|
এম সাখাওয়াত হোসেন
hhintlbd@yahoo.com |
|
আজও অনুতপ্ত নয় পাকিস্তান!
27 March 2017, Monday
ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে রায়েরবাজার বধ্যভূমিইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে রায়েরবাজার বধ্যভূমি
আমাদের স্বাধীনতা ৪৬ বছর পেরিয়ে ৪৭-এ পদার্পণ করেছে। আজ বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে উন্নতির যে স্বাক্ষর রেখেছে, তাতে ‘বটমলেস বাস্কেট’ বা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র মতো মন্তব্যের হোতা হয়তো তাঁর জীবনসায়াহ্নে এসে অনুতপ্ত হতে পারেন। বাংলাদেশ এখন যে জায়গায়, সেখানে পৌঁছাতে বহু জীবন বলিদান দিতে হয়েছে। এখনো মার্চ মাস এলে সেই স্মৃতি ভেসে ওঠে। ইতিহাস হয়ে রয়েছে পাকিস্তানিদের দানবীয় আচরণ। ভিন্ন আঙ্গিকে হলেও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পটভূমি নিয়ে বর্তমানে পাকিস্তানেও প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। কিছু বই পাকিস্তানিদের পছন্দ না হলেও অন্য দেশ থেকেও প্রকাশিত হচ্ছে। এ রকম একটি বই, আরশাদ সামি খানের থ্রি প্রেসিডেন্টস অ্যান্ড অ্যান অ্যাইড, লাইফ, পাওয়ার অ্যান্ড পলিটিকস-এ তিনি আইয়ুব খান থেকে ভুট্টো পর্যন্ত তাঁদের রাজনীতি, বিশেষ করে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর ১৯৭০-৭১ সালের কর্মকাণ্ডের খণ্ডচিত্র তুলে ধরেছেন।
বইটি ভারতে প্রকাশিত হয়েছে, যার সারসংক্ষেপ প্রথম আলোয় কয়েক কিস্তিতে সোহরাব হাসান তুলে ধরেছিলেন। ওই লেখনীতে তুলে ধরা হয়েছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সামরিক জান্তার বর্বরোচিত হামলা ও এর প্রেক্ষাপট, বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়।
সেই সময়ের তরুণ বাঙালি সেনা কর্মকর্তা হিসেবে বইটিতে বর্ণিত অনেক বিষয় আমারও দৃষ্টিগোচরে এসেছিল। ১৯৭০ সালে আমার কর্মস্থল ছিল পাকিস্তানের লাহোরে। ছোট ছোট অনেক ঘটনা, ওই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে না হলেও ইতিহাসে জায়গা করে নিতে পারে।
১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। প্রশ্ন ছিল, পাকিস্তানে দীর্ঘ সামরিক শাসনের পর আরেক সামরিক জান্তা কেন এমন নির্বাচন করিয়েছিল? তার অন্যতম কারণ ছিল আওয়ামী লীগের দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পটভূমি এবং তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে একদা আইয়ুব খানের সহযোগী জুলফিকার আলী ভুট্টোর পার্টি পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) আন্দোলন। এই যুগপৎ আন্দোলনে তৎকালীন সামরিক জান্তার সামনে গণতান্ত্রিক নির্বাচন দেওয়া ছাড়া দ্বিতীয় পথ ছিল না। তবে ওই নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে তৎকালীন পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যে আভাস দিয়েছিল, তা কাজে লাগেনি। বরং ফল হয়েছিল উল্টো।
নির্বাচনের আগে ও পরে দু-একটা ঘটনা আমার স্পষ্ট মনে আছে, যার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ হয়তো অনেকে করেছেন। অন্তত উল্লেখিত বইটিতে কিছু কিছু উদ্ধৃত রয়েছে। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল যে ডিসেম্বরে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ওই সময় সমগ্র পাকিস্তানে বার্ষিক সামরিক মহড়ায় বিভিন্ন ইউনিট নির্ধারিত জায়গায় মহড়ারত ছিল। আমি তরুণ ক্যাপ্টেন হিসেবে লাহোরের সদরে ডিউটি অফিসার হিসেবে নিয়োজিত ছিলাম। বিশেষ করে রাতের ডিউটিতে আমাকে নিয়োজিত করা হয়েছিল। ওই সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে প্রতিটি ইউনিট থেকে মাসিক সিকিউরিটি অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট (এমএসআইআর) সেনাসদরে পাঠানো হতো। সেখানে সব রিপোর্ট এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর রিপোর্টও বিশ্লেষণের পর বিভিন্ন ডিভিশন সদরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য উপস্থাপন করা হতো।
এমন একটি রিপোর্ট আমার নজরে এসেছিল, যেখানে রাজনৈতিক অঙ্গনের বিশ্লেষণ বেশ গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করা হয়েছিল। ওই বিশ্লেষণে অনেক যোগ-বিয়োগ করে বলা হয়েছিল যে পিপিপি ও আওয়ামী লীগ কেউই এমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না, যার মাধ্যমে এককভাবে কোনো দল ৩০০ আসনের পার্লামেন্টে সরকার গঠনের মতো শক্তি অর্জন করতে পারবে। কাজেই আওয়ামী লীগ বা পিপিপি ক্ষমতায় আসতে পারবে না। অপর দিকে অন্যান্য দল, বিশেষ করে তথাকথিত ইসলামপন্থী দলগুলো সম্মিলিতভাবে সরকার গঠনের মতো শক্তি অর্জন করবে। ওই বিশ্লেষণে আরও বলা হয়েছিল যে ইসলামপন্থীরা, যার অগ্রভাবে থাকবে জামায়াতে ইসলামী, তারাও তেমন শক্তিশালী সরকার গঠন করতে পারবে না। ওই সরকারকে সামরিক বাহিনীর সাহায্য নিয়েই চলতে হবে। অর্থাৎ সরকারের টিকে থাকা নির্ভর করবে সামরিক বাহিনীর অনুকম্পার ওপর। ওই বিশ্লেষণে পিপিপি ও আওয়ামী লীগের কোয়ালিশন সরকারের সম্ভাবনার বিষয়টিও উল্লেখ ছিল। তবে সে ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা কী হবে, তা অবশ্য উল্লেখ ছিল না। এ বিষয় নিয়েই ১৯৭১ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের ডন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। বিশ্লেষণে বলা হয়েছিল যে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে হতাশ সামরিক জান্তা।
ওপরের ওই বিশ্লেষণ যে সারবত্তাহীন ছিল, তা প্রমাণিত হয়েছিল নির্বাচনের ফলাফল দেখে। গোয়েন্দা বিশ্লেষণে যেসব ইসলামপন্থী দলের নিশ্চিত বিজয়ের কথা বলা হয়েছিল, সেগুলোর এমন ভরাডুবি হবে, তা কারও ধারণায় ছিল না। ওই নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানে মাত্র চারটি আসন পেয়েছিল, তাও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে।
১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে ভুট্টোর দল পিপিপি ধারণা করেছিল যে প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে পাকিস্তান শাসন করা হবে। জুলফিকার আলী ভুট্টো যেকোনোভাবেই হোক ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার বাসনা পোষণ করতেন। এসব বিষয়ে আমার এক সহকর্মীর চাচা প্রায়ই আলোচনা করতেন। পরে তিনি পিপিপি থেকে পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পর কয়েকবার তিনি আক্ষেপ করেছিলেন যে ভুট্টো ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। এর প্রমাণ ভুট্টোর ‘এক পাকিস্তানে দুই প্রধানমন্ত্রী’ পদের প্রস্তাব। ভুট্টোই যে বাংলাদেশে সামরিক অভিযানের উসকানিদাতা তা দিবালোকের মতো সত্য। যদিও তিনি তাঁর রচিত বই দ্য গ্রেট ট্র্যাজেডিতে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার অপারেশন সার্চলাইট প্রসঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা পরোক্ষভাবে অস্বীকার করেছেন।
বইটির উদ্ধৃতি দিয়ে কয়েক দিন আগে মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর প্রবন্ধ ‘ভুট্টোর চোখে শেখ মুজিব’ লিখেছিলেন, যা ২৩ মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়। আমি মনে করি, ইয়াহিয়ার বাঙালি নিধনের দায়দায়িত্ব জুলফিকার আলী ভুট্টো কোনোভাবে এড়াতে পারেন না। ইতিহাস তাঁকে সেভাবেই চিহ্নিত করবে।
নির্বাচনের পরে জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি, বিশেষ করে ইয়াহিয়া খান যখন বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী বলে আখ্যায়িত করেন, তারপর থেকে তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ও বেসামরিক প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের আলোচনা থেকে বাঙালিদের ক্ষমতায়ন নিয়ে বেশ উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হয়েছিল। জ্যেষ্ঠ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে তাঁদের শঙ্কার কথা বলতেন যে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হলে বাঙালিদের সমতায় আনতে উচ্চ পদে পদায়নের মাধ্যমে অনেক জ্যেষ্ঠ পাকিস্তানি কর্মকর্তাকে হয়তো অবসরে পাঠাবেন। এই আতঙ্ক বেশি ছিল উচ্চ পদের সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে। উল্লেখ্য, ওই সময় হাতে গোনা কয়েকজন বাঙালি কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব পদে থাকলেও একমাত্র ওয়াসিউদ্দিন ছাড়া জেনারেল পদে বাঙালি কোনো সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন না।
এ ধরনের আলোচনা ব্যাপকভাবে চলছিল। মনে হয়েছিল, নির্বাচনের ফলাফল সামরিক জান্তাসহ উচ্চপদস্থ বেসামরিক আমলারা মেনে নিতে পারেননি। আর সেই পরিস্থিতিরই সুযোগ নেন ভুট্টো।
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভুট্টো সামরিক বাহিনীর একাংশের সহযোগিতায় খণ্ডিত পাকিস্তানের শাসক হিসেবে অবতীর্ণ হন। তিনি শুরুতেই পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি মাত্র পাঁচ বছর ক্ষমতায় টিকে থাকতে পেরেছিলেন। ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে তাঁরই নিয়োজিত সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউল হক এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভুট্টোকে উৎখাত করেন। এর আগেও ভুট্টোকে উৎখাতের জন্য পাকিস্তানি বাহিনীতে অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা হয়েছিল, যা সফল হতে পারেনি। ভুট্টোর পুরো সময়টা ইয়াহিয়া খান ছিলেন গৃহবন্দী।
জিয়াউল হকের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, সামরিক জান্তার ক্ষমতায় টিকে থাকা আর বাঙালিদের ক্ষমতা থেকে দূরে রাখাই পাকিস্তান ভাঙার একমাত্র কারণ নয়। এর পেছনের ইন্ধনদাতা ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। জিয়াউল হক ১৯৭১ সালের বাঙালি নিধনের প্ররোচনায় ভুট্টোর ভূমিকা তদন্তে ১৯৭৭ সালে ইয়াহিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাকিস্তান টেলিভিশনের একটি দলকে ইয়াহিয়ার
কাছেও পাঠিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া ওই বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। পরে জিয়াউল হক ভুট্টোকে একটি হত্যা মামলায় অপরাধী সাব্যস্ত করে ফাঁসি দিয়েছিলেন। (দ্য ডন, ১৯ মার্চ ২০১৭)
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৫ তারিখে বাংলাদেশে বিশ্বের অন্যতম জঘন্য যে গণহত্যা হয়েছিল, তার দায়দায়িত্ব পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি ভুট্টোকেও নিতে হবে। ১৯৭১ সালে বাঙালিদের একমাত্র অপরাধ ছিল তাদের ন্যায্য পাওনা এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করা। এই লড়াই করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জীবনের বড় একটি অংশ পাকিস্তানের কারাগারে কাটিয়েছেন।
আজ বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের অবস্থান পাকিস্তানের অনেক ওপরে। অপর দিকে ৭০ বছর বয়সী পাকিস্তান এখনো অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। কিন্তু দেশটি আজও তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত বলে মনে হয় না।
এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন