|
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
test@gmail.com |
|
ফেব্রুয়ারি ও মার্চ ॥ বাংলার মানুষের জীবনে দুটি সহোদর মাস
11 March 2017, Saturday
ফেব্রুয়ারি মাসকে যদি বলা হয় আমাদের ভাষার মাস। তাহলে মার্চ মাস কি আমাদের স্বাধীনতার মাস? আমরা বলি, ভাষা আন্দোলনই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রসূতি। তাহলে ফেব্রুয়ারি ও মার্চের সম্পর্কটা কী দাঁড়াল? জননী ও সন্তানের কি? আমি বলি ফেব্রুয়ারি ও মার্চ দুই সহোদরা। একে অন্যের পরিপূরক। ভাষা আন্দোলন থেকে যেমন বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত; তেমনি স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যবোধ থেকেই বাঙালির ভাষা আন্দোলনের বিকাশ।
প্রাচীন বাঙালি কবিদের কণ্ঠে একই সঙ্গে স্বাধীনতা আর ভাষার গান ধ্বনিত হয়েছে। এক কবি গেয়েছেন, ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়’, তারই প্রায় সমসাময়িক আরেক কবি গেয়েছেন, ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা।’ এই ভাষাতেই কবিতা লিখে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার জয়ী হয়ে বিশ্বসভায় বাংলা ভাষাকে দাঁড় করিয়েছেন। আবার এই ভাষাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে উত্তাল জনসমুদ্রের সামনে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন।
ফেব্রুয়ারি ও মার্চ এ দুটি মাসেরই গুরুত্ব স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের জীবনে তাই অপরিসীম। ফেব্রুয়ারি বাঙালিকে তার ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তার শিকড়ে পৌঁছে দিয়েছে। মার্চ মাস সেই শিকড়কে একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের ভৌগোলিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে। ইউরোপের মানুষ যেমন ফরাসি, জার্মান, ইতালিয়ান ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত হতে পারে, কিন্তু তাদের সামগ্রিক পরিচয় ইউরোপিয়ান; বাঙালিরাও তেমনি আজ নানা রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে চিহ্নিত হতে পারে, কিন্তু তাদের সামগ্রিক পরিচয় বাঙালি।
বাঙালিত্ব আমাদের কালচারাল নেশনহুড বা সাংস্কৃতিক জাতীয়তা। এই লোকায়ত সাংস্কৃতিক জাতীয়তার স্রোত হাজার বছর ধরে বহমান। কোনো প্রতিকূলতাই এ স্রোত বন্ধ করতে পারেনি। পারেনি প্রাচীনকালের ব্রাহ্মণ্য শাসকরা, পারেনি পাকিস্তান আমলের অবাঙালি শাসকরা। ভাষা আন্দোলনের গর্ভ থেকেই জন্ম মুজিব নেতৃত্বের। তিনি একুশের ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যেমন নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনি নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বাধীনতার যুদ্ধেও। মার্চ মাসে আমাদের স্বাধীনতার জন্ম। আবার এ মার্চেই স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবেরও জন্ম।
এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস সদ্য বিদায়ী। মার্চ মাস সদ্য শুরু হয়েছে। চৈত্রের দাবদাহ চলছে। তার ঝরা পাতায় রুদ্র বৈশাখের আগমনবার্তা শোনা যায়। কালবোশেখি এলো বলে। লণ্ডভণ্ড করবে অনেক মানুষের ঘর। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসকে তুলনা করা চলে একটা প্রচণ্ড কালবোশেখির লণ্ডভণ্ড করা ঝড়ের সঙ্গে। ফাল্গ–নের কৃষ্ণচূড়ার মতো রক্তলাল হয়ে গিয়েছিল বাংলার মাঠ-ঘাট-প্রান্তর। ৩ মার্চ নবনির্বাচিত পার্লামেন্টের অধিবেশন মুলতবি করা সম্পর্কে ইয়াহিয়ার এক ঘোষণার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা নগরী। ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় অসহযোগ আন্দোলনের। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বজ্র কণ্ঠে ধ্বনিত হল, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
একুশে ফেব্রুয়ারির একটি ঘটনায় মাসটি যেমন একটি ইতিহাস হয়ে গেছে তেমনি সাত মার্চের ওই একটি ঘোষণায় মার্চ মাসটি বাংলাদেশের মানুষের জীবনে অমরত্ব লাভ করেছে। এ মাসের ১৭ তারিখে বঙ্গবন্ধুর জন্ম। ২৫ মার্চের রাতে একাত্তরের সেই কালরাত্রি। যে রাতে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী নির্মম গণহত্যা শুরু করেছিল। হত্যা করেছিল সেরা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের। যে হত্যা নিয়ে গান রচিত হয়েছে, ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’। আবার ২৬ মার্চ গ্রেফতার হওয়ার আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন স্বাধীনতার। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে সেই ঘোষণা প্রথম প্রচার করেন প্রয়াত জননেতা আবদুল হান্নান। তারপর পাঠ করেন তৎকালীন বাঙালি মেজর জিয়াউর রহমান। এমনি করে ২৬ মার্চ হয়ে গেল আমাদের স্বাধীনতা দিবস।
রক্ত ঝরানো ফেব্রুয়ারি এবং রক্তস্নাত মার্চ। একই বাঙালির অশ্রু ও রক্তে সিক্ত মাস দুটি হয়ে গেল যেন দুই সহোদরা। ফেব্রুয়ারি গেছে, মার্চ এসেছে। বাঙালি হাসছে এবং কাঁদছে। হাসি স্বাধীনতা অর্জনের আনন্দে। কান্না এই স্বাধীনতার জন্য ত্রিশ লাখ নর-নারীর আত্মদানের কথা স্মরণ করে। উপমহাদেশের তিনটি দেশ- বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শেষোক্ত দুটি দেশ স্বাধীনতা পেয়েছে বিদেশী শাসকদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলোচনার বৈঠকে বসে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে সশস্ত্র সংগ্রামের দ্বারা। এখানেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বৈশিষ্ট্য। প্রতি বছর মার্চ মাসে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের এ বৈশিষ্ট্যের কথা আমরা স্মরণ করি।
এখন প্রশ্ন, সশস্ত্র সংগ্রাম এবং ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, তার বৈশিষ্ট্য আমরা রক্ষা করতে পেরেছি কিনা? ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য এই যে, ভারত ও পাকিস্তানের বৈশিষ্ট্য ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে স্বাধীনতা লাভের। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বৈশিষ্ট্য ধর্মীয় বিভাজনকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে জাতিসত্তা এবং স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গঠন।
এর ফলে বাংলাদেশের মুসলমানের কয়েক শতকের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস বা পরিচয় সংকটের অবসান হয়েছিল। ‘আমরা প্রথমে মুসলমান, তারপর বাঙালি’ এ অবাস্তব পরিচয়ের মোহ কাটিয়ে উঠে বাঙালি মুসলমান ‘আমরা প্রথমে বাঙালি, তারপর মুসলমান’ এই নৃতাত্ত্বিক সত্যটি মেনে নিয়েছিল। ধর্ম দিয়ে যে জাতি-পরিচয় চিহ্নিত হয় না এ সত্যটি ইসলামের মহানবীও (সা.) প্রচার করেছিলেন। তিনি নিজেকে শুধু আরব নয়, মক্কার লোক বলে পরিচয় দিতেন। শত্রুদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সন্ধিপত্রে লিখতেন, ‘মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ আল আরাবি আল মক্কী’।
ব্রিটিশ ভারতে খেলাফত আন্দোলন পরিচালনাকালে মওলানা মোহাম্মদ আলী জওহর পরিচয় হয়েছিলেন ‘শেরে হিন্দ’ নামে, শেরে মুসলমান হিসেবে নয়। অনুরূপভাবে একে ফজলুল হকের উপাধি ছিল শেরেবাংলা, শেরে ইসলাম নয়। ইকবাল গান গেয়েছেন, ‘হিন্দুস্তান হামারা হায়’, পাকিস্তান বা ইসলামিস্তান হামারা হায় বলে গান লেখেননি। মানুষ ধর্ম পরিবর্তন করতে পারে। হিন্দু খ্রিস্টান হতে পারে, খ্রিস্টান মুসলমান হতে পারে। তাই বলে তার জন্মসূত্রে পাওয়া জাতি-পরিচয় বদলাতে পারে না। মাইকেল মধুসূদন দত্ত হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়েছিলেন। তাতে তার জাতি-পরিচয় মোছেনি। তিনি বাঙালি কবি বলেই পরিচিত রয়েছেন। ধর্ম পরিত্যাগ, ইংরেজ স্ত্রী গ্রহণ করে এবং ইংরেজিতে কবিতা লিখেও তিনি ইংরেজ কবি হতে পারেননি।
বাংলাদেশের মুসলমানদের এ সত্যটিই বুঝিয়েছিলেন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। সত্যটি হল, ‘আমরা প্রথমে বাঙালি, তারপর মুসলমান।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি এই সত্যটি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতাদের হত্যার পর এ সত্যটি মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে। পাকিস্তানমনা এক জেনারেল বন্দুকের সাহায্যে ক্ষমতা দখলের পর জাতির বাঙালি পরিচয়টি মুছে ফেলে বাংলাদেশী পরিচয়টিকে প্রতিষ্ঠাদানের চেষ্টা করেন।
এ চেষ্টার পেছনের উদ্দেশ্য ছিল আবার কৌশলে ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বে ফিরে যাওয়া। আসলে বাংলাদেশের মানুষের বাঙালি ও বাংলাদেশী পরিচয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। বাঙালি তার জাতি-পরিচয়। বাংলাদেশী তার নাগরিক-পরিচয়। এ দুটি পরিচয়ের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের মানুষের অসাম্প্রদায়িক বাঙালিত্ব ধ্বংস করে তাকে সাম্প্রদায়িক জাতীয়তায় ফিরিয়ে নিতে।
বাংলাদেশের মানুষের মনে আবার আত্মপরিচয়ের এ সংকট সৃষ্টি দ্বারাই তার পক্ষে স্বাধীনতার মূল্যবোধগুলো সম্পর্কে বিভ্রান্তি তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। দেশটিতে হিংস্র ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থানও সেজন্যই। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগোচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে তেমন এগোতে পারছে না স্বাধীনতার দ্বারা অর্জিত মূল্যবোধগুলোর ওপর সঠিকভাবে অবস্থান নিতে না পারায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রধান শত্রু দারিদ্র্য ও অভাব নয়; তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে। এ স্বাধীনতার প্রধান শত্রু তার অসাম্প্রদায়িক জাতি-পরিচয়ের ওপর অবিরাম আঘাত এবং এ পরিচয় ধ্বংস করার অবিরাম চক্রান্ত।
প্রতি বছর আমরা স্বাধীনতা দিবস পালন করি। কিন্তু স্বাধীনতার মূল শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতে পারি না। স্বাধীনতা দিবস তো পালন করেছে এই স্বাধীনতার শত্রু জামায়াত নেতারাও। তাদের গাড়িতে স্বাধীনতার পতাকাও উড়েছে। তাতে কি স্বাধীনতা দিবসের গৌরব বেড়েছে, না কমেছে? আওয়ামী লীগ ২০১৯ সালে আরেকটি নির্বাচন যুদ্ধে নামার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু তারা কি জানেন, শুধু নির্বাচন যুদ্ধে জয়ী হলেই চলবে না। তাদের জন্য একটি শেষ যুদ্ধ অপেক্ষা করছে। সেটি বাঙালিত্ব ও বাঙালির অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা রক্ষার শেষ লড়াই। শত্রুপক্ষ প্রস্তুতি চালাচ্ছে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকেও ঐক্যবদ্ধ প্রস্তুতি নিতে হবে। এ বছরের মার্চ মাস যেন এ সত্যটাই দেশপ্রেমিক সব বাঙালির মনে জাগ্রত করতে সক্ষম হয়।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন