত এবং হওয়া উচিত ছিল জাতির জীবনে আরেকটি মাইলফলক। তা না হওয়ার পরিণতি এ দেশের জনগণ শুধু এখন নয়, ২০৭৩-এ গিয়েও উপলব্ধি করবে। ওই নির্বাচনে দেশ থেকে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার নীতি গ্রহণ করে শুধু যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন হয়েছে তাই নয়, অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানের পথ প্রসারিত করা হয়। যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে, সেই অঙ্গীকারকে অস্বীকার করা হয়। জনপ্রিয় নেতা দেশ পরিচালনা করছিলেন, তাঁর প্রতি মানুষের আস্থা ছিল, তাদের আশা ছিল, সেই অবস্থায় সংসদে ৩৫-৪০টি আসন বিরোধী দল থেকে থাকলে সরকারের এক ছটাক ক্ষতি হতো না। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আমার হাত ধরে বললেন, ‘তিহাত্তরেই সর্বনাশ হইয়া গ্যাছে, তার খেসারত আরও দিতে হইব।’ তা যে দিতেই হবে, তা আমি ঘরে ফিরে ভেবে দেখলাম। কারণ, কথাটি তিনি একজন প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে সংসদে দাঁড়িয়ে বলতে পারেননি। বললেন, প্রাইভেটলি আমাকে বা আমার মতো আরও কারও কারও কাছে।
চুয়ান্নর নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন নিজে এবং তাঁর দল শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা তাঁর তারিফ করেছেন। সে প্রশংসা তিনি পেয়েছিলেন এই জন্য যে সরকারপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁর প্রশাসনকে প্রভাবিত করার কিছুমাত্র চেষ্টা করেননি। সেটা করলে পরাজিত হলেও তাঁর দল মুসলিম লীগ আরও বেশ কিছু আসন পেত। সেকালের সিভিল সার্ভেন্টরাও সরকারের আনুগত্য স্বীকার করতেন, কিন্তু সরকারি দলের দাসত্ব বরদাশত করতেন না। সরকারি দলের ছাত্র-যুব সংগঠনের বশ্যতাও মেনে নিতেন না। তাঁরা ছিলেন প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের দাস নয়।
এখন অনেকের কাছে তাজ্জবেরমতো মনে হবে। পৃথিবীর ইতিহাসে জনা পাঁচেক কুখ্যাত বর্বরের একজন হলেও জেনারেল ইয়াহিয়া খানকেও সত্তরের নির্বাচনের পর অনেকে প্রশংসা করেছেন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। সেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ফলাফল যখন তিনি ও তাঁর সহযোগীরা অগ্রাহ্য করেন তখন এ দেশের মানুষের নিজের ভাগ্য নিজেদের গড়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকল না। অনিবার্য হয়ে যায় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অভ্যুদয় ঘটে যে বাংলাদেশের তার ১৯৭২-এ গৃহীত সংবিধানই যেকোনো দলের যেকোনো নির্বাচনের সবচেয়ে ভালো নির্বাচনী মেনিফেস্টো হতে পারে। তার সঙ্গে সময়ের প্রয়োজনে যোগ হতে পারে নতুন নতুন অঙ্গীকার। জাতীয় সংসদ দুই কক্ষবিশিষ্ট হবে না তিন কক্ষবিশিষ্ট হবে, তা এই মুহূর্তের জরুরি বিষয় নয়। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করা হবে না আরও বাড়িয়ে দেওয়া হবে, সেটাও পরে দেখা যাবে। দুই কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট থাকার কথার মধ্যে রাজনৈতিক দর্শনের কিছু নেই। বিএনপি বলছে দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা। তাদের জোটের জামায়াতে ইসলামী যদি বলে দুই কক্ষে হবে না তিন কক্ষবিশিষ্ট সংসদ চাই, তাতে যে দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে, তা বিশ্বাস করা আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকের পক্ষে কঠিন।
রাজতন্ত্রে বংশানুক্রমে রাজার ছেলে রাজা হয়। গণতন্ত্রে যিনি জনগণের আস্থাভাজন তিনিই নেতা হন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নতুন নেতৃত্ব তৈরি করে। পুরোনো ও প্রবীণ নেতৃত্ব কি তা হলে বাতিল হয়ে যাবে? না, তা নয়। তাঁরা নতুন নতুন নেতৃত্বের অভিভাবক হিসেবে শ্রদ্ধার আসনে থাকেন। নতুনদের তাঁরা বুদ্ধি-পরামর্শ দেন। নতুনরা ভুল করলে মুরব্বির মতো তাঁদের শাসন করেন। গণতন্ত্রে নতুন-পুরানোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিপর্যয়ের কারণ নতুন নেতৃত্ব তৈরির পথ বন্ধ বহুদিন। দুই দল তাদের ভিশন ও রূপকল্প বাদ দিয়ে যদি পাঁচজন করে তাদের ভবিষ্যৎ নেতার নাম ঘোষণা করত, তাহলে জনগণের মধ্যে আশার সৃষ্টি হতো। ওই দশজনের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো জাতিকে তাঁরা কত ভালো নেতৃত্ব দিতে পারেন। তাঁদের কারও থেকে যদি কোনো ভিশন আসত, জনগণ সেটা বিবেচনা করত।
নির্বাচনের আওয়াজ যখন উঠেছে তখন নির্বাচন একটা হবেই। গণতান্ত্রিক রাজনীতি এবং বঙ্গীয় নির্বাচন এক জিনিস নয়। একশ্রেণির রাজনীতি করনেওয়ালাদের কাছে নির্বাচন একটি অর্থনৈতিক প্রকল্প। আরও সোজা করে বলতে গেলে বাণিজ্য। একজন শিল্পোদ্যোক্তা যখন একটি শিল্পকারখানা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন, তিনি তা করেন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য। বর্তমান অবস্থায় একজন জনদরদি নির্বাচিত হতে চান বৈষয়িকভাবে লাভবান হওয়ার লক্ষ্যে। তাঁর আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার তিলমাত্র সম্পর্ক নেই।
যে নির্বাচনী ব্যবস্থা আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে, তা গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূল নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তাই নির্বাচনী ব্যবস্থা একটা স্রেফ অর্থনৈতিক ব্যাপার, এর মধ্যে রাজনীতির লেশমাত্র নেই। এই নির্বাচনী ব্যবস্থায় যে পরিমাণ টাকা খাটিয়ে ২৫ বছরে যে মুনাফা হবে, কোনোক্রমে নির্বাচিত হলে একজন সাংসদ ৩-৪ বছরেই তার বহু গুণ অর্জন করতে পারেন।
তারপরও বলব, বাস্তবতার বাইরে আমরা যেতে পারব না। নিয়তি বাংলার মানুষকে এই অবস্থার মধ্যেই থাকতে বাধ্য করেছে। তাই বলব, যিনি যে দলেরই হোন, অঢেল টাকা ঢেলে বা যে প্রক্রিয়ায়ই নির্বাচিত হোন, শপথ নেওয়ার পর তাঁর প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় সংবিধান রক্ষা করা। সংবিধান রক্ষার সংজ্ঞা হলো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি অবিচল থাকা এবং মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা। ইট-পাথর, লোহালক্কড় ও সিমেন্টের মাধ্যমে যে উন্নয়ন তা অন্য জিনিস, গণতন্ত্র নয়। আগামী নির্বাচন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নির্বাচন হোক—এই প্রত্যাশা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন