‘আমরা যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকে হয়তো ৫০ কিংবা ৬০ গজ দূরে বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন। সেখান থেকে আমাদের কাছে আসতে তার অনেকক্ষণ সময় লেগেছে। দুইজন তাকে ধরে ধরে আনতে হয়েছে। আমরা খালেদা জিয়ার সাথে কথা বলেছি। তিনি ঘাড়ে, বাঁ-হাতে ও পায়ে ব্যথা অনুভব করছেন। তার হাত ঝিমঝিম করে। তিনি আগে যেসব ওষুধ সেবন করতেন, তার সাথে আরো কিছু ওষুধ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রক্ত ও এক্স-রে পরীক্ষা করতে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি, তাকে ব্যায়াম করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সর্বোপরি তিনি অসুস্থ, তবে গুরুতর নয়।’
ঢাকার নাজিমুদ্দীন রোডের পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ, অসুস্থ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে দেখে এসে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চার সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক ডা: মো: শামসুজ্জামান শাহীন বিবিসি বাংলাকে এ বর্ণনা দিয়েছেন। তার এই বর্ণনা দৈনিক প্রথম আলো, নয়া দিগন্তসহ জাতীয় দৈনিকগুলোকে প্রকাশিত হয়েছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের প্রধান এই চিকিৎসক, অধ্যাপক শামসুজ্জামান শাহীন আরো বলেন, খালেদা জিয়ার অসুস্থতা আগেও ছিল। এখন বেড়েছে। তবে তা খুব মারাত্মক নয়, গুরুতর পর্যায়ে যায়নি।
চার সদস্যের এই মেডিক্যাল বোর্ড ১ এপ্রিল রোববার কারাগারে গিয়ে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাপত্রও দেন। মেডিক্যাল বোর্ডের অন্য সদস্যরা হলেন- ঢাকা মেডিক্যালের নিউরোলজি বিভাগের প্রধান ডা: মনসুর হাবীব, ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের প্রধান ড. সোহেলী রহমান এবং ইন্টারনাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা: টিটো মিয়া। বেগম জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পর্কে জানাতে ২ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সাংবাদিকেরা যথারীতি সংবাদ সংগ্রহের জন্য সেখানে উপস্থিত হন; কিন্তু সংবাদ সম্মেলনটি আর হয়নি। ঢাকা মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের কোনো তথ্য দেননি। হাসপাতালের উপপরিচালক শাহ আলম তালুকদার সাংবাদিকদের জানিয়ে দেন, মেডিক্যাল বোর্ডের প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষের কাছে আসেনি। ওইদিন বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, মেডিক্যাল বোর্ড তাদের এই প্রতিবেদন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দেয়ার পর সেটা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানান, মেডিক্যাল বোর্ডের লিখিত প্রতিবেদন না পেলেও মৌখিকভাবে জানতে পেরেছেন, খালেদা জিয়া তেমন অসুস্থ নন। যেসব সমস্যা দেখা যাচ্ছে তা আগে থেকেই তার ছিল।
অবশেষে মঙ্গলবার ৩ এপ্রিল চার সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড তাদের প্রতিবেদন দিয়েছেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই প্রতিবেদন কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছে। প্রতিবেদন সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানান, মেডিক্যাল বোর্ড খালেদা জিয়ার রক্ত পরীক্ষা ও এক্স-রে করার জন্য সুপারিশ করেছে। মেডিক্যাল বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়া হবে। সরকারি বরাতে এতটুকু তথ্য গণমাধ্যমে জানানো হলেও বিশ্বস্ত সূত্রে আরো জানা গেছে, মেডিক্যাল বোর্ড কারাগারে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যসম্মত খাট এবং বিছানা সরবরাহেরও সুপারিশ করেছে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, এতদিন খালেদা জিয়াকে যে খাট ও বিছানা দেয়া হয়েছিল সেটা সম্ভবত তার থাকার উপযোগী ছিল না। এতে তার ঘুমেরও নিশ্চয় ব্যাঘাত ঘটেছে।
গত ২৭ মার্চ বুধবার জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার শুনানির দিন বকশিবাজার আলিয়া মাদরাসা মাঠের আদালতে খালেদা জিয়াকে হাজির করানো হয়নি। কারা কর্তৃপক্ষ সেদিন আদালতকে জানান, খালেদা জিয়া অসুস্থ থাকায় তাকে হাজির করা যায়নি। পরদিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাথে তার সাক্ষাৎও স্থগিত করা হয়। এ অবস্থায় বেগম জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে দেশের জনগণ এবং দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে। তাকে উন্নত চিকিৎসা দেয়ার দাবি ওঠে। খালেদা জিয়া দেশের একজন শীর্ষ রাজনীতিবিদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী, জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসন এবং প্রধান বিরোধী জোটনেত্রী। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রতিদিনই স্বাস্থ্য বুলেটিন প্রকাশ হওয়ার কথা; কিন্তু সরকারি মহল থেকে বুলেটিন প্রকাশ করা তো দূরের কথা, তার স্বাস্থ্য নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হলো। তিনি ‘অসুস্থ নন’ বলে সরকারি মহল থেকে প্রচার করা হয়। চিকিৎসকদের পরীক্ষার আগেই সরকারের মন্ত্রীরা বলতে থাকেন, তার কিছুই হয়নি। এ ক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে গিয়ে কথা বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া সুস্থ আছেন।’ তার এই বক্তব্যে সাধারণ নাগরিকদের মন্তব্য ছিলÑ কী অসাধারণ ডাক্তার ওবায়দুল কাদের!
খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে এ ধরনের বিতর্কের মুখে শেষ পর্যন্ত সরকার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের নিয়ে একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে। বোর্ড গঠনের পরপরই ওবায়দুল কাদের আবার বলে দেন, চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানো হবে। তার এই বক্তব্যে নতুনভাবে সন্দেহের সৃষ্টি হয় যে, তাহলে সরকার কি তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার কোনো দুরভিসন্ধি করছে? এ নিয়েও বিতর্ক চলে। এমনি এক অবস্থায় মেডিক্যাল বোর্ড খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন করে সুপারিশ দিয়েছে। মেডিক্যাল বোর্ডের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাপত্র খালেদা জিয়া অবশ্য গ্রহণ করেননি। তিনি তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নতুন ব্যবস্থাপত্রে দেয়া ওষুধ সেবন করবেন না বলে জানিয়েছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার থেকে জানানো হয় যে, খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসককে কারাগারে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হতে পারে। তাছাড়া কারাগারের বাইরে খালেদা জিয়াকে মেডিক্যাল বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী যেকোনো একটি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে নেয়া হতে পারে। বর্তমানে তিনি কারো সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারছেন না। আগের সমস্যাগুলো আরো বেড়েছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে আরো জানা গেছে, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা এখন খুবই দুর্বল। কারারুদ্ধ হওয়ার পর গত দুই মাসে তার স্বাস্থ্য অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। জীবনসায়াহ্নে ৭৩ বছর বয়সের এই রাজনীতিক কারাগারে যে অমানবিকতা ও নির্মমতার শিকার হচ্ছেন, অনেকেই এটাকে আখ্যায়িত করেছেন নজিরবিহীন হিসেবে। নাজিমুদ্দীন রোডের পরিত্যক্ত এই কেন্দ্রীয় কারাগার এমনিতেই জনমানবহীন এবং স্যাঁতসেঁতে। একজন সাধারণ সুস্থ মানুষকে ওই পরিবেশে রাখলে তারও অসুস্থ হয়ে যাওয়ার কথা। সেখানে রাখা হয়েছে, বেগম খালেদা জিয়ার মতো একজন ৭৩ বছর বয়সের প্রবীণ রাজনীতিককে। তিনি দীর্ঘ দিন ধরে শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন। তার হাঁটুতে দুই বার অপারেশন করা হয়েছে; একবার আমেরিকায়, অন্যবার সৌদি আরবে। এ ছাড়া লন্ডনে তার চোখের অপারেশন হয়েছে। তার ঘাড় এবং কোমরেও সমস্যা আছে। তিনি ডায়াবেটিসেরও একজন রোগী। এমন একজন অসুস্থ প্রবীণ রাজনৈতিক নেত্রীকে জনমানবহীন পরিত্যক্ত কারাগারে দিনের পর দিন রাখা হলে তার অবস্থা কী দাঁড়ায়, তা সহজেই অনুমেয়। স্বাস্থ্যসম্মত খাট ও বিছানা সরবরাহের সুপারিশ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, কারাগারে তাকে তার প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে।
মেডিক্যাল বোর্ডের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। গণমাধ্যমে এখন পর্যন্ত যতটুকু তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে এবং বিবিসির কাছে বোর্ডের প্রধান খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা কি উদ্বিগ্ন হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়া তেমন অসুস্থ নন। অন্য দিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়ার অসুস্থতা বড় কিছু নয়। এ কথা বলে তারা কী বুঝাতে চাচ্ছেন? তারা কি বেগম জিয়ার আরো বড় অসুস্থতা কামনা করছেন? খালেদা জিয়াকে তারা কি মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে চান? তিনি হতে পারেন অন্য একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেত্রী। তিনি তো একজন রাজনীতিবিদ। একজন রাজনৈতিক সহকর্মীর প্রতি এ কেমন আচরণ? রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়ার এ কী তৎপরতা? রাজনৈতিক সহকর্মীর প্রতি কি কোনো মায়া দয়া থাকতে নেই?
আওয়ামী লীগের নেতাদের সমীপে বলতে চাই, আপনারাও তো রাজনীতিবিদ। আজ বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি আপনারা যে নির্মমতা দেখাচ্ছেন, সেটা কেন? দেশের প্রতি কি তার কোনো অবদান নেই? আপনাদের জানার জন্য বলছি, এই সেই খালেদা জিয়া যার স্বামী জিয়াউর রহমান একাত্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এই সেই খালেদা জিয়া যিনি নিজেও মুক্তিযুদ্ধের সময় অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। দু’টি কোলের শিশুকে নিয়ে বন্দিশিবিরে দুঃসহ দিন কাটিয়েছেন। এই সেই খালেদা জিয়া যিনি নিরিবিলি পারিবারিক জীবন বিসর্জন দিয়ে, ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে জনগণের আহবানে সাড়া দিয়ে তাদের কল্যাণে রাজনৈতিক জীবন বেছে নিয়েছিলেন। এরপর দীর্ঘ নয় বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছেন। এই সেই খালেদা জিয় যিনি বাংলাদেশের সর্বত্র ঘুরে ঘুরে মানুষের দুঃখ কষ্টের সঙ্গী হয়েছেন। ক্ষমতায় এসে এসব দুঃখ কষ্ট লাঘবে সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন। হাজার হাজার তরুণ যুবকের চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ কালভার্ট, কৃষি ও শিল্পের উন্নয়ন করেছেন। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করেছেন। দেশের জন্য তিনি তার প্রিয়তম স্বামীকে হারিয়েছেন, সন্তানকে হারিয়েছেন, আরেক সন্তানের পঙ্গুত্ব এবং নির্বাসিত জীবনের যন্ত্রণা সহ্য করছেন। তার পারিবারিক জীবন বলতে এখন আর কিছু নেই। নিজের বাড়িটি পর্যন্ত হারিয়েছেন। পুত্রবধূ নাতনিদের সান্নিধ্য থেকেও বঞ্চিত। তিনি আজ জীবন সায়াহ্নে। এমন একজন রাজনীতিবিদের প্রতি কেন এই অমানবিকতা?
কয়েক দিন আগে লঞ্চে বরিশাল গিয়েছিলাম। সুন্দরবন-১০ লঞ্চটি ধরার জন্য বকশিবাজারের বাসা থেকে সদরঘাটের উদ্দেশে যাচ্ছিলাম। সন্ধ্যায় বকশিবাজারে কোনো যানবাহন পাচ্ছিলাম না। তাই হেঁটেই নাজিমুদ্দীন রোডের পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারের দিকে রওনা হই। কারাগারের উত্তর দিকের দেয়াল যেখানে শুরু, পুলিশ সেখানটায় ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে। কোনো যানবাহন যেতে দেয়া হয় না। তবে হেঁটে যাওয়া যায়। কারাগারের প্রধান গেটের সামনে গিয়ে থমকে গেলাম। চার দিকে এক ভুতুড়ে পরিবেশ। ওখানে ফ্লাড লাইটের আলো জ্বলত। ছিল অসংখ্য স্ট্রিট লাইট; কিন্তু দেখলাম, কোথাও কোনো আলো নেই। ফ্লাড লাইট ও স্ট্রিট লাইট নিভিয়ে রাখা হয়েছে। বিরাজ করছে ঘন অন্ধকার আর সুনসান নীরবতা। বাইরে দাঁড়িয়ে আমার ভয় ভয় লাগছিল। ভেবে পাচ্ছিলাম না-খালেদা জিয়ার মতো সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রী, একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ এবং সর্বোপরি, একজন প্রবীণ মহিলাকে কি নির্দয়ভাবে এই নির্জন, পরিত্যক্ত, স্বাস্থ্যের অনুপোযোগী অন্ধকার কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে। প্রতিহিংসা কোন পর্যায়ে গেলে একজন মানুষকে এমন কষ্টের শিকার হতে হয়!
তাই আজ যখন খালেদা জিয়া কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তখন তাকে নিয়ে দেশবাসীর সাথে আমারও খুব ভয় হচ্ছে। তার চিকিৎসার বিষয় নিয়ে হেলাফেলা করলে না জানি, কী অঘটন নেমে আসে সেই শঙ্কা হচ্ছে।
উন্নয়নের জেয়ারের কথা আজ ঢাকঢোল পিটিয়ে বলা হচ্ছে; কিন্তু আমাদের প্রিয় এই বাংলাদেশ যে অতলে তলিয়ে যাচ্ছে আমরা কি সে খবর রাখছি? ভেতরে ভেতরে এই দেশ কিন্তু নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ আজ কৃষ্ণগহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আগে সরকারি ব্যাংকের দুর্নীতির কথা শোনা যেত। বর্তমানে সরকারি ব্যাংকই নয়, সরকারি-বেসরকারি উভয় ব্যাংকই লুট হয়ে যাচ্ছে। শেয়ারবাজার লুট আগেই হয়েছে। আরেকবার লুট হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গণতন্ত্রের জায়গায় দেশ আজ স্বৈরতন্ত্রের কবলে। বাংলাদেশ যে স্বৈরতান্ত্রিক দেশে পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবেও তা আজ স্বীকৃত! নির্বাচনীব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। বিচার বিভাগ, প্রশাসন ধ্বংস হয়ে গেছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত করে গণমাধ্যমকে একমুখী করে ফেলা হয়েছে। বিরোধী দল ও বিরোধী মতকে স্তব্ধ করে দিয়ে একদলের কর্তৃত্ববাদী শাসন চালানো হয়েছে। খালেদা জিয়াকে আজ কথিত দুর্নীতির অভিযোগে কারাদণ্ড দিয়ে জেলে রাখা হয়েছে, অন্য দিকে দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। কেউ যেন দেখার নেই। পুরো দেশই যেন পরিণত হয়েছে লুটের স্বর্গরাজ্যে।
দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ে তোলার জন্য স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খালেদা জিয়ার সরকার। আজ সেই দুদক সরকারের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। প্রায় বারো বছর ধরে বিএনপি সরকারে নেই; কিন্তু দুদক ব্যস্ত বিএনপির নেতাদের ফাঁসানোর কাজে। তাদের চোখের সামনেই পাহাড় পরিমাণ দুর্নীতি হচ্ছে। দুর্নীতির অঙ্ক শত কোটির ঘরে আজ নেই, হাজার হাজার কোটি টাকার অঙ্কে দুর্নীতি হচ্ছে। দুদক তা দেখছে না। সরকারের পুতুল হয়েই কাজ করছে। খালেদা জিয়ার সাজা কিভাবে বাড়ানো যায়, বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের জেলে নেয়া যায়, সরকারকে কিভাবে আরেকটি প্রহসনের নির্বাচনে সহযোগিতা করা যায় সেটাই এখন দুদকের কাজ। বেগম জিয়ার আইনজীবীরা ইতোমধ্যে অভিযোগ করেছেন উচ্চ আদালতে তার জামিন নিয়ে যে উদাহরণ সৃষ্টি করা হয়েছে, তা নজিরবিহীন। এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে জামিন সহজেই হয়ে যায়; কিন্তু খালেদা জিয়াকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। দুদককে দিয়ে খালেদা জিয়ার সাজা বাড়ানোর লিভ টু আপিল দায়ের করানো হয়েছে।
এই লিভ টু আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তিনি জামিন পাচ্ছেন না। অর্থাৎ কতদিন পর তিনি জামিন পাবেন, আদৌ পাবেন কিনা, কেউ জানে না। আমরা জানি না ‘গণতন্ত্রের মা’ হিসেবে দেশের জনগণের হৃদয়ে আছেন যে নেত্রী, সেই প্রিয় খালেদা জিয়ার ভাগ্যে আরো কী নির্মমতা অপেক্ষা করছে। দেশের অগণিত মানুষের সাথে আমিও তার কল্যাণ চাই, মুক্তি চাই। আজ তাকে নাজিমুদ্দীন রোডের পরিত্যক্ত কারাগারে বন্দী করে রাখার মাধ্যমে গণতন্ত্রকেই বন্দী করে রাখা হয়েছে। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার মাধ্যমে কারাগারে বন্দী গণতন্ত্রকেও আজ মুক্ত করতে হবে। দেশের যে আজ দুর্দশা, সে অবস্থা থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে বেগম খালেদা জিয়াকে প্রয়োজন হবে। তিনি যেন বেঁচে থাকতে পারেন সেজন্য মহান আল্লাহর রহমত কামনা করছি। দেশের স্বার্থেই খালেদা জিয়ার দীর্ঘায়ু চাই। দেশকে বাঁচাতে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে তাই অবিলম্বে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে তার সুচিকিৎসার পথ সুগম করা হোক।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাতীয় প্রেস ক্লাব।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন