হেফাজতের দাবি মেনে ভাস্কর্য সরানো হয়রবীন্দ্রপ্রেমী প্রাবন্ধিক ও দর্শনবিদ আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর রচনার শিরোনাম দিয়েছেন ‘পথের শেষ কোথায়?’ কবির কবিতার আধ্যাত্মিক উপাদান বিশ্লেষণ করতে গিয়ে একটি কবিতা থেকে ওই কথাটি চয়ন করেছেন। মানবজীবনে পথ অতি গুরুত্বপূর্ণ। পথ নানা রকম। আধ্যাত্মিক জীবনের পথ, বাস্তব জীবনের পথ প্রভৃতি। ব্যক্তি-জীবনের পথের মতো জাতীয় জীবনেরও পথ রয়েছে। মানুষ জীবনে চলার পথ বেছে নেয়। কারও পথ চাকরিবাকরির, কারও ব্যবসা-বাণিজ্যের, কারও লেখালেখি। কারও পথ আধ্যাত্মিক সাধনার এবং কারও পথ চুরিচামারি করে অতি সুখে জীবন কাটিয়ে দেওয়া। প্রত্যেক জাতিকে পথ বেছে নিতে হয়। বাঙালি জাতি বা বাংলাদেশের মানুষ কোন পথ বেছে নিয়েছে এবং সেই পথের শেষে কী আছে, তা জানে না কেউ।
আওয়ামী লীগ কমিউনিস্ট পার্টির মতো সেক্যুলার রাজনৈতিক সংগঠন নয়, জন্মলগ্ন থেকেই এটি একটি মধ্যপন্থী অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল। সমস্ত পাকিস্তানি জমানাতেই দলটি তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্রটি অক্ষুণ্ন রেখেছে। অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। এই দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ১৯৭২ সালে এই দলের সরকারের প্রণীত সংবিধানে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যহার নিষিদ্ধ করা হয়। করা হয় সংগত কারণে। ধর্ম এক জিনিস—এক মহান আধ্যাত্মিক বিষয়। রাজনীতি আর এক জিনিস—বাস্তব জীবনের বিষয়। রাজনীতিতে উন্নত নীতি-আদর্শ যেমন আছে; তেমনি অসত্য, ভন্ডামি, প্রতারণা প্রভৃতি অনৈতিক বিষয়ও আছে। সুতরাং রাজনীতির সঙ্গে মহান ধর্মকে মেশানো যায় না। তা ছাড়া, বাংলাদেশের সব মানুষ এক ধর্মাবলম্বী নয়।
বিশ্বব্যাপী পীর, মাশায়েখ, আলেম-ওলামারা অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র। ধারণা করা হয়, তাঁরা নিষ্কলুষ জীবনের অধিকারী। মানুষের তাঁরা সত্যপথের প্রদর্শক। এই উপমহাদেশের বহু আলেম ঔপনিবেশিকতাবিরোধী আন্দোলনে নিষ্ক্রিয়ভাবে সমর্থন দেননি, সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, এমনকি নেতৃত্বও দিয়েছেন। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে হাজার হাজার আলেম-ওলামা ও ইসলামি চিন্তাবিদ অংশগ্রহণ করে জেল–জুলুম সহ্য করেছেন। মাওলানা শওকত আলী, মাওলানা মোহাম্মদ আলী গান্ধীজির সঙ্গে সমগ্র ভারতবর্ষ ঘুরেছেন। লন্ডনে গোলটেবিলে যোগ দিয়েছেন। কারা বরণ করেছেন। ভারতে প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তোলেন আল্লামা হজরত মোহানি এবং সে জন্য তাঁর কঠোর সাজা হয়। তাঁর মুক্তির জন্য ভারতের হিন্দু-মুসলমান দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। বিশের দশকে মাওলানা আজাদ সুবহানির ভূমিকা অবিস্মরণীয়। আলী ভ্রাতৃদ্বয় এবং হাসরত মোহানি ও আজাদ সুবহানির লাখ লাখ অনুসারী কংগ্রেসের হিন্দু নেতাদের সঙ্গে একত্রে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। ইতিহাসে তাঁরা স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
ওই আলেম-ওলামাদেরই উত্তরসূরি ছিলেন মাওলানা ভাসানী, মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ প্রমুখ। তাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে ধর্ম পালন করেছেন এবং জনগণের মুক্তির জন্য রাজনীতিও করেছেন। মাওলানা ভাসানী ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং তাঁর পরে মাওলানা তর্কবাগীশও আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের উভয়ের সময়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক।
একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে বিতাড়িত করতে যখন বাঙালি রুখে দাঁড়ায়, তখন অসংখ্য ইমাম-মুয়াজ্জিন মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দেন। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামের সমর্থক অল্প কিছুসংখ্যক দেশদ্রোহী রাজাকার, আলবদর, আলশামসের খাতায় নাম লেখায় এবং গণহত্যায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। তাদের যে শাস্তি প্রাপ্য ছিল তা স্বাধীনতার পরপর না পাওয়ায় তারা সমাজকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করার অবকাশ পায়। তারা অজ্ঞ ও অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষদের ব্যবহার করার পথ বেছে নেয়। অসংখ্য কথিত কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে তারা এমন শিক্ষার বিস্তার ঘটায়, যা বাস্তব জীবনের জন্য আদৌ কার্যকর কিছু নয়। দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের একটি কায়েমি স্বার্থবাদী গোত্র ওই শিক্ষাকেই জাতীয় জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধপরিকর।
সব মাদ্রাসাশিক্ষাই নিম্নমানের এবং বাস্তব জীবনে অকার্যকর, তা নয়। কলকাতা মাদ্রাসা, হুগলি মাদ্রাসা, ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষা ছিল একসময় ইউরোপীয় মানের। উপমহাদেশের প্রখ্যাত রসায়নবিজ্ঞানী মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা ছিলেন মাদ্রাসার ছাত্র। সেটা অনেক আগের কথা। আমাদের সময় ষাটের দশকের শুরুতে আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পাস করে যাঁরা উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়ে মাস্টার্স পাস করে বেরিয়ে গেছেন, দেখেছি তাঁদের শিক্ষার মান ছিল উঁচু। তাঁরা অনেকে ঢাকা কলেজ হোস্টেল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতেন, তাঁদের মধ্যে কোনো রকম গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা দেখা যায়নি। তাঁরা যে আধুনিক মানুষ ছিলেন তা-ই নয়, তাঁদের অনেকে ছাত্র ইউনিয়নের মতো অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল সংগঠনের নেতা-কর্মী ছিলেন। আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পাস করা আমাদের সহপাঠীদের কেউ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ পর্যন্ত হয়ে অবসরে গেছেন।
গত ১১ এপ্রিল হেফাজতের নেতারা গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁরা তাঁদের বিচিত্র আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা করেন। বৈঠকে কওমি মাদ্রাসাকে শর্তহীনভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি আদায় করেন। ওই স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি আধুনিক মানুষদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কেউ মনে করেন সঠিক হয়েছে—কারণ ১৩-১৪ লাখ শিক্ষার্থী জাতির মূলধারার বাইরে থাকছে, তাতে দেশের ক্ষতি। অনেকে মনে করেন, কোনো পর্যবেক্ষণ না করে কওমিদের স্বীকৃতি এবং মাস্টার্স পর্যায়ের সনদ দেওয়া ভুল হবে। যা হোক, সেটা খুব দীর্ঘ আলোচনার বিষয়।
ওই বৈঠকে হেফাজতের প্রধান নেতা মাওলানা শফী সাহেবও ছিলেন। বর্ষীয়ান আলেমকে প্রধানমন্ত্রী উপযুক্ত সম্মান দিয়েছেন। সেখানে সুপ্রিম কোর্টের সামনের গ্রিক দেবীর মূর্তি অপসারণ নিয়েও কথা হয়। ভাস্কর্যটি শিল্পগুণসম্পন্ন নয়, এ জন্য তা সরানোর সিদ্ধান্ত নিতে তাঁরা বলেননি, ইসলামবিরোধী বলে সরানোর দাবি জানান। সে দাবির প্রতিও সম্মান দেখানো হয়।
গত শতকের প্রথম দিকে এই উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রধান নেতা ছিলেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। তিনিসহ নবাব পরিবারের সবাই ছিলেন আচারনিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মানুষ। নবাব আহসানউল্লাহর এক কিশোর পুত্র সলিমুল্লাহর ভাই অকালে মারা যান উনিশ শতকের শেষ দিকে। নবাব বাহাদুর ছবি দেখে সেই ছেলের একটি মার্বেল পাথরের মূর্তি তৈরি করান এক ইংরেজ ভাস্করশিল্পীকে দিয়ে। সেই মূর্তি আহসান মঞ্জিলের দোতলার বারান্দার পশ্চিম দিকে নবাব সলিমুল্লাহ স্থাপন করেন। সলিমুল্লাহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ শুধু নয়, তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেন প্রতিদিন গভীর রাত পর্যন্ত। নবাবের জনাচারেক বেগমও ছিলেন পরহেজগার। শুধু নবাবের ভাইয়ের মূর্তি নয়, আহসান মঞ্জিলে বহু মূর্তি ছিল। বাঙালি মুসলমানের স্বার্থ রক্ষায় সলিমুল্লাহর চেয়ে বেশি অবদান আর কারও ছিল কুড়ি শতকের প্রথম দিকে, তা আমার জানা নেই।
হেফাজতের নেতারা বাংলাদেশের কত শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য আমার হাতে নেই। তবে তাঁদের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে আড়াই-তিন কোটি অমুসলমান ছাড়া সব মানুষেরই তাঁরা প্রভু। তাঁদের কথায় আমাদের এবং সরকারকে ওঠবস করতে হবে।
২০১৩ সালে ১৩ দফা দাবি নিয়ে হেফাজত ‘আন্দোলন’-এর ডাক দেয়। তাদের সিপাহসালার যেমন ছিলেন কয়েকজন, সৈনিক ছিলেন কওমি মাদ্রাসার লাখ লাখ তালেবইলেম। শেখ হাসিনার সরকারকে হটাতে তাঁরা ঢাকা অবরোধের জন্য সারা দেশ থেকে রাজধানীর দিকে ধেয়ে আসেন। তাঁদের ১৩ দফা নিয়ে মতবিনিময় করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিডিয়ার প্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের থেকে কয়েকজনকে গণভবনে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে আমাকেও ডাকা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে তাঁদের দাবি বিবেচনার আশ্বাস দেন। এবং অনুরোধ করেন তাঁরা যেন ঢাকায় এসে অরাজকতা সৃষ্টি না করেন। ঘণ্টা দুই আলোচনা করে শেখ হাসিনা যখন মাগরিবের নামাজ আদায় করতে ভেতরে যান, আমার সঙ্গেও তাঁর কথা হয়। তিনি আধুনিক প্রগতিশীল মানুষ, কিন্তু ধর্মীয় নেতাদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল মনে হলো। সেটা শাপলা চত্বরে ইসলামি বিপ্লব আয়োজনের এক দিন আগে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হওয়ার পর ওই দিনই রাতে আমি প্রথম আলোতে হেফাজতকে বিপ্লব প্রচেষ্টা থেকে আপাতত বিরত থাকতে বিনীত অনুরোধ করে একটি আবেদনমূলক লেখা লিখি। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কথা তাঁরা শুনবেন, তেমন নেতাই তাঁরা নন। তাঁরা ঢাকার রাস্তায় বিপ্লব ঘটালেন। বহু যানবাহন পোড়ালেন, ফুটপাতের বইয়ের দোকানসহ সবকিছু পুড়িয়ে ছাই করলেন, রাস্তার গাছ পর্যন্ত করাত দিয়ে কাটলেন। শাপলা চত্বর থেকে নেতারা আগামী দিন সকালে সচিবালয়ে নতুন সরকার গঠন করে নাশতা করবেন বলে কেউ কেউ ঘোষণা দিলেন। রাতদুপুরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা তাঁদের বিতাড়িত না করলে পরদিন সরকার গঠন করুন বা না করুন বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংকসহ মতিঝিলের ব্যাংক ও বিমা প্রতিষ্ঠান পুড়ে ছাই হয়ে যেত।
প্রধানমন্ত্রীর ভালো ব্যবহারের মর্যাদা না দিয়ে আবার শুরু হয়েছে আন্দোলন। মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে যে ভাষায় কথা বলছেন তা রীতিমতো বেয়াদবি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেউ রাজনীতি করতে চাইলে করতে পারেন, কিন্তু দেশকে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া বানানোর ষড়যন্ত্র করলে তা কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিক সহ্য করতে পারেন না। কোনো কোনো গোষ্ঠী দেশে একটা গোলমাল বাধানোর তালে আছে।
স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় বাংলাদেশের মানুষের অঙ্গীকার ছিল একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। মধ্যযুগীয় ধর্মীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং সমাজব্যবস্থাও মেনে নেবে না মানুষ। কিন্তু আমরা কোথায় যাচ্ছি, বোঝা যাচ্ছে না। এ পথের শেষ কোথায় এবং কী আছে শেষে, তা এখন বলা সম্ভব নয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
উৎসঃ প্রতমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন