|
সৈয়দ আবদাল আহমদ
abdal62@gmail.com |
|
ভারতীয় ঋণ এবং পিনাক রঞ্জনের খোঁচা
12 October 2017, Thursday
ভারতীয় ঋণের জালে আবারো জড়িয়ে গেল বাংলাদেশ। বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ সই হয়ে গেল বড় একটি ঋণচুক্তি। গত ৪ সেপ্টেম্বর ভারতের কাছ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ নেয়ার এই চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশী মুদ্রায় এ ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ অবকাঠামো খাতের প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে বলে উল্লেখ করা হয়।
ভারতের সাথে এর আগে একই ধরনের আরো দু’টি ঋণচুক্তি সই করে বাংলাদেশ। এই চুক্তি লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) নামে পরিচিত। প্রথম এলওসি ছিল ১০০ কোটি ডলারের, দ্বিতীয়টি ২০০ কোটি ডলারের আর বর্তমান তৃতীয়টি ৪৫০ কোটি ডলারের। ২০১০ ও ২০১৬ সালে ভারতের সাথে সই হওয়া দু’টি ঋণচুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া খুবই মন্থর এবং হতাশাজনক। ১০০ কোটি ডলারের প্রথম ঋণচুক্তির আওতায় ১৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা থাকলেও অর্ধেক প্রকল্পের কাজও বাস্তবায়িত হয়নি। ভারত অর্থ ছাড় করেছে মাত্র ৩৫ কোটি ডলার। আর দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে ২০০ কোটি ডলারের দ্বিতীয় ঋণচুক্তির কোনো অর্থ অর্থাৎ একটি টাকাও এখন পর্যন্ত ছাড় হয়নি। এ অবস্থায় ৪৫০ কোটি ডলারের আরো একটি বড় ঋণচুক্তি করা বাংলাদেশের ঘাড়ে বড় ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেয়ার শামিল নয় কি? এ ঋণ একদিন বাংলাদেশের গলায় কাঁটা বা ফাঁস হয়ে দাঁড়ায় কি না সেটাই দেখার বিষয়।
নতুন ঋণচুক্তির শর্ত আগের দু’টির মতোই। অর্থাৎ ভারতীয় ঠিকাদারেরাই প্রকল্পের কাজ পাবেন। পূর্ত কাজের প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ পণ্য ও সেবা ভারত থেকে আনতে হবে। পূর্ত কাজ ছাড়া অন্য প্রকল্পের জন্য ভারত থেকে বাধ্যতামূলকভাবে আনতে হবে ৭৫ শতাংশ পণ্য ও সেবা। একই মানের পণ্য কম দামে অন্য দেশ থেকে পাওয়া গেলেও তা আনা যাবে না। ঋণের সুদের হার ১ শতাংশ। এর বাইরেও রয়েছে দশমিক ৫০ শতাংশ প্রতিশ্রুতি মাশুল। সুদ ও মাশুল মিলে ঋণের বিপরীতে বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হবে ১ দশমিক ৫০ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক ঋণ পরিশোধে ৪০ বছর সময় দেয়। গ্রেস পিরিয়ড মেলে ১০ বছর। আর ভারতের ক্ষেত্রে সেটা ২০ বছর ও পাঁচ বছর। প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় কেনাকাটার বেশির ভাগই করতে হবে ভারত থেকে। সেক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।
হঠাৎ করে এমন শর্তে কেনো এই ভারতীয় ঋণ, এর সুস্পষ্ট কোনো জবাব নেই। বাংলাদেশ বড় ধরনের আর্থিক সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে, এমন আশঙ্কাও ছিল না। বরং আমরা জানি দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে ৩২ থেকে ৩৩ বিলিয়ন ডলার। সাধারণত ঋণ নেয়া হয় ফরেন এক্সচেঞ্জের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকে যে পরিমাণ রিজার্ভ রয়েছে সে কারণে ফরেন এক্সচেঞ্জের জন্য আপাতত সমস্যায় পড়ার কথা নয়। এজন্য এখন বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজন ছিল না। এই ঋণচুক্তি তাই অনেক প্রশ্ন ও রহস্যের সৃষ্টি করছে।
ভারতের এই বড় ঋণচুক্তি নিয়ে দেশের বিশেষজ্ঞরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা মো: আজিজুল ইসলাম ইতোমধ্যে বলেছেন যে, এ ঋণের প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এ মুহূর্তে দেশে এ ধরনের ঋণের প্রয়োজন ছিল না। ভারতের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঋণ নেয়ার থেকেও আমাদের বেশি প্রয়োজন অন্য দুটো বিষয়Ñ যার একটি হলো ভারতের বাজারে আমাদের রফতানির পণ্য প্রবেশে শুল্কবহির্ভূত বাধাগুলো দূর করা। দেশটিতে পণ্য রফতানিতে অ্যান্টি ডাম্পিং, কাউন্টার ভেইলসহ নানা বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে আমাদের রফতানিকারকদের। যেমন- আমাদের বিএসটিআইর পণ্য পরীক্ষা ভারত গ্রহণ না করে চেন্নাইয়ে আবার পরীক্ষার জন্য পাঠায়। এভাবে সময় এবং অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি নানা হয়রানির মুখে পড়তে হচ্ছে রফতানিকারকদের।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, ভারত থেকে আমাদের কাঙ্ক্ষিত খাতে বিনিয়োগ নিয়ে আসা। এ দু’টি ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন না এলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত থেকে আমাদের খুব বেশি লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই। তাই ভারত থেকে নেয়া ঋণ, ঋণের শর্ত, সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে আমাদের সক্ষমতা বিবেচনায় নিলে এ ঋণ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই। যেখানে ভারত থেকে নেয়া প্রথম এক শ’ কোটি ডলার ঋণের প্রকল্পগুলোর কাজই এখনো শেষ হয়নি এবং দ্বিতীয়বারের দু শ’ কোটি ডলার ঋণের প্রকল্পে হাতই দেয়া সম্ভব হয়নি, যেখানে তৃতীয়বারের মতো ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বোঝা বাড়ানো ছাড়া কিছুই নয়।
আসলে এ চুক্তির ফলে বাংলাদেশ লাভবান তো হবেই না, বরং ভারত কৈয়ের তেলে কৈ ভাজবে। আর বাংলাদেশ ক্রমেই ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকবে। কিছু দিন আগে এক অনুষ্ঠানে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী বলেছিলেন, ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হচ্ছে তৃতীয় নম্বর উৎস। বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ ভারতীয় চাকরি করছেন। ভারতের বিরাট বাজার বাংলাদেশ। সামনের দিনগুলোয় ভারতনির্ভরশীলতা আরো কত বেশি হয় সেটাই প্রশ্ন।
ভারত আসলে কার বন্ধু?
ভারতের সাথে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকার ঋণচুক্তি সইয়ের পর ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির মন্তব্য ছিল, ‘বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বোত্তম। এটা অন্যান্য দেশের জন্য মডেল।’
আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত বলেন, বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককে আমি বলব, ‘গোল্ডেন পিরিয়ড অব ফ্রেন্ডশিপ বা বন্ধুত্বের স্বর্ণযুগ’। অর্থাৎ দুই অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ভারতের পরম বন্ধু এ কথাই দাঁড়ায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ভারত যদি আমাদের পরম বন্ধুই হয় কিংবা এই সময়টা যদি সর্বোত্তম এবং বন্ধুত্বের স্বর্ণযুগই হয়, তাহলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা এতিম হয়ে গেলাম কেন? আমরা তো কয়েক বছর ধরেই জানি ভারত আমাদের বন্ধু, চীন আমাদের বন্ধু, রাশিয়া আমাদের বন্ধু। কিন্তু আমাদের বড় বিপদের দিনে এই তিন বন্ধুর কাউকেই তো আমরা কাছে পেলাম না। আর আমাদের সেটাও দেখতে হলো চীন এবং রাশিয়া যে কাজটি প্রকাশ্যে করেনি, ভারত আগ বাড়িয়ে গিয়ে সেটা প্রকাশ্যে করেছে। রাখাইনে যখন গণহত্যা চলছে, রোহিঙ্গা মুসলমানরা যখন স্রোতের মতো বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমারে গিয়ে অং সান সু চিকে জোর সমর্থন জানিয়ে এসেছেন। সু চি বলছেন, রাখাইনে আমরা সন্ত্রাস দমন করেছি। আর নরেন্দ্র মোদি তার কথায় সুর মিলিয়ে ঘোষণা করলেন এই সন্ত্রাস দমনে ভারত আপনাদের পাশে আছে। বাংলাদেশের সাথে এই হলো ভারতের বন্ধুত্বের নমুনা।
সু চি যদি সত্যিকার সন্ত্রাস দমনই করতেন, তাহলে আজ রাখাইনের পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এলো কেন? আরাকান স্যালভেশন আর্মি বা আরসার সদস্যসংখ্যা বড়জোর ৫০ জন বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মিডিয়ার রিপোর্টে এসেছে। এই ৫০ জনকে ধরতে কিংবা দমন করতে কি তিন হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা, অসংখ্য নারী ধর্ষণ এবং গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে হবে? পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমানকে মাতৃভূমির ভিটেমাটি ছাড়া করতে হবে? পালাতে বাধ্য করতে হবে? আসলে সন্ত্রাস দমনের কথাটা একটা অজুহাত মাত্র। সন্ত্রাস দমন করতে চাইলে মিয়ানমার আরসাকে দমন করত। জাতিগত নিধন কিংবা গণহত্যা চালাত না। এখানে রোহিঙ্গাকে চিরতরে উচ্ছেদই আসল কথা। আর কোনো রাখঢাক না করেই মিয়ানমারে উপস্থিত হয়ে মিয়ানমারের এই কাজে সমর্থন জানালেন ভারতের নরেন্দ্র মোদি। তাহলে ভারত কার পরম বন্ধু? বন্ধুত্বের স্বর্ণযুগ কাদের সাথে? নিশ্চয় সেটা বাংলাদেশ নয়, মিয়ানমার।
পিনাক রঞ্জনের খোঁচা
ঢাকায় একসময় ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। তিনি বাংলাভাষী। ঢাকায় ৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ-ভারত দুই অর্থমন্ত্রীর মধ্যে যখন ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হয়, তার এক দিন পর তিনি বিবিসিকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। এই সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশকে খোঁচার পর খোঁচা মেরে বুঝিয়ে দিলেন ভারত বাংলাদেশের কেমন বন্ধু! বিবিসির সাংবাদিক রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে তাকে প্রশ্ন করেছিল। তিনি সরাসরি জবাব দেন, ‘‘রোহিঙ্গা তো আমাদের প্রবলেম না। এটা তো বিটুইন মিয়ানমার অ্যান্ড বাংলাদেশ। বাংলাদেশ চায় আমরা মিয়ানমারকে প্রেসার দিয়ে এ প্রভলেম সলভ করে দেই। কিন্তু তাতো হতে পারে না। মিয়ানমারের সাথে তো ভারতের একটা ‘নিজস্ব সম্পর্ক’ রয়েছে। বাংলাদেশের এ আশা করা তো ঠিক না।’’
এটুকু বলেই ক্ষান্ত হননি পিনাক রঞ্জন। বাংলাদেশকে খোঁচা দিতেও ছাড়েননি। তিনি বলেন, ‘চায়না (চীন) ওদের (বাংলাদেশের) বিশেষ বন্ধু হয়েছে এখন। চায়নাকে জিজ্ঞেস করুক। ওরা কিছু করুক। যখন দরকার হয় তখন বাংলাদেশ তো চায়নার কাছে ছুটে যায়। ... কিছু রোহিঙ্গা চায়না নিয়ে নিক না।’
অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রতি খুব রাগ! চীনের সাথে কেন মাখামাখি করতে গেল বাংলাদেশ। ক্ষোভের কারণ এটাই। ভারত ছাড়া অন্য কারো সাথে বাংলাদেশ সম্পর্কে জড়াবে কেন এটাই বুঝিয়ে দিলেন পিনাক রঞ্জন। এই মনোভাব অবশ্য পিনাক রঞ্জনের একারই নয়, ভারতীয় গোটা প্রশাসনেরই। বাংলাদেশ জ্বি হুজুর হয়ে থাকবে, তারা কেন কথার বাইরে যাবে, ভাবখানা এরকম। এখানে মানবিক দিক বা বাস্তবতার প্রশ্ন গৌণ। মিয়ানমার গণহত্যা চালিয়ে কত লোক মারল, কত লোক উদ্বাস্তু হলো সেটা তাদের দেখার বিষয় নয়। তবে পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী কিংবা ভারতীয় প্রশাসনের এমন মনোভাবই যে সবকিছু নয়, সেটা সেদেশেরই মুম্বাই চলচ্চিত্রের সুপার স্টার আমির খানের বক্তব্যে উচ্চারিত হয়েছে। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইনে যা ঘটেছে এবং রোহিঙ্গা মুসলমানদের যে দুর্দশা তাতে আমার বুক ভেঙে গেছে। বিশ্বের যেকোনো জায়গায় মানুষ যখন নির্যাতনের শিকার হন, যেকোনো জায়গায় এ ধরনের ট্র্যাজিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যখন মানুষকে যেতে হয় তা দেখে হৃদয় মুচড়ে ওঠে।’ এটাই মানবতা। স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে কখনো কখনো তো মানবতার জন্য দাঁড়াতে হয়। আজ হয়তো আমি বিপদে পড়েছি, কাল তো আপনার কপালেও এর চেয়ে বড় বিপদ আসতে পারে। এই উপলব্ধি আজ যদি পিনাক রঞ্জন কিংবা ভারতীয় প্রশাসনের মধ্যে জাগ্রত হতো তাহলে পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারত। নরেন্দ্র মোদি দৌড়ে মিয়ানমার যেতেন না, পিনাক রঞ্জনও বাংলাদেশকে এমন খোঁচা দিতেন না। বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতেন। তবুও আমরা আশা করব ভারতের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভারত বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেসক্লাব
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন