সবাই এখন নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া এবং কমিশনের ভবিষ্যৎ চরিত্র নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। বুঝে বা না-বুঝে নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে সবাই এতই আলোচনামুখর, যেন মনে হয় দেশে আর কোনো সমস্যা নেই। রাজনৈতিক অঙ্গনে তর্ক-বিতর্ক চলছেই।
এমন আলোচনা-সমালোচনার মাঝে যে বিষয়টি আড়ালে পড়েছে তা হলো আগামী নির্বাচন যাতে ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো না হয়, তার জন্য করণীয়। আমি আগেও বলেছি এবং এখন আবার উল্লেখ করতে চাই যে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন একমাত্র ক্ষমতাবান নির্বাচন কমিশন হলে তার একার পক্ষে করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সহযোগীদের সহযোগিতা। তবে সক্ষম ব্যক্তিদের দ্বারা কমিশন গঠিত হলে সহযোগীদের সহযোগিতা আদায় করা যায়। সহযোগীদের মধ্যে প্রধান সহযোগী ওই সময়কার সরকার। এ কথা অনস্বীকার্য যে একটি ভালো, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি সক্ষম নির্বাচন কমিশনের বিকল্প নেই। আর তারই প্রয়াসে রত ছিল ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি। অবশ্য এবারের সার্চ কমিটির উদ্যোগ আগের চেয়ে যথেষ্ট স্বচ্ছ এবং আন্তরিক বলে দেশবাসীর মনে হয়েছে।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে, কোনোটি নিয়ে এত মাতামাতি ও এত আলোচনা হয়নি কিংবা এমনভাবে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। এমনকি বিদায়ী কমিশন গঠনের সময়েও হয়নি। যাঁরা নির্বাচন কমিশন নিয়ে গবেষণা করছেন বা করবেন, এবারের পরিস্থিতি তাঁদের জন্য বিশ্লেষণের বিষয় হয়ে থাকবে। নির্বাচন কমিশনের গঠন প্রক্রিয়া বা গঠন করা রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সমাজের রুটিন বিষয়। অথচ ইদানীং নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সারা দেশে যেভাবে আলোচনা হচ্ছে, তা অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে সচরাচর দেখা যায় না।
এবারের নির্বাচন কমিশনের গঠন প্রক্রিয়ার ভিন্নতর বিষয় ছিল কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে কী ধরনের ব্যক্তিদের প্রয়োজন তা ঠিক করা, যার মধ্যে গোটা হুদা কমিশনের সব সদস্য অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আর এ কারণেই সম্পূর্ণভাবে কিছু কারিগরি বিষয় তুলে ধরার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। আমি আমার বক্তব্য লিখিত আকারে দিয়েছিলাম। ওই বক্তব্যে শুধু কমিশনের সদস্যের ন্যূনতম গুণাবলির কথাই নয়, তার বাইরে সার্বিকভাবে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং দায়িত্বের কথাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। আমার গবেষণালব্ধ যৎসামান্য জ্ঞান এবং কমিশনার হিসেবে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি বিষয়গুলো উল্লেখ করেছি।
হুদা কমিশনের অভিজ্ঞতা শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমিত ছিল না। নির্বাচনের আয়োজনের বাইরেও কমিশনকে একটি স্বাধীন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার সর্বাঙ্গীণ প্রয়াস ছিল। ছিল ভৌত কাঠামোগত স্বাধীনতা, যার মাধ্যমে প্রায় সাড়ে চার শ উপজেলাভিত্তিক সার্ভার স্টেশন, জেলা, আঞ্চলিক এবং কমিশন সদর ভোটার তালিকা, জাতীয় পরিচয়পত্র, বিশাল তথ্যভান্ডার স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং এ জন্য লোকবল নিয়োগ—সবই পাঁচ বছরের মধ্যে শেষ করা হয়েছিল। আইনের ব্যাপক সংস্কার করা এবং এ প্রক্রিয়ায় শরিকদের সম্পৃক্ত করার সংস্কৃতির সূচনা করা হয়েছিল। এ অর্জনগুলোর কারণে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন উপমহাদেশে তো বটেই আফ্রো-এশিয়ান দেশগুলোর রোলমডেল হতে পারত। এ জন্য প্রয়োজন সঠিক ব্যক্তিদের কমিশনে অন্তর্ভুক্তি এবং এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখা, যার অনেকটা ব্যত্যয় হতে দেখা গেছে। এখানেই আমি মনে করি বাছাই কমিটির বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকতে পারে।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রায় চার হাজারের কাছাকাছি। এত বড় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কমিশনের ওপর শুধু জনগণ অথবা রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিবিদদেরই আস্থা নয়, বরং শত-সহস্র কর্মকর্তা-কর্মচারীর আস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব জনবলও একটি সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও পরবর্তী কর্মকাণ্ডের বড় ধরনের শরিক। কাজেই অস্থায়ী কমিশন সদস্যদের ওপর আস্থা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই অস্থায়ী কমিশন সদস্যদের কর্মকাণ্ড এবং সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানকে শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় করতে যেমন সহায়ক হতে পারে, তেমনি দুর্বল করতেও পারে।
স্মরণযোগ্য যে ২০০৬ সালে নির্বাচন কমিশন শুধু সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়নি, বহু জায়গায় অনেক অফিস জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সামগ্রিকভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দারুণ হীনম্মন্যতায় ভুগছিলেন শুধু কমিশনের সদস্যদের ওপর দেশবাসী ও অভ্যন্তরীণ অনাস্থার কারণে। এর আরও উদাহরণ হয়তো বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যাবে। অভাব ছিল নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় সার্বিক কার্যকর ইলেকটরাল গভর্ন্যান্সের (Effective Electoral Governance)। কাজেই সদস্য নির্বাচন, নিয়োগের সময় এ বিষয়টি বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশ প্রয়োজন। এখনো আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত শক্ত হতে পারেনি।
বাংলাদেশের সংবিধান নির্বাচন ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের তিনটি স্বীকৃত কাঠামোর মধ্যে (সরকারি, মিশ্র ও স্বাধীন) স্বাধীন নির্বাচন কমিশনকেই গ্রহণ করেছে এবং এই কমিশন বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরিচালিত। কারণ, সংবিধান বা অন্য কোনো আইন অন্য ধরনের ব্যক্তিদের উল্লেখ করেনি। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন মোটা দাগে তিন ধরনের সদস্যমণ্ডলী দ্বারা পরিচালিত হতে পারে। যথা: শুধু বিচারিক ব্যবস্থাপনায় (Judiciary Based) যেমন ব্রাজিল, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বেশ কিছু দেশ। কমিশন পরিচালিত হতে পারে রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সংমিশ্রণে। সে ক্ষেত্রে সংসদে উপস্থিত রাজনৈতিক দলেরই মাত্র অন্তর্ভুক্তি হয়ে থাকে। তবে এ ব্যবস্থাপনায় বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক সদস্যের মিশ্রণে হয়ে থাকে। তবে রাজনৈতিক মতামত গ্রহণ করা হয় নির্বাচনসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও পরিচালনায়। মেক্সিকো, আইভরি কোস্ট ও মোজাম্বিক তার উদাহরণ। বাস্তবতার নিরিখে স্বাধীন ও বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরিচালিত নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সংগঠন বা নির্বাচন কমিশনকে গবেষকেরা সবচেয়ে বেশি কার্যকর বলে মনে করেন। তবে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনই সবচেয়ে বেশি গণতান্ত্রিক দেশে গৃহীত হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের সচিবালয় ২০০৯ সালে আইন দ্বারা কমিশনের এখতিয়ারে ন্যস্ত হওয়ার পুরোপুরি স্বাধীন সংস্থা হিসেবে নির্বাচন কমিশনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও পূর্ণতা পেয়েছে। এর মধ্যে যে বিষয়গুলো এই প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী বা ক্ষমতাবান করে তোলে তার মধ্যে রয়েছে সাংগঠনিক, আর্থিক ও কার্যক্রমের স্বাধীনতা; নিরপেক্ষতা, বিশ্বাসযোগ্যতা, স্বচ্ছতা, দক্ষতা, পেশাগত উৎকর্ষ এবং সেবার মনোভাব। কাজেই যাঁদেরই নিয়োগ দেওয়া হোক না কেন, প্রতিষ্ঠানের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য শুধু অনুধাবনই নয়, সমুন্নত রাখার প্রয়াস যেমন নিতে হবে, তেমনি এ প্রয়াস দৃশ্যমান হতে হবে। এর মধ্য দিয়ে ব্যাপক আস্থার সংকটে ভুগতে থাকা নির্বাচন কমিশন সংকট কাটিয়ে ওঠার প্রয়াস পাবে।
কমিশনের সদস্যদের মধ্যে হৃদ্যতা এবং দল হিসেবে কর্মপরিচালনা করার দক্ষতাসম্পন্ন মানুষের প্রয়োজন। যিনি শীর্ষ দায়িত্বে থাকবেন, তাঁকে যেমন নেতৃত্ব দিয়ে দল গঠন করতে হবে, তেমনি অন্যদের সহযোগিতার মনোভাব থাকতে হবে। তার মানে এই নয় যে নিজস্ব স্বকীয়তা বিসর্জন দিতে হবে। তবে সংকটের সমাধানে একত্রে কাজ করার মনোবৃত্তির প্রয়োজন খুব বেশি। অতীতে এই মনোভাবের অভাবে অনেক কমিশন অকার্যকর হয়েছে অথবা তেমনভাবে কার্যকর হয়নি।
নির্বাচন কমিশন সদস্যদের বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য কমিশনারদের অভিজ্ঞতার মেয়াদ, বয়স ও প্রশাসনিক প্রজ্ঞা কাছাকাছি হওয়ার বিষয়টিও গুরুত্ব বহন করে। কারণ, বিশেষ করে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো সম–মতামতের ভিত্তিতে গৃহীত হয়। যদিও আইন বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার শুধু সচিবালয়ের দৈনন্দিন পরিচালনার দায়িত্বে থাকলেও এখানেও প্রয়োজনবোধে অন্য সদস্যদের সম্পৃক্ততা যৌথভাবে কাজ করার স্পৃহাকে উন্নত করে। এসব বিষয় অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের কার্যকারিতা ও ক্ষমতার ওপর প্রতিফলিত হয়।
পরিশেষে চীনের কমিউনিস্ট আদর্শিক নেতা মাও সে–তুংয়ের ভাষায় বলতে হয়—অস্ত্র নয়, অস্ত্রের পেছনের মানুষগুলোই আসল (It is not gun but man behind the gun matters)। আমিও মনে করি কাদের নিয়ে গঠিত হবে আগামী নির্বাচন কমিশন তার ওপরই নির্ভর করবে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার স্পৃহা, জনগণের হারানো বিশ্বাসের পুনরুদ্ধার এবং কমিশনের অভ্যন্তরীণ মনোবল।
নির্বাচন কমিশন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম, যার মাধ্যমে পরিচালিত হয় নির্বাচন এবং রচিত হয় গণতন্ত্রের ভিত। এ ভিত কেমন হবে তা নির্ভর করে নির্বাচনের ওপর। একটি গ্রহণযোগ্য, স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার যেমন নৈতিক, আইনগত ও জনগণের সমর্থনে যে শক্তি অর্জন করে, তা একটি অস্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে সম্ভব হয় না। কাজেই আমাদের দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে আরও কার্যক্ষম করতেই হবে। তবে প্রশ্ন থাকে যে একটি কার্যক্ষম নির্বাচন কমিশন (Effective Election Commission) এবং নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা দ্বারাই কি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব? উত্তর ‘না’। একটি স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও অবাধ নির্বাচনের জন্য এই দুটির পাশাপাশি কমিশনের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি খুবই জরুরি। আমরা আশাবাদী যে এবারের প্রয়াস সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এবং যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ হবে। অন্যথায় বিতর্ক পিছু ছাড়বে না।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন