|
এম সাখাওয়াত হোসেন
hhintlbd@yahoo.com |
|
নতুন নির্বাচন কমিশনের সামনে চ্যালেঞ্জ
16 February 2017, Thursday
.
দেশব্যাপী প্রায় তিন মাসের আলোচনার পর অবশেষে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের জন্য পাঁচজন মানুষ খুঁজে পাওয়া গেল, যাঁরা বিতর্কিত কাজী রকিবউদ্দীন কমিশনের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। এই নাম পাওয়া এবং বাছাইপ্রক্রিয়া নিয়েই তর্ক হচ্ছে রাজনৈতিক মহল ও নাগরিক সমাজে, বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার অতীত নিয়ে। এই কমিশনের দুজন ছাড়া আমার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কারও পরিচয় নেই। যে দুজনকে ভালোভাবে চিনি তাঁদের একজন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত কমিশনার সাবেক সচিব রফিকুল ইসলাম, যিনি আমাদের সঙ্গে মানে হুদা কমিশনে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কয়েক বছর ছিলেন। ওই পদে থাকার কারণে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনের সঙ্গে যেমন পরিচিত, তেমনি নির্বাচনকালীন মাঠপর্যায়ের প্রশাসনের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল। আমি তাঁকে সোজাসাপ্টা কর্মকর্তা হিসেবেই দেখেছি। তবে পরিবর্তিত দায়িত্ব তিনি কীভাবে পালন করবেন তা বুঝতে কিছুটা সময় লাগবে।
একই মতামত অপর কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাহাদাৎ হোসেন চৌধুরীর জন্যও প্রযোজ্য। তিনি নির্বাচন কমিশনে তৃতীয় সাবেক সামরিক কর্মকর্তা। সাহাদাৎ হোসেন ড. হুদা কমিশনের প্রায় প্রথম থেকেই ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কয়েক বছর ছিলেন। তখন তিনি সেনাবাহিনী থেকে প্রেষণে নিযুক্ত ছিলেন। দক্ষতার সঙ্গে এবং অত্যন্ত সার্থকভাবে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব, ভোটার তালিকা ও ডেটাবেইস তৈরি সম্পন্ন করেছিলেন। পরে সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে ইউএনডিপির সঙ্গে বছরখানেকের ওপরে আফগানিস্তানে একই ধরনের প্রকল্পে নিয়োজিত ছিলেন।
আশা করা যায় অন্তত এই দুজন তাঁদের পূর্ব-অভিজ্ঞতার আলোকে কমিশনকে যে বিতর্কিত অবস্থায় রকিব কমিশন রেখে গিয়েছে, তার থেকে উত্তরণ ঘটাতে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করবেন। তাঁদের এই নতুন পরিচয়ে কার্যক্ষমতা দেখার অপেক্ষায় গোটা জাতি। সিইসিসহ অপর দুজনের সঙ্গে আমার তেমন পরিচয় নেই, তাই তাঁদের সম্বন্ধে তেমন কিছুই বলতে না পারলেও নিশ্চয় তাঁরা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে উজ্জ্বল ছিলেন। তা না হলে তাঁদের উচ্চপর্যায়ের এই সার্চ কমিটি কীভাবে খুঁজে পেল এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন এবং ছোট ছোট দল, যারা বৃহৎ দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ, তারাই-বা তাঁদের খুঁজে পাবে কীভাবে?
সার্চ কমিটির ভাষ্যমতে, তারা রাজনৈতিক দলের নামগুলোরই প্রাধান্য দিয়েছে, হয়তো এসব দলের রাজনৈতিক অবস্থান মাথায় রেখেই ১৬ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রদত্ত ছকে ১০ জনকে নির্বাচন করেছে। কাজেই যাঁদের নির্বাচন করে তালিকাভুক্ত করেছে সার্চ কমিটি, তাঁদের কাউকে কাউকে নিয়ে বিতর্ক করে লাভ কী? কারণ, তাঁরা তো স্বেচ্ছায় নাম প্রদান করেননি। খুঁজে বের করার দায়দায়িত্ব মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাদের হাতেই দিয়েছেন।
২.
নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশন এমন অবস্থায় দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, যেখানে তাদের পূর্বতন কমিশন অনেক চ্যালেঞ্জের জায়গা তৈরি করে গেছে। এসব চ্যালেঞ্জকে নুরুল হুদা কমিশনকে অবশ্যই ধর্তব্যের মধ্যে নিতে হবে। আমি বিস্তারিত না গিয়ে স্বল্পপরিসরে যতটুকু সম্ভব তা জনসাধারণ এবং নুরুল হুদা কমিশনের জন্য উপস্থাপন করছি। এগুলো আমার অভিজ্ঞতা ও গবেষণার আলোকে লব্ধ। তবে বাস্তব নিরিখে অনেকেই এই মতামতগুলোর সঙ্গে একমত হবেন।
চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে প্রথম হলো নতুন কমিশনকে গত কমিশনের ব্যর্থতার কারণগুলো খুঁজে তার প্রতিকার কীভাবে করবে তার ছক তৈরি করা। তাদের ওপর মানুষের, রাজনৈতিক দল এবং অন্য শরিকদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে যোগাযোগ সৃষ্টি করা। মনে রাখতে হবে শরিকদের সহযোগিতা ছাড়া নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করা সম্ভব নয়। এ যোগাযোগ একাধিকবার হতে পারে। বিগত কমিশন তার পূর্বসূরিদের দেখানো পথে হাঁটেনি বিধায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শরিকদের সঙ্গে যেমন যোগাযোগ করেনি, তেমনি কোনো সহযোগিতাও পায়নি। একটি আমলাতান্ত্রিক আবরণ বজায় রেখেছিল, যার কারণে ‘মেরুদণ্ড তত্ত্বে’র জন্ম হয়েছিল।
এই কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা। পূর্বতন কমিশন এই আস্থা পুরোপুরি নষ্ট করেছিল বলেই জোরালো অভিযোগ রয়েছে। এই আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে হলে কমিশনের সৎসাহস ও স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। এই কমিশনকে আগামী সংসদ নির্বাচন করতে হবে সংসদ রেখে এবং দলীয় সরকারের অধীনে। এ বিষয় মাথায় রেখে সামনের প্রতিটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের সততা, নিরপেক্ষতা আর দক্ষতার প্রমাণ দিতে পারলে ক্রমেই মানুষের মনে নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর বিশ্বাস ফিরতে শুরু করবে। তবে মনে রাখতে হবে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক মানদণ্ডে বিচার করা যাবে না।
নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্বের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব জাতীয় নির্বাচন করা। মাত্র দুই বছর অথবা তারও কম সময় রয়েছে জাতীয় নির্বাচনের। এ দুই বছরে সবার কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, তার একটি রূপরেখা তৈরি করে জনসমক্ষে প্রকাশ করে পরিবেশ সৃষ্টির জন্য শরিকদের এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির সঙ্গে আলোচনার পথ উন্মুক্ত করলে স্বচ্ছতার ক্ষেত্র তৈরি হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে রকিবউদ্দীন কমিশন তাদের পূর্বসূরির রাস্তা ধরেনি বরং শরিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেইনি। বিশ্বব্যাপী যে উদ্যোগকে নির্বাচনী প্রশাসনের ভালো উদ্যোগ বলা হয় তার ধারেকাছে দিয়েও পূর্বতন কমিশন যায়নি, যার কারণে একদিকে যেমন বিচ্ছিন্ন ছিল, অপর দিকে নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। আস্থা ফিরিয়ে আনতে না পারলে কমিশনের কোনো উদ্যোগই বিশ্বাসযোগ্য হবে না।
আরও গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ রয়েছে নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশনের, যা লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেছে। বহু বছর ধরে সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এবং হুদা কমিশনের দৃঢ় অবস্থানের কারণে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়কে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে নির্বাচন কমিশনের আওতায় দেওয়ায় নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে।
২০০৮ সালে জারিকৃত ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয় অধ্যাদেশ’ পরবর্তী সময়ে অপরিবর্তিত অবস্থায় ২০০৯ সালে সংসদ দ্বারা আইন অনুমোদিত হয়। এ দাবি আদায় করতে বহু আন্দোলন হয়েছিল। প্রতি দলের রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকলেও ২০০৮ পর্যন্ত করা হয়নি। অবশ্য পরে আওয়ামী লীগ সরকার অধ্যাদেশটি আইনে রূপান্তরিত করে। এই আইনের অধীন নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত নিয়োগবিধিসহ অন্যান্য বিধি তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে নিয়োগ, বদলি এবং নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার পদোন্নতিও বিধির আওতাভুক্ত হওয়ায় সচিবালয়ের ওপর স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা হয়েছিল। প্রেষণে শুধু সচিবসহ সচিবালয়ের কয়েকটি পদ উন্মুক্ত ছিল। এই বিধি তৈরির ফলে সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সরকারের প্রভাবমুক্ত অবস্থায় কর্মসম্পাদন করার নতুন সংস্কৃতি হুদা কমিশন সম্পন্ন করে বহু বছরের পদোন্নতির জট খোলার চেষ্টা করেছিল। নতুন কাঠামো তৈরি করে মধ্যম ও উচ্চপর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিশেষ করে মাঠপর্যায়ে পদোন্নতির পথ খুলে দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন সত্তা হিসেবে পূর্ণাঙ্গতা পায়।
এসব বিধি অজ্ঞাত কারণে রকিব কমিশন যেভাবে পরিবর্তন করে, তাতে জেলা পর্যায়ে জেলা কর্মকর্তাদের জন্য যে উপসচিবের এবং অন্য পদগুলোতে সরকারের কর্মকর্তাদের প্রেষণের সুযোগ করে দেওয়া এবং মধ্যম ও উচ্চতর পদোন্নতিতে সরকারের অনুমতির বিধি সংযোজন করে পরিবর্তন করাতে স্বাধীন সবিচালয়ের অবস্থানে আমুল পরিবর্তন করা হয়েছে, যা কাম্য ছিল না।
[বাংলাদেশ গেজেট এপ্রিল ৬, ২০১৬ এবং ওই গেজেটের বিধি ২ (খ)-এর প্রতি পদে বিশেষ করে আঞ্চলিক ও জেলা পর্যায়ে কর্মকর্তা নিয়োগবিধি দ্রষ্টব্য]। এ কাজটি বিগত নির্বাচন কমিশন কেন করেছে, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। এসব কর্মকাণ্ডে নির্বাচন কমিশন শুধু নিজের স্বাধীনতাই খর্ব করেনি, বরং নির্বাচন কমিশনের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনেও জটিলতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে।
এ বিষয়টি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিপরীত। শুধু কমিশনই নয়, সচিবালয় যদি সরকারের প্রভাবের আওতামুক্ত না থাকে তবে কমিশনের স্বাধীনতা যে খর্ব হবে বা হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি মনে করি, নিয়োগবিধি এবং সার্বিকভাবে বিধিতে অন্যান্য পরিবর্তন ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ২০০৯’-এর আইনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যকে পরাভূত করেছে। এর ব্যাখ্যা কী হতে পারে জানা নেই।
নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই এ পরিবর্তন নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে ঠেলে দেবে। বিশেষ করে যখন আগামী সংসদ নির্বাচন পরিবর্তিত সংবিধানের আওতাতেই করতে হবে। স্থানীয় সরকারের দলীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গ নাই–বা উত্থাপন করলাম। এ নিয়োগবিধি এসব নির্বাচনকেও প্রভাবিত করবে।
নতুন নির্বাচনের সামনে বহু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব মোকাবিলা করতে হলে কমিশনকে একটি ‘টিম’ হিসেবে স্বচ্ছতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করতে হবে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শরিকদের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। নির্বাচন কমিশন চাইলে সহযোগিতার অভাব হবে না। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক না কেন এর জবাব কথায় নয়, কাজের মাধ্যমে দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে সবার আস্থা অর্জন করতে হবে। নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশনের পথ সহজ হবে না। তবে আন্তরিকতার মাধ্যমে পথ সুগম করা সম্ভব। আমি ব্যক্তিগতভাবে কমিশনের সফলতা কামনা করি।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার, গবেষক ও কলাম লেখক৷
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন