|
সৈয়দ আবদাল আহমদ
abdal62@gmail.com |
|
এফবিসিসিআই-এর কর্মসূচী নিয়ে নানা প্রশ্ন
09 February 2015, Monday
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মতিঝিলে ১৫ মিনিটের এক প্রতিবাদী অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। ফেডারেশন ভবনের সামনে অনুষ্ঠিত অবস্থান কর্মসূচিতে দেশের সব ব্যবসায়ীদের পক্ষে স্মারকলিপি পড়েন এফবিসিসিআই-এর সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদ। তিনি আইন করে হরতাল অবরোধ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। একইসঙ্গে বলেন টানা অবরোধ-হরতালে প্রতিদিন দেশের ব্যবসা বাণিজ্যে ২ হাজার ৭শ’ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। এ পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে পরিবহন খাতে ৯ হাজার ৫ শ’ কোটি, পোষাক খাতে ৩০ হাজার কোটি, উৎপাদনশীল খাতে ৪ হাজার কোটি, পর্যটন খাতে ৬ হাজার ৫শ’ কোটি, কৃষি ও পোলট্টি খাতে ৯ হাজার ৫১৮ কোটি, হিমায়িত খাদ্য খাদে ২৫০ কোটি, আবাসন খাতে ৭ হাজার ৭৫০ কোটি, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা খাতে ১৫ হাজার কোটি টাকা। অবিলম্বে তিনি হরতাল অবরোধ বন্ধ করার দাবি জানিয়ে বলেন, ধ্বংসাত্মক রাজনীতি চান না ব্যবসায়ীরা।
একই দিন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪দলীয় জোট রাজধানীর গাবতলী থেকে যাত্রাবাড়ি পর্যন্ত ১৩টি স্পটে হরতাল অবরোধ সহিংসতা বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। ১৪ দলের সমন্বয়ক আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে বলেন, অবরোধ হরতাল সহিংসতায় আপনি যে রক্ত ঝরিয়েছেন, প্রতি ফোটা রক্তের হিসাব নেয়া হবে। নির্বাচন হবে, তবে ২০১৯ সালে। অনুরূপ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে আওয়ামী লীগের শুভাকাংখী সংগঠন হিসেবে পরিচিত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সংগঠনের নেতা শাহরিয়ার কবির প্রয়োজনে সেনাবাহিনী তলব করে হরতাল অবরোধ সহিংসতা বন্ধের দাবি জানান।
এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশ আজ একটি চরম সংকটকাল অতিক্রম করছে। দিন দিন এ সংকট ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। এমন ঘোর সংকট জাতির জীবনে কখনো আসেনি। জনজীবনের শান্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে গেছে। শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত। দেশের পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে এফবিসিসিআই তথা ব্যবসায়ীরাও উদ্বিগ্ন না হয়ে পারেন না। তারা এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চাইতেই পারেন। ঐকিক নিয়মের মতো হিসাব করে ৭৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির অংক নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ক্ষতি হচ্ছে এটা ঠিক।
কিন্তু এফবিসিসিআই-এর মতো ব্যবসায়ীদের একটি শীর্ষ সংগঠন যখন সরকারের সুরে কথা বলে, লেজুড়বৃত্তি করে এবং সরকারি দলের সঙ্গে কাধে কাধ মিলিয়ে একই রকম এবং একইদিন কর্মসূচি পালন করে, তখনই তা জনমনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করে। ৮ ফেব্রুয়ারি ১৪ দলের এবং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কর্মসূচি পূর্বনির্ধারিত ছিল।
এফবিসিসিআইআইকে একইদিন একই রকম কর্মসূচি পালন করতে হবে কেন? ব্যবসায়ীরা একটি মাত্র দলের সদস্য নন। এফবিসিসিআই এর সঙ্গে দলমত নির্বিশেষে সবাই আছেন। দুঃখজনক হচ্ছে, সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন নিরপেক্ষ এ সংগঠনটিকে যেনো সরকারি দল আওয়ামী লীগের চাহিদা পুরণের সংগঠনে পরিণত করেছেন। তিনি আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা ম-লীর সদস্য একথা অনেকেই জানেন। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা দোষের কিছু নয়। তবে একজন ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি যখন এফবিসিসিআইয়ের মতো ব্যবসায়ীদের নিরপেক্ষ সংগঠনের নেতা হবেন, তাকে অবশ্যই নিরপেক্ষভাবেই সংগঠনের কার্যক্রম চালাতে হবে। তার রাজনৈতিক মত সংগঠনের ওপর কেন চাপিয়ে দেবেন? অতীতেও দেখা গেছে, বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে তার আচরণ রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বমূলক। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনারও সৃষ্টি হয়েছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারির অবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি আরও বেশি করে বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন। কর্মসূচিতে তার একতরফা দাবির কারণে মনে হয়েছে এফবিসিসিআই আওয়ামী লীগের একটি সহায়ক সংগঠন হিসেবে কাজ করছে। কর্মসূচি চলাকালে তার পাশে ছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। আওয়ামী লীগের দুই আমলেই শেয়ারবাজার কেলেংকারীর জন্য তার বেশ নামডাক। আরেকজন ব্যবসায়ী নেতা আনিসুল হক ওয়ান ইলেভেনের জরুরি সরকার ক্ষমতা নেয়ার আগে প্রকাশ্যে সংকট নিরসনে সেনা হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন। তিনিও ওই কর্মসূচিতে কাজী আকরাম উদ্দিনের পাশে ছিলেন। ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে তারা অবস্থান কর্মসূচি করবেন, বক্তব্য দেবেন তা অন্যায় কিছু নয়। আপত্তি শুধু তাদের মতলবি তথা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আচরণ নিয়ে। সংকট নিরসন হোক এটা সবার কাম্য। কিন্তু সংকট উত্তরণের চেয়েও এফবিসিসিআই রাজনীতিকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।
দেশের বর্তমান সংকটটি একটি ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকট। ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর প্রহসনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলগুলো আন্দোলন করছে। সরকার এ আন্দোলন দমনে বলপ্রয়োগ করছে। উভয় পক্ষ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। এমন একটি অবস্থায় এক পক্ষের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বললে সংকটের সমাধান হবে না। আন্দোলনকারি পক্ষকে হরতাল অবরোধ প্রত্যাহারে দাবি জানানোর পাশাপাশি সরকারকেও উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার আহবান জানাতে হবে। এই রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং দেশের নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন মহল সংলাপের আহবান জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, হরতাল অবরোধ, সহিংসতা কিংবা বলপ্রয়োগ সংকটের সমাধান নয়। সবদলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সংলাপই পরিত্রানের উপায়। কিন্তু এফবিসিসিআই তাদের অবস্থান কর্মসূচিতে সংকটের জন্য বিরোধী দলকেই দায়ী করেছে এবং একতরফাভাবে হরতাল অবরোধ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে।
এফবিসিসিআই-এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একতরফা আহবান অনেকের মধ্যে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সিপিডি’র ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে টিভি টকশোতে স্পষ্টভাবে বলেছেন, এফবিসিসিআইকে হরতাল অবরোধ প্রত্যাহারের পাশাপাশি রাজনৈতিক হয়রানি, ধরপাকড় বন্ধ এবং সংলাপের বিষয়টিও বলা উচিত ছিল। তাদের এই কর্মসূচির ব্যাপারে বিএনপিও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। তারা এফবিসিসিআইকে স্থিতিশীল রাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকারকে দ্রুত পদত্যাগের পরামর্শ দিতে আহবান জানিয়েছে। বিএনপি বলেছে, জনপ্রতিনিধিত্বশীল সংসদ ও সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ব্যবসাবান্ধব স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত হবে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এফবিসিসিআই সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদের সমালোচনা করে বলা হয়, এফবিসিসিআই-এর দলবাজ সভাপতির কারণে ব্যবসায়ী সমাজের বক্তব্য সরকারের কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই চলমান রাজনৈতিক সংকট ও অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। এফবিসিসিআই নিরপেক্ষভাবে সংকট সমাধানের চেষ্টা চালালে বিএনপিকে হয়ত এমন প্রতিক্রিয়া জানাতে হতো না। এফবিসিসিআই-এর মতো ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনকে এভাবে বিতর্কিত এবং অকার্যকর করার জন্য ব্যবসায়ীরা অবশ্যই একদিন বর্তমান সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিনদের জবাবদিহিতা চাইবে।
লেখক : জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন