অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন এখনো বলবৎ আছে, কিন্তু সেটা বড় কথা নয়, কারণ এই স্বাধীন রাষ্ট্রে আইন মানতে সবাই বাধ্য নন। তা ছাড়া ঈদ-পরবর্তী পুনর্মিলনীতে চা-নাশতার এন্তেজাম অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতায় পড়ে না। সে চায়ের দাওয়াতও দু-চার শ লোকের জন্য নয়, অতিথি সাকল্যে জনা পনেরো। সে মেহমানও যেনতেন ব্যক্তিরা নন। একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি, যিনি একটি রাজনৈতিক দলেরও প্রধান। অন্যান্য মেহমানও জাতীয় পর্যায়ের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। কারও সম্পর্কেই জঙ্গি সম্পৃক্ততার কোনো অভিযোগ নেই। তাঁরা সবাই ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। অতিথিদের একজন বীর উত্তম, মুক্তিযুদ্ধে যাঁর অবদান দেশের কারও চেয়ে কম নয়। যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের প্রায় সবাই কমবেশি দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। আমন্ত্রণকারী স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একজন শীর্ষ নেতা। শুধু তা-ই নয়, তিনি আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০০ মেয়াদের সরকারের মন্ত্রী ছিলেন।
মেহমানদের কেবল কুশল বিনিময়ের পর্ব শেষ হয়েছে। বৈঠকখানায় পুলিশ। কারও ধারণা হলো তিনি ডিউটি করতে করতে পিপাসার্ত, তাই পানি খেতে এসেছেন। কিন্তু না, তা নয়। তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বার্তা বহন করে এনেছেন। তা হলো একটি হুকুম: ওখানে সভা করার পূর্বানুমতি নেই, তাই বৈঠক করা চলবে না।
সেদিনের নেতাদের আলাপ-আলোচনায় সরকারের পক্ষে-বিপক্ষেই যে কথা হতো তাই-বা সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এবং গোয়েন্দারা আগাম জানলেন কী করে? অতিথিরা তাঁদের কৈশোর-যৌবনে দেখা সিনেমা নিয়েই হয়তো স্মৃতি রোমন্থন করতেন। কেউ কথা বলতেন হেমা মালিনী সম্পর্কে, কেউ বৈজয়ন্তীমালা, কেউবা আশা পারেখের অনুপম শারীরিক সৌন্দর্য কিংবা তাঁর পরনের ঘাগরা নিয়ে। আমরা ২৪ বছর পাকিস্তানি ছিলাম। সুতরাং সেকালের ফিল্মের কথাই-বা মনে থাকবে না কেন? মনোরম নীলো কিংবা সাবিহা বা মুশররাত নাজির—কারও রূপযৌবন কম নয়। শুধু লাহোর বা টালিউড-বলিউডের হৃদয় হরণকারীরাই নন, হলিউডের অনেক তারকার কথা আজও প্রবীণ অনেক নেতার স্মৃতিতে অম্লান। এলিজাবেথ টেলর কয়বার বিয়ে করেছেন এবং একজনকে দুবার সে কথাও ভোলার নয়। সোফিয়া লরেন, ব্রিজিত বার্দোত পৃথিবীর পুরুষদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন। সেসব নিয়েও আলোচনা হতে পারত, কিন্তু কথা শুরু হওয়ার আগেই আসে নির্দেশ: কথা বলার অনুমতি নেই।
প্রথমবার পুলিশ কর্মকর্তাকে বিদায় করা গেলেও, রাষ্ট্র সেখানেই থেমে থাকেনি। আবার কিছুক্ষণ পরে আসে হুকুম, ‘তাড়াতাড়ি শেষ করেন’। ওদিকে তখন রান্না চুলায়। শেষ হতে আরও কিছু বাকি। তখন হয় গৃহকর্তার সঙ্গে পুলিশকর্তার বাহাস। রাতের খাবার না খাইয়ে তিনি এবং অতিথিপরায়ণ গৃহকর্ত্রী মেহমানদের কী করে বিদায় করেন? সুতরাং আরও কিছু সময়ের প্রয়োজন। যাহোক, রাষ্ট্র দয়াপরবশ হয়ে সে সময়টুকু দিয়েছিল। সম্মানিত অতিথিদের খুব বেশি অপমান করা হয়নি, তাঁরা কেউ গ্রেপ্তারও হননি।
যাঁরা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন, তাঁরা সবাই আমার ঘনিষ্ঠ, কেউ কেউ বিশেষ বন্ধু। সবারই বয়স হয়েছে। এই বয়সে গুরুপাক খাদ্য ক্ষতিকর। তাই পোলাওয়ের পরিবর্তে সাদা ভাতই হয়েছিল। চিকেন প্রভৃতির সঙ্গে লইট্যা মাছের একটি আইটেমও ছিল বলে বন্ধুদের মুখে শুনেছি। গভীর উদ্বেগের মধ্যে খেয়েদেয়ে তাঁরা যখন বেরিয়ে যান, সেই বিদায়ের দৃশ্য মিডিয়ায় দেখেছি। একই সঙ্গে লোভ, ক্ষোভ ও হাসি এল। লোভ কিসের জন্য তা পাঠক অনুমান করতে পারেন, ক্ষোভ এতগুলো সম্মানিত ব্যক্তিকে অপমান করায় এবং হাসি বঙ্গীয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি দেখে। মাঠে-ময়দানে সমাবেশ করতে দেবে না, সে ক্ষমতা সরকারের আছে, কিন্তু ঘরের ভেতরে বসে আলাপ-আলোচনার স্থায়ী অধিকার রাষ্ট্রের সংবিধান প্রতিটি মানুষকে দিয়েছে। সেই জন্মগত অধিকার হরণ করার অধিকার সরকারের প্রশাসনের, সংসদের এবং রাষ্ট্রের কারও নেই। তা যে নেই তা সংবিধান যাঁরা পাঠ করেছেন তাঁরা জানেন। নিজের বাড়িতে শান্তিপূর্ণভাবে নিরাপদে বাস করা ও আলাপ-আলোচনার অধিকার সংবিধানের ৪৩ ধারা প্রদত্ত মৌলিক অধিকার। ম্যাজিস্ট্রেটের লিখিত নির্দেশ ও অনুমতি ছাড়া পুলিশ কারও ঘরে প্রবেশ করতে পারে না। তল্লাশি করতে পারে না। মালামাল জব্দ করতে পারে না। পুলিশের কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিকদের মানবিক অধিকার নিশ্চিত করা—লঙ্ঘন করা নয়। তবে কর্মকর্তাবিশেষকে এ জন্য দোষারোপ করা যাবে না। তিনি তাঁর ওপরওয়ালার নির্দেশ পালন করেছেন মাত্র।
তাঁর ওপরওয়ালা নির্দেশ পালন করেছেন আরও ওপরওয়ালার।
সেদিন যদি নেতারা ঘরের ভেতরে বসে সরকারের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিতেন, তাতে সরকারের তিল পরিমাণ ক্ষতি হতো না। বাধা দেওয়ায় তাঁদের কিছুমাত্র ক্ষতি হয়নি, বিরাট ক্ষতি হয়েছে সরকারেরই। অতি উৎসাহী যাঁরা উত্তরায় অভিযান চালানোর বুদ্ধি বের করেছিলেন, তাঁরা সরকারের ও দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন। এমনিতেই ক্ষতিগ্রস্ত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, তার মধ্যে পুঁতে দিয়েছেন আরেকটি কাঁটা। বহুদিন এই কাঁটার আঘাত থেকে যাবে।
কয়েকজন খ্যাতনামা নেতাকে ঘরের ভেতরে চা-নাশতা বা রাতের খাবারের আয়োজনে বিপত্তি সৃষ্টি করার ঘটনাটি তখন ঘটল, যখন লন্ডনে বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্র নিয়ে একটি সেমিনার হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের গুরুত্ব যদি মোটেই না থাকত, তাহলে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সরকারি দল অত অর্থ ব্যয় করে সেখানে গেল কেন? দেশে যখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা এক টেবিলে বসেন না, বিদেশে গিয়ে বসা কতটা নৈতিক দিক থেকে যৌক্তিক? যেকোনো একটা উপলক্ষে লন্ডন সফর করা এক কথা আর দেশের রাজনীতি ও মানবাধিকার নিয়ে সেমিনারে অংশগ্রহণ অন্য জিনিস। তারপর সেখানে গিয়ে আলোচনায় অংশ না নেওয়ার নেতিবাচক দিকটি কি তাঁরা ভেবে দেখেছেন? ২০০৫ সাল থেকে যে সংগঠনের আয়োজিত সেমিনারে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করে আসছে, এবার তা বয়কট করার পেছনে যে যুক্তি দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে, তা আয়োজক ও বাঙালিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। সরকারি দলের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে।
আরেকটি ঘটনা। ঘটনাটি ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রে তার অভিঘাত ছোট নয়। প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের বিরূপ ধারণা সৃষ্টি করতে ঘটনাটি খুবই সহায়ক। বিশেষ করে ধারণা দেবে কী ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে জনগণ ও সরকারি কর্মকর্তারা বাস করছেন।
পঞ্চম শ্রেণির এক শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধুর একটি ছবি দিয়ে বরগুনার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজী তারিক সালমন আগৈলঝাড়ার ইউএনও থাকার সময় স্বাধীনতা দিবসের আমন্ত্রণপত্র করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ওই ছবিটি একজন বঙ্গবন্ধুপ্রেমীর পছন্দ হয়নি। তা না হতেই পারে। সবার রুচি ও বিচার-বিবেচনা সমান নয়। ছবিটি ‘বিকৃত’ এই অভিযোগে ফরিয়াদি ইউএনওকে আসামি করে ফৌজদারি মামলা ঠুকে দিয়েছেন। বিজ্ঞ আদালত তাঁর বিরুদ্ধে সমন জারি করেন। তিনি বিচারকের এজলাসে হাজিরা দিতে যান এবং জামিন প্রার্থনা করেন। জামিন প্রথমে নাকচ হয়। তখন একজন সম্মানিত কর্মকর্তাকে পুলিশ সদস্যরা চুরি-ডাকাতি-খুনের আসামির মতো হাজতের দিকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যান। তা তাঁরা করেন নিয়ম মেনেই। কারণ, আসামি যদি দৌড়ে পালিয়ে যান অথবা তাঁর বন্ধুবান্ধব যদি তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে যান, তখন সে দায় কে নেবে?
হাজতের ভাত কর্মকর্তাকে খেতে হয়নি। ঘণ্টা দুই পরেই একই বিজ্ঞ বিচারক তাঁকে জামিন দিয়েছেন। অমর্যাদা যা হওয়ার তা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে তাঁর। যিনি মামলা করেন তাঁর দেশপ্রেম, বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর অপার ভালোবাসা, বর্তমান সরকারের প্রতি তাঁর অবিচল আস্থা—এ সবকিছুতে আমাদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। যে বিজ্ঞ বিচারক মামলাটি আমলে নিয়েছেন তাঁর মেধা ও প্রজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তোলার দুঃসাহসও আমাদের নেই। ফরিয়াদির বিজ্ঞ আইনজীবীদের জ্ঞান, নৈতিকতা ও বিচার-বিবেচনা সম্পর্কেও কারও সন্দেহ নেই। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকা কী? যিনি মামলা ঠুকেছেন একজন সম্মানিত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে, তিনি একজন দলীয় ব্যক্তি এবং এ ধরনের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। দলীয় লোকদের স্বার্থরক্ষা না হলেই সরকারি কর্মকর্তারা খারাপ। গত কয়েক বছরে বহু কর্মকর্তা সরকারি দলের লোকজনের হাতে অপদস্থ হয়েছেন। আতঙ্কিত মানুষের কাছ থেকে আনুগত্য আশা করা যায় না।
সরকারি কর্মকর্তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, সরকারের নয়। তাঁরা বেতন-ভাতা পান রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে, কোনো দলের তহবিল থেকে নয়। তাঁদের নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দেওয়া সব নাগরিকের কর্তব্য। ফরিয়াদি যে মামলা ঠুকেছেন তা স্থানীয় নেতাদের অজানা ছিল না। তাঁদের সমর্থন ছিল বলেই বিজ্ঞ আদালত বিচার ও শুনানির আগেই সাজা অর্ধেক দিয়ে দিয়েছিলেন। কোন অভিযোগে, কোন আসামিকে কী সাজা দিতে হবে বিজ্ঞ বিচারক তা বিলক্ষণ জানেন।
সরকার প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করবে, আবার দলীয় লোকদের দিয়ে তাঁদের অপদস্থ করবে, তাতে প্রশাসন সন্তুষ্ট থাকবে, সেটা মনে করার কোনো কারণ নেই। ওই কর্মকর্তার ব্যক্তিগত জীবনে ও চাকরিজীবনে অভিশাপ নেমে আসত, যদি না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং এবং সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ফরিয়াদির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ না দিতেন।
সহিষ্ণুতা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। ভিন্নমত প্রকাশের মুখে কুলুপ এঁটে দিলে শ্বাসরোধে গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়। গণতন্ত্রের গায়ে কাঁটা ফোটাতে, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে অসুন্দর ও কলুষিত করতে রক্তারক্তির মতো বড় ব্যাপারের প্রয়োজন হয় না, ছোট ছোট কিছু ঘটনাই যথেষ্ট। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবার—নীতিনির্ধারক ও কর্মকর্তা—সতর্কতা আবশ্যক।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন