বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা ও জাতীয় রাজনীতির ধারাবাহিকতায় বারবার ছেদ পড়েছে। এক পদ্ধতি থেকে আরেক পদ্ধতিতে যেতে সময় লেগেছে মাত্র এক দিন। এবং তা করতে জনগণের সম্মতির প্রয়োজন হয়নি। একদিন সকালে উঠে জনগণ দেখেছে আগের দিন তারা যে ধরনের ব্যবস্থায় ছিল, পরদিন আর তাতে নেই। তবে যা-ই ঘটুক জনগণ নীরবে মেনে নিয়েছে অথবা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।
স্বাধীনতার পর তিন বছর একটি সংসদীয় পদ্ধতিতে দেশ শাসিত হয়েছে। তাতে দুর্বলতা ছিল, ভুলভ্রান্তি ছিল, কিন্তু তা ছিল একটি স্বীকৃত ও পরিচিত পদ্ধতি। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী এক দশক ধরে ওই পদ্ধতির প্রতিশ্রুতিই দেওয়া হয়েছিল জনগণকে। তা ছাড়া ওই পদ্ধতিই ছিল মানুষের প্রত্যাশা। স্বাধীনতার পরে দেশের নেতৃত্বে ছিলেন এমন এক নেতা, যাঁর ওপর জনগণের অপার আস্থা ছিল। কারণ, তাঁর নেতৃত্বেই দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। তাই তাঁর উপস্থিতিই ছিল একটা বড় ভরসা। তারপর যখন সংসদীয় থেকে একদলীয় রাষ্ট্রপতি পদ্ধতিতে যাওয়া হলো, জনগণের মতামত বা গণভোট না নিয়ে, সংসদে এবং সংসদের বাইরে আলোচনা ও বিতর্ক না করে, তখন তার ভালো দিক বা মন্দ দিক নিয়ে ভাবার অবকাশ পেল না মানুষ।
সেই একদলীয় পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার দায় কি শুধু ক্ষমতাসীন দলেরই ছিল, অন্য কোনো দলের নয়? সেদিন দেশে আর কোনো দল ছিল না? সব দল যখন নিষিদ্ধ হলো তার প্রতিবাদে ওই সব দলের নেতাদের কী ভূমিকা ছিল? সেদিন যদি কোনো ভুল বা অন্যায় হয়ে থাকে, তার দায় থেকে সেদিনের রাজনীতিকেরা ক্ষমা পেতে পারেন না। জেনারেল ওসমানী ও ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ব্যক্তিগতভাবে ভিন্নমত পোষণ করে বাকশালে যোগ দেননি। তাঁদের তো বঙ্গবন্ধু জেলে ঢোকাননি।
১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইনের বিধানে পাকিস্তানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারই দেশ চালাচ্ছিল। প্রদেশে প্রাদেশিক পরিষদ ছিল। ১৯৫৬-তে সংবিধান প্রণয়নের আগ পর্যন্ত কেন্দ্রে গণপরিষদ ছিল। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে আইয়ুব খান সেই সংসদীয় পদ্ধতি কতল করেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে প্রবর্তন করেন ‘মৌলিক গণতন্ত্র বা বনিয়াদি গণতন্ত্র’। সেই গণতন্ত্র মানুষের মেনে না নিয়ে উপায় ছিল না। কারণ, তার তারিফ করে খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী দেদার প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। বনিয়াদি গণতন্ত্রের শানে নজুল বা ব্যাখ্যা করে প্রকাশিত পুস্তিকায় সারা দেশ সয়লাব হয়ে গিয়েছিল। বনিয়াদি গণতন্ত্রের প্রতিবাদে লেখা একখানা গোপন হ্যান্ডবিলও আমাদের চোখে পড়েনি।
একই সঙ্গে স্বাধীন হলেও পাকিস্তানে গণতন্ত্র হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লেও ভারতে তা অব্যাহত থাকে। পাকিস্তানে বিরোধী দলের কোনো দাম ছিল না। ভারতে বিরোধী দলকে মূল্য দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাম রাজনীতিক ও লেখক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে শোনা একটি কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে। তিনি আমাকে বলেছেন, লোকসভায় সিপিআইয়ের পক্ষ থেকে তাঁর বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। তাঁকে সময়ও দেওয়া হয়েছে বেশি। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায় জ্যোতি বসুর বক্তব্য উপভোগ করতেন। তিনি স্পিকারকে বলতেন, ‘জ্যোতি বলুক না আরও!’ সে দেশে এই সব সেই সময় ঘটেছে, যখন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীর মাথা ফেটে চৌচির হয় এবং তাঁকে শুধু পরিষদ কক্ষ নয়, এই পৃথিবীই ত্যাগ করতে হয় চিরদিনের জন্য।
সামন্ততন্ত্রে বিরোধী মতের মূল্য নেই। কিন্তু গণতন্ত্রে শুধু শাসক দল নয়, বিরোধী দলের প্রয়োজন অপরিহার্য। (অবশ্য ২০১৪-পরবর্তী বাংলাদেশের সংসদে বিরোধী দল বিশ্বের ইতিহাসে অদ্বিতীয়) উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সরকারি দল তার কোনো একজন মন্ত্রীকে সামাল দিতে পারছে না। তাঁর অসদাচরণ বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিরোধী দল যদি সংসদে কঠোর বক্তব্য দেয় সরকারি দলের সুবিধা হয় তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। তা ছাড়া সরকারের ভুল ও দুর্বলতা নিয়ে বিরোধী দল যুক্তিসংগত সমালোচনা করলে সরকার নিজেদের সংশোধন করে জনপ্রিয় হতে পারে। বাংলাদেশে যদি গণতন্ত্র থাকত এবং সংসদে বিরোধী দল থাকত, তাহলে বিশ্ব ঐতিহ্যে সুন্দরবন বেঁচে যেত এবং জাতীয় কমিটি ও ইউনেসকোর এই বিশ্বসম্পদ নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন হতো না।
গণতন্ত্র তো পরের কথা। সেটা থাকলে ভালো, না থাকলেও চলে। কিন্তু গণতন্ত্র থাকুক বা না থাকুক, একটি আধুনিক রাষ্ট্রে রাজনীতি নামক জিনিসটি তো থাকতে হবে। ১৯৫৮ থেকে ’৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশে গণতন্ত্র ছিল না, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র দেশ চালিয়েছে, কিন্তু রাজনীতি তো ছিল। রাজনীতি ছিল বলেই মুক্তিযুদ্ধ হতে পেরেছে। বাংলাদেশে আজ প্রশাসন আছে, আইন-আদালত আছে, পুলিশ আছে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আছে, ব্যবসা-বাণিজ্য আছে, ‘উন্নয়ন’ কর্মকাণ্ড আছে, ঘুষ-দুর্নীতি আছে, কিন্তু যা নেই তা হলো রাজনীতি। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে এমন কোনো বালক বা বালিকা যদি প্রশ্ন করে বাংলাদেশে এত রাজনৈতিক দল আছে, তাহলে রাজনীতি থাকবে না কেন? রাজনৈতিক দল আর রাজনীতি কি তাহলে দুই জিনিস? সেই বালক-বালিকাকে বলব, একুশ শতকের বঙ্গে ‘রাজনৈতিক দল’ আর ‘রাজনীতি’ সম্পূর্ণ দুই জিনিস।
মাস তিনেক আগে দেশ উদ্ধারের দায়িত্ব পালন করতে প্রেসক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে ঢুকছি, মুখোমুখি হলাম আমার এক পুরোনো বন্ধুর। অনেক দিন পরে দেখা। অতি সজ্জন-সরল মানুষ। আর্থিক অবস্থাও সে রকম ভালো না বলে কাপড়চোপড় দেখে মনে হলো। স্বাস্থ্য ভালো না। বাইপাস করিয়েছে অনেক দিন আগে। ডায়াবেটিস আছে। বললাম, কেমন আছ? শরীর ভালো তো? ‘ভালো’ বলে সে চার পৃষ্ঠা কাগজ আমার হাতে দিল। বলল, একটা ঐক্য ফ্রন্ট—জোট গঠন করলাম। আমি বললাম, দেশে এখনো বাইপাস রোগীদের কোনো সমিতি-টমিতি নেই, সে রকম কিছু করছে নাকি? বলল, না, কাগজটা পইড়া দেখো। নির্বাচনী যুক্তফ্রন্ট।
কাগজটি পড়ে আমি হতবাক না হয়ে বরং উপভোগ করি। ৩৭-৩৮টি ‘রাজনৈতিক দল’ নিয়ে গঠিত হয়েছে নির্বাচনী ঐক্যজোট। আমি তাকে বললাম, আর কয়েকটি দলকে সঙ্গে নিলে ভালো হতো না? তা ছাড়া ২০১৯-এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা যদি তোমরা পাও, তাহলে কে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হবেন, তা ঠিক করেছ তো? সে বলল, আগামী নির্বাচনে আমরা খুব বেশি সিট পামু না। আমি বললাম, সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাইলেও অন্তত সব দলের সভাপতি ও সেক্রেটারি যদি পাস করেন, তা হইলেও তো ৭৪-৭৫টা আসন পাইবা। সংখ্যাটা শুনে তার চোখে-মুখে খুশির সূক্ষ্ম ঝিলিক খেলে গেল।
আমার বন্ধুটির উদ্দেশ্য মহৎ। তার জোট ক্ষমতায় গিয়ে দুর্নীতি বন্ধ করবে। সুইস ব্যাংক থেকে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনবে। শুধু তা-ই নয়, ভিসামুক্ত বিশ্ব তো গড়বেই, তা ছাড়া তার সুদূর লক্ষ্য সারা পৃথিবীতে একটা রাষ্ট্র বানানো। কোনো বাঙালিকে পাগল বলার অধিকার নেই। এখনো আমরা যারা অ-পাগল বলে নিজেদের মনে করছি তাদেরও। কিন্তু অনেকের কাজ-কারবারে বহু মানুষের মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম হতে পারে।
কয়েক মাস পরপরই পত্রিকায় দেখা যায় নতুন নতুন দল ও জোট গঠিত হচ্ছে প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে। সেগুলোর আহ্বায়ক মোটামুটি অজ্ঞাত ব্যক্তি। কোনো লোক যদি তার দেশব্রত থেকে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করতে চায়, তা তার ফান্ডামেন্টাল রাইট। সেই অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা তার সাংবিধানিক অধিকার হরণ করা। সুতরাং, তা করা যায় না। শুধু প্রশ্ন করতে পারি: রাজনীতিতে আপনি কে হে?
৩৫ বছর যাবৎ যথাযথ বিরতি দিয়ে ঘোষিত হচ্ছে ‘বাম বিকল্প’ জোটের আবির্ভাবের কথা। কখনো আবার ‘তৃতীয় ধারা’। বাঙালি ও বাংলাদেশি ধারা আছে। তারা দেশকে কিছু দিতে পারেনি। তাই তাদের বাইরে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে ‘বাম বিকল্প’ অথবা ‘তৃতীয় ধারা’র। সেই সব বিকল্প ও ধারার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ পোষণ করবে এমন বোকা বাঙালি নয়।
প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতার একটি কনস্টিটুয়েন্সি বা নির্বাচকমণ্ডলী থাকে। বাংলাদেশের বিকল্প বা ধারাওয়ালাদের কার কনস্টিটুয়েন্সি কোনটা, আমাদের জানা নেই। জাতীয় নির্বাচন ও জাতীয় রাজনীতি খুব বড় ব্যাপার। সারা দেশে প্রায়ই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের নির্বাচন হচ্ছে। পৌরসভাগুলোর নির্বাচন হচ্ছে। যাঁরা বাম বিকল্প বা তৃতীয় ধারা সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন, হাজার হাজার ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যের মধ্যে তাঁদের দলের কতজন আছেন? প্রেসক্লাবে বা ড্রয়িংরুমে বসে দল বা জোট গঠন দোষের নয়। কিন্তু সত্যিকারের রাজনীতিক যাঁরা, তাঁদের মানুষ দেখতে চায় জনগণের মধ্যে। আমার ওই বন্ধুর ৩৭-৩৮টি দল ছাড়াও বাংলাদেশে যে বিপুলসংখ্যক ‘দল’ রয়েছে, তাদের কোনো সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে গত ৪০ বছরে উল্লাপাড়া, ঝিকরগাছা বা ভূরুঙ্গামারীতে কেউ দেখেছে বলতে পারবে না। ওসব তো অনেক দূরে, কামরাঙ্গীরচর বা টঙ্গীতে বালু নদের তীরবর্তী কোনো পল্লিতেও তাঁদের পদধূলি পড়েছে, সেখানে গিয়ে জনসভা করেছেন, সে খবর কেউ কাগজে পড়েনি, লোকমুখেও শোনেনি। অথচ দিল্লি, লন্ডন ও নিউইয়র্ক দৌড়াতে ক্লান্তি নেই কারও।
রাজনীতি করেন না অথচ পরিচয় দেন রাজনীতিবিদ পদবাচ্যে। জনগণের সঙ্গে নেই, চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকেন ক্ষমতার দিকে। আগামী নির্বাচন কী রকম সহায়ক সরকারের অধীনে হবে, তা নিয়ে মাথাব্যথা, অথচ যখন সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী তড়িৎগতিতে পাস করিয়ে নেওয়া হয়, তখন তার প্রতিবাদে রাজপথে নামেননি কেউ। এখন সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে বগল বাজাচ্ছেন অনেকে। আগামী নির্বাচনে ২৫৩ জন যদি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন এবং অবশিষ্ট ৪৭ আসনের সব কটিতে তৃতীয় বিকল্প ধারার নেতারা সবাই নির্বাচত হন, তাতেই-বা জাতির কী লাভ?
মানুষ আজ ভয়ানক বিরক্ত। বিরক্ত শুধু ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গসংগঠনের ওপর নয়, বিরোধী দলের নেতাদের ওপর। রাজনীতিশূন্যতার মধ্যে এমন সব ব্যাপার-স্যাপার হচ্ছে, যা সাধারণ নাগরিকদের স্নায়ুর ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করছে। তারা তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারছে না নেতৃত্বের অভাবে। মানুষ চাপা যন্ত্রণায় ভুগছে। জাতি এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসান চায়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন