|
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
test@gmail.com |
|
এমন একটি চলচ্চিত্র আমাদেরও নির্মাণ করতে হবে
18 March 2017, Saturday
কিছুদিন আগে ‘ব্রিটেন আন্ডার নাজি রুল’ বা নাৎসি শাসনে ব্রিটেন নামে একটি ইংরেজি বই পড়েছি। সম্প্রতি বইটি ছায়াছবিতে রূপান্তরিত হয়েছে। কাহিনী সম্পূর্ণ কল্পনাভিত্তিক। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলার পরাজিত না হয়ে যদি জয়ী হতেন এবং ফ্রান্সের মতো ব্রিটেনেও নাৎসি শাসন প্রতিষ্ঠিত হতো, তাহলে ব্রিটেন ও ব্রিটেনবাসীর অবস্থা কী দাঁড়াত তার একটি কাল্পনিক চিত্র এটি। কিন্তু এই কল্পনাটা অবাস্তব নয়, বাস্তবতাভিত্তিক। বইটি পড়লে বা ছবিটি দেখলে যে কোনো পাঠকের শরীর শিহরিত হবে। হবে কেন, হয়তো অসংখ্য পাঠক অথবা দর্শকের হয়েছে। নইলে ছবিটি এত আলোচিত কেন?
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে বাহাত্তর বছর আগে। এই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর শহর-বন্দর নতুনভাবে গড়ে উঠেছে। তবু এত বছর পরও মানুষকে কেন নাৎসি আমলের বর্বরতা ও নিষ্ঠুর শাসনের কথা ছায়াছবি নির্মাণ করে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়? আমার এক ইংরেজ বন্ধুকে সে কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বললেন, সাধারণ মানুষের স্মরণশক্তি বড় দুর্বল। সহসাই তারা বড় বড় বর্বরতার কথা ভুলে যায় এবং বর্বরদের প্রতি আবার সদয় হয়ে ওঠে। এজন্য এই বর্বরতার ইতিহাস তাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দিলে রাষ্ট্রে অথবা সমাজে বর্বরদের আবার অভ্যুত্থান রোধ করা অনেকটা সম্ভব হয়।
তিনি বললেন, এই দেখুন না, ইউরোপে নাৎসি আগ্রাসন ও শাসনের অবসান হয়েছে, ষাট-সত্তর বছর হয়। নির্মম হলোকাস্ট (ইহুদি হত্যা) এই সময়েই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। হিটলারের হামলায় রাশিয়ার বিরাট এলাকা তো সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এরই মধ্যে ইউরোপ-আমেরিকায় মানুষ সব ভুলতে বসেছে। ব্রিটেনে তেরেসা মে’র আবির্ভাব ঘটেছে। যিনি ব্রিটেনকে আবার ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্মল আইল্যান্ডে (ক্ষুদ্র দ্বীপে) পরিণত করতে চান। ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নব্য নাৎসিরা এতটাই শক্তি সঞ্চয় করেছে যে, তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে পারে বলেও আশংকা দেখা দিয়েছে।
আমার এই ইংরেজ বন্ধু পেশায় ব্যবসায়ী হলেও বিশ্ব-পরিস্থিতি তার নখদর্পণে। তিনি বললেন, আমেরিকার মতো দেশে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো এক ব্যক্তির অতি সহজে হোয়াইট হাউস দখল করা বিশ্বের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কী আভাস দেয়? অনেকেই সঠিকভাবে ভাবছেন কিনা জানি না, তবে ভাবছেন, বিশ্বে আবার নতুন চেহারায় ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব হতে চলেছে। এই ফ্যাসিবাদ যদি আবার শাসনদণ্ড ভালোভাবে হাতে পায়, তাহলে তার পরিণতি কী হতে পারে, সে সম্পর্কে জনসাধারণকে সতর্ক করার জন্য আটলান্টিকের এপারে-ওপারে অনেকেই লেখালেখি করছেন এবং ছবি তৈরি করছেন। তা কল্পনা হলেও অতীতের অভিজ্ঞতাভিত্তিক। তাই বহুকাল আগে নাৎসি বর্বরতার অবসান হলেও তার পুনর্জন্ম রোধ করার জন্যই ‘ব্রিটেন আন্ডার নাজি রুলের মতো বই ও ছায়াছবি দরকার।’ আমি তার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেছি।
শুধু এই বই বা ছায়াছবি নয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর পশ্চিমা অনেক বুদ্ধিজীবী আশংকা করছেন, বুশ জুনিয়রের আমলে আমেরিকায় ‘নিউকন’ নামে যে নয়া ফ্যাসিবাদের সূচনা, তা ট্রাম্পের আমলে পূর্ণতা পাবে। টিমোথি স্নাইডার (Timothy sûder ) নামে এক বিখ্যাত ইতিহাসবিদ এ সম্পর্কে একটি বই লিখে বিশ্বের মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছেন। বইটির নাম On tyranû : Twenty Lessons from the Twentieth Century (প্রসঙ্গ নির্যাতন : কুড়ি শতাব্দী থেকে কুড়িটি শিক্ষা)।
বইটির পরিচিতি দিতে গিয়ে লন্ডনের ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় (১১ মার্চ শনিবার) বলা হয়েছে- A renowned historian offers examples from Nayi Germaû and Eastern Europe to teach us hwo to defend democracy in the age of Trump.
(একজন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ নাৎসি জার্মানি ও পূর্ব ইউরোপ থেকে উদাহরণ তুলে ধরে কী করে ট্রাম্পযুগে গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হবে তার শিক্ষা দিয়েছেন)
স্নাইডারের কুড়িটি উদাহরণ নিয়ে এখানে আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাবে, তাই এখানে একটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ সম্পর্কে আলোচনাতেই আমার বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখছি। হিটলার যে তার নির্বাচনী প্রচারণায় ইহুদিদের সম্পর্কে অনেক মন জোগানো কথা বলে তাদের ভোট বাগানোর চেষ্টা করছেন, এটা জার্মান ইহুদিদের ধূর্ত বণিক সম্প্রদায়ও তখন বুঝতে পারেনি। তারা ভেবেছিল, হিটলার ক্ষমতায় গেলে টাকার জোরে তাকে কিনে ফেলবে। কিন্তু তারা তা পারেনি। এই ভুলের দাম দিতে হয়েছিল পরবর্তীকালে কয়েক লাখ ইহুদিকে প্রাণ দিয়ে।
স্নাইডার তার আরেকটি বই ‘ব্লাক আর্থে’ নাৎসি জার্মানিতে ইহুদি নির্যাতনের কারণ দর্শিয়েছেন এই বলে যে, কেবল এন্টি-সেমিটিজম থেকে হলোকাস্ট অনুষ্ঠিত হয়নি। অনুষ্ঠিত হয়েছে ইহুদিদের দ্বারা দখল করা বিস্তীর্ণ কৃষি এলাকা নাৎসি সরকারের হাতে এনে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় জলবায়ু পরিবেশের উন্নতি ঘটানোর জন্য। তার এই বক্তব্য সম্পর্কে অবশ্য বিতর্ক চলছে। তবে এটা সত্য, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে জার্মানিতে যেভাবে ইহুদিরা ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি সবকিছু করায়ত্ত করে রেখেছিল এবং জার্মানির রাজনীতিও নিয়ন্ত্রণ করত, তাতে সাধারণ জার্মান নাগরিকদের একটা বড় অংশের মধ্যেও এক ধরনের ইহুদি-বিদ্বেষ তৈরি হয়েছিল। হিটলার তার সুযোগ নিয়েছেন।
স্নাইডার তার বইতে দেখিয়েছেন, কীভাবে মিথ্যাকে সত্যের মতো প্রতিষ্ঠা দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা যায় এবং তাদের ওপর স্বৈরাচারী শাসন চাপিয়ে দেয়া যায়। হিটলারের প্রচার সচিব গোয়েবলস প্রথম এই তত্ত্বের কার্যকারিতা প্রমাণ করেন। স্নাইডারের মতে, আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানও মিথ্যাকে সত্যের মতো করে প্রচার দ্বারা- And indeed when trump brands aû criticism as fake news and proclaims blatant untruths as facts, we have entered the era of post truth. (ট্রাম্প যখন যে কোনো সমালোচনাকে বানানো খবর আখ্যা দেন এবং নির্জলা অসত্যকে সত্য বলে প্রচার চালান, তখন আমাদের জন্য পোস্ট ট্রু–থ যুগের শুরু)।
রাজনীতিতে এই পোস্ট-ট্রু–থ যুগের শুরু বাংলাদেশে অনেক আগেই। দেশটিতে নয়া ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান ইতিহাস-বিকৃতি ও নির্জলা মিথ্যা প্রচার দ্বারা। উগ্র মৌলবাদী শক্তির উত্থানও প্রকৃত ধর্মকে ভিত্তি করে নয়, প্রকৃত ধর্মের বিকৃতি দ্বারা। উপমহাদেশে জামায়াত বা মধ্যপ্রাচ্যে আইএস যে ইসলামের কথা বলে, তার সঙ্গে প্রকৃত ইসলামের সম্পর্ক খুব কম। বিএনপি রক্তপাত ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসার পর স্বাধীনতার ইতিহাসের শুধু বিকৃতি ঘটানো নয়, তার মৌলিক সব আদর্শকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
একবার মিথ্যার জঞ্জাল স্তূপীকৃত হলে এবং তার বিভ্রান্তি মানুষের মনে দাগ কেটে গেলে তা থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। নেহেরু বলেছিলেন, দু’শ বছর ধরে ইংরেজরা ভারতবর্ষের যে বিকৃত ইতিহাস তৈরি করে গেছে, তা থেকে মুক্তি পেতে আমাদের আরও দু’শ বছর লাগবে। বিএনপি ও জামায়াত বাংলাদেশে তাদের যৌথ শাসনামলে যে মিথ্যার পাহাড় তৈরি করে গেছে, মানুষের মনে বিভ্রান্তি ও ধর্মান্ধতা তৈরি করে গেছে, তার মোহজাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসতে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। তারা কতদিনে তা পারবেন অথবা আদৌ পারবেন কিনা তাও এক প্রশ্ন।
শোনা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সে দেশে জর্জ অরওয়েলের ‘উনিশশ’ চুরাশি’ বইটির বিক্রয় নাকি বেজায় বেড়ে গেছে। এই বইটিতেই বিশ্বে পোস্ট-ট্রু–থ যুগের শুরু এবং দানবশক্তির আবির্ভাব সম্পর্কে বিশ্বের মানুষকে সতর্ক করা হয়েছিল। টিমোথি স্নাইডারের বইটিতে বিশ্বে দানবশক্তির পুনরুভ্যুত্থানের আশংকা সম্পর্কে শুধু সতর্কবাণী উচ্চারণ করা নয়, তাকে প্রতিরোধ ও প্রতিহত করারও কুড়িটি উপায় বাতলে দেয়া হয়েছে। এই উপায়গুলো নিয়ে পশ্চিমা কাগজগুলোতে বিতর্ক চলছে। কিন্তু স্নাইডারের কৃতিত্ব, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় যে আমেরিকায় পোস্ট-ট্রু–থ যুগের সূচনা ঘটিয়েছে এই সত্যটি আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরা।
স্নাইডারের মতে, The creeping destruction of democracy can be stopped or reversed (ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলা গণতন্ত্রকে রক্ষা করা যায় অথবা তার মোড় উল্টোদিকেও ঘুরিয়ে দেয়া যায়)। তার জন্য তিনি বিশটি উপায় বাতলেছেন। এই উপায়ের মধ্যে প্রধান উপায়টিই হল, দানবশক্তির মিথ্যা প্রচার সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং তাকে সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয়ভাবে প্রতিরোধ। আমার মতে, এই জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং তাকে প্রতিরোধের সদাজাগ্রত শক্তি গড়ে তুলতে হলে অতীত ও বর্তমানের দানবশক্তির অত্যাচার-নির্যাতনের (tyranû and torture) ছবি তাদের সামনে সব সময় তুলে ধরতে হবে। তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। Britain under Nayi rule বা নাৎসি শাসনে ব্রিটেন সম্পর্কিত ছায়াছবিটি এই উদ্দেশ্যেই নির্মিত এবং প্রদর্শিত।
আমার মনে হয়, বাংলাদেশে ২০১৪ সালের নির্বাচন যদি বিএনপির বাধাদানের মুখে না হতো এবং বাংলাদেশে আধা তালেবানি শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারত, তাহলে কী ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হতো, তার একটা কাল্পনিক অথচ বাস্তব অভিজ্ঞতাভিত্তিক ছায়াছবি নির্মাণের কথা আমাদের চলচ্চিত্র-নির্মাতারা বিবেচনা করে দেখতে পারেন। দানবশক্তির পুনরুভ্যুত্থানের আশংকা রোধে এই ছবিও হবে একটা বড় হাতিয়ার।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন