কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত দেশের ১১তম নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যেই একটি সংক্ষিপ্ত রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনার রূপরেখা গণমাধ্যমের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানিয়েছে। বর্তমান ইসিকে আমরা এ জন্য ধন্যবাদ জানাতে পারি। আগামী ১১তম সংসদ নির্বাচন ঘিরে তাঁদের কর্মকাণ্ডের কিছু ধারণা পাওয়া যায়। রূপরেখা প্রণয়ন করার রীতি শামসুল হুদা কমিশন করলেও তার ধারাবাহিকতা পরবর্তী সময়ে দেখা যায়নি। ওই সময় দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে, বিশেষ করে ভোটারদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের দূরত্ব রয়ে যায়, যার কারণে ভোটার এবং নির্বাচনের প্রধান শরিকদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়নি পূর্বতন কমিশন, যদিও এটাই অনাস্থার একমাত্র কারণ তা নয়। অবশ্য আমি মনে করি, জনগণের নৈকট্য, আস্থা ও স্বচ্ছ হতে হলে এ ধরনের কর্মপরিকল্পনা অত্যন্ত কার্যকর উপাত্ত বলে বিবেচিত।
বিগত শামসুল হুদা কমিশন পরবর্তী সময়ে নির্বাচন কমিশনের জন্য পঞ্চবার্ষিক কর্মপরিকল্পনা এবং দুই বছরের চলতি পরিকল্পনা প্রণয়নও করেছিল, যার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ মেয়াদকালের এবং আগামী কমিশনের জন্য দিকনির্দেশনামূলক কর্মপরিকল্পনা রাখা ছিল। কিন্তু তা পরবর্তী সময়ে হিমাগারেই থেকে যায়। এ ধরনের পরিকল্পনাও পরে আর তৈরি হয়নি।
নুরুল হুদা কমিশন সম্পূর্ণ কর্মপরিকল্পনার রূপরেখা দিলে ভালো করত। বর্তমানে যে ‘রোডম্যাপ’ দিয়েছে তা পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় যে শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখেই এই পরিকল্পনা। ২০১৮-১৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই চারটি সিটি করপোরেশন—রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেটের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে, তার উল্লেখ নেই নির্বাচন কমিশন ঘোষিত রূপরেখায়।
এই চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ দুটি কারণে—প্রথমত, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন, দ্বিতীয়ত, ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই এই সম্ভাব্য সর্বদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই চারটি সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়ররা বিরোধী বিএনপি দলের, যাঁদের মধ্যে প্রায় সবাই জেলে আসা–যাওয়ার মধ্যে রয়েছেন। উল্লিখিত বিশেষ দুটি কারণে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আইন ও বিধিমালায় বেশ পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে এই স্থানীয় নির্বাচনগুলো শুধু নিবন্ধিত দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সার্বিকভাবে অন্যান্য অনিবন্ধিত দলের জন্যও উন্মুক্ত রাখা উচিত বলে মনে করি। অন্যথায় নতুন দলগুলোর বিকাশ সহজেই হওয়ার নয়। বিকশিত না হলে কার্যকরী দলের সংখ্যা যেমন বাড়বে না, তেমনি লেজুড়বৃত্তিরও ইতি হবে না। তা ছাড়া, স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোও যখন দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সে কারণেই নির্বাচনী আইনেও বেশ পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে সিটি করপোরেশন পর্যন্ত নতুনভাবে আচরণবিধি তৈরি করার।
যা-ই হোক, নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত কর্মপরিকল্পনায় মোটা দাগে যে সাতটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে তার বিশদ বিবরণ ও সময়সীমা ধার্য করা নেই। তবে সাতটি বিষয়ের মধ্যে দুটি ছাড়া সব বিষয়েও নির্বাচন কমিশনের একক দায়িত্বের মধ্যে বর্তায়। রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ এবং অন্যদের আলোচনার ভিত্তিতে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গা সাধারণত আইনগুলোর সংস্কার ও নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার আরও উৎকর্ষ সাধনের মধ্যেই সাধারণত সীমিত রাখা ভালো। ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ আইন মোতাবেক চলমান প্রক্রিয়া। ২০১৭ ও ২০১৮ সালের সময়সীমার মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদের প্রয়োজন। গতবারের হালনাগাদকৃত ভোটার তালিকা নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছিল, যার কোনো সুরাহা হয়েছে বলে মনে হয় না। প্রতিবার ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার পর শুদ্ধতার জরিপ করানো উচিত। ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো নিরপেক্ষ ও দক্ষ সংগঠন দ্বারা ভোটার তালিকার জরিপ করানো হয়েছিল, এমনকি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণাকল্পে এ ধরনের জরিপ করে বিশুদ্ধতা নিরূপণ করেছিল। এ ধরনের প্রক্রিয়া জনগণের আস্থা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
কর্মপরিকল্পনায় উদ্ধৃত নির্বাচনপূর্ব কাজের মধ্যে জটিল কাজটি হলো সংসদীয় আসনের সীমানার পুনর্বিন্যাসকরণ। এ কাজটি নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্বের অন্যতম। এ কাজটি এতই জটিল এবং রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর যে নির্বাচন কমিশন তার অবস্থানে দৃঢ় না থাকলে সঠিকভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। কারণ, সংসদীয় আসনের সীমানা প্রার্থীরা, বিশেষ করে সরকারি দলের প্রার্থীরা যেভাবে তৈরি করেন, তা তছনছ হতে দিতে চান না। অতীতে যোগসাজশের মাধ্যমে অনেক সংসদীয় আসনের সীমানা নিজের সুবিধামতো পরিবর্তন করার অভিযোগও রয়েছে। ৩০০ আসনের মধ্যে প্রায় ১৬ কোটি মানুষের সমান বণ্টন যেমন সম্ভব নয়, তবে অন্তত জেলার ভেতরের আসনগুলোতে সমতা আনারও প্রয়োজন রয়েছে। কোনো প্রার্থী এমনকি দলও তাদের সুবিধামতো সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাস অথবা তাদের সুবিধাজনক অবস্থায় থাকার কারণে নানা ধরনের বাধাবিপত্তির সৃষ্টিও করে থাকে। এ ধরনের বিরোধিতা নির্বাচন কমিশনের কাজে আরও জটিলতার সৃষ্টি করে। এসব জটিলতার কারণে এবং নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্বকে আইনের মাধ্যমে নিশ্চয়তা ও বৈধতা দেওয়ার কথা সংবিধানের ১২৫(এ)-তে স্পষ্টকরণ করা হয়েছে। সংবিধানের উল্লেখিত ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে যে সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক গৃহীত কোনো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হবে না।
সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড গঠনের অন্যতম উপাত্ত। কারণ, অন্তত একই অঞ্চলের আসনের মধ্যে ভোটার সংখ্যার বড় ধরনের তারতম্য প্রার্থীদের জন্য বৈষম্যমূলক হয়। সে কারণেই যত দূর সম্ভব একই অঞ্চলের আসনগুলোর মধ্যে ন্যূনতম সমতা আনা প্রয়োজন। এ কাজটি করার জন্য যে আইনটি বিদ্যমান তার আওতায় সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাসের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ‘দ্য ডিলিমিটেশন অব কনস্টিটুয়েন্সি অরডিন্যান্স ১৯৭৬’-এর ধারা ৮-এর উপধারা (এ)-তে বলা হয়েছে যে প্রতি আদমশুমারির পর পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের জন্য সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। উল্লেখ্য, এ প্রক্রিয়ায় চলমান সংসদের আসনগুলোর বিন্যাসে কোনো প্রভাব পড়বে না। একই ধারার (বি)-তে উল্লেখিত যে আদমশুমারি ছাড়াও প্রতিটি নির্বাচনের আগে সীমানা পুনর্নির্ধারণ অবশ্যই করতে হবে, অন্যথায় না করার কারণ লিপিবদ্ধ রাখতে হবে। কাজেই এ কাজটি করার নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
সীমানা পুনর্নির্ধারণের ইতিহাস পর্যবেক্ষণে থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে ১৯৮৪ সালের পর ২০০৮ সালে, অর্থাৎ প্রায় ২৪ বছর পর পূর্ণ পুনর্নির্ধারণ করতে গিয়ে প্রায় ১৩৩টি আসনে ব্যাপক রদবদল করতে হয়েছিল, যার কারণে বেশ কয়েকটি জেলায় আসনসংখ্যা কমে বড় শহরগুলোতে আসনসংখ্যা বেড়েছিল। এর কারণ, ২৪ বছরের গ্যাপ এবং ওই সময়ের মধ্য দুটি আদমশুমারি হলেও রাজনৈতিক কারণে তৎকালীন ইসিসমূহ এ কাজটি হাতে নেয়নি। যার ফলে ঢাকা জেলায় একটি আসনে ২ লাখের নিচে এবং শহরের একটি আসনে ১১ লাখ ভোটার সংখ্যা ছিল। এই জেলার মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন শহর হওয়ায় এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে আসনসংখ্যা প্রায় দেড়গুণ বাড়াতে হয়েছিল। শুধু ঢাকা শহরেই ৮টি আসন বেড়ে ১৫ আসন হয়েছিল, যার কারণ ছিল জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে আসন পুনর্বিন্যাসের বাধ্যবাধকতার।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে ক্রমেই জনসংখ্যা বাড়ছে এবং ভবিষ্যতেও বাড়বে। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ মাইগ্রেশনের ফলে প্রান্তিক অঞ্চলে জনসংখ্যাও কমার বিষয়টি প্রতিফলিত হচ্ছে আদমশুমারিতে। ২০০৮ সালে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে গিয়ে শামসুল হুদা কমিশনের সামনে ঢাকা মেট্রোপলিটন শহর নিয়েই বড় সমস্যা হয়েছিল। ভবিষ্যতেও এমনটিই হবে। কারণ, আদমশুমারির দিনে যে যেখানে থাকেন, তাঁকে সেখানের লোকসংখ্যার মধ্যে গণনা করা হয়।
যা-ই হোক, ২০০৮ সালে ঢাকা বিভাগ তথা ঢাকা শহরের জনসংখ্যা অনুপাতে আসন বাড়াতে গিয়ে প্রান্তিক অঞ্চলের আসন কমাতে হয়েছে, যা কাম্য ছিল না কিন্তু উপায়ও ছিল না। ঢাকা শহরকে বর্ধিত প্রতিনিধিত্ব দিতে গিয়ে বেশ কয়েকটি জেলায় প্রতিনিধিত্ব হারাতে হয়েছে। জনসংখ্যার যে ফর্মুলা করা হয়েছিল, তাতে মেহেরপুরে একটি আসন থাকার কথা ছিল, তথাপি ২০০৮ সালের নীতির আওতায় জেলার জন্য ন্যূনতম দুটি আসনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় মেহেরপুরে দুটি আসন রাখা হয়েছিল।
আগেই বলেছি, সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করার অন্যতম উপাত্ত। কাজেই এ কাজটি সংবিধান ও আইনের আওতায় করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যে জটিলতার বিষয় ওপরে আলোচনা করেছি, বিশেষ করে ঢাকা শহরের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা আর আনুপাতিক হারের আসন বণ্টনের, সে জটিলতা নিরসনে শামসুল হুদা কমিশন ২০১১ সালে বিভিন্ন আইনের কিছু পরিবর্তনের এবং পরিবর্ধনের যে সুপারিশ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে প্রস্তুত করেছিল, তার মধ্যে নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ আইন, ২০১১-এর একটি খসড়া এবং বিধিমালা ২০১১ খসড়া তৈরি করা হয়েছিল। ওই খসড়া বিধিমালার ধারা ৩(গ)-তে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে আলাদা ইউনিট হিসেবে গণ্য করে ১০টি স্থায়ী আসন বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। উপধারা ৩(ক)-তে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩টি এবং ঢাকার ১০টি মোট ১৩টি আসন বাদ দিয়ে ২৮৭ আসনের মধ্য পুনর্বিন্যাসের সুপারিশ করা হয়েছিল। এসব সুপারিশ, নির্বাচনী আইনের সংস্কার, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপের প্রতিবেদন ২০১২ সালে মুদ্রিত প্রতিবেদনে সংযোজন করা হয়েছিল। ওই সব সুপারিশ বিগত পাঁচ বছরের ওপর হিমাগারেই রয়েছে।
যাই হোক আমি মনে করি রোডম্যাপ অনুযায়ী আইনের সংস্কার নিয়ে আলোচনাকালে নির্বাচন কমিশনের উচিত সবার আগে সীমানা পুনর্নির্ধারণের বর্তমান আইনের পরিপ্রেক্ষিতে জটিলতা এবং করণীয় নির্ধারণ করা। কারণ, আইনের পরিবর্তন না করে এ জটিল কাজে হাত দিলে কাঙ্ক্ষিত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি শুরুতেই হোঁচট খাবে। আশা করব, নির্বাচন কমিশন আলোচনার পথ খোলার আগে পূর্বতন সুপারিশগুলো খতিয়ে দেখবে। কমিশন ঘোষিত রোডম্যাপের কার্যকারিতা ও সার্থকতা কামনা করি।
এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন