|
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
test@gmail.com |
|
আওয়ামী লীগে বিদ্রোহী প্রার্থীদের এত সংখ্যাধিক্য কেন?
12 March 2017, Sunday
আওয়ামী লীগে বিদ্রোহী প্রার্থীদের এত সংখ্যাধিক্য কেন?
ওসমানীনগর ও জগন্নাথপুর এই দু’টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। নির্বাচনে জয়-পরাজয় আছেই। বহু দেশেই মধ্যবর্তী কোনো নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল পরাজিত হয়, তারপর সাধারণ নির্বাচনে আবার পূর্ববর্তী পরাজয় সামলে ওঠে। কিন্তু ওসমানীনগর ও জগন্নাথপুরের উপজেলা নির্বাচন এ জন্যই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে যে, এই দু’টি নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের কারণেই আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়েছে। এই দু’টি নির্বাচনই যেন ছিল আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ যুদ্ধ। এই আত্মঘাতী দ্বন্দ্বের ফল বিএনপি প্রার্থীদের জয়লাভ।
দু’টি উপজেলা নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের দুই বিদ্রোহী প্রার্থী দলের মনোনয়ন মেনে নেননি। তারা চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এবং দলীয় প্রার্থীসহ নিজেরাও পরাজিত হয়েছেন। দু’টি নির্বাচনের ঘোষিত ফল দেখে বোঝা যায়, বিদ্রোহী প্রার্থীরা না দাঁড়ালে আওয়ামী লীগের মূল প্রার্থী বিরাট ভোটের ব্যবধানে জয়ী হতেন। আওয়ামী লীগের ভোট ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ায় বিএনপি’র দুই প্রার্থী জয়ী হতে পেরেছেন।
এই ঘটনা যে আজ নতুন তা নয়, সাম্প্রতিক অতীতেও দেখা গেছে, উপজেলা, পৌরসভার নির্বাচন, এমনকি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেও আভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের দৌরাত্ম্যে আওয়ামী লীগ বহুক্ষেত্রে পরাজিত হয়েছে। এই অবস্থায় যে কোনো প্রতিকার ও পরিবর্তন হয়নি ওসমানীনগর ও জগন্নাথপুর- দু’টি উপজেলায় নির্বাচন তার প্রমাণ। এই অবস্থা যদি চলতে থাকে, তাহলে আগামী সাধারণ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের জয়ের আশা থাকা সত্ত্বেও কি ঘটবে বলা মুশকিল।
যে-কোনো বড় রাজনৈতিক দলেই আভ্যন্তরীণ কোন্দল, গোত্র ও গ্রুপবিবাদ থাকে। শীর্ষ নেতৃত্ব তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে দল রক্ষা পায়। ভারতে নেহেরু ও ইন্দিরা কংগ্রেসের নেতৃত্বে থাকাকালে দলে কোন্দল ছিল, কিন্তু মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। নির্বাচনের সময় বিদ্রোহী প্রার্থীরাও দাপট দেখাতে পারেনি। বর্তমানে কংগ্রেসের দুরবস্থা চলছে এবং নির্বাচনেও তারা সুবিধা করতে পারছে না। দলের ভেতরে নানা কোন্দল এবং উপদলীয় বিবাদ দূর করা যাচ্ছে না। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব এখন খুবই দুর্বল।
এদিক থেকে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ খুবই ভাগ্যবান দল। এই দলে শেখ হাসিনার শক্ত নেতৃত্ব রয়েছে এবং দলটিরও রয়েছে ঐক্যবদ্ধ থাকার একটা সুকঠিন নীতিগত ভিত্তি। সেটা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার দর্শন। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ কেন আভ্যন্তরীণ কোন্দলে এতটা জর্জরিত এবং নির্বাচন এলে দলে এত বিদ্রোহী প্রার্থী মাথা তুলতে সাহস পায়, সেই প্রশ্নটিও আজ বাস্তব অবস্থার নিরিখে বিচার করে দেখা উচিত। সামনেই আর বছর দেড়েক পর রয়েছে নির্বাচনী লড়াই। এই লড়াইয়ের জন্য এখন থেকে প্রস্তুতি না নিলে দলের ভেতরের বর্তমান আত্মসন্তোষের ভাব আত্মবিনাশের রাস্তা তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা এখন এক অপরাজেয় ব্যক্তিত্ব। তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বেছে নিয়েছেন দলের এক ত্যাগী সংগ্রামী কর্মী ওবায়দুল কাদেরকে। তাদের দু’জনকেই অনুরোধ জানাই, আওয়ামী লীগ নামক প্রাচীন বটবৃক্ষটিকে তারা সজীব রাখুন। বর্তমান সরকার যত শক্তিশালী হোক, আওয়ামী লীগ ততটা শক্তিশালী নয়। আর সংগঠনের শক্তি ছাড়া কোনো সরকার তার শক্তির ভিত্তি বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারে না। ভারতে কংগ্রেস সংগঠনের দুর্বলতার জন্যই কংগ্রেস সরকার এখন দিল্লির সিংহাসনে নেই। কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের চেয়েও গ্রুপ-নেতৃত্ব অধিক শক্তিশালী।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সৌভাগ্য, দলটিতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এখনো শক্তিশালী। গ্রুপ-নেতৃত্ব ও কোন্দল কংগ্রেসের মতো দলটিতে বিপর্যয় ঘটাতে পারেনি। কিন্তু বিপর্যয় ঘটাবে যদি এখন থেকেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব শক্ত হয়ে দলকে আগাছামুক্ত করার কাজে তত্পর না হন। নির্বাচনের সময় অনেক গণতান্ত্রিক দলেই বিদ্রোহী প্রার্থী দেখা দেয়। প্রশ্ন, আওয়ামী লীগে তাদের সংখ্যা এত বেশি কেন? এবং তারা কোন্ শক্তিবলে বিদ্রোহী হওয়ার সাহস ও উত্সাহ পায়?
আমি এই ব্যাপারে নানা সূত্র থেকে কয়েকটি বড় কারণ জেনেছি। একটি কারণ, নির্বাচনকালে মনোনয়ন-বাণিজ্য। জনগণের পছন্দের এবং দলের দীর্ঘকালের ত্যাগী ও উপযুক্ত কর্মীকে মনোনয়ন না দিয়ে যার টাকার ও পেশীর জোর বেশি তাকে দলের মনোনয়ন দেওয়া। তাতে উপযুক্ত প্রার্থী যেমন ক্ষুব্ধ হন, তেমনি ক্ষুব্ধ হন স্থানীয় ভোটদাতা জনগণ। অনেক সময় এই ভোটদাতাদের চাপেও দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত ও ক্ষুব্ধ একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতে বাধ্য হন। অথবা এলাকায় নিজের জনপ্রিয়তা দেখে নিজেই নির্বাচন প্রার্থী হতে প্রলুব্ধ হন। এ ক্ষেত্রে এই হঠকারিতার জন্য দল দায়ী। তাদের মনোনয়ন-বাণিজ্যই দলের একজন অনুগত ব্যক্তিকেও বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতে প্ররোচিত করে।
দ্বিতীয় কারণ, আওয়ামী লীগে এক শ্রেণির মন্ত্রী ও এমপির নিজ নিজ এলাকায় একাধিপত্য রক্ষার স্বার্থে দলের ভেতরে নিজেদের সমর্থক গ্রুপ গঠন করেন। তাদের নানারকম সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারে পৃষ্ঠপোষকতা দেন। তারা স্থানীয় জনসাধারণের ওপর অত্যাচার চালায়, দুর্নাম হয় আওয়ামী লীগের। নির্বাচনের সময় এই ধরনের ব্যক্তিদের পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন, এমনকি জাতীয় সংসদেও মনোনয়ন দানের চেষ্টা চালিয়ে দলের কোনো কোনো মন্ত্রী বা এমপি নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে চান। কোনো কারণে এই ধরনের ব্যক্তিরা নির্বাচনে মনোনয়ন না পেলে স্বতন্ত্র প্রতীক নিয়ে দাঁড়িয়ে দলের প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং দলের ভরাডুবির ব্যবস্থা করেন। একশ্রেণির মন্ত্রী ও এমপি এই অনুগত ব্যক্তিদের নির্বাচনে জয়ী করে আনতে তলে তলে দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
তৃতীয় কারণ, বিদ্রোহী প্রার্থীদের সম্পর্কে দলের দুর্বলতা। কোনো কোনো সময় দেখা যায়, কোনো কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে দলের মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যদি জিতে যান, তাহলে দল তার বিরুদ্ধে গৃহীত দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের শাস্তি প্রত্যাহার করে তাকে দলে আবার টেনে নেন। এটা হয়তো বিশাল জনপ্রিয়তার অধিকারী কোনো কোনো বিদ্রোহী প্রার্থীর জন্য প্রযোজ্য। যেমন নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে (এবার নয়, আগের বার) দলের মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সেলিনা হায়াত্ আইভী বিশাল ভোটে জিতে যান; কিন্তু দল তাকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য অভিযুক্ত করেনি। তাকে দলে টেনে রেখেছে।
এটা আওয়ামী লীগ ও সেলিনা হায়াত্ আইভী দু’পক্ষের জন্যই ভালো হয়েছে। এবার আইভী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়েই বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু ওসমানীনগর ও জগন্নাথপুরের উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনের বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের তুলনা টানা যায় না। তারা নির্বাচনে নিজেরা জয়ী হতে পারেননি এবং দলের মনোনীত প্রার্থীদেরও পরাজিত হতে সাহায্য জুগিয়েছেন। এই ধরনের বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দলের উচিত কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।
বিদ্রোহী প্রার্থীদের সম্পর্কে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে তা ভবিষ্যতে বিদ্রোহী প্রার্থীদের সংখ্যা বাড়াতে সহায়ক হয়। বিদ্রোহী প্রার্থীরা তাতে উত্সাহিত হন এবং ভাবেন, নির্বাচনে জয়ী হলে দল তাকে এমনিতেই লুফে নেবে। আর নির্বাচনে পরাজিত হলেও দল তাকে প্রাপ্য শাস্তি না দিয়ে ক্ষমা করবে। অনেক কারণের মধ্যে তার একটি বড় কারণ, দলের এক শ্রেণির মন্ত্রী ও এমপি’র সাহায্য ও সমর্থন তার পেছনে রয়েছে। তিনি এলাকায় তাদের আধিপত্য বজায় রাখার লাঠিয়াল। এই লাঠিয়ালের সহস্র অপরাধ মার্জনীয়।
আওয়ামী লীগের সহযোগী ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিকলীগ প্রভৃতি সংগঠনেও যে আজ এত কোন্দল, সংঘর্ষ ও রক্তপাত, তার মূল কারণও পেছনে কলকাঠি নাড়েন একশ্রেণির মন্ত্রী ও এমপি, এলাকায় তাদের একাধিপত্য ও কায়েমী স্বার্থ রক্ষার স্বার্থে। দলের সব সংগঠনেই তারা নিজস্ব কোটারি ও গ্রুপ গঠন করে রেখেছেন। এই কোটারি ও গ্রুপগুলোর মধ্যে নিত্যনিয়ত স্বার্থ ও আধিপত্যের দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। পেছনে কলকাঠির নিয়ন্ত্রণ থাকায় তারা এক হতে পারেছে না।
এই অবস্থা থেকে দেশের সবচাইতে বড় গণতান্ত্রিক দল আওয়ামী লীগকে কি করে মুক্ত করে আগের শক্তিশালী অবস্থানে ফিরিয়ে নেওয়া যায়, তা আজ ভেবে দেখা দরকার। আওয়ামী লীগ যদি দুর্বল হয়, ক্ষমতা হারায়, তাহলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তি দুর্বল হবে এবং হিংস্র মৌলবাদী চক্র মাথা তোলার সুযোগ পাবে। এ জন্যই আওয়ামী লীগের একটি কার্যকর সংস্কার পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার।
ভারতে কংগ্রেসকে আবর্জনামুক্ত করার জন্য নেহেরু একবার কমেরাজ-কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করে তার উপর এ সম্পর্কে সুপারিশ করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনারও উচিত, আগামী নির্বাচনের আগেই দলকে জঞ্জালমুক্ত করার জন্য অনুরূপ একটি কমিটি গঠন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। দলের নতুন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বিষয়টি ভেবে দেখুন। সরকারের জনপ্রিয়তা আছে, দলের নেই। এই অবস্থাটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য শুভ নয়। ভারতের কংগ্রেস দল থেকে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের শিক্ষ নেওয়া উচিত।
উৎসঃ ইত্তেফাক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন