|
এম সাখাওয়াত হোসেন
hhintlbd@yahoo.com |
|
নির্বাচনকালীন সরকার ও কমিশনের ভূমিকা
10 May 2017, Wednesday
গত মাসের শেষ সপ্তাহে কয়েক দিনের জন্য আমার গবেষণার কাজে কলকাতায় গিয়েছিলাম। কলকাতায় আমার গবেষণার ভারতের নির্বাচন কমিশনের অধ্যায়ের কিছু সন্দেহ দূর করতে এক সাক্ষাৎকারে অনেকক্ষণ আলাপ হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের সাবেক প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা মি. জহর সরকারের সঙ্গে তাঁর ফ্ল্যাটে। মি. জহর সরকার বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত (আইএস অফিসার) ইউনিয়ন পর্যায়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব ছিলেন। চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েক মাস আগেই ‘প্রচার ভারতীর মহাপরিচালক, কেন্দ্রীয় সচিব সমতুল্য’ পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে অবসর নেন।
মি. জহর তাঁর চাকরিজীবনের তিনটি বছর সরাসরি ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে পশ্চিম বাংলা রাজ্যের প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৯৭-৯৮ সালে তাঁর আওতাধীন রাজ্যে দুটি পার্লামেন্ট নির্বাচন পরিচালনা করেন এবং ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট (জেলা প্রশাসক) থাকাকালে পদাধিকারবলে জেলা নির্বাচন অফিসারও ছিলেন। উল্লেখ্য, ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী বলতে নেই। সমগ্র নির্বাচন পরিচালনায়, নির্বাচন কমিশনার থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট রিটার্নিং অফিসার পর্যন্ত, ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের আইএএস (IAS) কর্মকর্তারাই দায়িত্বে থাকেন। এমনকি নির্বাচন কমিশন যাদের পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়, সেখানেও এই ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারাই প্রাধান্য পেয়ে থাকেন।
মি. সরকার যথেষ্ট পণ্ডিত ব্যক্তি। কিছুদিন আগে ঢাকায় পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে বাংলা একাডেমির আমন্ত্রণে এসেছিলেন। তাঁর কাছে যে বিষয়টি আমি স্পষ্টকরণের জন্য প্রথমে উত্থাপন করেছিলাম, সেটি ছিল নির্বাচনকালে ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা এবং নির্বাচনকালীন সরকারের অবস্থান। কারণ, বহু ঘাঁটাঘাঁটির পরও নির্বাচন চলাকালে এই দুই প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা ইত্যাদির আইনগত ভিত্তি অন্তত আমার চোখে পড়েনি। মি. সরকার যা বললেন তা হলো, ভারতের সংবিধানের আওতায় নির্বাচন চলমান সরকার ও সংসদের মেয়াদকালেই হয়ে থাকে, যদি আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয়। ভারতে আগাম নির্বাচনের খুব বেশি নজির নেই। আগাম নির্বাচন করতে হলে সংসদ ভেঙে দিতে হয়, সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্নতর হয়ে থাকে।
ভারতে সাধারণ নির্বাচনের সময় সরকার শুধু রুটিনকাজ করে থাকে, যেকোনো নতুন কাজ অথবা এমন কোনো নতুন বিষয় বা পরিকল্পনা, এমনকি চলমান কোনো কাজের পরিধি বাড়ানো বা সংশোধন করার মতো সিদ্ধান্ত এককভাবে নেয় না। এসব ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের পূর্ব অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। এমনকি নির্বাচনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়, এমন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো পদাধিকারীর পরিবর্তন, স্থানান্তর, প্রমোশন ইত্যাদি নির্বাচন কমিশনের পূর্বানুমতি ছাড়া সম্পন্ন করা হয় না। অন্যদিকে সাংসদ, মন্ত্রিপরিষদ, যাঁরা নির্বাচনে প্রার্থী, সাধারণ প্রার্থীর মর্যাদাই পেয়ে থাকেন। এই সময়ে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন সরকারের ওপর ‘ওয়াচ ডগ’ হিসেবে কাজ করে থাকে এবং প্রতিটি রাজ্যের সিইওর ওপর বাড়তি দায়িত্ব থাকে রাজ্য সরকারের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখা। মি. জহর সরকার জানালেন, ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের এ ক্ষমতা অলিখিত। অলিখিত হলেও সব সরকার এ ব্যবস্থা মেনেই নির্বাচনের মাঠে নামে। তিনি আরও জানালেন, এ ব্যবস্থার প্রবক্তা ভারতের কিংবদন্তি প্রধান নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশান। তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশানের পর ধারাবাহিকভাবে নির্বাচন কমিশন উচ্চ আদালত কর্তৃক সংবিধানের ধারা ৩২৪-এর অধিক ব্যাখ্যায় শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচন কমিশনের সহায়ক শক্তি হিসেবে সহযোগিতা করেন। ভারতে বহু উদাহরণ রয়েছে, যেখানে নির্বাচন কমিশন সরকারের নির্বাচনী আইন এবং কমিশনের বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণে আদালতের আশ্রয় নিয়েছে। মি. সরকারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মাঠপর্যায়ে নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর নির্বাচনকালীন কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কোনো প্রভাব থাকে কি না। উত্তরে মি. সরকার বললেন যে ভারতের নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি শক্ত অবস্থানে রয়েছে এবং তাদের দৃঢ়তা ও বিচার বিভাগের শক্ত অবস্থানের কারণে প্রভাব তেমন কাজ করে না। তবে দু-একটি দৃষ্টান্ত যে নেই, তেমনও নয়। ভারতের নির্বাচন কমিশনের ধারাবাহিকতা এই শক্তির মূলে রয়েছে।
আমার গবেষণায় ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে এবং মি. সরকারের আলোচনায় যে বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ আমার ধারণায় পোক্ত হয়েছে, তা হলো যে নির্বাচন কমিশনের দৃঢ়তা অবশ্যই একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্যতম উপাদান। আমাদের সংবিধানের ১১৯ ধারাতেও অন্তর্নিহিত যে ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া রয়েছে, তার প্রয়োগের জন্য নির্বাচন কমিশনের দৃঢ়তার প্রয়োজন রয়েছে। তথাপি এ ধরনের ক্ষমতাকে আইনের আওতায় আনার সুপারিশ এ টি এম শামসুল হুদা কমিশন রেখেছিল। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে ওই সব সুপারিশ আলোর মুখ দেখেনি। আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন এখনো দৃঢ় অবস্থানে দাঁড়াতে পারেনি। এর মুখ্য কারণ যে আমাদের সহায়ক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোও নির্বাচন কমিশনকে তেমনভাবে সহায়তা করেনি।
অতীতে প্রায় সব সরকারই নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনকালে তেমন দৃঢ় অবস্থানে দাঁড়াতে সাহায্য করেনি, যার বহু উদাহরণ রয়েছে। প্রয়াত এম এ সাঈদ সিইসি থাকাকালে ২০০৫ সালে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাহিদা দেওয়া সত্ত্বেও পায়নি। ওই নির্বাচনে ৮৩ জনের প্রাণহানি হয়েছিল। এমনকি তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে সংসদেও নেতিবাচক আলোচনা হয়েছিল, এমনকি পদচ্যুত করার দাবিও উঠেছিল। ওই সময়কার পত্রপত্রিকায় এসব বিষয় ফলাও করে প্রকাশিতও হয়েছিল। এর আগে মাগুরা-২, আরও পরে ঢাকা-১০ এবং টাঙ্গাইল–৮-এর উপনির্বাচনের খতিয়ান পর্যালোচনা করলে তৎকালীন সময়ের সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর সরকারের প্রভাব দৃশ্যমান হবে। আরও পরে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনও উদাহরণ হয়ে আছে। এসবের মধ্য দিয়েই সাধারণ জনগণ নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার নিরূপণ করে, যা হয়তো অনেকেই উপলব্ধি করেন না যে নির্বাচন কমিশনের সহায়কেরা যথেষ্ট সহযোগিতা করেন কি না। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রতীয়মান যে দলই সরকারে থাকে, নির্বাচন কমিশনকে শক্ত ভিতে দাঁড় করানোর কথা মনে রাখে না। অথচ ক্ষমতার বাইরে থাকলে নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থাহীনতার প্রশ্নে আন্দোলনেও পিছপা হয় না। এসব উল্লিখিত অতীত ঘাঁটলে প্রতীয়মান এবং তাত্ত্বিক ও বাস্তবে এ কথা প্রমাণিত যে আমাদের দেশের মতো দেশে শুধু নির্বাচন কমিশনই নয়, নির্বাচনকালীন সরকারের ভূমিকার ওপর নির্ভর করে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, যদিও এ ধরনের নির্বাচনের জন্য দৃঢ়চেতা নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা অপরিহার্য।
২.
দেশে আগামী নির্বাচনের সময় ক্রমেই এগিয়ে আসছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ক্রমেই রাজনীতির মাঠ গরম হয়ে উঠছে। প্রতিদিন বিভিন্ন নেতার মন্তব্য, তর্কবিতর্ক ও বাদানুবাদ মিডিয়াকে আচ্ছন্ন করা শুরু করেছে। মানুষের মনে চাপা শঙ্কা রয়েছে, কেমন হবে আগামী নির্বাচন? আমরা কি পুনরায় ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো অবস্থার পুনরাবৃত্তি দেখব? এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এ সময়ে সহজতর মনে হয় না। অপর দিকে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের হাতে তেমন সময় নেই। একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য প্রায় দুই বছর সময়ের প্রয়োজন। ক্রমেই সে সময় সংকুচিত হয়ে আসছে এরই মধ্যে বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তাপ। আগামী নির্বাচনকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করতে হলে এবং ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদসহ অন্যান্য নির্বাচনের অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিস্থিতি থেকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে বের হতে হলে নির্বাচন কমিশনকে অনেক ব্যতিক্রমধর্মী পদক্ষেপ নিতে হবে, যার অন্তর্নিহিত ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়টি ধারা ১১৯, ১২৪ ও ১২৬-এ রয়েছে।
আগামী নির্বাচন বর্তমান সংবিধানের ধারা ১২৩(৩) (এ) মতে অনুষ্ঠিত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে ওই সময়েরসরকারের আকার, কাঠামো বা রুলস অব বিজনেসে কোনো পরিবর্তন হবে কি না, সেসব নিয়ে আলোচনার অবকাশ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে, বিশেষ এসব বিষয় নিয়ে নির্বাচন কমিশনের শরিক বলে কথিত রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য নাগরিক সংগঠন ও সমাজসচেতন ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরিতে।
প্রয়োজন রয়েছে বর্তমান নির্বাচনী আইন আরপিও ১৯৭২ কিছু কিছু সংযোজন ও বিয়োজনের। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কমিশনের ভূমিকা বিগত যেকোনো নির্বাচন কমিশন থেকে আরও দৃঢ় হতে হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষ করে, ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের হাতে আইনগতভাবে প্রচুর ক্ষমতা রয়েছে। তবে যা রয়েছে, তা হলো প্রয়োগের মনমানসিকতা।
এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন