রাষ্ট্র যখন প্রকাণ্ড সব ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তখন ছোটখাটো বিষয়ে নজর দেওয়ার ফুরসত পায় না। বাংলাদেশ এশিয়া মহাদেশের বা আরও বড় কোনো অঞ্চলের বাঘ হতে চলেছে। অর্থবিত্তের দিক থেকে সে যে অনেক খ্যাতিমান দেশকে ছাড়িয়ে গেছে, তা প্রমাণ করা মোটেই কঠিন নয়। যে কেউ শুধু সুইস ব্যাংকগুলোতে খোঁজ নিলেই জেনে যাবে বাংলাদেশ কত বড়লোকের দেশ।
২০১৬ সালে বাংলাদেশের ভাগ্যবানদের কাছ থেকে সুইস ব্যাংকে গেছে ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে গেছে ৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ২০১৪-তে গেছে ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা। তার আগের বছরগুলোতে যে কত টাকা গেছে, তা বিধাতা ও ব্যাংক কর্মকর্তা ছাড়া আর কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয়। আগেরগুলো বাদ দিয়ে শুধু গত বছরে যাঁদের টাকা সুইস
ব্যাংকে গেছে, তাঁদের নামটাও জানা যায় না। সে যেন ভূতের টাকা। আমার যদি সুইস ব্যাংকে লাখখানেক টাকা থাকত, আমি তা সগর্বে বলে বেড়াতাম। অথচ অত টাকা যাঁদের, তাঁরা কেন গর্ব করে বলতে পারছেন না। বিত্তবান হওয়ার ভেতরে যে নির্মল আনন্দ, তা থেকেও এই লোকগুলো বঞ্চিত। ব্যাংকে জমা দেওয়ার আগে ডাকাতি হতে পারত, কিন্তু ব্যাংকের লেজার খাতায় নাম ওঠার পর তা কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। সুতরাং তা বললে ক্ষতিটা কোথায়?
আমাদের নিজেদের দেশ ভরে গেছে ব্যাংকে। নিজেদের ব্যাংকে টাকা না রেখে বিদেশবিভুঁইয়ে টাকা পাঠানো কেন? পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে অবৈধ পথে এই টাকা পাচার হয়ে থাকবে। যাঁদের ওই টাকা, নির্বাচনের পর যদি তাঁদের পক্ষে দেশে থাকা সম্ভব না হয়, তাই ভবিষ্যতের চিন্তা করে টাকা বিদেশি ব্যাংকে জামানত রাখা হয়েছে।
সুইস ব্যাংকে যে শত শত বস্তা বাংলাদেশের টাকা স্তূপীকৃত হয়েছে, তা সঞ্চয়ের উৎস কী? সঞ্চয়কারী সোজা লোক হলে, সৎ পথে টাকা কামাই করলে দেশের ব্যাংকেই রাখতে পারতেন। ওই বিপুল অর্থ যেমন-তেমন শিল্পকারখানা করে উপার্জন সম্ভব নয়। সরকারের সর্বোচ্চ চাকরি করেও রোজগার করা যায় না। একজনমে তো নয়ই, পঞ্চাশবার পুনর্জন্ম নিয়েও সম্ভব নয়। ওই অর্থ তাঁরা কেউ কামাই করেছেন রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করে, কেউ সরকারি প্রকল্প থেকে চৌর্যবৃত্তি করে, কেউ নর-নারী পাচার করে এবং আরও বহু পথ আছে বঙ্গীয় ভূখণ্ডে—সেগুলো থেকে।
নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশেরই এই অবস্থা, যেদিন উচ্চ আয়ের দেশে প্রমোশন পাবে বাংলাদেশ, সেদিন সুইস ব্যাংকের কর্মকর্তারা হাতজোড় করে বলবেন, তোমাদের টাকা রাখার মতো ভল্ট আমাদের নেই। নিজের দেশেই খাদ্যশস্যের সাইলোর মতো গুদাম বানিয়ে তাতে তোমাদের টাকা জমা রাখো গিয়ে।
এই যে দেশটিতে এত ধনদৌলত, তার সন্তানেরা পেটের দায়ে জীবিকার আশায় সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে মরছে। পানিতে ঝাঁপ দিয়ে মরছে, নৌকার খোলের মধ্যে না খেয়ে মরছে। নৌকায় মারা গেলে জীবিতরা মৃতদেহ সমুদ্রে ফেলে দিচ্ছে। হাঙর-কুমিরে খেয়ে ফেলছে বঙ্গসন্তানের শরীর।
হাঙর-কুমির যাদের মাংস খাচ্ছে, তারা এক হিসেবে ভাগ্যবান। বেঁচে থাকে যারা, সেই অভাগা ও হতভাগিনীদের মরণ না হওয়া চরম অভিশাপ। কেনই-বা তারা মানুষের ঘরে জন্ম নিয়ে পৃথিবীতে আসে! সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে যারা মরে, তাদের খায় ক্ষুধিত হাঙর-কুমির। যারা বেঁচে থাকে, তাদের শরীর খায় এমন শ্রেণির জানোয়ার, যে রকম জানোয়ার পৃথিবীর কোনো জঙ্গলে, গহন অরণ্যে বা সমুদ্রের তলদেশে নেই। তাদের দুই পা, দুই হাত, মানুষের মতো মুখমণ্ডল—কিন্তু তারা পশুর চেয়ে খারাপ। মানুষ তাদের নাম দিয়েছে নরপশু। বর্তমানে পৃথিবীতে নরপশুর সংখ্যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
গত ২৯ জুন প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে জানা গেছে: বাংলাদেশ ও ভারতের পাচারকারী চক্র বাংলাদেশের ভাগ্যবিড়ম্বিত নারী ও শিশুদের সরলতা ও অসচেতনতাকে পুঁজি করে তাদের বিক্রি করে দিচ্ছে যৌনপল্লিতে। ফলে ভারতের যৌনপল্লিগুলোতে শিশু, কিশোরী ও নারীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। ভারতে মানব পাচার বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে এমন অভিমত দিয়েছেন দিল্লি থেকে বাংলাদেশের হাইকমিশনার।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘দিল্লি ও মুম্বাইয়ের কূটনৈতিক সূত্রে সম্প্রতি যোগাযোগ করে জানা গেছে, ভারতের যৌনপল্লিগুলোতে বাংলাদেশের শিশু, কিশোরী ও নারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এমন তথ্য পাওয়ার পর মে মাসে দিল্লি ও মুম্বাইতে কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা মুম্বাইয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়া শিশু, কিশোরী ও নারীর সঙ্গে কথা বলেন।...একটি আশ্রয়কেন্দ্রের ৪০ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, এদের ২৯ জনই এসেছে বাংলাদেশ থেকে।...মুম্বাইয়ের আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে আসা একাধিক কূটনীতিক গতকাল (২৮ জুন) প্রথম আলোকে জানান, মুম্বাই ছাড়াও গোয়া ও পুনের যৌনপল্লিগুলোতে বাংলাদেশ থেকে পাচার নারীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।’
মুম্বাইতে বাংলাদেশের উপহাইকমিশনারের বরাত দিয়ে প্রথম আলোর প্রতিনিধি লিখেছেন, ‘২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মুম্বাই, গোয়া, পুনে, কেরালা, দামান ও তামিলনাড়ু থেকে উদ্ধারের পর অন্তত ৩৭০ নারী ও শিশুকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।’
দিল্লি থেকে পাঠানো হাইকমিশনারের চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘দরিদ্র বাবা-মা অভাবের কারণে সন্তানকে অপরিচিত লোকের হাতে তুলে দিচ্ছেন। আবার কেউ বিয়ে বা বিদেশে চাকরির ফাঁদে পা দিয়ে মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ছে। আবার উন্নত জীবনের আশায় নিম্নবিত্ত নারীরা পাচারকারীদের শিকারে পরিণত হচ্ছে। চূড়ান্তভাবে এদের ঠাঁই হচ্ছে ভারতের যৌনপল্লিগুলোতে। একই সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে থাকার পরও ভারতের যৌনপল্লিগুলোতে পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর নারী ও শিশুর সংখ্যা যথেষ্ট কম। ভারতের গণমাধ্যম মানব পাচার নিয়ে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার এবং মানব পাচার রোধ আইনের কঠোর প্রয়োগ এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে বলে মত দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে মানব পাচার রোধের আইন প্রয়োগের শিথিলতা ও সচেতনতার অভাব ভারতে মানব পাচারের পথ করে দিচ্ছে।’
একই দিনের প্রথম আলোর আরেকটি সংবাদ: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানব পাচারবিষয়ক ‘ট্রাফিকিং ইন পারসনস রিপোর্ট’-এ বাংলাদেশ সম্পর্কে পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘মানব পাচার বন্ধে সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপকে ইতিবাচকভাবে নিয়ে এত দিন বাংলাদেশকে দুই নম্বর ধাপে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সরকার মানব পাচার রোধে ন্যূনতম মান বজায় রাখতে পারেনি। এই অভিযোগ তুলে এক ধাপ নামিয়ে “দুই নম্বর ধাপের নজরদারিতে” থাকা দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ তালিকায় প্রথম ধাপে মানব পাচার প্রতিরোধে সফল রাষ্ট্রগুলো এবং দ্বিতীয় ধাপে মাঝামাঝি অবস্থায় থাকা রাষ্ট্র এবং তৃতীয় ধাপে ব্যর্থ রাষ্ট্রগুলোর নাম রয়েছে। কোনো রাষ্ট্রকে দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় ধাপে নেওয়ার আগে নজরদারির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।’
নজরদারির তালিকা থেকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় যদি আগামী দিনে বাংলাদেশের নাম ওঠে, তা হবে চরম লজ্জার। আগের বছরে মানব পাচার রোধে উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু পরে তা কার্যকর হয়নি।
‘মানব পাচারবিষয়ক অপরাধের তদন্ত, মামলা পরিচালনা ও অপরাধীর দণ্ড দেওয়ার বিষয়টিও কমে এসেছে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মানব পাচারে জড়িত থাকার বিষয়টি গুরুতর সমস্যাই রয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সীমান্ত এবং জনশক্তি-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ তদন্ত, মামলা ও দণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রেও সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি।’
নাম দেওয়া হয়েছে মানব পাচার, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ থেকে হচ্ছে যুবতী, মেয়েশিশু ও কিশোরী পাচার। আমরা কি মিনিট পাঁচেক চোখ বন্ধ করে ভেবে দেখেছি, আমাদের মেয়েদের যারা চাকরি দেওয়ার কথা বলে পাপঘরে বিক্রি করে দিয়েছে, সেই মেয়েদের মুখচ্ছবি?
বিভিন্ন পত্রিকার খবর থেকে জানা যায়, শুধু ভারতে নয়, পাকিস্তানে নয়, মধ্যপ্রাচ্যে নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পতিতালয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে বাংলাদেশের কিশোরী ও যুবতীরা। কী তাদের শেষ পরিণতি? যেদিন তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে, সেদিন ওই নরক থেকে তাদের বের করে রাস্তায় ছুড়ে দেবে পিশাচরা। ভিক্ষা করে কিছুদিন বেঁচে থাকবে। তারপর একদিন রাস্তায় অথবা পার্কের গাছতলায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করবে। এই তো বাঙালি হতভাগিনীদের নিয়তি। যৌনপল্লিতে আটক মেয়েরা প্রায়ই নানা রকম সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে যন্ত্রণায় কাতরায়। ব্যয়সাপেক্ষ সুচিকিৎসা তারা পায় না। শয্যাগত হলে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু অবধারিত।
ইসলামি জঙ্গিরা খুব খারাপ প্রজাতি। নারী পাচারকারীরা তাদের চেয়ে কম জঘন্য নয়। জঙ্গিদের মতোই পাচারকারীদের আস্তানা আছে। সেসব আস্তানার খোঁজ গোয়েন্দারা রাখতে পারেন না, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। জঙ্গিদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়ে সরকার যে আত্মপ্রসাদ লাভ করে, নারী পাচারকারীদের পাকড়াও করায় তেমন উদ্যোগ নেই বলেই বাংলাদেশ আজ নজরদারির তালিকায়।
যুবতী-কিশোরী পাচার শুধু অবৈধ নয়, অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ। এই অপরাধই হলো ব্যবসা। এ ব্যবসায় পুঁজি লাগে না, উপার্জন বিপুল। কোন আর্থসামাজিক অবস্থায় হতদরিদ্র মেয়েরা পাচারকারীদের ফাঁদে পা দেয়, তার মূল কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। তারপর বিভিন্ন যৌনপল্লি থেকে যাদের উদ্ধার করা হয়, সরকারের নৈতিক দায়িত্ব তাদের সম্মানজনক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন