|
সৈয়দ আবুল মকসুদ
test@gmail.com |
|
যে অপমৃত্যুর দায় নেই কারও
11 July 2017, Tuesday
অসাধারণ মেধাবী, পণ্ডিত, সৃষ্টিশীল ও মানবকল্যাণে নিবেদিত মানুষ আমাদের মাটিতে রোজ রোজ জন্মগ্রহণ করেন না। সৃষ্টিশীলতা বিকাশের ক্ষেত্র হিসেবেও আমাদের সমাজ যথেষ্ট অনুকূল নয়। বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান সমাজ গান-বাজনা-নৃত্যকে একসময় পাপ বলে গণ্য করত। ফলে এ সমাজে বড় সংগীতশিল্পী-নৃত্যশিল্পী দেখা যায়নি বহুদিন। নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরী ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আমাদের কৈশোরে। তাঁকে দেখিনি। আমরা দেখেছি এবং মিশেছি আরেকজন নৃত্যশিল্পীর সঙ্গে। তিনি গওহর জামিল। ভরতনাট্যম ও কত্থক নৃত্যে তিনি ছিলেন পারদর্শী। তিনি নৃত্যকলায় তালিম নেন উদয়শঙ্কর, মারুথাপ্পা পিনাই প্রমুখ উপমহাদেশের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পীদের কাছে। ঢাকার পাটুয়াটুলী থেকে ওয়াইজঘাটে পঞ্চাশের দশকে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে প্রায়ই যেতাম। তিনি ছিলেন তাঁর শিক্ষক। তিনি একজন অসামান্য সংগঠকও ছিলেন। বিখ্যাত জাগো আর্ট সেন্টার তাঁরই প্রতিষ্ঠিত। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বহু খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী তাঁরই হাতে গড়া। কবি জসীমউদ্দীন তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।
অধ্যাপনাকে অনেকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন, কিন্তু সবাই পাণ্ডিত্যের অধিকারী হন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ইতিহাসবিদকে জানতাম, যাঁরা ছিলেন অসামান্য পণ্ডিত। প্রফেসর আগা মেহেদী হোসেন ছিলেন অবাঙালি, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি এবং প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট। তাঁর অধ্যাপনার শুরু অবিভক্ত ভারতে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি জানতেন উর্দু, ইংরেজি, বাংলা ছাড়া হিন্দি, ফারসি, সংস্কৃত, জার্মান, ফরাসিসহ অনেক ভাষা। অনেক আকর গ্রন্থের প্রণেতা। তাঁর বই প্রকাশিত হয়েছে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, বরোদা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তাঁর শেষ জীবন কাটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হলের সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে। পরিবার-পরিজনহীন তাঁর অসহায় মুখ আজও চোখে ভাসে।
ঘনিষ্ঠতা ছিল প্রফেসর মফিজুল্লাহ কবিরের সঙ্গে। তিনিও ছিলেন অসামান্য পণ্ডিত ও মেধাবী ইতিহাসবিদ। অনেক গ্রন্থেরও প্রণেতা। তাঁর সর্বশেষ দায়িত্ব ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্পে। তিনি ছিলেন দলিলপত্রের অথেনটিকেশন কমিটির সভাপতি। হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন প্রকল্প পরিচালক ও সম্পাদক। ওই সময় তাঁদের সঙ্গে কিছু কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।
আমাদের চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে শিক্ষিত ও মেধাবী যে অল্প কয়েকজন, তাঁদের একজন ছিলেন আলমগীর কবির। ইংরেজি-বাংলা দুটো ভাষাতেই ছিল তাঁর সমান দক্ষতা। তিনি ছিলেন উচ্চতাসম্পন্ন চিত্রনির্মাতা। সাংবাদিকতায়ও তাঁর অবদান যথেষ্ট। ছিলেন অবিচল বাঙালি জাতীয়তাবাদী। সে জন্য ষাটের দশকে জেলও খেটেছেন। স্বাধীনতার আগে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘ঢাকা সিনে ক্লাব’। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান স্মরণীয়। জহির রায়হানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। জহির রায়হান এবং তাঁর স্টপ জেনোসাইড এবং লিবারেশন ফাইটার্স অমূল্য দলিল। তাঁর ধীরে বহে মেঘনা, সূর্যকন্যা, সীমানা পেরিয়ে, রূপালী সৈকতে প্রভৃতি অমূল্য কাজ। সবশেষে তিনি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র করতে চিত্রনাট্য তৈরি করছিলেন। সে ব্যাপারে তিনি শওকত ওসমান এবং আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে আলোচনায় বসতেন। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের সংস্কৃতিমান আধুনিক মানুষ।
১৯৭৮ সালে একুশের বইমেলার সময় একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে আহমদ ছফার রুমে গেছি। তিনি বললেন, সড়ক দুর্ঘটনায় ড. আগা মেহেদী হোসেন স্যার আহত হয়ে হাসপাতালে মারা গেলেন, কেউ শোকও জানালো না, পত্রিকায় নিউজও হলো না। অবশ্য দু-একটি কাগজে ছোট করে সংবাদ হয়েছিল। আমি তাঁর পরিণতির কথা শুনে কষ্ট পাই এবং ইত্তেফাক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে একটি বড় প্রবন্ধ লিখি।
১৯৮০ সালে অফিসে বসে আছি। আমাদের একজন রিপোর্টার এসে খবর দিলেন নৃত্যশিল্পী গওহর জামিল সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তাঁর অকালমৃত্যু আমাদের সংস্কৃতি জগতের বিরাট ক্ষতি করল। ১৯৮৬-তে একদিন সকালে পত্রিকায় দেখি আমাদের শ্রদ্ধেয় মফিজুল্লাহ কবির আর নেই, সড়ক দুর্ঘটনায় আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কয়েক দিন আগেই তিনি একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে আমার বাসায় এসেছিলেন। তখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জাহানারা ইমাম ও আমার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়। তাঁর মৃত্যুতেও খুব দুঃখ পাই। আগা মেহেদী ও মফিজুল্লাহ কবিরের মৃত্যু পরিণত বয়সে, তবে বেঘোরে অপমৃত্যু।
১৯৮৯ সালে শীতের মধ্যে খেজুরের রস খেতে দুই-তিন দিনের জন্য গ্রামে গিয়েছিলাম। খুব সকালে আমরা কয়েকজন আরিচার কাছে পদ্মার তীরে যাই। একটি চায়ের দোকানে ট্রানজিস্টর বাজছিল। এমন এক খবর সেখান থেকে আমার কানে এল যে বিশ্বাস করতে চাইল না মন। আমাদের অগ্রজপ্রতিম আলমগীর কবির বগুড়া গিয়েছিলেন। ঢাকায় ফেরার পথে তাঁর গাড়ি নগরবাড়ী ঘাটে ফেরিতে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছিল। পেছন থেকে একটি ট্রাক তাঁর ছোট গাড়িটাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে যমুনায় ফেলে দেয়। তাঁর গাড়িতে অভিনেত্রী টিনা খানও ছিলেন। সড়ক দুর্ঘটনায় যমুনা নদীতে গাড়িসহ তাঁদের সলিলসমাধি ঘটে। আলমগীর কবিরের মৃত্যু আমাকে ভীষণভাবে বিচলিত করে। অনেক বড় কাজ তাঁকে দিয়ে হতো। তাঁর অকালমৃত্যু আমাদের চলচ্চিত্র জগতের জন্য ছিল কঠিন আঘাত। তিনি শুধু একজন চিত্রনির্মাতা ছিলেন না, ছিলেন তরুণ সম্ভাবনাময় চিত্রনির্মাতাদের একজন শিক্ষক।
নাইজেরিয়াতে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় বহু মানুষ মারা যেত। বিষয়টি নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক ওলে সোয়েঙ্কাকে ব্যথিত করে। তিনি তাঁর দেশে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ব্যবস্থা নিতে নোবেল পুরস্কারের টাকার একটি অংশ সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ব্যয় করার ঘোষণা দেন। সেই খবরে আমি প্রভাবিত হই কিন্তু আমার টাকা কোথায়? আলমগীর কবিরের মৃত্যুর পর এই বিষয়ে লেখালেখি করে সামান্য জনমত গঠনের চেষ্টা করি। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয় না।
এর মধ্যে অনেক দিন গেছে।
প্রতিদিন বাংলাদেশে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সড়কে প্রাণ দিচ্ছে মানুষ। দীন ভিখারি থেকে ধনকুবের শিল্পী-সাহিত্যিক-রাজনীতিক-সমাজকর্মী, দুগ্ধপোষ্য শিশু থেকে শতায়ু বৃদ্ধ—শত শত মানুষ প্রতিদিন সড়কে যানবাহনের চাকায় পিষ্ঠ হয়ে প্রাণ হারায়। আমাদের দেশের সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃতি বিচিত্র। বাসের সিটে বসেও মারা যায়। আমাদের যাত্রীবাহী বাসগুলোর দুই পাশের শরীর ঘষাঘষিতে বিশ্রী রূপ নিয়ে থাকে।
আমাদের সাধারণ নাগরিকদের কিছুই করার নেই দুঃখ পাওয়া ছাড়া। এর মধ্যে আমাদের দুই ঘনিষ্ঠজন চিত্রপরিচালক তারেক মাসুদ ও সংবাদমাধ্যম ব্যক্তিত্ব মিশুক মুনীর সড়কে নিহত হলেন আরও কয়েকজনসহ। তাঁদের অমন মৃত্যুতে ছাত্র-যুবক ও সাধারণ মানুষের মধ্যেও ক্ষোভ দেখা দেয়। সামনেই ছিল ঈদ। প্রতিদিন মানুষ পথেঘাটে মরছিল যন্ত্রদানবের চাকায় পিষ্ট হয়ে। আমরা সর্বস্তরের মানুষ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ঈদের দিন জমায়েত হয়ে প্রতিবাদ করি। তাতে কিছু কাজ হয়। সরকার সাড়া দেয়। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন উদ্যোগ ও ব্যবস্থা নেয়। সভা-সমাবেশ-গোলটেবিল প্রভৃতি হচ্ছে সচেতনতা বৃদ্ধিতে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান গবেষণা করছে। একাডেমিক পর্যায়েও কাজ হচ্ছে। মিডিয়াতে, বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রচুর টক শো হচ্ছে। কিন্তু দুর্ঘটনা থেমে নেই।
প্রথম আলো কয়েক মাস যাবৎ প্রতিদিনের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা হালনাগাদ করছে। গত ১৪৬ দিনে নিহত হয়েছে ১ হাজার ৩২৩ জন। এটি হলো ঘটনাস্থলে মৃত্যুর সংখ্যা। আহত যারা হাসপাতালে মারা গেছে, তাদের সংখ্যা যোগ দিলে অঙ্কটি আরও অনেক বেশি হবে। আহত ব্যক্তিদের অনেকে দু-চার মাস ভুগে মারা যায়। তাদের হিসাব কেউ রাখে না। তা ছাড়া, যারা চিরপঙ্গুত্ব বরণ করে বেঁচে থাকে, তাদের জীবন যে কত বড় অভিশাপ, তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যের উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
কোনো কোনো সড়ক দুর্ঘটনায় একটি পুরো পরিবার শেষ হয়ে যায় অথবা একটি শিশু ছাড়া সবাই মারা যায়। কোনো দুর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম উপার্জনশীল মানুষটি হঠাৎ চলে গেলে পরিবার পথে বসে। আরও মর্মান্তিক ব্যাপার হলো কোনো কোনো দুর্ঘটনায় একটি পরিবারের স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়। যেমন গত দেড় বছরে দেড় শর মতো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রছাত্রী নিহত হয়েছে। মা-বাবার সব স্বপ্ন শেষ।
সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারানো জাতীয় অর্থনীতির জন্যও তা ক্ষতির কারণ। নিরাপদ সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা টেকসই অর্থনীতির জন্যও অতি জরুরি। সড়ক দুর্ঘটনা পৃথিবীর সব দেশেই হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার চরিত্র আলাদা। কোথাও গাড়িচাপা পড়ে কোনো পথচারী মারা গেলে সেই গাড়িটি ভাঙচুর করা হয়, সেই গাড়ি পালিয়ে গেলে রাস্তার অন্যান্য অসংখ্য গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। গত এক দশকে ওভাবে হাজার হাজার মূল্যবান গাড়ি চুরমার করা হয়েছে। এসবই অর্থনৈতিক ক্ষতি।
অথচ যে যানবাহন দুর্ঘটনা ঘটায় তার চালক ও মালিক নিরাপদে থাকেন। চালকের শাস্তি হয় না। মালিককে ক্ষতিপূরণের টাকা গুনতে হয় না। নাগরিক সমাজ থেকে আমরা সড়ক আইন সংশোধনের দাবি জানিয়েছি, কিন্তু মালিক–নেতা ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা বিরাট ক্ষমতার অধিকারী। তাঁরা সরকারকে পরোয়া করেন না।
এখন সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করার জন্য বিভিন্ন সংগঠন তৈরি হয়েছে। দেশ এবং বিদেশ থেকে তহবিলও পাওয়া যায়। সরকারও বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয় না। তা না হওয়ার কারণ স্বার্থের সংঘাত। সরকারের যাঁরা নীতিনির্ধারক এবং যাঁরা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবেন, তাঁরাই পরিবহন মালিক সমিতির নেতা অথবা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা। সুতরাং রাস্তায় মানুষ মরবেই। গত দুই বছরে অন্তত ৪০ জন চালক ও হেলপার দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। কিন্তু সড়কে ছোটাছুটি করে আমার এই ধারণা জন্মেছে যে অনেক চালক নিজে বেপরোয়া চালিয়ে নিজে মরতে এবং অন্যকে মারতে কোনো দুঃখ পান না। পথচারী, চালক, যাত্রী, যানবাহনের মালিক, শ্রমিকনেতার মনোভাব পরিবর্তন ছাড়া এবং সরকারের কঠোর অবস্থান ব্যতীত বাংলাদেশের মানুষকে সড়কে মৃত্যুবরণের অভিশাপ থেকে বাঁচানো যাবে না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন