আদালত কক্ষে বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে দেশের তিনবারের নির্বাচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া একটি ফরিয়াদ জানিয়েছেন। তার এই ফরিয়াদটি ছিল- একটি ভিত্তিহীন অভিযোগ দায়ের করে বিচারের নামে দীর্ঘ দিন ধরে তাকে হয়রানি, পেরেশানি ও হেনস্তা করা হচ্ছে। বিচারের আগে, বিচার চলাকালে এবং বিচারের নামে তাকে জনসমক্ষে অপমান-অপদস্থ করা হচ্ছে। তিনি জানতে চান- ‘এর বিচার তিনি কার কাছে চাইবেন? কোথায় পাবেন এর প্রতিকার?
গত ১৯ অক্টোবর ঢাকার বকশীবাজার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে তিনি এই ফরিয়াদ জানান। চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। সেখানে চিকিৎসা ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কিছু দিন অবস্থান করার পর গত ১৮ অক্টোবর তিনি দেশে ফিরে আদালতে হাজিরা দেন। এর আগে ১২ অক্টোবর একই আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় হাজিরা দিতে গিয়ে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, ‘আমি নিজেকে একজন সামান্য মানুষ বলেই মনে করি। তবে দেশ-জাতির স্বার্থ ও কল্যাণে আমার জীবন, সীমিত শক্তি-সামর্থ্য এবং মেধা ও জ্ঞানকে উৎসর্গ করেছি। অথচ বিচারের নামে আজ আমাকে জনসমক্ষে হেয় করা হচ্ছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের একটি পয়সাও অপচয় কিংবা তছরুপ হয়নি। অথচ ‘এতিমের টাকা চুরি করে খেয়েছেন’ বলে মানহানিকর ও কুৎসিত উক্তি করে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী। এ নিয়ে ভিত্তিহীন ও মিথ্যা অভিযোগে আমার নামে হয়রানিমূলক মামলা দেয়া হয়েছে।
দুদকের আইনগত কর্তৃত্ব ও এখতিয়ারের বাইরে এ মামলায় আমার প্রতি ন্যক্কারজনক আচরণ করা হচ্ছে। একই ধরনের অন্যান্য মামলা কোর্ট-কাচারিতে হলেও আমার বেলায় হচ্ছে এখানে। বিডিআর বিদ্রোহের দায়ে অভিযুক্তদের বিচার করার জন্য এই আলিয়া মাদরাসা প্রাঙ্গণে এজলাস বসানো হয়েছিল। রাষ্ট্রদ্রোহ, হত্যা ও বিদ্রোহের বিচারের জন্য যেখানে এজলাস স্থাপন করা হয়েছিল, সেখানে আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বিচার কেন এ এজলাসে করা হবে?’ এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ জন্য মাননীয় আদালত আপনি দায়ী নন। এটা সরকারের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। এর মাধ্যমে সরকার আমাকে অপদস্থ করছে। এটা বিচারপ্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ। সরকার সম্ভাব্য সব পন্থায় বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার অবিরাম অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’ তিনি প্রশ্ন করেন ‘বিচারাধীন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মানহানিকর কুৎসিত উক্তি কি আইনের লঙ্ঘন এবং বিচারপ্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ নয়? বিচার প্রভাবিত করার এই অন্যায় ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার প্রতিবিধান কি আমি আপনার কাছে চাইতে পারি না?’
কতটা বিপন্ন ও অসহায় হলে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং একটি বড় দলের বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেত্রী এমন অভিযোগ জানাতে পারেন, আদালতে দেয়া তার এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে। এ মামলাই শুধু নয়, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এমন ৩৯টি হয়রানিমূলক মামলা দেয়া হয়েছে। সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা তিনি ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অনবরত কুৎসা প্রচার করে বেড়াচ্ছেন। শারীরিক ও মানসিক পীড়নে বলা যায়, তাকে কোণঠাসা এবং তার জীবন একপ্রকার তছনছ করে দেয়া হচ্ছে।
১-১১-র জরুরি সরকারের সময় যে নির্যাতনের শুরু, তার ধারাবাহিকতা আরো বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এ সরকার। এরই মধ্যে তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মালয়েশিয়ায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। লন্ডনে চিকিৎসাধীন বড় ছেলের বিরুদ্ধে এমন সব মামলা দেয়া হয়েছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হচ্ছে, যাতে তার দেশে ফেরার পথ একেবারে রুদ্ধ হয়ে যায়। খালেদা জিয়াকে বাড়িছাড়া করা হয়েছে। ক্যান্টনমেন্টের ৩৮ বছরের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে তাকে এক কাপড়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিনাভোটের নির্বাচনের প্রতিবাদ করায় তাকে গুলশান কার্যালয়ে ৯২ দিন অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। তার দলকে কোনো রকম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডই চালাতে দেয়া হচ্ছে না। এমনকি ঘরের মধ্যে সভা করতে গেলেও পুলিশ গিয়ে তা বন্ধ করে দিচ্ছে। দলের মহাসচিবকে ছয়বার জেলে নেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ৮৬টি। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী ও কেবিনেট সচিব এম কে আনোয়ার ৩৭টি মামলার যন্ত্রণা নিয়ে মঙ্গলবার এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। একজন সৎ, নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত এম কে আনোয়ারকে এ সরকার দুইবার জেলে নেয়। বিএনপির প্রায় চার লাখ নেতাকর্মী ২৫ হাজার মামলার আসামি। আদালতে হাজিরা আর হাজিরায় তাদের দিন যায়। অনেকে হয়েছেন হত্যা ও গুমের শিকার।
লন্ডনে ব্যক্তিগত চিকিৎসা নিতে গিয়েও খালেদা জিয়া ক্ষমতাসীনদের আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি। সরকারের মন্ত্রীরা প্রচার করতে থাকেন তিনি পালিয়ে গেছেন, নিখোঁজ হয়ে গেছেন। বাংলাদেশে আর ফিরে আসবেন না। ‘আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, মামলার ভয়ে তিনি দেশে ফিরবেন কি না, আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে [প্রথম আলো, ১৭ জুলাই ২০১৭]। প্রধানমন্ত্রীর বেয়াই এলজিআরডি মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, মামলার ভয়ে খালেদা জিয়া দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন, (আরটিভি ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম, ২১ জুলাই ২০১৭] এক মন্ত্রী বলতে থাকেন ‘লন্ডনে তিনি কী কী ষড়যন্ত্র করছেন আমরা তার খবর রাখছি।’
রোহিঙ্গা মুসলমানদের আশ্রয় দেয়ার দাবি জানিয়ে খালেদা জিয়াই প্রথম বিবৃতি দেন। অথচ এক মন্ত্রী বলে দিলেন, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে খালেদা জিয়ার কোনো দায় নেই বলেই তিনি লন্ডনে বসে আছেন। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বিবৃতি দিয়েই খালেদা জিয়া তার দায়িত্ব শেষ করেননি, সেখান থেকে তিনি দলের নেতৃবন্দকে ত্রাণকাজ চালাতে নির্দেশ দেন। স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে ত্রাণ কমিটি গঠিত হয়। প্রথমে ২২ ট্রাক ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বিএনপি ঘটনাস্থলে রওনা হয়। কিন্তু সরকার এই ত্রাণের ট্রাক আটকে দেয়। এর পরও বিএনপি নানা কৌশলে সব ত্রাণসামগ্রী রোহিঙ্গাদের কাছে পৌঁছায়। দলের মহাসচিব এবং সিনিয়র নেতারা রোহিঙ্গা আশ্রিত অঞ্চলে গিয়ে ত্রাণবিতরণ এখনো অব্যাহত রেখেছেন। রোববার খালেদা জিয়া সেখানে যাবেন ত্রাণ দিতে। তার আমলে ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গা সঙ্কট তিনি সফল কূটনৈতিক তৎপরতায় সমাধা করেছিলেন।
অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানের কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে খালেদা জিয়ার বিএনপিই প্রথম আহ্বান জানায়। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরই প্রথম সরকারকে চীন, ভারত ও রাশিয়ায় দূত পাঠিয়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে সমর্থন আদায়ের পরামর্শ দেন। পরে একই পরামর্শ অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং ড. কামাল হোসেনও দিয়েছেন। বিএনপিই প্রথম সংবাদ সম্মেলন করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ত্রাণকাজে সেনাবাহিনী নিয়োগের দাবি জানান। বর্তমানে সেখানে সেনাবাহিনী ত্রাণকাজ পরিচালনা করছে।
লন্ডন থেকে খালেদা জিয়া যথাসময়েই দেশে ফিরেছেন এবং কোর্টে গিয়ে হাজিরা দিয়েছেন। লাখো জনতা বিমানবন্দরে গিয়ে তাদের প্রিয় নেত্রীকে হৃদয়ের ভালোবাসা জানিয়েছেন। এখন ওবায়দুল কাদের কী বলবেন? কী বলবেন ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন? আসলে তাদের বলার কিছু নেই। খালেদা জিয়াকে মানুষ কেন এত ভালোবাসে, তার দল কেন এত জনপ্রিয় সেটাই মাথাব্যথার কারণ। আসলে তারা চায় রাজনীতিতে খালেদা জিয়া নিঃশেষ হয়ে যান। এ জন্যই তার প্রতি এত আক্রোশ, এত প্রতিহিংসা। এ অবস্থায় ধৈর্যধারণ এবং সহিষ্ণুতা দেখানোই খালেদা জিয়ার অবলম্বন, যে দৃষ্টান্ত তিনি বারবার দেখিয়েছেন।
সুষমার সফরে নির্বাচন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
গত রোববার পল্টন মোড় থেকে সচিবালয়ের ফুটপাথ ধরে প্রেস ক্লাবে আসার পথে এক বিএনপি নেতার সঙ্গে দেখা। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। সাংবাদিক হিসেবে আমাকে সামনে পেয়ে জানতে চাইলেন নতুন কোনো খবর আছে কি না। তাকে বললাম ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এসেছেন, এর চেয়ে বড় খবর আর কী চান? তিনি বললেন, তাহলে আমার কাছে শুনুন। আমার ওই আত্মীয় বলেছেন, ‘বেশি লাফালাফি করো না। আগামী নির্বাচনে ১৫১ আসন নিশ্চিত করেই তবে আমরা বাকি আসন নিয়ে তোমাদের সঙ্গে দেনদরবার করব। দেখোনি প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার চেয়ার কিভাবে উল্টে গেল!’ তাকে বেশ হতাশ মনে হলো। বললেন, ভাই নির্বাচন নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে।
আগামী নির্বাচনে কী হবে সে সম্পর্কে এমন চিন্তা আর নানা কৌতূহল শুধু তার মতো বিএনপি নেতাকর্মীদেরই নয়, বেশির ভাগ মানুষের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে। সুষমা স্বরাজের সফর এ ক্ষেত্রে কৌতূহলের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। আর এই সফর নিয়ে মানুষের মধ্যে গুঞ্জন ছিল প্রধান বিচারপতি ও নির্বাচন নিয়ে নিশ্চয়ই ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ কোনো বার্তা পাবে। সুষমা স্বরাজ তার সফরে প্রকৃতপক্ষে ঢাকাকে কী বার্তা দিয়ে গেলেন সে বিষয়টি পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। তবে কিছু কিছু বিষয় যে একেবারে পরিষ্কার হয়নি, তাও কিন্তু নয়।
সুষমা স্বরাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। গণমাধ্যমে এসেছে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে ভারতের জোর সমর্থন লাভের বিষয়ে একটি আশ্বাস পাওয়া গেছে। তিনি বলেছেন, ‘মিয়ানমারের নাগরিকদের দেশে ফেরাতেই হবে।’ তার এই বলা মানে ব্যক্তি সুষমার বলা নয়, ভারতের মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয় সুষমা স্বরাজ তার আলোচনায় একটি বারের জন্যও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি। তিনি উচ্চারণ করেছেন ‘রাখাইনের বাস্তুচ্যুতরা’ শব্দটি। অর্থাৎ মিয়ানমারের নীতিরই প্রতিফলন ঘটেছে। মিয়ানমার তাদের রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকার করে না। তা ছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে সুষমার যে বক্তব্যটি প্রেসে এসেছে, তা সরাসরি তার মুখ থেকে শোনা যায়নি, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিবের বরাতে এসেছে। ফলে এ নিয়ে ভারত কতটা সিরিয়াস তা দেখার জন্য আরো অপেক্ষা করতে হবে। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ব্যাপারে সুষমা কোনো কিছু আলোচনা করেছেন কি না এ নিয়ে কিছুই কোথাও উল্লিখিত হয়নি। দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোয়াজ্জেম আলী ভারতীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, ছুটি শেষ করে পদে যোগ দিতে পারবেন প্রধান বিচারপতি। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যেখানে বললেন, প্রধান বিচারপতি পদে ফেরা সুদূরপরাহত, সেখানে কয়েক দিন পর মোয়াজ্জেম আলীর এ বক্তব্যে বোঝাই যাচ্ছিল বিষয়টি ভারত স্বাভাবিকভাবে নেয়নি বলেই তাকে এটা বলতে হয়েছে। তা ছাড়া মোয়াজ্জেম আলী নিজ থেকে নিশ্চয়ই এই স্পর্শকাতর বক্তব্য দেননি, নির্দেশিত হয়েই তাকে এ বক্তব্য দিতে হয়েছে। সে জায়গায় ঢাকায় এসে সুষমা স্বরাজ বিষয়টি তুলবেন না তা কেউই মানতে নারাজ।
নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এর বেশি কিছু সরকারের তরফে বলা হয়নি। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলোচনার অনেক কিছু প্রকাশ পেয়েছে। একটি বক্তব্য এসেছে যে, সুষমা স্বরাজ বলেছেন বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু হোক ভারত তা দেখতে চায়। এ বক্তব্য এসেছে বিএনপি মহাসচিবের তরফে। ভারত এটা চাইলে তো ভালো কথা। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের কাছ থেকে এর বেশি কিছু আশা করে না। ভারত নির্বাচনে হস্তক্ষেপ না করে নিরপেক্ষ থাকলেই হলো। তবে এ আলোচনায় একটি বিষয় লক্ষ করা গেছে যে, সুষমা স্বরাজ নিজে বলার চেয়ে আগামী নির্বাচন সম্পর্কে বিএনপি চেয়ারপারসন ও অন্য নেতাদের কাছ থেকে জানার চেষ্টাই বেশি করেছেন। তিনি তাদের দেশে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের উদাহরণের কথা বলেছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন তাকে বারবার বোঝাতে চেয়েছেন ভারতের নির্বাচন আর বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা এক নয়। ভারতে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হয় না। ভারতের নির্বাচন কমিশনের মতো বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন স্বাধীন নয়।
এ আলোচনায় এটাই বোঝা যায়, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ আলোচনার সূত্র ধরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একটি সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করেছেন। পরদিনই তিনি বলেন, সহায়ক সরকার নিয়ে সুষমার সমর্থন পায়নি বিএনপি। এর অর্থ দাঁড়ায়, তিনি বলতে চেয়েছেন শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে সুষমার সমর্থন রয়েছে, তা কিন্তু নয়। সুষমার এ ধরনের আশ্বাসের বাণী কোথাও উদ্ধৃত হয়েছে তা আমরা দেখিনি। এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব সুস্পষ্টভাবেই গণমাধ্যমকে বলে দিয়েছেন, তাদের দল এ আশা করেনি যে, কেউ এসে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে যাবে। তিনি বলেন, আমরা কারো কাছে দয়ার ভিক্ষা করি না যে আমাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দাও। অধিকার সংগ্রাম করেই আদায় করতে হয়। ওবায়দুল কাদেরকে উদ্দেশ করে তিনি প্রশ্ন করেছেন, আপনারা সেনা মোতায়েন করতে দেবেন না, সহায়ক সরকার করতে দেবেন না, সংসদও বহাল রাখবেন- তাহলে নির্বাচন করার দরকার কী?
‘বিএনপি মহাসচিব উচিত কথাই বলেছেন। ক্ষমতাসীনেরা বিনা ভোটের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বাইরে চিন্তা করতে পারছেন না। পরে পৌর, সিটি করপোরেশন, উপজেলা ও ইউপি নির্বাচনগুলো কিভাবে হয়েছে ভোটাররা তা প্রত্যক্ষ করেছেন। ভোট শুরুর আগেই ৬০ শতাংশ ভোট কাস্ট করে ফেলা হয় অর্থাৎ আগের রাতেই ভোটের বাক্স ভর্তি করার খারাপ নজিরের কথা কে না জানে?
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির তিক্ত অভিজ্ঞতা সবার জানা। বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে- ওবায়দুল কাদের এটা আশা করেন কিভাবে? বিনা ভোটের আরেকটি নির্বাচনী প্রহসন হোক এটা কেউই সম্ভবত চাইবে না। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে বিষয়টি কিছুটা হলেও পরিষ্কার হয়েছে যে, ভারতও দেখতে চায় বাংলাদেশে একটা ভালো নির্বাচন হোক।
ভারত বাংলাদেশে তাদের স্বার্থের বিষয়টি অবশ্যই দেখবে। তবে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যেভাবে নগ্ন হস্তক্ষেপ করেছিল, সে ধরনের হস্তক্ষেপ আগামী নির্বাচনেও যে হবে, সুষমা স্বরাজের কথাবার্তায় অন্তত এমনটা মনে হয়নি। বাংলাদেশের মানুষও নির্বাচনে প্রতিবেশী ভারতের নিরপেক্ষ ভূমিকার বেশি কিছু আশা করে না। সুজাতা সিংয়ের মতো কাউকে পাঠিয়ে ভারতের বর্তমান নেতৃত্বও নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করুক- বাংলাদেশের মানুষ এটা দেখতে চায় না। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও আবার বিনা ভোটের প্রহসন চেয়ে চেয়ে দেখবে- এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। এবার নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সঙ্গে উল্লেখযোগ্য কোনো দেশের নেতৃবৃন্দের বৈঠক হয়েছে এমন খবর আমরা দেখিনি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এটাও একটা বার্তা।
সুজাতা সিংয়ের সেই মিশন
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভারত সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছিল। তখন ভারতের ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। এই হস্তক্ষেপে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং। তিনি নির্বাচনে মনোনয়পত্র প্রত্যাহারের কয়েক দিন আগে ঢাকায় ২৬ ঘণ্টার এক ঝটিকা সফরে আসেন বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমান নিয়ে। তার এই ঝটিকা সফরে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সম্ভাবনা ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। তিনি নানা জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করে চাপ সৃষ্টি করেন। বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং জাতীয় পার্টি নেতা এরশাদের সঙ্গে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকটি ছিল শুধুই সৌজন্যমূলক একটি বৈঠক। এরশাদের সঙ্গে বৈঠকটি ছিল তাকে একতরফা নির্বাচনে আনতে বাধ্য করার। সুজাতা সিং কী কী চাপ দিয়েছিলেন তা গণমাধ্যমে ফাঁস করেও দিয়েছিলেন এরশাদ।
৫ ডিসেম্বর ২০১৩ দৈনিক প্রথম আলোর ‘নির্বাচনে যেতে জাতীয় পার্টিকে উৎসাহ জুগিয়েছেন সুজাতা সিং’ শীর্ষক খবরই এর প্রমাণ। সেটা হলো : ‘জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ বলেন, দেশের যে অবস্থা তাতে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। সুজাতা সিং তাকে বলেছেন, জাপা নির্বাচনে না গেলে যদি অন্য কোনো দল জয়ী হয়, তাহলে জামায়াতের উত্থান হবে। আমি বলেছি যদি জামায়াতে ইসলামীর উত্থান হয়, তাহলে তার জন্য দায়ী শেখ হাসিনার সরকার। সুজাতা সিং বলেন, হাসিনা অনেক ভালো কাজ করেছেন। জবাবে আমি বলেছি, হ্যাঁ, অনেক ভালো কাজ করেছেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছেন। কিন্তু রাজনীতি ঠিক করেননি। সব খাতকে হত্যা করেছেন। দেশের মানুষ উনার পক্ষে নেই আজ। সুজাতা বলেন, মনোনয়ন প্রত্যাহারের এখনো সময় আছে। দেখেন পরিস্থিতির উন্নতি হয় কি না। উনাদের ইচ্ছা একতরফা নির্বাচনটিই হোক। তিনি আমাকে চাপ দেন আপনাকে নির্বাচন করতেই হবে।’
৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ। ৩ ডিসেম্বর ২০১৩ এই ঘোষণা দিয়ে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। তিনি জাপার সব মন্ত্রী এবং উপদেষ্টাকে পদত্যাগ এবং প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারেরও নির্দেশ দেন। ২৬ ঘণ্টা আত্মগোপনে থেকে তিনি ৪ ডিসেম্বর সুজাতা সিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের পর সুজাতা সিংয়ের চাপের কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ করে দেয়ার পর র্যাব-পুলিশ তার বাসা ঘিরে ফেলে। তিনি হুমকি দেন তাকে গ্রেফতার করার চেষ্টা হলে আত্মহত্যা করবেন। কিন্তু র্যাব-পুলিশ কৌশলে তাকে বাসা থেকে তুলে সিএমএইচে নিয়ে যায় এবং আটকে রাখে।
নির্বাচনে প্রণব মুখার্জির হস্তক্ষেপ
বাংলাদেশের ১৯৯৬, ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার যে নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করেছে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য তাদেরই যে ইঙ্গিত ছিল সে কথা স্বয়ং ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি স্বীকার করেছেন।
বাংলাদেশের মানুষের মনে বদ্ধমূল একটি ধারণা ছিল যে, প্রণব মুখার্জি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করছেন। কিন্তু এর প্রামাণ্য কোনো সূত্র ছিল না। প্রণব মুখার্জি নিজেই আড়ালের সেই সত্য প্রকাশ করে দিয়েছেন।
প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস ১৯৯৬-২০১২’ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এই বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ ভারতের ইন্ডিয়া টুডে সাময়িকীতে প্রকাশ পায়। এর ভিত্তিতে খবরটা বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়। প্রণব মুখার্জি তার বইয়ে লিখেন- ‘২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ ছয় দিনের সফরে ভারতে আসেন। এ সময় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। অনানুষ্ঠানিক আলোচনার সময় আমি তাকে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির বিষয়ে গুরুত্ব বোঝাই। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন যে, শেখ হাসিনা বের হয়ে আসার পর তাকে চাকরিচ্যুত করতে পারেন। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্ব নিই। তাকে আশ্বস্ত করি শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে তিনিই বহাল থাকবেন।’ তিনি আরো লিখেন, ‘শেখ হাসিনা আমাদের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে একটি নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির মাধ্যমে ভারত তার দাবি পূরণে সহায়তা করার চেষ্টা করেছে।’ তিনি আওয়ামী লীগের গৃহবিবাধ নিরসনেও যে ভূমিকা রাখেন সে কথা লিখেছেন তার বইয়ে। তিনি লিখেন- ‘শেখ হাসিনা কারাগারে থাকাকালে কিছু নেতা তাকে পরিত্যাগ করলে আমি তাদের ভর্ৎসনা করে বলি, কেউ যখন এমন বিপদে থাকে, তখন তাকে ত্যাগ করা অনৈতিক। ২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচন হয়। শেখ হাসিনা বিপুল বিজয় পান।’
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন