|
সৈয়দ আবদাল আহমদ
abdal62@gmail.com |
|
র ্যাব : শেখ হাসিনার গেস্টাপো বাহিনী
29 June 2014, Sunday
গেস্টোপো ছিল হিটলারের গোপন পুলিশ বাহিনী। ১৯৩৩ সালে গঠনের পর থেকে ১৯৪৫ সালের মে মাসে নিষিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত নািস জার্মানির লোকজন গেস্টাপোর ভয়ে তটস্থ থাকতেন।
দেশদ্রোহ, অন্য দেশের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি, নাশকতা ও নািসদের ওপর আক্রমণের তদন্ত করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল গেস্টাপোকে।
তাদের কাজের জন্য জবাবদিহির কোনো আইনি ব্যবস্থা ছিল না। ফলে তারা ছিল আইনের ঊর্ধ্বে। গেস্টাপো বাহিনীর প্রধান এক সময় দম্ভ করে বলেছিলেন, ‘যতক্ষণ তারা নেতাদের ইচ্ছা পূরণে দায়িত্ব পালন করে ততক্ষণ তা আইনের মধ্যেই হচ্ছে বলে ধরে নিতে হবে।’
গেস্টাপো ক্ষমতার অপব্যবহারের অন্যতম উপাদান ছিল ‘প্রটেকটিভ কাস্টডি’ বা সুরক্ষামূলক হেফাজত। এর মাধ্যমে তারা বিচারবিভাগীয় প্রক্রিয়া ছাড়াই যাকে খুশি যতদিন বন্দি করে রাখত। শুধু তাই নয়, বন্দিকে লিখে দিতে হতো যে বন্দির ‘অনুরোধেই’ গেস্টাপো তাকে গ্রেফতার করেছে। গেস্টাপোর প্রটেকটিভ কাস্টডিতে থাকার সময়ই হাজার হাজার নাগরিক গুম হয়ে যেতেন। মানে তাদের হত্যা করে লাশও গুম করা হতো।
জার্মানির হিটলার এখন নেই। তবে হিটলারি শাসনের অবসান হয়নি। সুযোগ পেলেই হিটলারি শাসন কোথাও না কোথাও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ এখন এমনই একটি রাষ্ট্র। বর্তমানে এখানে হিটলারি কায়দায় জনগণের ওপর বল প্রয়োগ করে সরকার চালাচ্ছেন শেখ হাসিনা। ১/১১-র সেনা সমর্থিত সরকার ও প্রতিবেশি ভারতের কংগ্রেস সরকারের সহযোগিতায় ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ একটানা পাঁচ বছর দমন-পীড়নের মাধ্যমে দেশ শাসন করেন। সরকারের জবাবদিহি বলতে কিছুই ছিল না। বাংলাদেশ পরিচিতি লাভ করে একটি মৃত্যু উপত্যকা, একটি গুমরাজ্য এবং একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে। এ সময়ে সংবিধানে ক্যু করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলোপ করা হয়। উচ্চ আদালত এবং প্রশাসনেও ক্যু করে দলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। পাঁচ বছরের স্বৈরশাসনের অবসানের পর মানুষ আশা করেছিল স্বচ্ছ গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, প্রতারণা এবং জবরদস্তির মাধ্যমে এ ধরনের একটি নির্বাচনের সম্ভাবনা নস্যাত্ করে দেয়া হয়। শেখ হাসিনাকে এ কাজে নির্লজ্জভাবে সহযোগিতা করে ভারতের কংগ্রেস সরকার। পাঁচ বছর পর যে নির্বাচন হওয়ার কথা সেই নির্বাচনই গায়েব করে দেয়া হয়। ৫ জানুয়ারি আয়োজন করা হয় ভোটারবিহীন, ভোটবিহীন, প্রার্থীবিহীন এক প্রতারণার নির্বাচন। ওই নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত করা হয়। আওয়ামী লীগ এবং তার জোটভুক্ত গুটি কয়েক দল ছাড়া বাংলাদেশের বিরোধী কোনো রাজনৈতিক দলকেই ওই নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি। একদলীয় প্রহসনের এ নির্বাচনে ১৪৭ আসনে ভোট অনুষ্ঠিত হলেও ৫ শতাংশের বেশি ভোট কোথাও পড়েনি। ৯৫ শতাংশের বেশি জনগণ ভোট বর্জন করে। কিন্তু বল প্রয়োগ করেই সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা। বর্তমানে দেশে চলছে শেখ হাসিনার বেপরোয়া দানবীয় শাসন। আর এই দানবীয় শাসনের অন্যতম লাঠিয়াল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক বাহিনী।
১৯৭২-৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশাল শাসনামলে রক্ষীবাহিনী অত্যাচার-নির্যাতনের এক বিভীষিকা সৃষ্টি করেছিল। সেই রক্ষীবাহিনীও ছিল হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর মতো একটি বাহিনী। বর্তমানে র ্যাব সেই রক্ষীবাহিনীকেও হার মানিয়ে দিয়েছে। জনগণের কাছে র ্যাব এখন প্রকৃতই শেখ হাসিনার গেস্টাপো বাহিনী।
জনগণের নিরাপত্তা এবং দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ২০০৪ সালে বাংলাদেশে র ্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র ্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’ গঠন করা হয়েছিল। পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে এ বাহিনী গঠন করা হয়। সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে তাদের দায়িত্ব পালনের কথা। শুরুতে র ্যাব বেশ প্রশংসাও কুড়িয়েছিল। ২০০৫ সালে দেশের ৬৩ জেলায় একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান এবং বাংলাভাইসহ অন্যান্য নেতাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় র ্যাব। তেমনি সন্ত্রাসীদের বেশ কয়েকজন গডফাদারকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার কাজও করে র ্যাব। কিন্তু এ প্রশংসা বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি তারা। শুরু হয় র ্যাবের প্রশ্নবিদ্ধ যাত্রা।
শেখ হাসিনার সরকার র্যাবকে অতিমাত্রায় রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার শুরু করে। ফলে র ্যাব এখন দেশ-বিদেশে একটি বিতর্কিত বাহিনী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। র ্যাবের সদস্যরা মূল কাজ থেকে সরে গিয়ে ক্রসফায়ার, অপহরণ, খুন, গুম, জমি দখল, চাঁদাবাজি ও ডাকাতির কাজে জড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়েছে। এমনকি টাকার বিনিময়ে ভাড়াটে বাহিনী হিসেবেও কাজ করেছে র ্যাব। বর্তমানে দেশে এমন সব ঘটনা ঘটেছে যার ফলে এই বাহিনীর চেইন অব কমান্ড একেবারেই ভেঙে পড়েছে। র ্যাব তার নৈতিক অবস্থান হারিয়ে ফেলছে।
একের পর এক অপহরণ, গুম আর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশ পরিণত হয় আতঙ্কের জনপদে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই গুম আর বিচারবাহির্ভূত হত্যার দায় এসে পড়ে র ্যাবের ওপর। ফলে র ্যাব এক বিভীষিকার নাম হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। নারায়ণগঞ্জে ৭ জনকে গুম ও নির্মমভাবে হত্যা করে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয়ার ঘটনা উন্মোচিত হলে র ্যাব নিয়ে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে।
গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭ জনকে প্রকাশ্যে সড়ক থেকে গুম করা হয়। ৩০ এপ্রিল তাদের লাশ পাওয়া যায় শীতলক্ষ্যা নদীতে। ৪ মে নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহিদুল ইসলাম অভিযোগ করেন, নারায়ণগঞ্জ এলাকার র ্যাব-১১ অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন এবং নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্প প্রধান লে. কমান্ডার এসএম মাসুদ রানা প্রতিপক্ষ কাউন্সিলর নূর হোসেনের কাছ থেকে ৬ কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে এই গুম ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে। র ্যাবের এই তিন কর্মকর্তার সঙ্গে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেন ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার ছেলে দিপু চৌধুরী। র ্যাব-১১ অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মন্ত্রী মায়ার জামাতা। গুমের পর শহিদুল ইসলাম মামলা করতে গেলেও মামলা নেয়া হয়নি। হাইকোর্টের হস্তক্ষেপের পর জড়িত র ্যাব কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। সেনাবাহিনী থেকে তাদের চাকরিও গেছে। তবে এ ঘটনার সঙ্গে র ্যাবের আরও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কর্নেল জিয়াউল আহসানের নাম জড়িত থাকার কথা লে. কমান্ডার মাসুদ রানা স্বীকার করলেও তাকে এখনও গ্রেফতার করা হয়নি।
২০১০ সালের ২৫ জুন ঢাকার শেরেবাংলা নগর থেকে গুম হন ঢাকার ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম। চার বছর হলেও এখনও তার খোঁজ নেই। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল গুম হন বিএনপির প্রভাবশালী তরুণ নেতা ইলিয়াস আলী। দু’বছরেও তার কোনো খোঁজ নেই। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সারাদেশে ২৬৮ জন গুম হয়েছেন। এর মধ্যে ৪৩ জনের লাশ পাওয়া গেছে। গুমের পর ছেড়ে দেয়া হয় ২৪ জনকে। কিন্তু ১৮৭ জনের কোনো হদিস নেই। তারা বেঁচে আছেন নাকি মরে গেছেন কেউ তা জানে না। এসব গুমের অধিকাংশের সঙ্গেই র ্যাব জড়িত বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন।
আসকের তথ্যে ২০১০ সালে গুম হন ৪৬ জন। এরমধ্যে ৩৩ জনের কোন খোঁজ নেই। এই তালিকায় আছেন ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম।
২০১১ সালে গুম হন ৫৯ জন। এরমধ্যে ১৬ জনের লাশ উদ্ধার হয়। গুমের পর ছাড়া পান ৪ জন। বাকি ৩৯ জনের কোনো খোঁজ নেই। ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা কে এম শামীম আক্তার ২০১১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার পল্টন থেকে গুম হন। তিন বছর ধরেও তার কোনো খোঁজ নেই। স্ত্রী ঝর্ণা খানমের কান্নাই এখন সম্বল। ২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সী কিশোরের পায়ে গুলি করে র্যাব। তার পা নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে। এ ঘটনায়ও র্যাবের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
২০১২ সালে গুম হন ৫৬ জন। এর মধ্যে ৩৪ জনের খোঁজ নেই। ওই বছরই সবচেয়ে আলোচিত গুমের ঘটনা ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া। তার স্ত্রী তাহসিনা রুশদী এখনও আশা নিয়ে স্বামীর পথ চেয়ে আছেন। ২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি গুম হন কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আল মুকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহ। হাইকোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও এখনো তাদের খোঁজ নেই।
২০১৩ সালে ৬৮ জনকে গুম করা হয়। এরমধ্যে ৫ জনের লাশ পাওয়া যায় এবং ৬ জন ছাড়া পায়। বাকি ৫৫ জনের কোনো খোঁজ নেই। এ বছরের ২৭ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসার পথে গুম হন সাবেক এমপি লাকসাম বিএনপির সভাপতি সাইফুল ইসলাম এবং পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ূন কবির। তাদেরও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
আসকের তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ৩৯টা গুমের ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে ১২ জনের লাশ উদ্ধা রহয়। গুমের পর ছেড়ে দেয়া হয় চট্টগ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরীসহ ৪ জনকে। অন্য ২৩ জনের কোনো খোঁজ নেই। এরপর ২৭ এপ্রিল নারায়ণঞ্জে র ্যাবের ৭ জনকে গুম ও হত্যার ঘটনা দেশব্যাপী তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করে।
গুম গুপ্ত হত্যা ছাড়াও র্যাবের বিরুদ্ধে ডাকাতি, জমি দখল এবং চাঁদাবাজিরও একের পর এক অভিযোগ ছড়িয়ে পড়ে। ২০১১ সালে চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারার তালসরা দরবার শরীফে অভিযান চালানোর নাম করে দরবারের মসজিদ নির্মাণের ২ কোটি ৭ লাখ টাকা লুটের অভিযোগ ওঠে।
তত্কালীন র ্যাব-৭ অধিনায়ক লে. কর্নেল আলী মজুমদারসহ অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পর ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং সেনাবাহিনী থেকে তাদের চাকরি চলে যায়। ২০১২ সালে চট্টগ্রামের লাভলেইন এলাকায় আবেদীন কলোনির একটি বাড়ি দখলে সহযোগিতা করতে ওই বাড়ির মালিকের ছেলেকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টার অভিযোগ ওঠে র ্যাব-৭-এ কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। র ্যাবের সোর্স এবাদুর রহমানকে পুলিশ গ্রেফতার করে। পরে বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। গত ১৪ মে কুমিল্লা থেকে চার যুবককে ধরে এনে তাদের ইয়াবা দিয়ে মুগদা থানায় সোপার্দ করায় ধনিয়া র ্যাব-৩-এর খিলগাঁও ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডারসহ ১৭ জনকে প্রত্যাহার করে সদর দফতরে সংযুক্ত করা হয়। ২৮ মে সায়দাবাদ বাস টার্মিনালে একটি দোকানে ৫শ’ টাকার একটি জাল নোট দিয়ে জিনিস ক্রয়ের সময় দোকানদারের হাতে র ্যাব-১০ সদস্য শামসুর রহমান আটক হন। পরে তার কাছে আরও জালনোট পাওয়া যায়। তাকে যাত্রাবাড়ি থানায় সোপার্দ করা হয়। গত ৮ জুন উত্তর খানের একটি জমি দখল করতে গিয়ে জনতার হাতে আটক হন র ্যাব সদস্য আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ও কর্পোরাল মিজানুর রহমান। তাদেরকে গ্রেফতারের পর বিচারের জন্য নিজ বাহিনীতে পাঠানো হয়। নারায়ণগঞ্জের ঘটনা ছাড়াও র্যাব-১১ অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদের বিরুদ্ধে সিদ্দিরগঞ্জের ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেনকে তুলে নিয়ে দুই কোটি টাকা চাঁদা নেয়ার অভিযোগ ওঠে। ইসমাইল হোসেনের আত্মীয়স্বজন তদন্ত কমিটির কাছে এ অভিযোগ তুলে ধরেন।
বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, অপহরণসহ ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ায় ইতিমধ্যে র ্যাব বিলুপ্ত করার দাবি উঠেছে। আন্তর্জাতিক মহলও র ্যাব নিয়ে এখন সোচ্চার। বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, র ্যাব জনগণের নিরাপত্তার জন্য গঠন করা হয়েছিল। তখন তারা ভালো কাজ করেছিল। কিন্তু এখন তাদেরকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করছে সরকার। তারা এখন গুম-খুনে জড়িয়ে পড়েছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গুম করছে, অত্যাচার-নির্যাতন করছে। তাই অবিলম্বে এই বাহিনী বাতিলের দাবি জানাচ্ছি। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, র্যাব তার নৈতিক অবস্থান হারিয়েছে। এই বাহিনীর সদস্যরা তাদের মূল কাজ থেকে সরে গিয়ে ক্রসফায়ার, অপহরণ, গুম এবং গুমে জড়িয়ে পড়ে মানুষের আস্থা হারিয়েছে। এই বাহিনীকে চালিয়ে রাখা কঠিন। কারণ, র ্যাবের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে। ২০০৪ সালে র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় ১৪০০ মানুষকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। আর তাদের হাতে গত ৪ মাসে গুম হয়েছেন ৫৩ জন। তাই এই বাহিনীর কোনো জবাবদিহি নেই। যদি র্যাবকে রাখতেই হয় তাহলে র ্যাবের শীর্ষ থেকে মাঠপর্যায় পর্যন্ত বদলে ফেলতে হবে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, চার-পাঁচ বছর ধরেই আমরা গুম ও অপহরণের সংস্কৃতি দেখছি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের কোনো বাহিনীর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উঠছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থ্যা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) র ্যাব ভেঙে গিয়ে নতুন একটি সম্পূর্ণ বেসামরিক প্রতিষ্ঠান গঠনের পরামর্শ দিয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে এ দাবি করা হয়। প্রতিবেদনে র্যাবের কর্মকাণ্ড যাচাই করতে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনেরও সুপারিশ করা হয়। এর আগে সংস্থাটির আরেক প্রতিবেদনে হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয় যে, র ্যাব বিলুপ্ত না করলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়ার আহবান জানানো হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, র ্যাব বছরের পর বছর ধরে বিচারবহির্ভূত হত্যা, অপহরণ ও গুমসহ ক্ষমতার অপব্যবহারের মতো একের পর এক অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে।
৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন বিতর্কিত নির্বাচন বিষয়ে ১৬ জানুয়ারি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিতর্কেও র ্যাব বিলুপ্তির আহবান জানানো হয়েছে। ওইদিন হাউস অব কমনসের বিতর্কে ব্রিটিশ এমপিদের সমালোচনার একটি বড় অংশজুড়ে ছিল বাংলাদেশের র্যাব বাহিনী ও মানবাধিকার প্রসঙ্গ। বিতর্কে র্যাবকে একটি ‘ঘাতক বাহিনী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
তারা র ্যাব ভেঙে দেয়ার দাবি জানাতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহবান জানান।
নারায়ণগঞ্জে রোমহর্ষক ও নৃশংস ৭ খুনের ঘটনায় ভাড়াটে ঘাতকের ভূমিকা পালনের অভিযোগ র্যাবকে নিয়ে চলা গত কয়েক বছরের বিতর্ককে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। এখন মানুষ বলাবলি করছে র্যাব শেখ হাসিনার গেস্টাপো বাহিনী। র্যাবের কার্যক্রম বিগত শতাব্দীর লাতিন আমেরিকায় ঘটে যাওয়া একই ধরনের ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। তেমনি মনে করিয়ে দিচ্ছে মেক্সিকো নামক রাষ্ট্রের অরাজক পরিস্থিতির কথা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন