|
এম সাখাওয়াত হোসেন
hhintlbd@yahoo.com |
|
নির্বাচন কমিশনের পারদর্শিতা প্রশংসনীয়
15 December 2017, Friday
নেপালে দুটি নির্বাচনের, ২০০৮ ও ২০১৩, মধ্য দিয়ে গঠিত দুটি গণপরিষদ সাত বছর লাগিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ২০১৫ সালে সংবিধান কার্যকর করেছিল। প্রথম পরিষদ তার নির্ধারিত পাঁচ বছরে নানা কারণে সংবিধানের কাজ শেষ করতে না পারায় দ্বিতীয় দফা নির্বাচিত গণপরিষদ এই দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করে। নেপালের বহুজাতিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সংবিধান তৈরি করার কাজটি সহজ ছিল না। নেপাল ২০০৬ সাল পর্যন্ত ২০ বছর এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মধ্যে ছিল, যার মূল প্রতিপক্ষ ছিল কমিউনিস্ট পার্টি, মাওবাদী। মাওবাদীদের প্রধান দাবি ছিল, নেপালের ২৪০ বছরের রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করে সব জাতিগোষ্ঠীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় সংসদীয় গণতন্ত্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা। ২০ বছরের সশস্ত্র সংগ্রামের ফসল হিসেবে দেখা হয় ২০১৫ সালের সংবিধান।
২০১৫ সালের সংবিধানের আওতায় নেপাল এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র থেকে ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। নেপাল বর্তমানে সাতটি প্রদেশে বিভক্ত। সংবিধানের আওতায় কেন্দ্রে রয়েছে দুটি কক্ষ। উচ্চকক্ষ ও জাতীয় বা প্রতিনিধি পরিষদ। সর্বশেষ গণপরিষদের মেয়াদ শেষে প্রথম সংসদীয় গণতান্ত্রিক নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালে, তবে সে নির্বাচন কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাতীয় সংসদের সদস্যসংখ্যা ২৭৫ এবং উচ্চকক্ষের সদস্যসংখ্যা ৫৯। বিভিন্ন প্রদেশের জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন নির্ধারিত।
সংবিধানের আওতায় প্রথম জাতীয় সংসদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন যুগপৎ দুই ধাপে ২০১৭ সালের নভেম্বর ২৬ এবং ডিসেম্বর ৭-এ অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম পর্বের নির্বাচনের একাংশের ফলাফল প্রকাশিত হলেও দ্বিতীয় পর্ব এবং অন্য প্রক্রিয়ার ফলাফল এখনো (এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত) ঘোষণা করা হয়নি।
এবারের এই প্রথম সাংবিধানিক ধারামতে, নির্বাচনে অন্যান্য দলসহ প্রধান তিনটি জোট গঠিত হয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণ করে। তিনটি জোটের মধ্যে রয়েছে কে পি শর্মা ওলির নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট) এবং সাবেক মাওবাদী গেরিলা নেতা পুষ্প কমল দহল ওরফে প্রচন্ডের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি সেন্ট্রাল (মাওবাদী)। জোটটি বামপন্থী হিসেবে পরিচিত। অপর দুটির একটি শের বাহাদুর দিউবার নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসসহ ডানপন্থী অন্যান্য দল। তৃতীয় জোটটি এককালের মাওবাদী নেতা বাবুরাম ভট্টরয়ের নেতৃত্বে নতুন দল ‘নমাশক্তি পার্টি’ এবং অন্যান্য গোর্খা গণতান্ত্রিক দল নিয়ে গঠিত।
প্রথম পর্বের প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী বামপন্থী জোট নেপালের পরবর্তী সরকার গঠনের অবস্থায় রয়েছে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্টদের আত্মপ্রকাশ অনেক বিশেষজ্ঞকেই বিস্মিত করেছে। ওই দলের পরেই রয়েছে জোটের অন্য শরিক মাওবাদীদের অবস্থান এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নেপাল কংগ্রেসের জোটের একধরনের ভরাডুবি হয়েছে।
নেপালের গত দুটি গণপরিষদ নির্বাচন ২০১৭ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের এবং প্রথম স্থানীয় সরকার নির্বাচন ২০১৭ যথেষ্ট শান্তিপূর্ণ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পর্যবেক্ষকদের মত। এমনকি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধিরাও যথেষ্ট প্রশংসা করেছেন। আমি নিজে ২০০৮ সালের প্রথম গণপরিষদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। নির্বাচন কমিশন নেপালের দক্ষতায় অভিভূত হয়েছিলাম। যদিও ২০১৩ সালের নির্বাচন নিয়ে মাওবাদীরা যথেষ্ট আপত্তি তুলেছিল, তবু তারা নেপালের গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নে সহযোগিতা মাথায় রেখে মেনে নিয়েছিল। ২০১৬ সালে প্রচন্ড প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি আমাকে এমন কথা বলেছিলেন। মাওবাদীরা তৃতীয় স্থানে থাকলেও টেকনিক্যাল কারণে ২০১৫ সালে তারা সরকার গঠন করেছিল।
নেপালের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা উপমহাদেশের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে জটিল। নেপালের প্রথম গণপরিষদ থেকেই মিশ্র নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় (মিক্সড সিস্টেম) অনুষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এ প্রক্রিয়া সংবিধানের আওতায় আনা হয়েছে। মিশ্র প্রক্রিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট (এফপিটিপি) এবং পার্টি লিস্ট আনুপাতিক (পার্টি লিস্ট পিআর) প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ২০১৭ সালের নির্বাচনে সংবিধানের ধারা ৮৪ বলে ১৬৫ সংসদীয় আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠ তত্ত্বে (এফপিটিপি) এবং ১১০টি আসনে পার্টি লিস্ট আনুপাতিক হারে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুরূপভাবে ৭টি প্রদেশের মোট ৫৫০টি আসনে ৩৩০টি সংখ্যাগরিষ্ঠ (এফপিটিপি) তত্ত্বে এবং ২২০টি আসনে পার্টি লিস্ট পিআর প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হয়েছে।
নেপালের রাজনীতিবিদেরা অতীত দুটি গণপরিষদ নির্বাচনে বড়সংখ্যক ছোট ছোট দলের সংখ্যানুপাতিক হারের কারণে উপস্থিতি এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কথা মাথায় রেখে ন্যূনতম ভোটের শতকরা নির্ণয় করেছেন। আনুপাতিক হারের নির্বাচনে ন্যূনতম প্রদত্ত ভোটের ৩ শতাংশ না পেলে যে দল যেমন কোনো আসনের দাবি করতে পারবে না, তেমনি ওই দল বা দলগুলো জাতীয় দল হিসেবে নিবন্ধিত হবে না। অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ তত্ত্বে কোনো দল ন্যূনতম একটি আসন অর্জন না করলে জাতীয় দল হিসেবে বিবেচিত হবে না। নির্বাচন বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই ন্যূনতম শতাংশের সুবাদে বহু ছোট দল যেমন জাতীয় পর্যায় থেকে ঝরে যাবে, তেমনি সংসদে অস্থিতিশীলতাও কমবে। উল্লেখযোগ্য যে, এই অস্থিরতার কারণে নেপালে ২০০৮ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ১১ বার সরকারি দল বদল হয়েছিল। তবে নেপালের ক্ষুদ্র দলগুলো মনে করে, এত উচ্চ হার রাখার কারণে তাদের বিকশিত হওয়ার সুযোগ কমবে এবং এসবই বড় দলগুলোর স্বার্থেই নির্ণয় করা হয়েছে। ন্যূনতম ভোটপ্রাপ্তির শতকরা হার নির্ধারণ করার কারণেই ২০১৭ সালের নির্বাচনে আনুপাতিক হার প্রক্রিয়ায় মাত্র ৪৫টি দল নিবন্ধিত হয়েছিল। আনুপাতিক হারে প্রতিটি দলের জন্য ‘ওয়াটার মার্ক’ পদ্ধতিও নির্ধারণ করা হয়েছে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে প্রতিটি দলের জন্য ভোটপ্রাপ্তির প্রেক্ষাপটে সর্বোচ্চ আসনপ্রাপ্তি নির্ধারণ করা হয়।
নেপালের পার্টি লিস্ট আনুপাতিক তত্ত্বের প্রক্রিয়ার নির্বাচন ক্লোজড পার্টি লিস্ট প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে ভোটাররা পছন্দের প্রার্থীকে নয়, বরং পার্টির মার্কাকে ভোট দিয়ে থাকে। পরবর্তী সময়ে পার্টি পূর্বনির্ধারিত লিস্ট থেকে ক্রমানুসারে প্রার্থী নির্ধারণ করে থাকে। এর কারণ যে প্রার্থীর পক্ষে সমগ্র দেশে প্রচার করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি যেহেতু নির্ধারিত সংসদীয় এলাকা নেই, সেহেতু প্রার্থী ভোটারদেরও পরিচিত হন না।
এ পদ্ধতির অন্যতম নেতিবাচক দিক হলো যে প্রার্থী নির্বাচন পার্টির শীর্ষ নেতাদের হাতে থাকার কারণে চূড়ান্ত সদস্য নির্বাচনের তালিকায় তাঁদেরই ইচ্ছার বা পছন্দের প্রতিফলন হতে পারে। এ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয়। এ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করতে হলে তৃণমূল পর্যায় থেকে প্রাথমিক নির্বাচনপদ্ধতি সহায়ক হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
নেপালের সংবিধানের ৮৪ ধারামতে, সংখ্যাগরিষ্ঠ পদ্ধতির জন্য দেশটিকে ১৬৫টি সংসদীয় আসনে বিন্যাস (ডেলিনিলেশন) করা হয়েছে। অন্যদিকে পার্টি লিস্ট আনুপাতিক হারের জন্য সমগ্র নেপাল একক আসন হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ সংখ্যানুপাতিক তত্ত্বে নির্বাচিত প্রার্থীদের কোনো নির্ধারিত সংসদীয় আসন থাকে না।
নেপালের সংবিধান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং প্রতিবন্ধীদের সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেছে। এ ধরনের পিছিয়ে পড়া ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংবিধানে নির্ধারণ করা হয়েছে। তদুপরি জাতীয়, প্রাদেশিক পরিষদসহ উচ্চকক্ষেও এক-তৃতীয়াংশ নারী সদস্য করার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে। প্রতিটি পার্টিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ তত্ত্বের নির্বাচনে এক-তৃতীয়াংশ নারীকে নির্বাচিত করার লক্ষ্যে নমিনেশন দেওয়ার বিষয়টি বাধ্যতামূলক শর্ত হিসেবে রাখা হয়েছে। কোনো পার্টি ওই প্রক্রিয়ায় এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে না পারলে ওই সংখ্যক সংখ্যানুপাত প্রক্রিয়া থেকে পূরণ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এক কথায় সব সংসদেই এক-তৃতীয়াংশ নারীর সদস্যপদ সাংবিধানিকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ধরনের বিধান নেপাল ব্যতীত উপমহাদেশের আর কোনো দেশের সংবিধান বা নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় নেই। এদিক থেকে নেপাল অবশ্যই এগিয়ে রয়েছে।
উচ্চকক্ষের নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে আলাদা ইলেকটোরাল কলেজের ভোটার তালিকা তৈরি করতে হয়। উচ্চকক্ষে প্রতিটি প্রদেশের জন্য আটটি আসন নির্ধারিত। মোট ৫৯ আসনের ৩টি সংরক্ষিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থেকে একজন নারী এবং বাকি দুজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং প্রতিবন্ধী থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ৫৬টি আসনের ইলেকটোরাল কলেজে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা, গ্রাম বোর্ডের সভাপতি ও উপসভাপতিরা এবং পৌরসভার মেয়র ও ভাইস মেয়ররা ভোটার লিস্টে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ভোট প্রদান করেন।
নেপালের নির্বাচন কমিশনের ইতিহাস ১৯৫১ সাল থেকে শুরু হলেও ২০০৮ সালেই প্রথম বহুদলীয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধারায় প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠান করে। বিগত তিনটি নির্বাচনে যে পারদর্শিতা নির্বাচন কমিশন দেখাতে সক্ষম হয়েছে, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। নেপালের নির্বাচন কমিশন নিয়োগ হয় আইনি প্রক্রিয়ায় সাংবিধানিক কাউন্সিল দ্বারা। কমিশনার নিয়োগের ন্যূনতম বয়স ৪৫ এবং সর্বোচ্চ ৬৫ বছর। পদে থাকার সময় ছয় বছর অথবা সর্বোচ্চ বয়সসীমা। একজন কমিশনার পদে নিয়োগ হতে অবশ্যই একজন ব্যক্তিকে অন্য গুণাবলির সঙ্গে সঙ্গে কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজ থেকে ন্যূনতম স্নাতক হতে হয়। ভারতের মতো নেপালের নির্বাচন কমিশনে সব শর্ত পূর্ণ সাপেক্ষে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার বিধান রয়েছে। যার কারণে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ শূন্য হলে জ্যেষ্ঠ কমিশনার ওই পদে নিয়োজিত হন। এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।
নেপাল এই উপমহাদেশের সবচেয়ে কনিষ্ঠতম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও শুরু থেকেই যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নির্বাচনী সংস্কৃতির সূচনা করেছে, তা অনেক দেশের জন্য অনুসরণীয় হতে পারে। আশা করি, নেপাল ধারাবাহিকভাবে যে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের উদাহরণ রেখেছে, তাতে উপমহাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা সমৃদ্ধ হবে।
এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন