এককালে বাঙালির ছিল বারো মাসে তেরো পার্বণ। তা নিয়ে বাঙালি ব্যস্ত থাকত। জীবনের গভীরতর বিষয় নিয়ে ভাববার অবকাশ পেত কম। এখন বাঙালির গণমাধ্যম, লেখক ও পাঠক বারো মাসে বারো বিষয় নিয়ে মহাব্যস্ত থাকে। কোনোটি ভাষার মাস, কোনোটি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার তো কোনোটি বিজয়ের প্রভৃতি। জুন হলো বাজেটের মাস। আগের দিনে ছিল এটা আম, জাম, লিচুর মাস। প্রকৃতিও নতুন রূপে সাজত। কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, শিমুলের ফুলে আলোকিত হতো বাংলার সর্বত্র। হিজল ফুলের মিষ্টি সুবাসে গ্রামের পুকুরঘাটের পাশ দিয়ে খুব কম বেরসিকই অন্যমনস্ক না হয়ে পারত। এখন আর সে অবস্থাটা নেই।
এখন নিম্নমধ্য আয়ের দেশটিতে বাজেটসর্বস্ব জীবন। রাজধানীর দামি হোটেলের জলসাঘর, বিভিন্ন কনভেনশন সেন্টার, মিলনায়তন ও সভাকক্ষ থেকে বস্তি, গ্রামের পুকুরঘাট, বটতলার চায়ের দোকান, বোরো ধানের খেতের আলে পর্যন্ত জুন মাসে বাজেট নিয়ে মাথা ঘামানোর মানুষের অভাব নেই। কোন জিনিসের দাম বাড়ল, তা নিয়ে উদ্বেগ পথের ভিখেরি পর্যন্ত। হেঁসেলের রাঁধুনির উদ্বেগ মসলার দাম নিয়ে। তরকারিতে জিরার গুঁড়া না দিলে চলে না। দোকানদারের আনন্দ কত বেশি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কত বাড়ে।
আগে সাধারণ মানুষ বেকুফ ছিল। তাই রাষ্ট্রের কোথায় কী হচ্ছে, তা তারা জানত না। বহির্বিশ্বের কথা তো নয়ই। আজ তথ্যপ্রযুক্তির কারণে কোথায় কোন দেশের জনসমাবেশে বোমা পড়ল আর কোন দেশের কোন জননেতা কার প্রেমে পড়ল, সে খবর দিনে দিনেই সবাই পেয়ে যাচ্ছে। ভিখেরির কথা বললাম এ জন্য যে দেশের পেশাদার ভিখেরি সম্প্রদায় ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। সম্ভবত তারাও কর্মকৌশল নির্ধারণে বৈঠকে বসেছে, তবে সে খবর কোনো সংবাদদাতা কভার করেন না। এবার খোদ বাজেটদাতার মুখে তারা শুনেছে যে দেশে আগামী দিনে ভিখেরি থাকবে না। কী প্রক্রিয়ায় ভিক্ষুক নির্মূল হবে, তা জানা যায়নি। উদ্বেগ সে জন্যও নয়। তাদের দুশ্চিন্তা আয়কর দেওয়ার বিড়ম্বনা নিয়ে। তাদেরও অনেকে এখন ‘যথেষ্ট বিত্তবান’; কারণ, লাখ টাকার বেশি তাদের অনেকের ব্যাংকে গচ্ছিত—হয়তো তা অন্য কারও নামে, স্বনামেও হতে পারে। কী সব ট্যাক্সের কারণে তাদের টাকা ব্যাংকে রেখে কমিয়ে ফেলার বেকুফি আর করবে না, হাঁড়িতে ঢুকিয়ে ভালো করে মুখ বেঁধে মাটিতে পুঁতে রাখবে। তাতে অন্তত মূল টাকাটা অক্ষত থাকবে।
মস্ত বড় অঙ্কের একটা বার্ষিক বাজেট দিলে বোঝা যায় দেশটা বড়লোক। কিন্তু মহৎ জাতি গঠনের জন্য প্রকাণ্ড বাজেটের ভূমিকা বিশেষ নেই। সেটা কষ্টসাধ্য সাধনার ব্যাপার। কোনো ভূখণ্ডে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আর মহৎ জাতি গঠন দুই জিনিস। শুধু কথা দিয়ে জাতি গঠন সম্ভব নয়, সে হয় কাজ দিয়ে। যে জাতি মূর্তি নিয়ে অর্থহীন মাথা ঘামায়, তার ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মূর্তি আর ভাবমূর্তি দুই জিনিস। চুল, দাড়ি কামানোর ব্লেডের দাম কমবে না দামি গাড়ির দাম কমবে, তাতে একটি জাতির বিশেষ কিছু আসে-যায় না। তা নিয়ে হাহাকার করা সময়ের অপচয় মাত্র। দেশের মর্যাদা বাড়াতে বড় বড় বিষয়ের দিকে নজর দিতে হয়। সমস্যা আড়াল করলে বা তা অনালোচিত থাকলে তার সমাধান হয় না।
৩০ হাজার কোটি টাকার রপ্তানি পণ্য হুমকিতে—এমন শিরোনামে খবর পড়ে যেকোনো মানুষের উদ্বেগ হওয়া স্বাভাবিক। ‘সিভিল এভিয়েশনের গড়িমসি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আকাশপথে রপ্তানি বাণিজ্য হুমকির মধ্যে পড়েছে। অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ব্রিটেনের পর এবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), অর্থাৎ ইউরোপের ২৮টি দেশ একযোগে বাংলাদেশকে উচ্চ ঝুঁকির দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। এর ফলে আকাশপথে কার্গোবাহী বিমান তৃতীয় কোনো দেশে আবার স্ক্যানিং করতে হবে। তা ছাড়া, বাংলাদেশ থেকে কোনো কার্গোবাহী বিমান সরাসরি ইউরোপে যেতে পারবে না। এ মর্মে তারা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। গত ১ জুন থেকে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে।’ [সমকাল, ১০ জুন]
এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে: ‘নিরাপত্তার স্বার্থে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেওয়া কতিপয় সুপারিশ আমলে না নেওয়ায় পুরো ইউরোপে এবার নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ল বাংলাদেশ। নিষেধাজ্ঞার ফলে বছরে ৩০ হাজার চার শ কোটি টাকার কার্গো পণ্য রপ্তানি হুমকির মুখে পড়েছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে।...এর আগে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ২০১৬ সালের মার্চে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি কার্গো ফ্লাইট পরিচালনার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাজ্য। এরপর অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানিও পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।...এফবিসিসিআইর সাবেক সহসভাপতি ও বিমানের সাবেক বোর্ড মেম্বার আবুল কাশেম আহমেদ বলেন, “ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ থেকে আকাশপথে সরাসরি কার্গো পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় তৈরি পোশাক ও চামড়াজাত পণ্য খাত ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে।”’
এই নিষেধাজ্ঞা আমাদের আশপাশের কোনো দেশকে দিল না, বাংলাদেশকে দিল কেন—এই প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্তারা যুক্তিগ্রাহ্য কী জবাব দিতে পারেন? আমাদের বিমানবন্দরের সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়ার পেছনে কারা দায়ী? শুধু মাল পরিবহন নয়, বিমানবন্দরের যাত্রীসেবার মান নিয়ে অনবরত লেখালেখি হচ্ছে, কিন্তু কর্তৃপক্ষের ভ্রুক্ষেপ কম। যে দেশের এক কোটি লোক বিদেশে কর্মরত, সে দেশের সরকারি বিমান সংস্থার অবস্থা শোচনীয় কেন—সে প্রশ্নেরও সদুত্তর নেই। অথচ ওই প্রবাসী শ্রমিকদের উপার্জিত অর্থে আমাদের বাহাদুরি। অন্য দেশের সরকারি-বেসরকারি বিমান সংস্থাসমূহ বাংলাদেশে চুটিয়ে ব্যবসা করছে। কোনো দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সে দেশের এয়ারলাইনস ও বিমানবন্দরের ভূমিকা খুব বেশি।
অশুভ সংবাদ আরও আছে। ভ্রমণে বিপজ্জনক দেশের তালিকায় নাম উঠেছে বাংলাদেশের। অস্ট্রেলিয়ার প্রভাবশালী দৈনিক দ্য ফিনানশিয়াল রিভিউ সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’ (ডব্লিউইএফ)-এর সমীক্ষা নিয়ে করা এক প্রতিবেদনে ৯ জুন এ কথা জানায়। প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ সম্পর্কে সমীক্ষা চালায় সংস্থাটি। এ বছর ১৩৬টি দেশের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে বাংলাদেশকে ১৪তম বিপজ্জনক দেশ হিসেবে স্থান দিয়েছে। বিপজ্জনক হওয়ার কারণ হিসেবে সংস্থাটি সন্ত্রাস ও মৌলবাদ কিংবা জঙ্গিবাদের বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে।
বিপজ্জনক দেশ হিসেবে ক্রমানুসারে রয়েছে কলম্বিয়া, ইয়েমেন, এলসালভাদর, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, ভেনেজুয়েলা, মিসর, কেনিয়া, হন্ডুরাস, ইউক্রেন, ফিলিপাইন ও মালি। বাংলাদেশের পর ১৫ নম্বরে রয়েছে চাদ। এই সব দেশে নানা রকম চরমপন্থী ও জঙ্গিগোষ্ঠী তৎপর, যা পর্যটকদের জন্য বিপজ্জনক।
এই খবরটি সরকারের নেতাদের অনেকের কাছে উপভোগ্য না হলেও নিজেদের স্বার্থে প্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। বাংলাদেশের মাঠ-ঘাট, অলিগলি যে জঙ্গিতে গিজগিজ করছে, তা অন্য কেউ বলার আগে নেতারাই বলছেন। বঙ্গীয় জঙ্গি আস্তানায় দুগ্ধপোষ্য শিশু থেকে থুরথুরে বুড়োবুড়ি পর্যন্ত থাকার বিষয়টি আমরাই বলে বেড়াচ্ছি।
জাতীয় স্বার্থ আর দলীয় স্বার্থ আর ব্যক্তিস্বার্থ একেবারেই তিন রকম বিষয়। তবে জাতীয় স্বার্থ আর দলীয় স্বার্থ যদি এক হয়, তাহলে তা শুভ। জঙ্গিবাদী যে দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের নাম যোগ হয়েছে, সেগুলোর অবস্থা দোজখের মতো। কেন সেই খাতায় বাংলাদেশের নাম ওঠে, তা বিচার-বিশ্লেষণ করা সরকার ও নাগরিক সমাজের অবশ্যকর্তব্য। সেই দায়িত্ব এড়ানোর অর্থ জাতিকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া। গত হপ্তায় বিখ্যাত সাময়িকী ইকোনমিস্ট-এ খুবই নেতিবাচক এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সবকিছু তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলে এবং চোখ বন্ধ করে রাখলে প্রলয় বসে থাকে না।
দেশের মানুষ যখন ভ্যাট-আবগারি শুল্ক প্রভৃতি নিয়ে হাহাকার করছে, তখন ‘২০১৭ সালে বাংলাদেশ-সম্পর্কিত চতুর্থ পরামর্শ প্রদান’ কালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত বৃহস্পতিবার এক বার্তায় চলতি অর্থবছর থেকে নতুন ভ্যাট ব্যবস্থা প্রণয়নকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে সেই আইএমএফই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, বিনিয়োগে তা প্রভাব ফেলবে। তবে মার্কিন নিয়ন্ত্রিত ওই সব আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ইত্যাদি কখন কী বলে আর কখন কী করে, তা পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়নের সময় বোঝা গিয়েছিল।
তুচ্ছ বিষয়ে আমরা বিপুল সময় ও প্রচুর মেধা নষ্ট করি। জাতীয় জীবনের গভীরতর বিষয় আড়ালে থেকে যায়। দর্শন, বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের মতো গভীরতর বিষয় বাদ দিলেও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় বিষয়গুলো যদি অনালোচিত থাকে, ভুল ও দোষ গোপন করা হয়, তাহলে অগ্রগতির পথটা রুদ্ধ হয়ে যায়। অগ্রগতির পথ অবরুদ্ধ রেখে উন্নয়নের মহাসড়ক মসৃণ হতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্রে এই কর্তৃপক্ষ আছে, ওই কর্তৃপক্ষ আছে, যা দরকার তা হলো বিচার-বিশ্লেষণ ও সমালোচনা করার কর্তৃপক্ষ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্রিটিক্যাল অথরিটি বা সমালোচনাকারী কর্তৃত্ব যদি না থাকে, ভুল ও দুর্বলতার মধ্যেই দেশ হাবুডুবু খায়।
মানহীন শিক্ষা এবং উপযুক্ত প্রশিক্ষার সঙ্গে যদি দুর্নীতি যোগ হয়, তাহলে সোনায় সোহাগা। এই তিন কারণেই আমাদের ওপর আজ বিভিন্ন দেশের অনাস্থা এবং তাদের নিষেধাজ্ঞা আরোপ। প্রতিটি বিভাগে বাজেট বরাদ্দে ও কেনাকাটায় কমতি নেই—কিন্তু যা নেই তা হলো দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা।
প্রতিটি খাতেই বছর বছর বরাদ্দ বাড়ানো হয়। তাতে বাজেট হয় বিশালাকার। কী লাভ তাতে? বেশি বরাদ্দ, বেশি দুর্নীতি, বেশি অপচয়। কম দক্ষতা বেশি বরাদ্দ খুব ক্ষতিকর। যে দেশে পূর্ববর্তী বছরের সব কাজ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে মাত্র ২৫ ভাগের মতো সম্পন্ন হয়, অবশিষ্ট কাজ হয় জুন মাসে এবং ৩০ জুনের মধ্যে সব টাকা উঠিয়ে নেওয়ার রীতি—কাজ হোক বা না হোক—সে দেশের উন্নতির আশা দুরাশা বটে। তাই টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বাড়ানো এক কথা আর দক্ষতা বাড়ানো আরেক কথা।
একটি মর্যাদাবান জাতি গঠনে দক্ষ ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। দক্ষতা আসে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও উপযুক্ত প্রশিক্ষা থেকে। সেই দুটো জিনিসের অভাবের কারণেই আজ আমাদের ওপর বিদেশিদের আস্থা নেই। বিমানবন্দর কার্গো ব্যবস্থাপনার মতো সাধারণ কাজটি আমরা পারি না, যা অন্য দেশ পারে। লজ্জার কথা বটে!
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন