নির্মাতার উপস্থিতিতে মাঝরাতে শুরু হয় ভাস্কর্য অপসারণের কাজঢাকা মহানগরীর মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা, নৈঃশব্দ্য হঠাৎ ভাঙে হাতুড়ি-শাবলের দুমদাম শব্দে। আশপাশের উঁচু বৃক্ষগুলোর শাখায় ঘুমিয়ে ছিল কাক ও অন্যান্য পাখপাখালি। ভয়ে তারা ডালের আশ্রয় ছেড়ে উড়াল দেয়। নিকটবর্তী ফুটপাতে ঘুমিয়ে ছিল পথবাসী ছিন্নমূল মানুষেরা। সন্তান বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিল মা। তারাও ধড়মড়িয়ে ওঠে। তারা দেখে রাতদুপুরে পুলিশে ভরে গেছে হাইকোর্ট এলাকা।
একদিন সবার অলক্ষ্যে গ্রিক দেবী থেমিসের আবির্ভাব ঘটেছিল এথেন্স থেকে বাংলার মাটিতে। বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের মন জয় করতে তিনি পোশাক বদলে পরেছিলেন বাঙালি নারীর প্রিয় শাড়ি। অবশ্য শাড়ির বদলে সালোয়ার-কামিজ পরালেও কোনো লাভ হতো না। বাংলার মাটিতে শুধু জাতীয়তাবাদীরা নয়, মৌলবাদীরাও এখন অধিপতি। তারা কোনো দেব-দেবীকে এ দেশে ভিসা দেবে না। আর দেবীর মূর্তি হলে তো নয়ই। সমস্ত নগর যখন ঘুমিয়ে, তখন নীরবে নয়, সশব্দে দেবীর তিরোধানের আয়োজন হয়।
দেবীর পায়ের দিকে যখন শাবল ও কুড়ালের কোপ এবং হাতুড়ির বাড়ি পড়তে থাকে, তখন যদি তাঁর বাংলা ভাষায় কথা বলার শক্তি থাকত, তাহলে থেমিস বলতেন, পায়ের গোড়ালিতে বড্ড লাগছে। আমাকে দিনের বেলায়ও সরাতে পারতে। শ্রমিক বেচারাদের রাতের ঘুমটা নষ্ট হতো না।
মহান নাট্যকার ইউরিপিডিস প্রমুখের গ্রিক ট্র্যাজেডিগুলোতে দেখা যায় চার অঙ্ক। প্রথম অঙ্কে সূচনামূলক স্বগতোক্তি, যাকে বলে প্রলগ, দ্বিতীয় অঙ্কে মূল বিষয়ের বর্ণনা, তৃতীয় অঙ্কে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এবং শেষ অঙ্কে কোরাসের মাধ্যমে বিয়োগান্ত ঘটনার বেদনার প্রকাশ। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট চত্বরের থেমিসের জীবনেরও চারটি পর্ব ছিল। শেষ পর্বটি গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো বড়ই করুণ।
ব্রিটিশ শিল্পী স্যার হেনরি মুরের আধা বিমূর্ত ব্রোঞ্জের কিছু কাজ সচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সেগুলোর দিকে তাকালে চোখ জুড়ায়। ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশেই স্যার হেনরির বহু কাজ প্রদর্শিত হচ্ছে। ভাস্কর্য বস্তুটির সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক আছে, তা আমার এই জীবনে আগে কোনো দিন শুনিনি, কিছুকাল যাবৎ শুনছি।
ইরান ইসলামিক রিপাবলিক। ইসলামবিরোধী কোনো কাজ সেখানে কেউ করলে তার ঘাড়ের ওপর মাথাটা থাকে না। তেহরান মহানগরীর একেবারে কেন্দ্রের সড়ক দিয়ে যাচ্ছিলাম। দূর থেকে চোখে পড়ল তিনতলা সমান উঁচু এক ভাস্কর্য। পাশে বসা সুন্দরী নারীকে জিজ্ঞেস করলাম, ওটা কার মূর্তি। তিনি বললেন, শাহনামার কবি আবুল কাসেম ফেরদৌসীর। কৌতূহলবশত ফেরদৌসীর পায়ের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। সুন্দরীকে বললাম, ভেবো না যে তোমাকে আমি ভাব দেখাচ্ছি। ফেরদৌসী আমাদের দেশে অনূদিত এবং পঠিত। তেহরানসহ পারস্যের সব নগরীই মূর্তি বা ভাস্কর্যে ভরপুর। ওই দেশটিও তৌহিদী জনতার দেশ। সেই তৌহিদী জনতা তাদের তাকদ দেখায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে, প্রাণহীন মূর্তির সঙ্গে নয়।
সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে গ্রিক ট্র্যাজেডি মঞ্চস্থ হওয়ার পর পত্রপত্রিকা বঙ্গীয় ভাস্কর্য বা মূর্তি নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির মতামত প্রকাশ করছে। প্রবীণ চিত্রশিল্পী হাশেম খান সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের সামনে যে ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছিল, সেটি নকল। তিনিই তো পরিষ্কার করে দিয়েছেন, ঢাকা শহরে এমন অনেক ভাস্কর্য রয়েছে, যেগুলো অপরিকল্পিত, রুচিহীনতার পরিচয়। বাংলা একাডেমির সামনে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, উদয়ন স্কুলের সামনে যা করা হয়েছে, তা আদৌ কোনো ভাস্কর্য নয়। এগুলো ভাস্কর্যের নামে অনাচার। এগুলো বানিয়ে ঢাকা শহরকে নোংরা করা হচ্ছে। এসব সরিয়ে ফেলে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে ভাস্কর্য স্থাপন করতে হবে। ভাস্কর্যের নামে এসব ধোঁকাবাজি বন্ধ করা দরকার।’ [সকালের খবর, ২৭ মে, ২০১৭]
অত্যন্ত মূলবান কথা বলেছেন শিল্পী হাসেম খান। একই রকম কথা আমাকে বলেছেন আরও কোনো কোনো প্রখ্যাত শিল্পী। কোনো সরকারি স্থাপনায় ভাস্কর্য স্থাপনের সিদ্ধান্ত হলে তার জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি থাকা আবশ্যক। তাতে থাকবে খ্যাতিমান শিল্পীদের একটি পরামর্শ পরিষদ। ভাস্কর্যের জন্য টেন্ডার হবে যে রকম দরপত্র আহ্বান করা হয় বিভিন্ন কাজের জন্য। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পরামর্শ পরিষদের অনুমোদন নিয়ে কাজ করানো উচিত। সেই কাজের পরে যদি কোনো তৌহিদী বা তালেবানি কেউ তলোয়ার উঁচিয়ে প্রতিবাদ করতে আসে, তাহলে তা প্রতিহত করবে দেশের মানুষ। গ্রিক দেবী তৈরি ও স্থাপনের সিদ্ধান্ত কবে হলো, কোন কর্মকর্তা তাঁকে ওয়ার্ক অর্ডার দিলেন কত তারিখে, স্থাপনে ব্যয় হয়েছে কত এবং শিল্পী কত টাকা পারিতোষিক পেয়েছেন—এ সবকিছুই পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনে আসে নাই।
ভাস্কর্য বিষয়ে এটা গেল এক দিক। অন্য দিক হলো গ্রিক দেবীকে সরানোর প্রতিবাদসংক্রান্ত। গত সাড়ে আট বছরে খালেদা জিয়ার বিএনপি আন্দোলন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি যতটা না ক্ষতি করেছে, এই মূর্তি সরানোর কথা হওয়ার পর থেকে তাঁর অনুগ্রহধন্য বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীরা তার চেয়ে বহুগুণ ক্ষতি করেছেন। গত কয়েক দিনে তাঁরা যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তা মির্জা আলমগীর, গয়েশ্বর রায় ও রুহুল কবির রিজভীর বক্তব্যের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর।
ভাস্কর্যটি সরানোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে—এই আভাস পেতেই কয়েকজন তরুণ আমাকে বললেন, প্রতিবাদে রাস্তায় নামা দরকার। আমি তাঁদের বললাম, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি যখন বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন, তাঁরা শুধু ব্যক্তি নন, দেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান, তাঁদের বিবেচনার প্রতি সম্মান দেখানো উচিত। এটা একটা ভাস্কর্য। দেশে আরও অসংখ্য ভাস্কর্য ও মূর্তি রয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীলরা যাতে বাড়াবাড়ি করে ওগুলোর গায়ে হাত দিতে না পারে, সে জন্য অসাম্প্রদায়িক শক্তির বৃহত্তর ঐক্য দরকার। বড় বড় দল ও বড় ছাত্রসংগঠনগুলো এ ব্যাপারে নীরব।
আমি আরও বললাম, শেখ হাসিনাকে আমি জানি, তিনি শতভাগ অসাম্প্রদায়িক মানুষ এবং ধর্মান্ধতার ঘোর বিরোধী। তিনি সব মানুষের প্রধানমন্ত্রী। সরকারপ্রধান হিসেবে অনেক রকম বাস্তবতা তাঁকে বিবেচনা করতে হয় সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলার স্বার্থে। তাঁরা আমার কথায় সন্তুষ্ট হলেন না। তাঁদের বক্তব্য, ভাস্কর্যটি এখান থেকে সরানো চলবে না।
নির্মাতার উপস্থিতিতে রাতের তৃতীয় প্রহরে শুরু হয়ে শেষ প্রহরে যখন দেবীর অপসারণের কাজ সাঙ্গ হয়, তখন ওই এলাকায় লঙ্কাকাণ্ড চলছিল। বিয়োগান্ত নাটকে যুদ্ধবিগ্রহ থাকে। প্রতিবাদী যুবকদের সঙ্গে সংঘর্ষে অনেকে আহত হয়েছেন। পরদিনও প্রতিবাদী মিছিলে কাঁদানে গ্যাস, পানিকামান, রঙিন পানি বর্ষণ করা হয়। আটক হন অনেকে, যদিও আটক হওয়ার মতো কোনো অপরাধ তাঁরা করেননি।
মিছিল থেকে শেখ হাসিনার সরকার যাতে ‘নিপাত’ যায়, সে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করাসহ যেসব স্লোগান দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে ‘শেখ হাসিনার সরকার মৌলবাদের পাহারাদার’, ‘যে সরকার ভাস্কর্য সরায়, সেই সরকার চাই না’ প্রভৃতি। [ ভোরের কাগজ, ২৭ মে]
দেশব্রতীদের কিছু কিছু বক্তব্য আমার অল্প বুদ্ধিতে বোধগম্য নয়। তাঁদের কেউ কেউ বলেন,এই ভাস্কর্য অপসারণ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত। স্বাধীনতা কি এতই ঠুনকো? এক ভাস্কর্য বা মূর্তি অপসারণেই তা চলে যাবে? আমরা কাকে বড় করছি আর কাকে ছোট করছি?
১০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি পরদিন এক বিবৃতিতে বলেছেন: ‘আমরা ক্ষুব্ধ এবং প্রগতিবিরোধী এহেন হীনকর্মে গভীর ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করছি। এই অপসারণকর্মের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল কর্তৃক গঠিত সরকার, কার্যত ধর্মান্ধ মৌলবাদী অপশক্তির কাছে নতি স্বীকার করেছে।’ বিবৃতিদাতাদের মধ্যে দেশের কোনো শিল্পী ও ভাস্কর ছিলেন না।
গ্রিক দেবী অপসারণের পর হেফাজতিরা শোকরানা মোনাজাত করেছিলেন, কিন্তু সেটি পুনঃস্থাপনের কথা শুনে ২৪ ঘণ্টা পর বিবৃতি দিয়ে তাঁরা জানান, এই পদক্ষেপে তাঁরা ‘বিস্মিত, হতবাক ও বাকরুদ্ধ’। হতবাক ও বাকরুদ্ধ দুটো একসঙ্গে হওয়ায় সুবিধা হয়েছে এই যে তারা আর এ নিয়ে কোনো কথা বলতে পারবেন না।
অন্যদিকে এই পুনঃস্থাপন ‘মন্দের ভালো’ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বুদ্ধিজীবীরা। প্রথম আলোকে ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘আমি মনে করি, ভাস্কর্যটি অপসারণ করা ঠিক হয়নি। তবে যদি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণেই এটি পুনঃস্থাপিত হয়, তাহলে আমি সেটাকে মন্দের ভালো বলব।’ মন্দের ভালোর সব রকম ব্যাখ্যা হয়। সব পক্ষই সন্তুষ্ট হতে পারে। ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘সরকার যা করেছে তা বিপজ্জনক এবং লজ্জাকর। সরকার হেফাজতে ইসলামের সক্ষমতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে।’
পুরো প্রক্রিয়াটিকে সরকারের জন্য ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থা হিসেবে দেখছেন কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন: ‘সরকারের অবস্থান শক্ত বলে মনে হয় না। সরকার দুই নৌকায় পা রাখছে।’ তিনি বলেন, ‘এখন নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো—এই সান্ত্বনা নিয়ে থাকতে হচ্ছে।’ শেখ হাসিনার সরকার হলো কথাশিল্পীর কানা মামা। তা না থাকলে দেশে কোনো মামাই থাকবে না। এবং সেই কানা মামার ‘অবস্থান শক্ত’ নয়। ভাগেনরা যদি শক্ত ও সাহসী হন এবং দুটোতে নয়, এক নৌকায় পা রাখতে পারেন, তাহলে কানা মামাকে দিয়েও কিছু ভালো কাজ করানো যায়।
দুই মন্ত্রী ভাস্কর্য অপসারণের তীব্র নিন্দা করছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। কিন্তু গাছের ডালের পাকা ফল এবং গাছের নিচে ছড়িয়ে থাকা ফল একই সঙ্গে আহরণ করা যায় না।
যদি আমরা একটি ভালো সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চাই, তাহলে আত্মপ্রতারণার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির কারণে সাধারণ মানুষের চেতনার মান এখন আর আগের মতো নেই। তারা সব বোঝে। কোন গোত্র ধর্মব্যবসায়ী, মধ্যযুগীয় ও মধ্যপ্রাচ্যপন্থী আর কোন শ্রেণি প্রগতিশীলতার নামে অপ্রগতিশীল, তা মানুষ বিলকুল বোঝে। মানুষ চায় বাংলাদেশ হাজার বছরের বাংলাদেশপন্থী হোক। একাত্তরে সে রকম চেতনাই ছিল। সেদিন ইসলামি সংস্কৃতির নামে বাঙালি মুসলমানরা পশ্চিম পাকিস্তানি সংস্কৃতি প্রত্যাখ্যান করেছিল। দেশের মানুষ ভাবেনি মুসলিম সংস্কৃতিবিহীন অতি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ কোনো বিজাতীয় সংস্কৃতি বাঙালি সংস্কৃতির নামে একদিন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হবে স্বাধীন বাংলাদেশে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন