|
এম সাখাওয়াত হোসেন
hhintlbd@yahoo.com |
|
নির্বাচন কমিশনের সংলাপ ও আগামী নির্বাচন
25 October 2017, Wednesday
গত ফেব্রুয়ারি ২০১৭ নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন ১৬ জুলাই, ২০১৭ আগামী ১১তম সংসদ নির্বাচনের আগে সাতটি প্রধান বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে একটি কর্মপরিকল্পনা লিখিত আকারে প্রকাশ করে। এই কর্মপরিকল্পনা ‘রোডম্যাপ’ বলে পরিচিত হলেও এটি ইসির কয়েকটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে তাদের পরিকল্পনার বিষয়গুলো জনসমক্ষে তুলে ধরেছে, যা ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ বলে মনে করা হয়। ২০০৮ সালের পরে এ ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে বর্তমান ইসি এ পর্যন্ত যে পদক্ষেপ নিয়েছে তেমন কিছুই বিগত রকীব কমিশন করতে পারেনি। যার কারণে ২০০৮ এর হুদা কমিশনের একটি সফল উদ্যোগের ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি এবং ওই কমিশন জনগণের কাছে স্বচ্ছ হওয়ার প্রচেষ্টাই করেনি। এ ধারাবাহিকতার প্রয়োজন ছিল, যার ফলে তাদের কর্মকাণ্ড জনসমক্ষে তেমন প্রকাশ পায়নি। এ ক্ষেত্রে বর্তমান কমিশনের উদ্যোগে আরো জাতীয় নির্বাচনের আগে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং তার আইনি সংস্কারের বিষয়টি স্থান পায়নি। এই নির্বাচনগুলো দলীয়ভিত্তিক হওয়ার কারণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
যা হোক, কর্মপরিকল্পনার বিষয়ের ওপর সম্যক ধারণা অর্জনের জন্য ইসি বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে সংলাপের পথটি বেছে নিয়েছে, যা অত্যন্ত ইতিবাচক বলে মনে করা হয়। ইসি যাদের সাথে সংলাপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেসব সংগঠন বা ব্যক্তির সমষ্টিকে গণতান্ত্রিক বিশ্বে নির্বাচন পরিচালনা সংস্থার (ইএমবি) সহায়ক অংশীদার বলে স্বীকৃত। এরই ধারাবাহিকতায় নুরুল হুদার নেতৃত্বে ১১তম ইসি ৩১ জুলাই ২০১৭ সুশীল সমাজের সাথে আলোচনা দিয়ে পরিকল্পিত ধারাবাহিক সংলাপের সূচনা করেছে। যদিও সংলাপের ধরনটি বিস্তারিত নয়। তবে ইতিবাচক হয়েছে বলে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। এ অনুষ্ঠানটি ছিল ইসির প্রথম জনসমক্ষে নিজেদের তুলে ধরার প্রয়াস। এ সংলাপের মাধ্যমে ইসি যেসব সুপারিশ পেয়েছে তা খুব বিস্তারিত না হলেও বিক্ষিপ্তভাবে অনেক বিষয়ে আমন্ত্রিতদের কাছ থেকে সম্যক ধারণা পেয়েছে। এ প্রক্রিয়াটি আরো বিষয়ভিত্তিক বিস্তারিত হলে ভালো হতো। এখানে মোটা দাগে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে, যার প্রতিফলন ঘটাতে ইসিকে সুস্পষ্ট প্রস্তাব তৈরি করতে হবে।
ইতোমধ্যে ইসি কতগুলো নিবন্ধিত দলের সাথে আলোচনা করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বর্তমান সংসদে বিরোধী দল বলে পরিচিত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি এবং দেশের অন্যতম বৃহত্তম দল, বিরোধী দল বলেই পরিচিত বিএনপির সাথে। এ পর্যন্ত যেসব দল আলোচনা করেছে সেগুলোতেও প্রায় মোটা দাগে আলোচনা হলেও বেশির ভাগ দলই নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ সরকার, সেনাবাহিনী নিয়োগ এবং অর্থ ও পেশিশক্তি যাতে ব্যবহার না হয় সেগুলোর ওপর বক্তব্য দিয়েছে।
বিএনপি বেশ কিছু বক্তব্য লিখিত আকারে তুলে ধরেছে, যেগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। রাজনৈতিক, আইনি এবং কিছু অস্পষ্ট ধারণা। এখানে সেনাবাহিনীর নিয়োগের বিষয়ে বেশ জোর দেয়া হয়েছে। তাদের দাবি ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের দেয়া। একই সাথে আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞার মধ্যে অন্তর্ভুক্তকরণ। অবশ্য পরের দাবির ওপর অতীতে শামসুল হুদা কমিশনও সুপারিশ করেছিল। তবে বর্তমান আরপিও ৮৯(এ) ধারা এবং সিআরপিসি ১৮৯৮ (ভি অব ১৮৯৮) আওতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর কোনো সদস্যকে ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারিক ক্ষমতা দেয়া যায় না।
যা হোক, এর পরেই বর্তমান শাসক দল আওয়ামী লীগের সাথে ইসির আলোচনায় হয়তো আরো কিছু প্রস্তাব আসতে পারে। ইসি তাদের আলোচনার ফলাফল বই আকারে প্রকাশ করবে বলে জানিয়েছে। কাজেই এর মাধ্যমে এ আলোচনার বিষয়গুলো জনসমক্ষে এলে আরো বিস্তারিত বিশ্লেষণ হওয়ার আশা করা যায়।
তাছাড়া বাকি সব প্রস্তাব সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, তার বেশির ভাগকে আইনি কাঠামোতে রূপান্তরিত করে পরবর্তী সম্মেলনগুলো আরো সুস্পষ্ট করতে হবে। এসব মোটা দাগের প্রস্তাব বেশির ভাগই ইসির আমলে নেবার মতো বিষয় রয়েছে এবং প্রস্তাবগুলো বহুল আলোচিত। বেশির ভাগই ২০১১ সালে তৎকালীন হুদা কমিশন এমনই সংলাপের মাধ্যমে তাদের মেয়াদ শেষের প্রাক্কালে সুপারিশ আকারে সংশ্লিষ্ট আইনি কাঠামোয় তৈরি করা হয়েছিল। যেসব মুখ্য বলে সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, ওই প্রস্তাব সবই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
যদিও সুশীলসমাজের সাথে প্রথম সংলাপে আমন্ত্রিত অনেক প্রাজ্ঞ ব্যক্তির মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন কারণে উপস্থিত হতে পারেননি, তবে তাতে এ আয়োজনের গুরুত্ব খর্ব হয়েছে বলে মনে করার কারণ নেই। প্রয়োজনে ইসি সুশীলসমাজের সাথে সীমিত আকারে দ্বিতীয় দফা আলোচনার আয়োজন করতে পারে।
ইতোপূর্বের আলোচনাগুলোতে কয়েকটি বিষয় মুখ্য বিবেচিত বলে তথ্যে প্রকাশ। তার মধ্যে বেশ জোরালো সুপারিশ এসেছে- জাতীয় সংসদ ও প্রয়োজনে অন্যান্য নির্বাচনে সেনা মোতায়েন এবং এর কার্যকারিতা; ভোটারদের গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণে না ভোটের পুনঃপ্রবর্তন; নির্বাচনকালীন নির্বাচনী ব্যয়ের পর্যবেক্ষণ এবং পরবর্তী পর্যায়ে নিরীক্ষণ। নির্বাচনে ইসির নিজস্ব জনবলের অধিক ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারই প্রাধান্য পেয়েছে। এর সাথে সঙ্গতভাবেই এসেছে ইসির নৈতিক ও আইনি ক্ষমতা; বিশেষ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির ক্ষেত্রে এবং পেশিশক্তি নিয়োগের বিষয়। এমনকি সংসদীয় সীমানা পুনঃনির্ধারণের বিষয়টিও তুলেছেন অনেকে। তবে বিষয়টি কারিগরি বিধায় তেমনভাবে উঠেছে বলে মনে হয় না।
এ পর্যন্ত উত্থাপিত দু-একটি বিষয়ের ওপর যৎসামান্য আলোচনার প্রয়োজন বলে মনে করছি। এ আলোচনায় আমার মতামত অভিজ্ঞতা এবং গবেষণার মিশ্রণে উপস্থাপিত করছি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিষয়টি আমাদের দেশের রাজনীতিতে সাংস্কৃতিক বিভাজনের মধ্যে পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হয়। বিশেষ করে বাহিনীর কার্যকর নিয়োগের ক্ষেত্রে। সেনা মোতায়েন বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো নতুন বিষয় নয়। প্রথম থেকে এ পর্যন্ত জাতীয় এবং অনেক স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও সেনা মোতায়েন হয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধারাবাহিকভাবে মোতায়েন করা হয়েছে। ২০০১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক বাহিনীতে আরপিওতে আইনশৃঙ্খল রক্ষাবাহিনীর সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল যা সম্ভবত ২০১০ সাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত অবস্থায় ছিল। ২০০৮ সালে অন্যান্য নির্বাচনের সংজ্ঞায়ও সংযোজিত হয়েছিল যাতে ওইসব নির্বাচনের আইনের প্রয়োগে পুলিশ তথা অন্যান্য বাহিনীর মতো স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। ২০১০ সালে শেষবার পৌরসভা নির্বাচনে এ সংজ্ঞা অনুযায়ী সেনাবাহিনী নির্বাচনে নিয়োজিত হয়েছিল। অবশ্য অন্যান্য বিষয়ের মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার আওতায় রিটার্নিং অফিসারের নিয়ন্ত্রণাধীন নিয়োজিত ও কর্ম পরিচালনা করার সুস্পষ্ট বিধানের অধীন রাখা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়োগ ইসির নিয়োগ নীতির আওতায় রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বের মধ্যে বর্তায়।
প্রশ্ন দেখা দেয় সেনা নিয়োগের প্রয়োজনীয়তার বিষয় বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে। উল্লেখ্য, প্রায় দশ কোটি ভোটারকে একদিনে ভোট দিতে হয়। প্রায় ৪০ হাজার কেন্দ্র এবং কয়েক লাখ বুথে এ ভোট গ্রহণ হয়। এক দিনের এই নির্বাচনে বেশ কয়েক স্তরের নিরাপত্তার প্রয়োজন; তার জন্য যে সংখ্যায় নিরাপত্তারক্ষী প্রয়োজন তা অপ্রতুলের কারণে সেনাবাহিনীকে শক্তি বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন হয়। আমাদের দেশের রাজনীতিতে যে পেশিশক্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। প্রতিদিনই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পেশিশক্তির বিবরণ প্রকাশিত হচ্ছে। কাজেই নির্বাচন কমিশনের প্রথম চিন্তাতেই নিরাপত্তার বিষয়টিই প্রাধান্য পায়। মাত্র বছর কয়েক আগে ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনে প্রচলিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতিতেও প্রায় ১১০ জনের প্রাণহানি এবং কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছিল। নির্বাচন হয়ে উঠেছিল ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন। কাজেই নিরাপত্তার বিষয়টিকে কোনোভাবেই ছোট করা যায় না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এটাই বাস্তবতা, যে কারণে অধিকতর বাহিনীর প্রয়োজন।
সেনাবাহিনী কার্যকরভাবে নিয়োগের সপক্ষের আরেকটি বড় যুক্তি জনসাধারণের আস্থা। যেহেতু সামরিক বাহিনী জনচক্ষুর অন্তরালে থাকলে দুর্যোগে সর্বাগ্রে মানুষের পাশে একটি নিরপেক্ষ ফোর্স হিসাবে দাঁড়াতে দেখা যায় এবং অন্যান্য বাহিনী, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, অধিকতর মানুষের আস্থার ভাটায় রয়েছে সে কারণে সামরিক বাহিনী নিরপেক্ষ মানুষের আস্থার জায়গায় থাকার কারণে তাদের উপস্থিতি মানসিকভাবে নিরাপত্তার সঞ্চার করে। নিরাপত্তার পরিবেশ ব্যাহত হলে নারী ভোটারদের উপস্থিতিতে ভাটা পড়ে। আমাদের দেশে বর্তমানে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ ভোটার নারী। কাজেই আমি মনে করি সামরিক বাহিনীর কার্যকর উপস্থিতির প্রয়োজন রাজনৈতিক কারণে নয়, নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনের কারণেই কার্যকরভাবে নিয়োগ করা প্রয়োজন।
এ সব আলোচনার লক্ষ্য হলো আগামী নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ এবং সবার সমান সুযোগ করে দেয়া, যা নির্বাচন কমিশনের প্রধান দায়িত্ব। তবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পূর্বশর্তই হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকারের চরিত্র ও আন্তরিকতা। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রত্যেক সরকারপদ্ধতিতে ১১টি সংসদীয় নির্বাচন হয়েছে, যার মধ্যে চারটি নির্বাচন হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। যার গ্রহণযোগ্যতা ছিল দেশ ও বিদেশে। যদিও নেতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে পরাজিত দল ফলাফল সহজে মেনে নিতে চায়নি। তবে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যানও করেনি। বাদবাকি নির্বাচনগুলো সামরিক সরকার এবং রাজনৈতিক দলীয় সরকারের অধীন হয়েছে, যার সবগুলোই ছিল বিতর্কিত এবং এই বিতর্কের আবর্ত থেকে নির্বাচন কমিশনও রেহাই পায়নি। ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে নতুন করে বেশি কিছু বলারও নেই।
এ ধরনের নির্বাচনে বিশেষ করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পরের নির্বাচনে গণতন্ত্র যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার চেয়ে বেশি হয়েছে প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের। আগামী নির্বাচনও হবে দলীয় সরকার ও সংসদ বহাল রেখে, যা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের জন্য অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। কিভাবে নির্বাচনে এই বাস্তবতার প্রভাব কমানো যায় সে চিন্তাই নির্বাচন কমিশনের সবার আগে করতে হবে। কাজেই ৮৯(এ)-এর ধারায় ইসি তাদের জ্যেষ্ঠ কিছু কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিতে পারে। অবশ্য এ ক্ষমতা আরপিওর নির্ধারিত ধারাগুলোর জন্যই প্রযোজ্য। এ ধরনের ক্ষমতা প্রিসাইডিং অফিসারদের দেয়া হলে আরো কার্যকর হবে কি না তা ভেবে দেখা যেতে পারে।
আমার বিবেচনায় আরেকটি বিষয় অনেক দল ও সুশীলসমাজের ৯০ শতাংশের সুপারিশ সামনে এসেছে তা হলো- না ভোট- যা ২০০৮ সালে প্রথম এ দেশে প্রবর্তিত হয়েছিল। সে বিধানটি ২০০৯ সালের আইনে বাতিল করা হয়েছিল। এই বিধানের বিপক্ষে প্রায় সব রাজনৈতিক দল এবং কিছুসংখ্যক মানুষ। কিন্তু তাদের যুক্তি খুব জোরালো নয়। এ বিধান যদি গণতন্ত্রের পরিপন্থী বলে বিবেচিত হতো তাহলে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের সর্বোচ্চ আদালত এ বিধানকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত করতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিত না। সে দেশেও রাজনীতিবিদেরা বিপক্ষে ছিল। গত নির্বাচন হতেই ‘নোটা’ (NOTA : Non of the Above) হিসেবে ব্যালটে যুক্ত হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে ‘না ভোট’ একজন ভোটারের গণতান্ত্রিক অধিকার, যা বাড়িতে বসে থেকে বা ভোটকেন্দ্রে অনুপস্থিত থেকে অথবা ব্যালট বিকৃত করে অধিকার রক্ষা গ্রহণযোগ্য নয়। কাজেই ভোটারদের এই মৌলিক অধিকার রক্ষার্থে ওই রায় দেয়া হয়েছিল। আমাদের দেশে ‘না ভোটের’ চর্চা থাকলে ২০১৪ সালে বিনা ভোটে ১৫৩ জন নির্বাচিত হতেন না এবং এই মনকষ্ট বহন করতে হতো না।
এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় এ কয়েকটি বিষয়ে আমার মতামত পাঠকদের সামনে তুলে ধরলাম। এর মানে এই নয় বাকি বিষয়গুলো কম গুরুত্বপূর্ণ। এখন দেখার বিষয় হবে নির্বাচন কমিশন এসব বিষয় নিয়ে তাদের মতামত এবং কতখানি দৃঢ়তা দেখাতে পারে। যদিও আইন প্রণয়ন সংসদ ও সরকারের হাতে তবু প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে নির্বাচন কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে। তবেই তারা এসব উদ্যোগের মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে। স্মরণযোগ্য, এসব যৌক্তিক আইনি পরিবর্তন, সংযোজন এবং বিয়োজনের সুপারিশ কমিশনের তৃণমূলের অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরা হয়েছে। কাজেই এসব সুপারিশ সুশীলসমাজেরই নয় প্রায়োগিক ক্ষেত্র থেকেও উঠে এসেছে। এখন দেখার বিষয় নির্বাচন কমিশন কিভাবে অগ্রসর হবে। আশা করি তাদের এ উদ্যোগ শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না প্রায়োগিক ক্ষেত্রেও কার্যকরের পদক্ষেপ নেবে।
এ প্রসঙ্গের ইতি টানব নির্বাচন কমিশনের সামনে আগামী নির্বাচনে যেসব বিষয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়াবে তার একটির উল্লেখ করেছি। চ্যালেঞ্জের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলো মোটা দাগে তুলে ধরছি।
নির্বাচন কমিশনকে ধর্তব্যের মধ্যে নিতে হবে দেশে বিরাজমান সুবিধাভোগী রাজনীতির সংস্কৃতির বিষয়টি, যার গভীর প্রভাব পড়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের ওপর। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন কাজে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ যেমন গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে তেমনি নজরদারির বিভিন্ন পথ খোলা রাখতে হবে। নির্বাচন কমিশনের অন্যতম দুর্বল দিক হলো নিরাপত্তা পরিকল্পনা, যার স্থায়ী কোনো ম্যানুয়াল নেই। নেই অভিযোগ লিপিবদ্ধ ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থাপনার দিকনির্দেশনা বা ম্যানুয়েল, নিদেনপক্ষে সুচিন্তিত এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নির্দেশনা।
এগুলোর ওপর বিবেচনা ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার পরিকল্পনা করার এখনই সময়। এসব নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রয়োজনে নির্বাচনের বেশ সময় হাতে রেখে আরেক দফা আলোচনা হতে পারে।
যা হোক, এ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের মনোভাব একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে, আন্তরিকতারও অভাব নেই বলে মনে হয়। নির্বাচন কমিশন একাই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পারে না, যদি না সহায়ক শক্তি ও সরকার পূর্ণ সহযোগিতা না করে।
নির্বাচন কমিশনের কাজ খুব সহজ হবে এমন মনে করা যায় না। যা দৃশ্যমান হতে হবে তা হবে নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টা।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার : কলাম লেখক নির্বাচনী বিষয়ে পিএইচডি গবেষক
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন