|
এম সাখাওয়াত হোসেন
hhintlbd@yahoo.com |
|
উপমহাদেশের অভিজ্ঞতা ও তুলনামূলক বিচার
12 March 2017, Sunday
প্রায় দুই বছর যাবৎ আমি বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা এবং শরিকদের ভূমিকা নিয়ে গবেষণায় বাংলাদেশ ছাড়াও উপমহাদেশের বড় তিনটি দেশের সার্বিক নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণের পর্যায়ে রয়েছি। এরই মধ্যে বাংলাদেশে রকিবউদ্দীন কমিশনের বিদায়ের পর দ্বিতীয় সার্চ কমিটির মাধ্যমে পাঁচ সদস্যের নতুন নির্বাচন কমিশন কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে প্রায় এক মাস সময় কাটিয়েছে। এখনো এই কমিশনের কর্মকাণ্ড জনসমক্ষে তেমন আসেনি, তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ বেশ বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার তাঁর ওপর আস্থা রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা প্রায় পাঁচ বছর ধরে যে আস্থার সংকটে রয়েছে, তা নিয়ে নতুন করে বলার অবকাশ নেই। বিষয়টি নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশন নিজেরাও বুঝতে পেরেছে বলে আমার বিশ্বাস। নবনিযুক্ত কমিশনের সামনে এটাই যে প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ,
তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার কথা নয়। এ চ্যালেঞ্জ নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশন কীভাবে মোকাবিলা করবে, তার কৌশল তাদের সত্বর বের করতে হবে।
সামনে রয়েছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই হবে তাদের অধীনে প্রথম বড় কোনো সর্বদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান। যদিও গুরুত্বের দিক থেকে স্থানীয় নির্বাচন জাতীয় সংসদ নির্বাচন চ্যালেঞ্জের উত্তর দেয় না, তবে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার দক্ষতার কিছু পরিচয় দিতে পারে। প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নির্বাচনী এলাকার নির্বাচন কুমিল্লার সঙ্গে একই দিনে হলেও ওই নির্বাচন সর্বদলীয় নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত নয়। যা-ই হোক, কুমিল্লায় সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তা হবে নবনিযুক্ত কমিশনের প্রথম ছোট পদক্ষেপ। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে নির্বাচন কমিশনের প্রতিকূল পরিবেশ হতে উত্তরণের বড় চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে নির্বাচনটি হবে সংসদের মেয়াদকালের মধ্যে। ওই নির্বাচন নিয়ে রাজনীতির মাঠ মাত্র উত্তপ্ত হতে শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশের নির্বাচনী আইন ও ব্যবস্থাপনার আইনগুলো তুলনামূলকভাবে উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ শক্তিশালী। তবু বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন অতীতে সেসব যথাযথ প্রয়োগ না করার কারণে বিতর্কিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিতর্কে পড়েছিল সদ্য বিদায়ী কমিশন। আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ না করার কারণে ২০১৪ সালের পর শুধু নারায়ণগঞ্জ ছাড়া আর কোনো নির্বাচনকেই
সুষ্ঠু বলা যাবে না। ব্যাপক অনিয়ম আর রক্তক্ষরণ হয়েছে পরবর্তী স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে, বিশেষ করে বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রায় ১২৫ জনের প্রাণ ঝরেছে। ভেঙে পড়েছে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা। কেন এমন হয়েছে এবং এখন থেকে ভবিষ্যতের পথ কী হবে, তার একটি সমীক্ষা নির্বাচন কমিশন নিলে ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ণয় করতে সক্ষম হবে।
শুধু শক্তিশালী আইনি ব্যবস্থা এবং নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ও আইনি ক্ষমতা থাকলেই হবে না, যদি নির্বাচন কমিশনের তা প্রয়োগের মনোবৃত্তি না থাকে তবে এসব কিছুই কাজে দেয় না। দেখা যাবে যে ভারতের নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা যথেষ্ট না হলেও এবং নির্বাচনী আইন পর্যাপ্ত ক্ষমতা না দিলেও ভারতের নির্বাচন কমিশন আইনের প্রয়োগ ও কর্মদক্ষতার দিক থেকে শুধু উপমহাদেশেই নয়, আফ্রো-এশিয়ার গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্য অনুকরণীয় মডেল।
তুলনামূলক গবেষণার তৃতীয় দেশ পাকিস্তানে বিভিন্ন কারণে এখনো যাওয়া হয়নি। ফলে প্রাথমিক তথ্যপ্রাপ্তি সাপেক্ষে অমুখ্য (secondary) তথ্য নিয়ে গবেষণা চালাতে গিয়ে এটা মনে হয়েছে যে, ক্ষমতা ও আইনের দিক বিবেচনায় নিলে উপমহাদেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান নির্বাচন কমিশন পাকিস্তানের। এই তিনটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ বাদে, পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন বর্তমানে কাঠামোগত, কার্যকারিতায় এবং আর্থিক স্বাধীনতা ভোগ করে, যা ভারতীয় কমিশন থেকে এক ধাপ এগিয়ে। ভারতীয় কমিশন এখনো আর্থিকভাবে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করেনি এবং বিষয়টি এক যুগের বেশি সময় ধরে নির্বাচন কমিশন সংস্কারের প্রস্তাবনায় রয়েছে।
পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের জনবলের নিয়োগ, বদলি, নিয়মানুবর্তিতা এবং পদোন্নতির ক্ষমতা পাকিস্তান প্রধান নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারে; যে ক্ষমতা ভারতীয় নির্বাচন কমিশনসহ উপমহাদেশের অন্য কোনো প্রধান নির্বাচন কমিশনার অথবা কমিশনের নেই। পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের অনেক ক্ষমতার মধ্যে অন্যতম ক্ষমতা হলো নির্বাচনী গেজেট প্রকাশনা-উত্তর সময় নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল গঠনের ক্ষমতা এবং হালে এই ক্ষমতায় যুক্ত করা হয়েছে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজদের ট্রাইব্যুনালে নিয়োগ দেওয়া। আরও অনেক বিষয়ে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন থেকে এগিয়ে থাকার পরও পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন তথা পাকিস্তানের ইতিহাসে সব পক্ষের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭০ সালে। তবে নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা নির্বাচনী ফলাফল মেনে নিতে পারেনি।
১৯৫২ সালে ভারতের নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার চার বছর পর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানের আওতায় গঠিত হয় নির্বাচন কমিশন। আইন এবং কার্যকারিতা একটি স্বাধীন কমিশন হিসেবে ভারতের অনুকরণেই প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের ঝুলিতে সার্থকতার ওই একটি নির্বাচন ছাড়া উল্লেখ করার মতো তেমন কিছুই নেই। দীর্ঘ সামরিক শাসনের পর ১৯৭১ সাল-পরবর্তী পাকিস্তানের নতুন সংবিধানে পাঁচ সদস্যের বিচার বিভাগভিত্তিক নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি যুক্ত করা হয়। সংবিধান অনুয়ায়ী বিচার বিভাগ থেকে সাবেক এবং চার প্রদেশে কর্মরত উচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়ে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন গঠিত হলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। পাকিস্তানের ইতিহাসে শুধু ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার তাদের পূর্ণ মেয়াদ শেষ করেছে এবং ২০১৩ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রথমবার গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছে।
এরপরও পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন স্বস্তিতে থাকতে পারেনি। তাদের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং পরবর্তীকালে ২০১৫ সালে লাহোর সংসদীয় এলাকা ১২২ (পাঁচ) উপনির্বাচন নিয়ে ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ এবং শাসকদল মুসলিম লিগের (নেওয়াজ) মধ্যে বিবাদের জেরে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। মুসলিম লিগের (নেওয়াজ) বিরুদ্ধে উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি, জাল ভোটসহ রিটার্নিং অফিসারদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগের ঢেউ ২০১৩ সালের সার্বিক নির্বাচনেও লাগে। সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক অচলাবস্থা। ওই সাধারণ নির্বাচনে সব দলের অনুরোধে উচ্চপর্যায়ের বিচারকদের প্রথমবারের মতো রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের পর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ইফতেখারের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপের অভিযোগও উঠে আসে।
রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান হয় সরকার কর্তৃক ২০১৩ এবং বিশেষ করে উপনির্বাচন ট্রাইব্যুনাল বাতিল করার পর পাঞ্জাব উচ্চ আদালত ওই রায়কে কেন খারিজ করা হয়েছিল, তার প্রেক্ষাপট ও অনিয়ম চিহ্নিত করার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্তের পর। তিন সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্তের প্রধান ছিলেন ২০১৪ সালে নিয়োজিত প্রধান বিচারপতি এবং অন্য সদস্যরা ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ দুজন বিচারক। তদন্ত কমিশন তাদের তদন্তের ফলাফল জমা দেয় ২০১৫ সালে। ওই তদন্তে ২০১৩ সালের নির্বাচন এবং উপনির্বাচনে যে অব্যবস্থাপনার কারণে নির্বাচন ও উপনির্বাচন নিয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, তার কারণ হিসেবে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ও সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন কমিশনের অহেতুক হস্তক্ষেপ এবং পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের অদক্ষতাকে চিহ্নিত করে ১১ দফা সুপারিশমালা উপস্থাপন করার পাশাপাশি নির্বাচনগুলোকে বৈধতা প্রদান করে।
২০১৫ সালে বিচারিক তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানের তথা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তরফ থেকে বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তনের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যেই সংবিধানে ২২তম সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের কাঠামো পরিবর্তন করা হয়। বাতিল করা হয় বিচার বিভাগ থেকে শুধু বিচারকের নিয়োগ। সংশোধনীতে উন্মুক্ত করা হয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও সদস্য নির্ধারণকল্পে বিচারকদের পাশাপাশি অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ আমলা এবং টেকনোক্র্যাটদের অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ। নির্দিষ্ট করা হয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য সদস্যদের দায়িত্ব। বাদবাকি আইনি সংস্করণের প্রস্তাবনা সংসদের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা সংস্কার কমিটি থেকে সংসদে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে, যেখানে উল্লেখযোগ্য সংস্করণ যুক্ত হবে ইলেকট্রনিক ভোটের মেশিন বা ইভিএমের ব্যবহার এবং ‘নোটা’ (NOTA) ‘ওপরের কাহাকেও নয়’ বা ‘না ভোটের’ বিধান। এসব সংস্কারের মাধ্যমে নতুনরূপে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতিতে রয়েছে। ইতিমধ্যেই প্রথমবারের মতো একজন জ্যেষ্ঠ অবসরপ্রাপ্ত আমলা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন।
ওপরের আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার হয়েছে যে সব ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন ক্ষমতা প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছিল এবং এর প্রভাব তৃণমূল পর্যায়েও দৃশ্যমান ছিল। ক্ষমতা শুধু কাগজে-কলমে থাকলে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় না। তার প্রয়োগের বিষয়টিই আসল। এখানে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন উপমহাদেশের কমিশনগুলোর মডেল, যা পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ এবং নাগরিক সমাজও স্বীকার করে।
উপমহাদেশের প্রতিটি দেশে ২০১৮ সালে নির্বাচন হওয়ার কথা। আশা করা যায়, অতীত থেকে শিক্ষা নেবে প্রতিটি নির্বাচন কমিশন। যার জন্য প্রয়োজন অতীতের সমীক্ষার ফলাফলে করণীয় নির্ধারণ। সুষ্ঠু নির্বাচন কার্যকর গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ মাত্র।
এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন